#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৭।
‘এটা তো কাজী অফিস না, সারাজ ভাই। আমরা এখানে কেন এসেছি?’
সারাজ বাইক থেকে নামতে নামতে জবাবে বলল,
‘তোর তো দেখছি কাজী অফিসে যাওয়ার খুব তাড়া।’
পুতুল কপাল কুঁচকে বলল,
‘আমার মোটেও কোনো তাড়া নেই। ইনফেক্ট, আমি এরকম বিয়ে চাইও না। তুমি বলেছিলে, তাই জিজ্ঞেস করলাম।’
সারাজ বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। পুতুলের দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধায়,
‘তাহলে কেমন বিয়ে চাস?’
পুতুল এগিয়ে সারাজের পাশেই হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। তারপর তাকায় সামনের খোলা প্রান্তরে। সেদিকেই বিভোর থেকে বলে,
‘আমি চাই একটা চমৎকার বিয়ে। যেখানে আমার কাছের মানুষগুলোর উপস্থিতি থাকবে; থাকবে তাদের একরাশ আনন্দের ছটা। চারদিক সেদিন রঞ্জিত হবে নিয়নের আলোতে। আমি সেদিন মন ভরে সাজব। হাত রাঙাব নিঁখুত মেহেদিতে। এই, তুমি না আমাকে একটা সিঁদুর লাল শাড়ি কিনে দিবে। আমি জানি, তোমার লাল পছন্দ না। তবে লাল ছাড়া কি বউ হয় না-কি? শোনো, বিয়েতে যা হবে সব আমার পছন্দের। তুমি তো হলে নিরামিষ মানুষ, তাই তোমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। সব আমাকেই দেখতে হবে।’
এতক্ষণ অনিমেষ চেয়ে পুতুলের বিয়ে বর্ণনা শুনছিল সারাজ। তাতেই অধর কোণে স্মিত হাসির রেশ ফুটে ওঠে। তবে পুতুলের দৃষ্টিগোচর হওয়ার আগেই সেই হাসি বিলিন করে সারাজ ক্ষিপ্ত সুরে বলে ওঠে,
‘আমাকে তোর নিরামিষ মনে হয়?’
‘অবশ্যই। একেবারে রষকষহীন তেতো একটা মানুষ।’
পুতুলকে নির্লিপ্ত শোনায়। সারাজ তখন ফিচেল হেসে বলে,
‘এই তেতো মানুষকেই আজীবন বহন করে চলতে হবে কিন্তু। এখনও সময় আছে, ভেবে নে।’
পুতুল সারাজের মুখের দিকে চাইল। হেসে বলল,
‘সমস্যা নেই। আমি তেতো’কে মিষ্টি বানাতে পারব।’
সারাজ দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
‘বাহ, খুব কনফিডেন্ট দেখছি।’
পুতুল জবাবে আর কিছু বলে না। কিছুক্ষণ দুজনেই ঈষৎ নিরবতা পালন করে। এই উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে হয়তো দুজনেই নিরবে তাদের চিত্তে চিত্তে সন্ধি ঘটাচ্ছে। স্বীকার না করুক। তবুও, তাদের হিয়ার প্রতিটি স্পন্দন তাদের এই প্রণয়ের সাক্ষী হয়ে যাচ্ছে।
অনেক সময় পর পুতুলের দীর্ঘশ্বাসের শব্দে প্রকৃতির এই নিরবতা কাটে। পুতুল চোখ তুলে সারাজের দিকে তাকায়। তবে সারাজের ঐকান্তিক দৃষ্টি এখনও পূর্বের মতোই স্থির। পুতুল মোলায়েম সুরে বলে উঠে,
‘জানো, আজ লীনাকে আমাদের ভার্সিটির একটা ছেলে প্রপোজ করেছে। প্রেম ভালোবাসার প্রস্তাব না কিন্তু; ডিরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব। কী সুন্দর করে বলছিল, “আমাকে বিয়ে করবে লীনা”। আমি হতভম্ব হয়ে দেখছিলাম সেই মানুষটাকে। আচ্ছা, প্রেম বুঝি চোখেও ভাসে? আমি ঐ ভাইয়ার মাঝে নিদারুণ প্রেম দেখেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, ভাইয়ার এই চাওয়া ঠুনকো না। উনি সত্যিই লীনাকে ভালোবাসেন। আর বোকা লীনা, বোকার মতো চেয়েই ছিল কেবল। ভাইয়া কম যায় না। জানো, লীনাকে রীতিমতো হুমকি দিয়েছে। সে নাকি বিয়ে করতে না চাইলে, উনি তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবেন। কী সাহস দেখেছো? আমার বেলাতে কেন এমন হলো না কে জানে?’
শেষের কথাটুকু আস্তে বলে পুতুল। তাও সেটা সারাজের শ্রবণেন্দ্রীয় এড়ায় না। কপালের ভাঁজ ফেলে সে পুতুলের দিকে তাকায়। বিদ্বিষ্ট সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘তোর বেলাতে এমন হলো না মানে?’
পুতুল সরে আসে। সারাজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্ষুব্ধ সুরে বলে উঠে,
‘মানে আমাকে কেউ এভাবে প্রপোজ করেনি। আমিও তো এমন একটা প্রপোজ ডিজার্ভ করি, তাই না?’
সারাজ নিমিষ চেয়ে তাকে পুতুলের বিষন্ন মুখাবয়বের পানে। পুতুলের মনঃক্ষুণ্ণ হলো যেন। সে পেছন ফিরে দু কদম এগুতেই হঠাৎ শাড়ির আঁচলে টান পড়ে। অবাক হয়ে পেছন ফেরে। চেয়ে দেখে সারাজ শক্ত মুঠে তার আঁচল ধরে আছে। পুতুল তখন ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
‘কী হয়েছে?’
মুঠোয় রাখা আঁচলের অংশটা আরেকটু হাতের মাঝে পেঁচায় সারাজ। পুনরায় টান পড়াতে পুতুল আরেকটু এগুয়। ভ্রু যুগলের মাঝের ভাঁজ তাতে আরো দৃঢ় হয়। সারাজের ঠোঁটের কোণে তখন উচ্ছ্বল হয় ঈষৎ হাস্য রেশ। আচমকাই টানের গতি বাড়ে। এবার খানিক জোড়েই টান পড়ে। পুতুল হুমড়ি খেয়ে পড়ে সারাজের প্রশ্বস্থ বুকে। বুকের কম্পন বাড়ে ততক্ষণাৎ। ভাগ্যিস, বেশি করে পিন মেরেছিল। নয়তো এতক্ষণে শাড়ির আঁচল খুলে সারাজের হাতে থাকত। পুতুল বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে সারাজের দিকে তাকায়। হঠাৎ থমকে যায় সে। সারাজ ভাই এভাবে কেন চেয়ে আছেন? এই দৃষ্টির সাথে তো পূর্ব পরিচিত নয় সে। সারাজ তাকে কখনো এভাবে দেখেনি। ঢোক গিলে পুতুল। কোমরে শক্ত পোক্ত হাতের স্পর্শ পেতেই আরো বেশি কুন্ঠিত হয়ে পড়ে যেন। সারাজ দুই হাতে শক্ত করে পুতুলের কোমর আঁকড়ে ধরেছে। পুতুলের নিশ্বাস আটকে আসার উপক্রম। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। পুতুলের এমন ভীত সন্ত্রস্ত মুখশ্রী দেখে সারাজের অধর কোণের হাসি দীর্ঘ হয়। সে পুতুলের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠে,
‘খুব না তখন বলছিলি, আমাকে তেতো থেকে মিষ্টি বানাবি। এই তার নমুনা? শিক্ষক যদি এত অপরিপক্ক হয়, তবে ছাত্রকে কীভাবে শেখাবে? হু?’
আরেকটু চেপে ধরে সারাজ। পুতুল এবার নাক মুখ কুঁচকে বলে,
‘সমস্যা কী তোমার? ছাড়ো। আশেপাশের কারোর চোখে পড়লে কালকেই হেডলাইন বেরুবে।’
‘ভয় পাচ্ছিস, নাকি লজ্জা?’
পুতুল মাথা নুইয়ে ধীর গলায় বলে,
‘দুটোই।’
সারাজ ঠোঁট কামড়ে হেসে পুতুলের লাজ মাখা মুখের দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে থাকে। ততক্ষণে তার হাত পুতুলের কোমর ছেড়ে এসে গালে ঠেকেছে। অন্যহাতে খুব যত্ন করে পুতুলের চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে কোমল স্বরে বলে উঠে,
‘বউ হবি আমার?’
পুতুল চোখের পল্লব নাড়িয়ে পিটপিট করে তাকায়। সারাজের অমন নির্লিপ্ত চাহনি তার লজ্জাকে আরো প্রশমিত করছে যেন। সে পুনরায় মাথা নুইয়ে ফেলে।
‘কিরে, উত্তর দিচ্ছিস না যে? বউ হবি না?’
মাথা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় সে। সারাজ ক্ষিপ্ত সুরে বলে উঠে,
‘বোবা হয়ে গিয়েছিস? মুখে বল।’
পুতুল জোরে নিশ্বাস ফেলে বলে,
‘হ্যাঁ, হব।’
কাঙ্খিত জবাবে অন্তস্থল শীতল হয় সারাজের। টুপ করে পুতুলের ললাটে অধর ছোঁয়ে দেয়। পুনরায় এমন অতর্কিত ছোঁয়াতে আরো বেশি ঘাবড়ে যায় পুতুল। একদিনে এত ঝটকা আর নিতে পারছে না। তড়িৎ গতিতে দুকদম পিছিয়ে যায়। তারপর বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলে বলে,
‘আজকেই তোমার এত প্রেম উতলে পড়ছে কেন বলতো? একদিনে এত চাপ আমি কী করে সহ্য করব?’
পুতুলের এমন নির্বোধ উক্তিতে না হেসে সারাজ পারল না। বলল,
‘তুই আসলেই একটা আহাম্মক, পুতুল। একেবারে উচ্চ পর্যায়ের আহাম্মক। তোকে নিয়ে আমি কী করে সারাজীবন কাটাব, বলতো? আমার তো এখনই চিন্তা হচ্ছে।’
পুতুলের সুন্দর অনুভূতিগুলো নিমিষেই উবে যায়। কোমরে হাত দিয়ে সে উঁচু স্বরে বলে উঠে,
‘এত চিন্তা হলে, আমাকে বিয়ে করার কী দরকার? যাও, বিয়ে করতে হবে না। আর এমনিতেও আমার পছন্দের মানুষ অন্যকেউ। তাই তুমি আমাকে বিয়ে না করলেও আমার তেমন কিছু যায় আসেনা।’
পুতুলের কথা শেষ হতেই সারাজ বাইক ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বুকের উপর হাত দুখানা ভাঁজ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
‘আচ্ছা, তোর পছন্দের মানুষ অন্য কেউ? আগে বলবি না, তাহলে আর তোকে এত কষ্ট দিতাম না। তুই এক কাজ কর, এখানে দাঁড়িয়ে থাক। আমি তোর পছন্দের মানুষকে এখানে পাঠাচ্ছি। তারপর দুজন গিয়ে কাজী অফিসে বিয়ে করে ফেলবি। চিন্তা নেই, মা বাবাকে আমি সামলে নিব।’
বলেই সারাজ বাইকে বসে বাইক স্টার্ট দেয়। পুতুল আঁতকে উঠে বলে,
‘আরে, তুমি আমাকে ফেলে কোথায় যাচ্ছ?’
সারাজ চোয়াল শক্ত করে বলে,
‘তোর পছন্দের মানুষকে আনতে।’
পুতুল দৌড়ে সারাজের কাছে এসে বলে,
‘উফ, তুমি মজাও বুঝো না? আমি তো কেবল মজা করছিলাম। আমার কোনো পছন্দের মানুষ টানুষ নেই। সব মিথ্যা।’
সারাজ তার কথায় পাত্তা দেয় না। বাইক স্টার্ট দিয়ে বসে। পুতুল চট করে বাইকের পেছনে উঠে বলে,
‘তুমি কী চিন্তা করছ? তোমার মতো রগচটা মানুষকে নিয়ে আমি কীভাবে সংসার করব, সেই চিন্তাতে তো আমি নাওয়া খাওয়া ভুলে বসেছি।’
‘আর একটাও বাজে কথা বললে কিন্তু এখানে ফেলে রেখেই চলে যাব।’
সারাজের হুমকিতে বিন্দুমাত্র ভয় পেল না পুতুল। তাও গম্ভীর মুখে বলল,
‘ঠিক আছে, চুপ আছি।’
_________
পুতুলের বাসার সামনে বাইক থামতেই নেমে দাঁড়াল সে। সারাজ তার সাথে কোনোপ্রকার কথা না বলে পুনরায় বাইক স্টার্ট দিতেই সে ডেকে উঠে,
‘সারাজ ভাই।’
সারাজ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। পুতুল মুচকি হাসে। সারাজের কাছে তার এই ভাবমূর্তি বোধগম্য হলো না। হঠাৎ এমন হাসছে কেন?
সে পুনরায় পুতুলের দিকে তাকানোর আগে ঝড়ের গতিতে পুতুল তার কাজ সেরে সেখান থেকে হাওয়া হয়ে গেল। সারাজ হতভম্ব। গালে হাত দিয়ে মনে মনে বলে উঠল,
‘আশ্চর্য! মেয়েটা আবার পাগল টাগল হয়ে যায়নি তো?’
চলবে…..
(বিয়ের পর্ব ইনশাল্লাহ কাল থেকেই শুরু হবে।)