#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩২।
মেহেদী প্রোগ্রামের জন্য পুতুল বাড়ির দুতালার বড়ো বেলকনিটা ঠিক করেছে। সেখানেই বর্তমানে সাজ-সজ্জা চালাচ্ছে ইভেন্টের লোকেরা। সবুজ, হলুদ রঙের রঙিন কাপড় আর রঙিন ফুলে সাজানো হচ্ছে জায়গাটা। সাথে পুরো জায়গা দীপ্তমান হচ্ছে ছোট ছোট ফেইরি লাইটের আলোতে।
পুতুল সেজেছে সবুজ রঙের জামদানীতে। এই শাড়িতে মোহনীয় লাগছে তাকে। নিচ থেকে হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। বাড়ি ভর্তি কাজের মানুষ। কাল থেকে মেহমানরাও আসা শুরু করবেন। মেহুলের একটু বসার জো নেই। সে সকাল থেকে ছুটে বেড়াচ্ছে। রাবীর অফিসে গিয়েছিল, কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে। যদিও এই মেহেদী উৎসবে বাড়ির বড়োদের তেমন কোনো কাজ নেই, তাও পুতুলের কথা মতো উপস্থিত থাকতে হচ্ছে সবাইকেই । লীনা আর সাদরাজও এসেছে নিচে। তবে সারাজ এখনও আসেনি। আসবে কি-না তাও পুতুলের জানা নেই। সে তো সেদিনই বলেছিল, এই সবুজ রঙের শাড়িতে সে পুতুলকে দেখতে চায় না। হয়তো সেইজন্যই আসেনি। মন খারাপ হলেও ঠিক পাত্তা দিল না পুতুল। এই সময়গুলো জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো আর আসবে না। তাই অযথা মন খারাপ করে সময়গুলো নষ্ট করার কোনো মানে হয়না।
একেবারে তৈরি হয়ে লীনাকে নিয়ে নিচে নামল পুতুল। বসার ঘরে গিয়ে দেখল তার বিয়ের কার্ড চলে এসেছে। পুতুল খুশি মনে রিতার পাশে গিয়ে বসল। একটা কার্ড হাতে নিয়ে বলল,
‘দেখেছো মামনি, আমাদের কার্ডটা কত সুন্দর হয়েছে। তোমার ছেলের থেকে আমার পছন্দ হাজার গুণ ভালো।’
‘দেখতো, আমাদের কার্ডটা পছন্দ হয় কি-না?’
পাশের বক্স থেকে আরেকটা কার্ড বের করে রিতা পুতুলের হাতে দিল। অবাক হলো পুতুল। বলল,
‘দুইটা তো একই। এটাও তো আমাদের, তাই না?’
রিতা হাসল। বলল,
‘না, এটা ছেলে পক্ষের কার্ড। সারাজ তোর পছন্দের কার্ড’ই নিয়ছে।’
বিস্মিত হয়ে বড়ো বড়ো চোখে চাইল পুতুল। হ্যাঁ, দুই বক্স আলাদা ভাবে রাখা। উপরে নাম লেখা, একটা ছেলেপক্ষ আর অন্যটা মেয়েপক্ষ। তার মানে সারাজ সেদিন তার অগোচরে তার পছন্দের কার্ড’ই নিয়েছিল? আত্মতৃপ্ত হয় পুতুলের। এই ছোট্ট ছোট্ট প্রয়াসগুলো দিয়েই যেন সারাজ তার ভালোবাসা ব্যক্ত করছে। আর এই ভাবনা আসতেই ততক্ষণাৎ পুতুলের অন্তঃস্থল শীতল হয়।
______
মেহেদী প্রোগ্রাম শুরু। ছোট ছোট গদি দিয়ে সবার বসার জায়গা করা হয়েছে। হরেক রকমের ফুল আর রঙিন কাগজ দিয়ে চারদিক সাজানো। কক্ষ জুড়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে রঙিন আলোকছটা। এতকিছুর মাঝেও একগাল অভিমান নিয়ে চুপচাপ বসে আছে পুতুল। মেহেদী প্রোগ্রাম নিয়ে এত আয়োজন অথচ এখনও মেহেদীই আনা হলো না। মেহুল এসে বলে গিয়েছে, কাকে নাকি পাঠিয়েছে আনতে। অথচ সেই লোকের কোনো খবরই নেই। এইদিকে বিকেল পেরিয়ে এখন দিবাবসান ঘটেছে। কিন্তু, মেহেদীর কোনো চিহ্ন’ই চোখে পড়ছে না তার। পুতুল তেতে উঠল। লীনাকে বলল,
‘আর দশ মিনিট অপেক্ষা করব, এর মাঝে যদি বাসায় মেহেদী না এসেছে তবে মেহেদী প্রোগ্রাম ক্যান্সেল।’
লীনা তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
‘কুল কুল, এত হাইপার হচ্ছিস কেন? চলে আসবে মেহেদী। আন্টি বলে গিয়েছেন তো। আরেকটু অপেক্ষা কর।’
কিছু প্রহর ক্ষান্ত হতেই নিচ থেকে একটা মেয়ে ছুটে এসে বলল,
‘মেহেদী চলে এসেছে।’
উচ্ছ্বল হয়ে উঠে পুতুলের মুখাবয়ব। যাক, অন্তত মেহেদী প্রোগ্রামটা তো আর ক্যান্সেল হচ্ছে না। পুতুল আগ্রহ সমেত দরজার পানে চেয়ে আছে। ফের আবার লীনার দিকে চেয়ে বলে,
‘এই, মেহেদী আনলে আগে এই ডালাতে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে ছবি তুলবি, কেমন?’
লীনা মাথা কাঁত করে সম্মতি জানাল।
দরজা পেরিয়ে ঘরে প্রবেশ করল সেই কাঙ্খিত ব্যক্তি। হাতে দুই খানা মেহেদীর বক্স। তবে সেই ব্যক্তিকে দেখা মাত্রই পুতুলের মনে হলো, না না, এই মুহুর্তে এই ব্যক্তি তো অনাকাঙ্খিত। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল সে। ঈষৎ সবুজ পাঞ্জাবীতে বুঝি কাউকে এতটা অনবদ্য লাগে! পুতুল নির্নিমেষ চেয়ে থাকে। সারাজ যে ইতিমধ্যেই তার পাশে এসে বসেছে সেই খেয়াল তার নেই। ইশারা করতেই পুতুলকে রেখে একে একে সকলে বেরিয়ে যায়। অকস্মাত পুরো রুম স্তব্ধ দেখে ভ্রু কুঁচকায় পুতুল। সারাজের দিকে চেয়ে বলে,
‘সবাই কোথায় গিয়েছে?’
সারাজ কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
‘আমি কী জানি?’
ভ্রু যুগলের মাঝের ভাঁজ কিঞ্চিৎ দৃঢ় হলো। পুতুলের জিজ্ঞেস করল,
‘মেহেদীর কথা তুমি কী করে জানলে?’
‘মা ফোন করে বলেছেন।’
সারাজ তারপর প্যাকেট খুলে সবগুলো মেহেদী পুতুলের কোলের উপর রাখে। বলে,
‘দেখতো, এতে হবে কিনা; নাকি আরো লাগবে।’
‘না না, চলবে।’
পুতুল মেহেদীগুলো সুন্দর মতো ডালা জুড়ে সাজিয়ে রাখল। এর মাঝেই হঠাৎ প্রশ্ন করল,
‘আমাকে দেখে তোমার বমি পাচ্ছে না?’
ফিচেল হাসে সারাজ। বলে,
‘পাচ্ছে তো। কী বিচ্ছিরি এই শাড়িটা! তোকে তো আরো বিচ্ছিরি লাগছে। দেখলেই কেমন বমি বমি একটা ভাব আসছে মনে।’
পুতুল হেসে তার দিকে তাকায়। আমোদ গলায় বলে,
‘তাই না? তাহলে আমার সাথে ম্যাচিং করে তুমি কেন সবুজ পাঞ্জাবী পরে এলে? তোমাকে তো কলা গাছের মতো লাগছে। কলা গাছের গায়ের রংটাও এমন ঈষৎ সবুজ।’
সারাজ ভাব নিয়ে বলল,
‘আমি অবশ্যই পরতাম না। আম্মু জোর করেছে বলে পরেছি।’
পুতুল ঠোঁট কামড়ে হাসে। বলে,
‘তুমি না একদম মিথ্যে বলতে পারো না, সারাজ ভাই।’
সারাজ কপাল কুঁচকে বলল,
‘আমার কথা তোর মিথ্যে মনে হয়?’
‘অবশ্যই।’
বলে পুরনায় হাসল পুতুল। সারাজ তেতে উঠে বলল,
‘একদম হাসবি না। তোর হাসিও জঘন্য।’
পুতুল এবার সারাজের মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘আমার সবকিছু যদি এতই জঘন্য হয়, তবে বিয়ে করছো কেন? এই জঘন্য মেয়েটাকে সারাজীবন কী করে সহ্য করবে, বলোতো?’
এত নিকট হতে পুতুলের স্নিগ্ধ মুখশ্রী দেখে বক্ষঃস্থল খানিক কম্পিত হলো সারাজের। এই মেয়েটার হরিণাক্ষীর ন্যায় অক্ষিযুগলের ঐ মসীবর্ণ কাজল তাকে সবসময়ই ঘায়েল করে। আজও করেছে। মারাত্মক ভাবে করেছে। পুতুল নিচের ঠোঁট’টা এখনও দাঁত দিয়ে চেপে ধরে আছে। তা দেখে ভ্রু কুঁচকায় সারাজ। ক্ষিপ্ত সুরে বলে উঠে,
‘আমার সম্পদে এভাবে দাঁত বসানোর অধিকার তোকে কে দিয়েছে, পুতুল? সেই অপরাধে এখন থাপ্পড় দিয়ে এই দাঁতগুলো ফেলে দিলে ভালো লাগবে?’
পুতুল থতমত খেয়ে যায়। কী বলছে লোকটা? ঠোঁট ছেড়ে সোজা হয়ে বসে। পরক্ষণেই লজ্জায় মিইয়ে যায় যেন। সারাজ সেসবে আর পাত্তা দেয় না। ডালা থেকে একটা মেহেদী হাতে তুলে পুতুলকে বলে,
‘হাত দে।’
ফের অবাক হয় পুতুল। সংশয় নিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। পুতুলকে আরো চমকে দিয়ে সারাজ সেই হাতের পিঠেই মেহেদী স্পর্শ করায়। পুতুল যেন এত বিস্ময় কাটাতেই পারছে না। সারাজ মাথা নুইয়ে খুব মনোযোগের সহিত পুতুলের হাতে মেহেদী দিয়ে কিছু একটা করছে। পুতুলের সেদিকে খেয়াল নেই। সে কেবল নিমিষ চেয়ে আছে সারাজের দিকে। বিয়ের কথা উঠার পর থেকে এই লোকটা মারাত্মক রকম বদলে গিয়েছে। আগের সেই রাগী, গম্ভীর, রগচটা সারাজ ভাই এখন যেন পাল্টে এক দুর্ধর্ষ প্রেমিক হয়ে উঠেছে। হঠাৎ উনার মাঝে এই আকস্মিক বদল’টা কী করে ঘটল?
মেহেদীটা রেখে দিয়ে সারাজ বলল,
‘নে, এই পিঠটা নষ্ট করে দিলাম। বাকি হাতে সুন্দর করে মেহেদী পরে ফেল।’
বলেই উঠে দাঁড়াল সে। যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়েও আবার একবার ফিরে তাকাল। তারপর কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
‘এই ক্যাটেক্যাটে সবুজ রংটাও আজ আমার কাছে মারাত্মক সুন্দর লাগছে, পুতুল। ভাবছি, বিয়ের পর তোকে আমি এই রঙের আরো আটটা শাড়ি কিনে দিব।’
পুতুল বিস্ফোরিত চোখে তাকাতেই সারাজ প্রসন্ন হেসে প্রস্থান ঘটায়। সারাজের একের পর এক অকস্মাত কর্মকান্ডে পুতুলের এখন মাথা ঘুরাচ্ছে। চোখ মেলে হাতের দিকে চেয়ে দেখে সেখানে লেখা,
“সারাজের ছোট্ট পুতুল।”
চক্ষু নিমীলিত করে পুতুল। আচ্ছা, আজ এত সুখ লাগছে কেন? আজ কী চারদিকে সুখের বাতাস বইছে?
চলবে….
ছবি:রত্নাবু❤️