#হিমাংশুর_জলপদ্ম [৮]
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
– তোর স্বামীকে ইন্দ্র মেরেছে আমি নিজে চোখে দেখেছি।
দিদির বুক থেকে মাথা তুলে বড় বড় চোখে তাকালো কুমুদ কামিনীর দিকে।কুমুদ অবাক কন্ঠে দিদিকে বললো,
– কিহ্?কি বলছো দিদি?কেন মারলো?
– হয়তো তোকে বিয়ে করেছে তাই।
– দিদি!
কামিনী চোখ তুলে কুমুদের দিকে তাকালো।কুমুদ ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।কামিনী বললো,
– জানতে চাস তো কেন বড় ছেলের সাথে বিয়ে না দিয়ে ছোট ছেলের সাথে বিয়ে দিল?
কুমুদ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।কামিনী মাথা নত করে বললো,
– তোর শাশুড়ি তার বড় ছেলের জন্য ভালো ঘরের মেয়েকে ঠিক করে রেখেছে।তাই তোকে ছোট ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে।ছোট ছেলে একয়েকদিন ঘরমুখ হয় এই ক্ষোভে যে তার সাথে কেন একটি জাত পরিচয়হীন মেয়ের বিয়ে দিলো আর বড় ছেলের জন্য কেন বড়ঘরের মেয়ে পছন্দ করলো।
– তুমি জানলে কিভাবে এসব?
– গ্রামের লোকের কানাঘুষতে জানতে পেরেছি।তোর সাথে দেখা করতে আসবো বলে তাড়াতাড়ি শিশু গাছের নিচে দিয়ে আসছিলাম তখন দেখি দুই ভাই কথা কাটাকাটি করছে।আমি একটু আড়ালে দিয়ে দাঁড়ালাম ওরা কি করে দেখতে।তখন একপর্যায়ে দেখলাম ইন্দ্র পাশ থেকে একটি ইট উঠিয়ে দেবের মাথায় বারি দিয়েছে।বারি দিয়ে সেও বুঝতে পারিনি হয়তো যে দেব মরে যাবে। দেবের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কাছে গিয়ে যেন কি দেখলো তারপর দৌড়ে পালালো।আমার সারা শরীর হিম হয়ে গিয়েছিল।আমি হাঁটতে পারছিলাম না এটা দেখার পর।অনেক কষ্টে এতটুকু হেঁটে এসেছি।
কামিনী কথা শেষ করে নিজের হাত থেকে একজনো সোনার বালা খুলে কুমুদের হাতে পরিয়ে দিলো।কুমুদের গাল দুইহাতে ধরে বললো,
– পালা কুমুদ।তোকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবি তুই কিছু জানিস না।না হলে ঐ ইন্দ্র তোকে বাঁচতে দিবে না।এখানে থাকলে এরা তোকে বাঁচতে দিবে না।
– কিন্তু দিদি তোমাকে এখানে একা রেখে আমি যাবো না।
– না বোন জেদ করিস না পালা।
কুমুদ আর কিছু বলতে পারলো না তার আগেই লতা পাল কুমুদের চুলের মুঠি ধরে নিয়ে গেল শ্মশানে চিতায় নিক্ষেপ করতে।বোনকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়ে দিদি কামিনীও ঝাপ দিলো নদীর অতল গহ্বরে। আর সেই দৃশ্য চোখে ভাসতেই দপ করে চোখ খুলে ফেললো কুমুদ। আশে পাশে তাকিয়ে আবছা আলোই দেখতে পেল ধূলোয় ভরা ঘরে হাজারও ইঁদুরের বসবাস।ঘরের এক কোণ থেকে অন্যকোণে দৌড়ে বেড়াচ্ছে তারা।খিদের যন্ত্রণায় নিজের ডান হাত কামড়ে ধরলো কুমুদ। আজ দু দুটো রাত এভাবে এখানে আটকে আছে সে।পেটে না পড়েছে একটু কোনো দানা আর না পড়েছে জলের কোনো ফোঁটা।নিভু নিভু চোখে কুমুদ ভাবতে থাকলো আর এক রাত এখানে বন্ধি থাকলে হয়তো সে সত্যিই এখানে পঁচে গলে মরবে।খিদে আর তৃষ্ণায় তার মৃত্যু অনিবার্য। খিদের যন্ত্রণা আর বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছায় হিংস্র হয়ে উঠলো কুমুদ। হিংস্র শিকারির মতো ঘরের একোণ থেকে অন্য কোণে দৌড়া দৌড়ি করা ইঁদুরগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সে।চোখ দুখানা লাল রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে।মুখ দিয়ে এক অদ্ভুত গোংরানি শুরু করলো কুমুদ।খিদের যন্ত্রণায় এতোটাই হিংস্র হয়ে উঠলো যে সে নিজেই বুঝতে পারলো না সে কি করলো?খপ করে সামনে থেকে যাওয়া একটি ইঁদুর ধরে সাথে সাথে মুখে পুরে দিলো।আবার সঙ্গে সঙ্গে থু করে ফেলেও দিলো।পেট মুচড়ে বমি বের হতে চায়লো।তবে পেটে কিছু না থাকায় শুধু মুখ দিয়ে শব্দ হলো কিছু বের হলো না।চিৎকার করে কেঁদে উঠলো কুমুদ। হাজারও অভিযোগ নিয়ে তার সৃষ্টি কর্তার কাছে বলতে লাগলো,
– এ কেমন জীবন দিলে আমাকে ভগবান?এমন ভাবেই যদি আমার জীবন সাজালে তাহলে কেন আমার এই সুন্দর পৃথিবীতে সুখের কাঙাল করে পাঠালে?খিটের জ্বালায় মরে যাচ্ছি আমি।হয় তুমি এখনই আমার দেহ থেকে জানটাকে নিয়ে নাও না হয় আমাকে বাঁচাও তাও আমি এই খিদের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না।
বলে হাত পা দাপাতে দাপাতে মেঝেতে শুয়ে পড়লো কুমুদ। দুই হাত দিয়ে পেটটা চেপে ধরলো। মেঝেতে পড়ে থাকা মরা ইঁদুরটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। অতঃপর ডানপা দিয়ে লাথি মেরে সেটাকে দূরে সরিয়ে দিলো।
চোখটা এবার বোধহয় আজীবনের মতো লেগে আসছে।আর বোধহয় এ দুচোখ খুলে এই পৃথিবীর আলোটাকে গায়ে মাখানো হবে না।
————
মিনালকে নিয়ে হাটে এসেছে হিমাংশু।আজ সে বাড়ি যাবে তাই কুমুদ আর তার দিদির জন্য তার প্রথম আয় দিয়ে কিছু কিনবে বলে বুধবারের জমজমাট ভরা হাটে এলো।কাপড়ের দোকানে বিভিন্ন শাড়ি দেখতে দেখতে একটি লাল শাড়িতে তার চোখ আঁটকে গেল।এমনিই এক লাল টুকটুকে শাড়িতে সে কুমুদকে দেখে এক নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়।শাড়িটিতে হিমাংশুর তার নরম হাত রাখে এপাশ ওপাশ হাত বুলিয়ে বলে,
– দাদা শাড়ির দাম কত?
– এইটা তো ভালো মানের শাড়ি তাই এর দাম তেরো টাকা।নিয়ে যান বৌদি খুশি হয়ে যাবে।
মিনাল চোখ কপালে তুলে অবাক কন্ঠে বললো,
– তেরো টাকা???দিনে দুপুরে ডাকাতি?
দোকানদার ভ্রুকুটি করে তাকালো মিনালের দিকে মুখ কালো করে বললো,
– পছন্দ হলে নেন না হয় না নেন ঝামেলা করেন না তো।
হিমাংশুর ঠোঁটে ভাসছে এক মিষ্টি হাসি।সে পকেট থেকে তেরোটাকা বের করে দোকানদারের হাতে দিলো।মিনাল অবাক চোখে হিমাংশুর কাজকর্ম দেখতে লাগলো।নিচু স্বরে হিমাংশুর কানে ফিসফিস করে বললো,
– কিরে হিমাংশু মাথাটা একদম গেছে নাকি?তেরো টাকা দিয়ে শাড়ি কিনছিস?বাকি মাস চলবি কি করে?
হিমাংশু মুখে হাসি নিয়ে বললো,
– তেরো টাকা কি বেশি?
মিনালে দু ঠোঁটের মাঝে দূরত্ব তৈরি হলো।সে হা করে শুধু হিমাংশুর দিকে চেশে আছে।হিমাংশু দোকানদারের থেকে তার দিদির জন্য একটি মেহরুন রঙের শাড়ি নিল।চুড়ির দোকান থেকে একগুচ্ছ চুড়ি নিল কুমুদের জন্য সাথে নিল একটি বেলি ফুলের মালা।আরেক গুচ্ছ চুড়ি নিল তার দিদি সুপ্রিয়ার জন্য।মনে হাজারও আনন্দ নিয়ে রওনা হলো দিদির বাড়ির উদ্দেশ্যে।
দিন দুপুরে বাড়িতে এতো নিস্তব্ধতা দেখে বেশ অবাকই হলো হিমাংশু।আরও অবাক হলো যখন দেখলো ঘরের সদর দরজায় তালা দেওয়া।হিমাংশু আশেপাশে তাকিয়ে গলা উঁচিয়ে তার দিদিকে ডাকলো কয়েকবার,
– দিদি?ও দিদি?কই গো সবাই?
কারো কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে হিমাংশু একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।বাড়ির উঁচু বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসলো এই আশ্বাসে যে কুমুদ আর তার দিদি আশেপাশেই কোথাও আছে এখনই ফিরে আসবে।বসতে বসতে তৃষ্ণা পেল হিমাংশুর উঠে দাঁড়ালো সে বেশ অনেকটা সময় ধরে বসে আছে এখানে।তবু কুমুদ বা তার দিদি সুপ্রিয়ার কোনো দেখা নেই।হিমাংশু নানান চিন্তা ভাবনা নিয়ে হেঁটে কল পাড়ে গেল।টিউবওয়েলে দুটো চাপ দেওয়ার পর জল পড়লো সেখান থেকে।সেখান থেকে দু’হাতে কিছুটা জল নিয়ে গলা ভেজালো হিমাংশু।তারপর গিয়ে ফের বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসলো।নানা কথা মাথায় আসছে তার এতোটা সময় হয়ে গেল কুমুদ বা সুপ্রিয়া কারো দেখা পেল না ব্যাপার কি?হিমাংশু বিড়বিড় করে বললো,
– দিদি কুমুদকে নিয়ে ও বাড়িতে যায়নি তো?আমি একবার গিয়ে দেখবো?
উঠে দাঁড়ালো হিমাংশু যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে ঠিক তখন অন্য কথা মাথায় এলো তার আবার সেই একই স্থানে বসে পড়লো। আবার বিড় বিড় করে বললো,
– না তা কেন যাবে?দিদি তো জানে বাবা আমাদের বের করে দিয়েছিল।আর বাবা যে কঠোর মানুষ একবার যখন বের করেছে তখন আর ঘরে তুলবে না।তাহলে দু’জন গেল কোথায়?
বলতে বলতে আবারও একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো হিমাংশু।ডান হাতের তর্জনি দিয়ে মেঝেতে আঁকাবাঁকা কিছু রেখা আঁকলো।তর্জনি দিয়েই কুমুদের নামটা লিখলো মেঝেতে হিমাংশু। এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হতাশ কন্ঠে উচ্চারণ করলো,
– প্রেম প্রহরে কেন বিরহ আসে?
জলপদ্মে পিয়াসে হিমাংশু ভাসে!
বলে নিজে নিজেই একটা মিষ্টি হাসি দিলো।আবার ধপ করে তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়।বিকেলের লাল রশ্মিতে ঘেরা আকাশের দিকে তাকিয়ে মুখ কালো করে ফেলে সে।মনে মনে বলে,
– এবার তো মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই দিদি ওকে নিয়ে ও বাড়িতে গিয়েছি।নাহ্ আর বসে থাকলে চলবে না কি হচ্ছে ওখানে কে জানে?
উঠে দাঁড়ালো হিমাংশু পায়ে জোর বাড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো সে।এই সন্ধ্যায় কোনো যাতায়াতের বাহন পাবে কি না তা অনিশ্চিত তবু অনিশ্চিত পথ চলা শুরু করলো হিমাংশু।
চলবে..
(আপনারা আমার সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করেন না।কষ্ট লাগে।লাস্ট পার্ট মনে হয় কাল দিবো।)