#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪২।
আজ পুরোটা দিন সারাজ আর পুতুল অনেক জায়গায় ঘুরেছে। আশেপাশের সমস্ত পর্যটন কেন্দ্র তাদের ঘোরা শেষ। কেনাকাটাও করেছে অনেক। এবার নৈশভোজ সেরে হোটেলে ফেরার পালা। তাই কাছেরই একটা হোটেলে ঢুকল সারাজ আর পুতুল। সারাদিনের এত ঘোরাঘুরিতে বড্ড ক্লান্ত পুতুল। কোনোরকমে খাবার খেয়ে যাত্রা করল হোটেলের উদ্দেশ্যে।
রুমে এসে পুতুল তার ক্লিষ্ট শরীর বিছানায় এলিয়ে দিল। আর সারাজ ঢুকল ওয়াশরুমে। এক পল চোখ বোজে থেকে আবার কী ভেবে যেন উঠে বসল পুতুল। চট করে গিয়ে ব্যাগ খুলে বের করল একটা লাল রঙের শপিং ব্যাগ। সেটা তুলে বিছানায় রেখে, উঠে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজাখানা বাইরে দিয়ে আটকে দিল। মনে মনে দারুণ এক পরিকল্পনা এঁটে ঠোঁট চেপে হাসল সে। অতঃপর আদ্যোপান্ত আর না ভেবে লেগে পড়ল সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে।
মাঝ পথেই দরজায় করাঘাত করতে আরম্ভ করল সারাজ। ডেকে বলল,
‘এই পুতুল, ওয়াশরুমের দরজা কি বাইরে দিয়ে আটকানো? আমি খুলতে পারছি না কেন?’
পুতুল অস্থির গলায় বলল,
‘হ্যাঁ, আমি লাগিয়েছি। ওয়েট করো, একটু পর খুলে দিব।’
সারাজ করাঘাতের শব্দ উল্টো আরো তীব্র করল। বলল,
‘মানে কী? দরজা আটকে দিয়ে তুই কী করছিস?’
নিঃস্পৃহ সুরে পুতুল বলে উঠল,
‘আহা, একটু দাঁড়াও না। খুলছি তো।’
সারাজ কপট রাগ দেখিয়ে জবাব দিল,
‘দুই মিনিটের মধ্যে খুলবি। নয়তো আমি কিন্তু দরজা ভাঙব।’
সারাজের ঠান্ডা হুমকি গলাধঃকরন করে পুতুল জলদি তার হাত চালাল। দুই মিনিটের জায়গায় দীর্ঘ পনেরো মিনিট সময় নিল সে। সারাজ ইতিমধ্যেই রেগে আগুন। ভেতর থেকে চেঁচিয়ে মরছে। পুতুল এতক্ষণে তার সেই রাগকে আমলে নিল। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে খুলে দিল দরজাখানা। সারাজ প্রস্তুতি নিয়েছিল, আজ ভীষণ রাগ দেখাবে। কয়েকশো ধমক তো অবশ্যই দিবে। কিন্তু, হলো সব উল্টো। দরজা খুলে চোখের সম্মুখে স্থির পুতুলকে দেখে হৃদপিন্ডের গতি কয়েক দফা তড়ান্নিত হলো। সেই প্রণয়িনীর আপাদমস্তক একবার পরখ করতেই গলা শুকিয়ে উঠল তার। তাই পরপর দুখানা ঢোকও গিলল। কম্পিত সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘এসব কী?’
ঠোঁট চেপে হাসি আটকাল পুতুল। সারাজের বিভ্রান্ত চোখ মুখ দেখে বড্ড হাসি পাচ্ছে তার। তাও সেটা চেপে অতি আহ্লাদের সহিত বলল,
‘তোমার জন্য একটা ছোট্ট সারপ্রাইজ।’
সারাজ বড়ো করে নিশ্বাস ফেলল। সারপ্রাইজ না ছাই! সারাজ জানে, এই মেয়ে এসব কেবল তার চুমু না খাওয়ার পণ ভাঙতে করছে। সেও তাই ঠিক করল, যাই হয়ে যাক না কেন আজ সে হারবে না। কথাখানা মস্তিষ্কে বার কয়েকবার আওড়িয়ে পুতুলকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগুলো সে। ভ্রু কুঁচকে চাইল পুতুল। জিজ্ঞেস করল,
‘কী হলো, আমাকে ইগনোর করছ কেন?’
সারাজ প্রথমে উত্তর না দিয়ে, টেবিল থেকে তুলে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি গিলল। অতঃপর গিয়ে বসল বিছানার পশ্চাৎ পার্শ্বে। পুতুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘কোথায় তোকে ইগনোর করলাম?’
পুতুল এগিয়ে এসে বসল সারাজের একদম গা ঘেঁষে। বলল,
‘খুব গরম লাগছে, তাই না? এসি’টা একটু ছাড়ব?’
সারাজ অন্যদিকে চেয়ে বলল,
‘হ্যাঁ ছাড়। তোকে না করল কে।’
পুতুল এসির রিমোট নেওয়ার বাহানায় সারাজের আরেকটু ঘনিষ্ঠ হতে নিলেই সে চট উঠে দাঁড়াল। পুতুল ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘কী হলো?’
সারাজ রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। বলল,
‘কিছু না। এসি ছাড়।’
এসি ছাড়া হলো। সারাজ দ্রুত করে গিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানার অপর পার্শ্বে। হাসল পুতুল। কিন্তু সেটা সারাজের অগোচরেই। পুতুলও তার সিদ্ধান্তে অটল। সারাজের পণ আজ রাতের মধ্যেই ভাঙিয়ে ছাড়বে। তাই সে গিয়ে বসল সারাজের অতি নিকটে। হাত ছোঁয়াল তার প্রশ্বস্থ ললাটে। ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ঘুম পাচ্ছে, সুইটহার্ট?’
বিস্ফোরিত চোখে চাইল সারাজ। বলল,
‘এই মেয়ে, কী চাচ্ছিস তুই?’
পুতুল কষ্টে হাসি চাপল। বলল,
‘তোমাকে।’
সঙ্গে সঙ্গেই চোখ বোজল সারাজ। বলল,
‘আমার এখন ঘুম পাচ্ছে।’
‘আমার তো পাচ্ছে না।’
‘তো, আমি কী করব?’
উত্তর দিতে তার কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিল পুতুল। ঠোঁট নাড়িয়ে মৃদু আওয়াজে বলল,
‘আদর করবে।’
‘অসম্ভব। আজ কোনোমতেই আমি তোর কথা শুনব না।’
এবার কিঞ্চিৎ শব্দ করে হাসল পুতুল। বলল,
‘অবশ্যই শুনবে। শুনতে তো তোমাকে হবেই।’
বলেই উঠে দাঁড়াল সে। তার গায়ে জড়ানো লাল রঙের পাতলা রাত পোশাকের উপরের অংশটার কাঁধের পাশটা একটু নামাল। শিষ বাজিয়ে সুর টেনে বলল,
‘জানেমান, ও মেরি জানেমান; একবার দেখো আমায়।’
সারাজ কপাল ভাঁজ করল, তবুও চাইল না। নাক ফুলিয়ে হাসল পুতুল। উঁচু আওয়াজে বলল,
‘আমিও দেখি, ঠিক কতক্ষণ তুমি আমাকে অগ্রাহ্য করে থাকতে পারো।’
অতঃপর উপরের অংশটা উন্মুক্ত করল সে। সেটা ছুঁড়ে মারল সারাজের মুখের উপর। এবার ক্ষিপ্ত হয়ে চোখ মেলে তাকাল সারাজ। পুতুলের দিকে চাইতেই মাথা আরও গরম হলো তার। রাগ দেখিয়ে বলল,
‘পাগল হয়েছিস?’
পুতুল সেসব তোয়াক্কা না করে বলল,
‘জানো, আমার ভার্সিটিতে সাহেল নামের একটা ছেলে আমাকে পছন্দ করত; ওকে এখন একটা ভিডিও কল দেই?’
‘তোকে এক থাপ্পড় দিয়ে আমি ছয় তালা থেকে নিচে ফেলে দিব, ফাজিল মেয়ে। এসব ঢং বন্ধ করে চুপচাপ শুতে আয়।’
‘উঁহু, আজকে নো শোয়া শোয়ি।’
পুতুল এগিয়ে গিয়ে ফের সারাজের অতি নিকটে বসে পড়ে। দুহাতে সারাজের গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,
‘তুমি এত সুন্দর কেন, সারাজ? আমি বার বার কেন তোমার প্রেমে পড়ি বলোতো?’
কথার মাঝেই তার এক হাত ইতিমধ্যে সারাজের গলা ছেড়ে আরেকটু নিচে নেমে গিয়েছে। সারাজ খপ করে সেই হাতখানা ধরে বলল,
‘খুব চালাক, তাই না? ইচ্ছে করে এসব করছিস? তুই জানিস, আমি আজ ক্ষেপলে তোর অবস্থা কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।’
পুতুল আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো। বলল,
‘হোক। আমি ভয় পাই না।’
ক্রূর হাসল সারাজ। বলল,
‘তাই?’
পুতুল দম্ভ দেখিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ।’
সারাজ এগিয়ে এল। দু হাতের আঁজলায় পুতুলের নিরুপম সুন্দর মুখখানা নিয়ে বলল,
‘তবে তাই হোক। আজ জিত’টা তোরই হোক। আমি না হয় এই পরাজয়টাই হাসি মুখে বরণ করে নিব।’
ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল পুতুল। সারাজ আরেকটু এগিয়ে এল। দুই জোড়া ওষ্ঠ মিলতে আর এক পলও বিলম্ব হলো না।
আজ আর পুতুল লজ্জা পেল না। ভুলে গেল সমস্ত লাজুকতা। চিত্তপটে কেবল একটাই খুশির স্রোত বইছে, সে জিতেছে। অথচ, সারাজ যেন আজ হেরে গিয়েও জিতে গিয়েছে। যদি হেরে যাওয়ার ফল এত সুখকর হয়, তবে এভাবে আরো হাজাবার হারতে রাজি সে।
_______
সকাল পেরিয়ে বর্তমানে দুপুর বারোটা পনেরো বাজে। পুতুলের উঠার কোনো নাম গন্ধ’ই নেই। সেই দশটা থেকে সারাজ তাকে টানা ডেকে যাচ্ছে। কিন্তু, সেই ডাক আদৌ পুতুলের কর্ণকুহুরে পোঁছাচ্ছে কি-না সেটা নিয়ে আছে যথেষ্ঠ সন্দেহ। পুতুলের মাঝে কোনো হেলদোল নেই। এমন ভাবে ঘুমাচ্ছে যেন, গত কয় মাস ধরে ঘুমহীন ছিল সে। সারাজও ডাকতে ডাকতে এবার বীতঃস্পৃহ। তাই ডাক বন্ধ করে রুমে বসেই সকালের নাস্তা অর্ডার করল।
পুতুলের ঘুম ভাঙল আরো বিশ মিনিট পর। তাও সারাজের তাকে টেনে বসাতে হলো। চোখ কচলিয়ে এদিক ওদিক চেয়ে সে বলল,
‘কয়টা বাজে?’
সারাজ নাস্তাগুলো গুছাতে গুছাতে বলল,
‘বেশি না, বারোটা চল্লিশ।’
চেঁচিয়ে উঠল পুতুল। বলল,
‘একটা বাজতে চলল, আর তুমি আমাকে ডাকোনি?’
সারাজ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
‘ডাকিনি মানে; ডাকতে ডাকতে গলা শুকিয়ে ফেলেছি। যা, এখন তাড়াতাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। নাস্তা ঠান্ডা হচ্ছে।’
পুতুল বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই মৃদু আর্তনাদ করে ওঠল। সারাজ চিন্তিত সুরে বলল,
‘কী হয়েছে?’
জবাবে ক্ষুব্ধ হয়ে তার দিকে চাইল পুতুল। পুতুলের অমন চাহনি দেখে ফিচেল হাসল সারাজ। বলল,
‘কাল রাতেই সাবধান করেছিলাম। এখন ওভাবে তাকিয়ে কোনো লাভ নেই।’
নাক মুখ মাত্রাধিক কুঁচকে পুতুল আওয়াজ করে বলল,
‘অসভ্য।’
চলবে….
ছবি: রত্নাবু❤️