#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৬।
লীনা বাকরুদ্ধ। এই বাইশ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে এত বড়ো ঝটকা এর আগে খায়নি সে। দুই ওষ্ঠের মাঝে কিঞ্চিৎ ফাঁক। চোখের পলক ফেলতেও বেমালুম ভুলে গিয়েছে। আজকে কি এই লোকটা একটার পর একটা ঝটকা দিয়ে তাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছে না-কি?
মাহাত ভ্রুকুটি করে। জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার? এমন হা করে চেয়ে কী দেখছ? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, বিয়ে করবে আমায়?’
পুতুলেরও একই দশা। সেও হতভম্ব। প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই; ডিরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব? এই মাহাত তো সাংঘাতিক ছেলে।
মাহাত এবার বীতঃস্পৃহ। পুতুলের দিকে চেয়ে বলে উঠল,
‘আপনার ফ্রেন্ডকে বলুন তো, এমন হা করে চেয়ে না থেকে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে।’
পুতুল নির্বোধের মতো মাথা নাড়িয়ে লীনাক বলল,
‘এই লীনা, জবাব দে।’
লীনা ভ্রু কুঁচকে চাইল পুতুলের দিকে। পুতুলও বোকার মতো চেয়ে আছে। এই অতর্কিত প্রস্তাবে দুজনেরই মারাত্মক মাথা ঘুরাচ্ছে। লীনা তো যেকোনো সময় পড়ে টড়েও যেতে পারে।
লীনার এহেন নিস্তব্ধতা দেখে মাহাত এবার ক্ষুব্ধ হলো ভীষণ। ঠোঁট কামড়ে এক পল চেয়ে থেকে বলল,
‘বুঝেছি, আজ জবাব দিবে না। সময় লাগবে তোমার? ঠিক আছে, দিলাম সময়। তবে ঠিক চব্বিশ ঘন্টা। আগামীকাল ঠিক এই সময় এসে তুমি আমার জবাব দিবে। আর অবশ্যই জবাব যেন আশাব্যঞ্জক হয়। অন্যথায়, তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব।’
লীনা এবার সত্যিই মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নেয়। সে এক পা পেছাতেই মাহাত তার হাত টেনে ধরে। তারপর মৃদু হেসে বলে,
‘আহা, এত দূর্বল হলে চলে? ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করবে। আর এই কৃষ্ণচূড়া ফুলটা রাখ। যদিও এতক্ষণে মজে গিয়েছে। তাও, আমার প্রথম দেওয়া ফুল। যত্ন করে রেখে দিও, আমাদের ছেলে মেয়েদের দেখাতে হবে না?’
আল্লাহ! লীনার মনে হচ্ছে এই জমিন কেন দুদিকে চিরে যাচ্ছে না; সে কেন এই জমিনের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে না? এই লোকটা এমন বেশরম হবে, সে এটা দুঃস্বপ্নেও কখনো ভাবেনি। এক লাফে বাচ্চা পর্যন্ত চলে গিয়েছে? বুকে ব্যথা করছে লীনার। এখনই নির্ঘাত একটা অ্যাটাচ ফ্যাটাক হয়ে যাবে।
মাহাত হাতের ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলল,
‘এখন আমাকে যেতে হবে। কাল আবার দেখা হচ্ছে। আশা করছি, কোনো টাল বাহানা না করে সুন্দর মতো আমার উত্তর দিয়ে দিবে।’
বলেই সে এক হাতে লীনার ডানপাশের গালটা টেনে দিয়ে প্রস্থান ঘটাল। এত জোরে গালে টান লাগল যে লীনা গালটা হাত দিয়ে ঘষতে লাগে। বলে উঠে,
‘কী অসভ্য লোক রে বাবা!’
পুতুল এক লাফে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
‘এই দোস্ত, কী হয়ে গেল এসব?’
লীনা দু হাতে মাথা চেপে বলল,
‘আমায় ধর, আমায় ধর। মাথাটা এখনও ঘুরছে।’
পুতুল দু হাতে তাকে আগলে ধরে বলল,
‘চল, ঐখানে গিয়ে বসি।’
____
‘তো, এবার কী উত্তর দিবি?’
লীনা ড্যাবড্যাব করে পুতুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘দেখেছিস, ছেলেটা কী সাংঘাতিক! মানে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে ডিরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব? আমার তো এখনও কিছু মাথায় ঢুকছে না।’
‘রাজি হয়ে যা। ভালো ছেলে, তোকে সুখে রাখবে।’
লীনা তেতে উঠে বলল,
‘তুই কী করে জানলি, সুখে রাখবে? তুই প্রেম করেছিলি আগে?’
‘আসতাগফিরুল্লাহ, কী বলিস এসব? আমার হবু দুলাভাই লাগেন উনি, দুঃস্বপ্নেও উনাকে নিয়ে এসব ভাবতে পারি না।’
‘তাহলে চুপ থাক। বললেই রাজি হওয়া যায় না-কি? আগে আমাকে দেখতে হবে না, উনি আদৌ সিরিয়াস কি-না। পরে যদি আমি ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে যাই?’
‘আরে না, তেমন কিছু হবে না। ভার্সিটিতে উনার বেশ প্রশংসা। উনাকে স্যার থেকে ছাত্র সবাই পছন্দ করে। আমার মনে হচ্ছে, উনি সিরিয়াস। নাহলে কি আর ডিরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব দিতেন? তুই একটু ভেবে দেখ। চব্বিশ ঘন্টা সময় তো আছেই।’
‘আর যদি রাজি না হই, তবে কি উনি সত্যি সত্যিই আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলবেন?’
ভীত শোনায় লীনার কন্ঠস্বর। পুতুল ঠোঁট চেপে আসে। মারাত্মক মজা লাগছে এসব তার। তারপর চোখ মুখ সিরিয়াস করে বলে,
‘হতেও পারে। ছেলেদের বিশ্বাস নেই রে। আমার মনে হয়, রাজি হয়ে যাওয়াটাই বেটার অপশন। তারপর বাকিটা তোর ইচ্ছে।’
_____
প্রোগ্রাম শেষে ভার্সিটির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পুতুল। লীনা বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে কিয়ৎক্ষণ আগেই। পুতুলের গাড়িটা প্রত্যহের মতো এক পার্শ্বে অবস্থান করছে। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে আবার একবার ফেসবুকে ঢুকল সে। স্টোরিতে তার শাড়ি পরা ছবিতে লাভ রিয়েক্টের বন্যা বইছে। সারাজও সিন করেছে সেই স্টোরি। অথচ একটা রিয়েক্টও দেয়নি। পুতুলের ভীষণ অন্তর্বেদনা হলো তাতে। আজকের দিনে কী সুন্দর মাহাত লীনার প্রতি তার ভালোবাসা জাহির করল। এত এত প্রেম দেখাল। অথচ এই ব্যক্তি, যার সাথে কয়দিন পর তার বিয়ে; সে কেন এত নির্লিপ্ত থাকে সবসময়? এই যে সে শাড়ি পরা ছবি দিল, একবারও কি এটা দেখে তার মনে প্রেম জাগল না? একবারও মনে হলো না, এই শাড়ি পরিহিত প্রেয়সীকে একবার বাস্তবে নিজ চোখে গিয়ে দেখে আসি? একবার তাকে গিয়ে বলি, “এই পুতুল, শাড়িতে তো তোকে মারাত্মক লাগছেরে।” তা না, সে এখানে সামান্য একটা রিয়েক্ট দিতেও কৃপণতা করছে।
পুতুল নাক মুখ কুঁচকে সামনে পা বাড়াতেই কোথ থেকে যেন সাহেল এসে হাজির হয়। পুতুলের দিকে চেয়ে বলে উঠে,
‘তোমাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছিল, পুতুল। আর তোমার গানও অসাধারণ হয়েছিল।’
এই মুহুর্তে এই ছেলেকে দেখে ভীষণ বিদ্বিষ্ট হলেও পুতুল সেটা প্রকাশ করল না। বরং হেসে বলল,
‘ধন্যবাদ।’
বলেই আবার সামনে পা বাড়াল। সাহেল তাকে ফের ডেকে বলল,
‘তুমি কি এখন বাসায় চলে যাবে?’
পুতুল ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
‘তো কি এখানে দাঁড়িয়ে ভার্সিটি পাহারা দিতে বলছ?’
সাহেদ বোকার মতো হেসে বলল,
‘না, তা কেন বলব? আসলে বলতে চাইছিলাম যে, তুমি যদি এখন ফ্রি থাক, তবে কি আমরা একটু ঐ সামনের কফি শপটাতে যেতে পারি?’
পুতুল ফুঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘দুঃখিত। আমার এখন তোমার সাথে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তুমি অন্য কাউকে নিয়ে যাও।’
সাহেল বিরক্ত ভঙিতে সেই জায়গা ছাড়ল। পুতুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আসছে কফি খেতে। ভেবেছে, এদের চালাকি আমি বুঝি না। যত্তসব আজাইরা পাবলিক।’
.
পুতুল তার গাড়ির দরজাটা খুলতেই শো করে একটা বাইক এসে থামল তার সামনে। অকস্মাৎ এই আগমনে প্রথমে সে কিছুটা ঘাবড়ে গেল, পরে পরিচিত বাইক আর বাইকের মালিককে দেখে ধাতস্ত হলো সে। মাথা থেকে হেলমেট’টা সরিয়ে জোরে শ্বাস টানল সারাজ। পুতুল ভ্রু কুঁচকাল তা দেখে। আচমকাই সারাজ হেঁচকা টানে পুতুলকে তার কাছে এনে দাঁড় করিয়ে বলল,
‘এই মামা, তুমি গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে যাও। আমি পুতুলকে নিয়ে আসব।’
অমনি গাড়ি ছেড়ে দিল। পুতুল সারাজের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বলল,
‘আমি তোমার সাথে যাব না।’
সারাজ কপাল কুঁচকে চাইল। বলল,
‘কেন?’
‘এমনি।’
নাক ফুলিয়ে বলল পুতুল। সারাজ কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো। হঠাৎ সে তার ডানহাতের বৃদ্বাঙ্গুল দিয়ে পুতুলের অধর ছোঁয়ে বলল,
‘এসব রং চং কেন মেখেছিস? কেমন লাগছে তোকে!’
অধরের পৃষ্ঠে সারাজের এমন অতর্কিত স্পর্শে প্রথমে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে পুতুল। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সারাজের কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে যায় তার। এসব রং চং? আর কেমন লাগছে মানে কী? তাকে কি সুন্দর লাগছে না?
পুতুল নাক মুখ ফুলিয়ে শুধাল,
‘আমাকে সুন্দর লাগছে না, সারাজ ভাই?’
পুতুলের গাল ফুলানো দেখে হাসি পেল সারাজের। কিন্তু সেই হাসি চেপে রেখে সে গম্ভীর গলায় বলল,
‘না, একদমই না।’
পুতুল দাঁতে দাঁত চেপে চেয়ে থাকে সারাজের দিকে। যদি আজ সারাজের চোখে তার এই সৌন্দর্য ধরা না পড়ে, তবে নিশ্চয়ই এই লোক অন্ধ।
সারাজ বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল,
‘চল তাড়াতাড়ি, লেইট হচ্ছে।’
পুতুল ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বাইকে উঠে বসল। রাগে শরীর রিঁ রিঁ করছে তার। এত সুন্দর করে সেজে কী লাভ, যদি এই সৌন্দর্য ভালোবাসার মানুষের চোখেই না পড়ে?
রাগে পুতুল প্রথমে খেয়াল করেনি যে, তারা উল্টো রাস্তায় যাচ্ছে। পরে ব্যাপারটা বুঝতেই সে প্রশ্ন করে,
‘আমরা এইদিকে কোথায় যাচ্ছি? এটা তো উল্টো রাস্তা।’
সারাজ সামনের আয়নায় পুতুলের চিন্তিত মুখটা একবার পরখ করে বলল,
‘কাজী অফিস যাচ্ছি।’
পুতুল আঁতকে উঠে বলে,
‘কেন?’
‘বিয়ে করতে।’
‘কী?’
চেঁচিয়ে উঠে পুতুল। সারাজ ক্ষিপ্ত সুরে জবাব দেয়,
‘এবার বেহুঁশ হলে, আছাড় মেরে জ্ঞান ফেরাব। তাও বিয়ে না করে ফিরব না।’
চলবে …