#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৫।
মায়ের ডাকে কোনোরকমে চোখ পিটপিট করে তাকায় পুতুল। চোখ জোড়া নিভু নিভু। তাও কোনোরকমে ঢুলতে ঢুলতে উঠে বসে। ঘুম জড়ানো কন্ঠে শুধায়,
‘কী হয়েছে, মা? ডাকছ কেন?’
মেহুল ব্যস্ত হয়ে কিছু একটা করছিল। মেয়ের দিকে নিঃস্পৃহ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
‘ডাকছি কেন মানে? উঠবি না তুই? সাতটা বাজে, পার্লারে যাবি কখন?’
পুতুল ফের বিছানায় গা এলিয়ে দিল। জড়ানো আওয়াজে বলল,
‘মা, পার্লারে যাব না। লীনা আমাকে সাজাবে। এই লীনা, সাজাবি না?’
বলেই তার পার্শ্বে শায়িত লীনাকে ধাক্কা দিল। ঘুমন্ত লীনা খানিকটা নড়ে উঠে বলল,
‘হু।’
মেহুল কোমরে হাত দিয়ে বলল,
‘বিয়ের দিনও পার্লারে যাবি না?’
‘উঁহু।’
প্রগাঢ় শ্বাস নিঃসৃত করে মেহুল। অতঃপর বলে,
‘ঠিক আছে। উঠ এবার। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে রেডি হতে বস। নয়তো পরে মেহমানরা চলে আসলে অসুবিধা হবে।’
পুতুল হাত উঁচু করে বলল,
‘আচ্ছা, উঠছি।’
মেহুল পুতুলের শাড়ি গহনা সব বের করে রেখে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। আজ অনেক কাজ। যদিও ক্যাটারিং এর লোকেরাই সব আয়োজন করছে, তাও সে তো মা। তাকে তো আর বসে থাকা মানায় না।
_______
চোখ কচলে উঠে বসল লীনা। পুতুলকে দুবার ধাক্কা দিল। কিন্তু, সে বেঘোরে তন্দ্রায় ব্যস্ত। লীনা উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এল। আবার বসল পুতুলের পাশে। পুতুল এখনও গভীর নিদ্রাচ্ছন্ন। লীনা ডাকল তাকে,
‘এই পুতুল, উঠ না। আর কত ঘুমাবি। আন্টি সেই কবে এসে ডেকে গিয়েছেন। উঠ, নয়তো বিয়ের দিনও কিন্তু বকা খেতে হবে।’
পুতুল নড়ে উঠল। অতঃপর পাশ ফিরে আবার শু’লো।
বীতঃস্পৃহ লীনা। ক্রমাগত ডেকেই যাচ্ছে তাকে। পুতুল ভ্রু কুঁচকে ফেলে। তেতে উঠে বলে,
‘কয়টা বাজে? এত তাড়াতাড়ি কেন উঠতে হবে, শুনি?’
‘কারণ আজ তোমার বিয়ে। বিয়ের দিন মানুষ তাড়াতাড়িই উঠে, এটাই নিয়ম।’
পুতুল উঠে বসল। গরম চোখে চাইল লীনার দিকে। লীনা হেসে বলল,
‘এবার লক্ষী মেয়ের মতো জলদি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।’
হাত পা ছুড়ে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল পুতুল। তারপর ঠোঁট নাড়িয়ে কী যেন বিড়বিড় করতে করতে ওয়াশরুমে ঢুকল।
____
সকালের নাস্তা সেরে পুতুল আর লীনা গেল বড়ো বাগানের দিকটায়। সেখানেই খাবার দাবারের আয়োজন করা হয়েছে। বুফে সিস্টেম খাবার হবে। চারদিকে আলো আর ফুলের চমৎকার সমারোহ। পুতুল আর সারাজের স্টেজটাও সেখানেই করা হয়েছে। সবকিছু অত্যন্ত অনবদ্য লেগেছে তার। যেন প্রকৃতির রঙে মিশে গিয়েছে এই আয়োজন। লীনা আপ্লুত সুরে বলল,
‘স্টেজ’টা কিন্তু চমৎকার হয়েছে।’
পুতুল হেসে বলল,
‘হ্যাঁ, আমারও খুব পছন্দ হয়েছে।’
‘এই, এবার চল তাড়াতাড়ি। তোকে সাজাতে বসাতে হবে। লেইট হলে আন্টি বকবেন কিন্তু।’
লীনা তাড়া দিতেই পুতুল ছুটল তার রুমের দিকে।
___________
নিচে থেকে হৈ চৈ এর শব্দ ভেসে আসছে। মেহমানদের আগমন ঘটছে হয়তো। পুতুল ছটফট করছে একবার নিচে যাওয়ার জন্য। কিন্তু, লীনাও তাকে এখন ছাড়বে না বলে পণ করেছে। পুতুলের সাজও প্রায় শেষের দিকে। এখন গয়নাগুলো পরিয়ে মাথায় দুপাট্টা দিয়ে দিলেই সমুদায় ব্যাপারটা পরিপূর্ণতা ভাবে।
গয়নাগুলো লীনা ভীষণ যত্ন সহিত পুতুলের গলা আর কানে আরোপণ করল। মাথায় দুপাট্টা দিয়ে পিন লাগাতেই চমৎকার হাসি প্রস্ফুটিত হলো অধর কোণে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলল,
‘দোস্ত, তোকে কী লাগছে রে!’
পুতুল চুরি পরছিল। লীনার কথা শুনে আরশিতে বিদ্ধ হওয়া স্বীয় প্রতিবিম্বটি পরখ করে সে। অবাক হয়। আসলেই, নিরুপম লাগছে তাকে। আহামরি রংচটা প্রসাধনী মুখশ্রীতে ঠাই না পেলেও, এই ক্ষুদ্রতার মাঝেও নিঁখুত চমৎকার ঠেকছে তার এই রূপ। গায়ে জড়ানো রক্তিম লাল শাড়ি, ওষ্ঠ জুড়ে পুষ্পিত লাল রঞ্জক আর ললাট রাঙানো ছোট্ট লাল বিন্দু। না, কেবল এইটুকুই না। অসিত অলকের মাঝ বরাবর তুলা সিঁথিতে স্থান পেয়েছে ছোট্ট একখানা টিকলি। ছোট্ট সরু নাকটাও বাদ যায়নি। বৃত্তাকার একটা বড়ো নোলকে সেটা চকমক করছে যেন।
অদ্ভুত ভাবে পুতুল লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠে। গালে লাল রঞ্জক প্রসাধনী ব্যবহার না করলেও তাতে নিদারুণ ভাবে ফুটছে রক্তিম আভা। তা দেখে লীনাও হাসে। বলে,
‘থাক, আর লজ্জা পাস না। আর এমনিতেও আজ রাতের পর থেকে ভাইয়া আর তোকে এরকম লজ্জা পেতে দিবেনও না।’
বলেই চোখ টিপল সে। পুতুল তার কুনুই দিয়ে গুঁতা দিল ঠিক লীনার পেট বরাবর। লীনা কুঁজো হয়ে পেট চাপড়ে বলল,
‘আজও মারবি?’
‘হ্যাঁ, বাজে কথা বললে অবশ্যই মারব।’
‘হু, সত্যি বললে সবার গায়েই ফোসকা বলে। থাক, আমি আর কিছু বললাম না।’
‘সেটাই ভালো। চুপ থেকে এবার নিজে গিয়ে রেডি হ। নয়তো পরে মাহাত ভাই এসে বলবেন, বান্ধবীকে রেডি করতে করতে আমার গার্লফ্রেন্ডটা একটু রেডি হওয়ার সুযোগও পেল না। ঐ যে তোর লেহেঙ্গা। জলদি পরে, জলদি রেডি হ।’
লীনা অবাকন্ঠে বলল,
‘মাহাতকে কে বলেছে?’
‘কেন, আমি বলেছি। আমার বিয়ে আর আমার বান্ধবীর হবু বর আসবে না? এমনটা আমি কী করে হতেই দেই, বল? তাই মাহাত ভাইও আসবেন। এখন তুই গিয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হ তো।’
লীনা এক পল ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থেকে, অতঃপর গেল তৈরি হতে।
__________
নিচে থেকে বেশ শোরগোল শোনা যাচ্ছে। সবাই বলছে, “বর এসেছে, বর এসেছে।” সেই সুর শুনেই নিচে নেমে গিয়েছে লীনা। এদিকে অস্থিরতায় পুতুলের অবস্থা কাহিল। এর মাঝে এক দুবার বারান্দায় দাঁড়িয়ে উঁকি ঝুঁকি মারাও হয়ে গিয়েছে। সারাজের গাড়ি আজ থেমেছে মেইন গেইটের বাইরেই। সেখানে মানুষের ভীড় জমে গিয়েছে যেন। এত মানুষের ভীড়ে কাঙ্খিত সেই ব্যক্তির মুখাবয়ব না দেখতে পেয়ে বিষন্ন মনে রুমে ফিরে আসল পুতুল। আরো যে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, কে জানে?
লীনা দৌড়ে পুতুলের রুমে এসে হাঁপাতে লাগল। পুতুল চমকে তাকিয়ে বলল,
‘কী হলো, এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন?’
দাঁত কেলিয়ে হাসল লীনা। লেহেঙ্গা গায়ে অনুপম সাজে মেয়েটার এই হাসি চমৎকার ঠেকল পুতুলের কাছে। পুতুলও আলতো হাসল। বলল,
‘তোকে ভীষণ সুন্দর লাগছেরে।’
লীনা বড়ো বড়ো নিশ্বাস ছেড়ে পুতুলের পাশে গিয়ে বসল। বলল,
‘ওসব ছাড়। এটা দেখ।’
পুতুল চাইল লীনার হাতের দিকে। টাকার বান্ডেল দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘এত টাকা?’
লীনা ফের দাঁত কেলিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, তোর জামাইয়ের পকেট কেটেছি। গেইট ধরার টাকা এটা?’
পুতুল মাথায় হাত দিয়ে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বলে,
‘বলিস কী? এত টাকা? তোরা তো দেখছি একদিনেই আমার জামাইকে ফকির বানিয়ে ছাড়বি।’
‘অবশ্যই। আমাদের দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র দুলাভাই। ফকির তো তাঁকে হতেই হবে।’
বলেই লীনা টাকা গুনতে মনোযোগ দিল। পুতুল ফিসফিসিয়ে বলল,
‘আমাকেও একটু ভাগ দিস, প্লিজ।’
অতঃপর লীনা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই পুতুল বোকা বোকা হাসি দেয়।
______________
পুতুলকে নিয়ে যাওয়া হলো স্টেজের সামনে। মাথায় টানা বড়ো ঘোমটার কারণে তার মুখশ্রী সকলের দৃষ্টিগোচরের বাইরে। তাও তারদিকে সবাই চেয়ে আছে নিষ্পলক চোখে। স্টেজের ঠিক মাঝ বরাবর টানিয়ে রাখা বড়ো ফুলের চাদর পেরিয়ে পুতুলকে দেখা মুশকিল। তবুও একজনের অবাধ্য তৃষ্ণার্ত অক্ষিযুগল সব পেরিয়ে তার বধূরূপী প্রেয়সীকে দেখতে ব্যস্ত। তবে ঐটুকু দেখাতে কি হয়? হয় না, ঐ ক্ষুদ্র দেখা কেবল অন্তরের অন্তঃস্থলের আকাঙ্খাকে তীব্র করে, অন্তরকে শীতল করতে পারে না।
পুতুলকে বসানো হলো সারাজের উল্টো পাশে। তাকে ঘিরে আত্মীয়স্বজন সবাই দাঁড়িয়ে আছে। মেহুল আর রিতা অফুরন্ত খুশিতে উন্মাদ। তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রাবীর আর সাদরাজ। আপ্লুত চোখে ছেলে মেয়েগুলোকে দেখছে। যেন চোখের পলকেই বড়ো হয়ে গিয়েছে তারা।
কাজী সাহেব কাবিননামা পড়ে শোনালেন। অতঃপর সারাজের দিকে চেয়ে বললেন,
‘বলো বাবা, আলহামদুলিল্লাহ কবুল।’
সারাজের নির্নিমেষ দৃষ্টি ঘোমটার আড়ালে তার পুতুলের পানেই। ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।’
পরপর আরো দুবার বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ, কবুল; আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।’
এবার কাজী সাহেব চাইলেন পুতুলের দিকে। কাবিননামা পড়লেন পুনরায়। একই ভাবে বললেন,
‘কবুল বলো, মা।’
কোনোপ্রকার ভনিতা ছাড়াই ঝরঝরে সুরে পুতুল বলে উঠল,
‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল, কবুল, কবুল।’
তাকে এত নির্লিপ্ত ভাবে কবুল বলতে দেখে অবাক চোখে চাইল সবাই। সারাজ নিজেও বিস্মিত। প্রথমবার কবুল বলার সময় যে মেয়ে ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল, আজ সেই মেয়ে এক শ্বাসেই কবুল বলে ফেলল? আশ্চর্য!
সবার অমন দৃষ্টি দেখে ইতস্তত সুরে পুতুল বলল,
‘এভাবে দেখছ কেন? কবুল’ই তো বলেছি। খুশি হওনি তোমরা?’
একসঙ্গে হেসে উঠল সবাই। সমস্বরে বলে উঠল,
‘আলহামদুলিল্লাহ।’
চলবে…
(যারা যারা বিয়েতে এসেছেন, গিফ্ট নিয়ে লাইনে দাঁড়ান। আমি আসছি, পুতুল আর সারাজের হয়ে গিফ্ট কালেক্ট করতে😁)
ছবি: রত্নাবু❤️