#শর্ত
#লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:০২
রাত্তিরটা বারান্দাতেই কেটে যায় রাতের। খুব ভোরে আজানের শব্দে ঘুম ভাঙে তার।চোখ খুলে নিজেকে দোলনায় দেখতে পায়।চোখজোড়া যেন বন্ধ হয়ে আসছে।মনে হয় ফুলে গেছে। উঠে দাঁড়ায় রাত।রুমে গিয়ে সায়ান আর শিশিরকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে সে। শিশির এক হাতে সায়ানকে আগলে আছে। সায়ানটা এমনি ওতো দুষ্টু না।একবার ঘুমালে এত সহজে উঠে না। রাত হালকা হেসে সায়ানের কপালে চুমু দিয়ে একটা সুতির শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিলো। সায়ানের পাশে এসে বসতেই আবারো রাজ্যের ঘুম চোখে ভর করলো। আস্তে আস্তে সেখানেই ঘুমিয়ে গেলো সে।
এদিকে শিশিরের হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় ঘুম ভাঙে তার। ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসে। এতটাই ঘুম তার চোখে যে বিপরীত পাশে বসে থাকা সুন্দরী তরুণী তার চোখে পড়লো না। কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো,
-“মিঃ চৌধুরী?”
শিশির গলাটা ঠিক করে বললো,
-“জ্বী বলছি।”
-“আমি থানার ওসি বলছিলাম।”
শিশির ভ্রু কুঁচকে ফোনের নম্বটা দেখে নিয়ে বললো,
-“জ্বী বলুন।”
-“মিঃ চৌধুরী আপনার ওয়াইফের খোঁজ পাওয়া যায়নি তবে ওনার রেখে যাওয়া চিঠির সূত্রানুসারে আমরা সব জায়গায় খুঁজছি।”
-“আমি কি আপনার কাছে জানতে চেয়েছি যে আমার স্ত্রী কোথায়?”(দাঁতে দাঁত চেপে)
-“আপনিই তো থানায় ডায়রী করলেন।”
-“আমি আমার স্ত্রীর নামে মামলা করেছি। ওনাকে খুঁজে শাস্তি দেয়াটা আপনাদের দায়িত্ব। মিনিটে মিনিটে ওর মত মেয়ের খবর নেয়ার সময় আমার নেই।”
-“তারমানে আমরা খুঁজে না পাওয়া অবধি আপনাকে ওনার বিষয়ে কিছু বলবো না। তাই তো!”
-“এক্সেক্টলি।”
-“ওকে মিঃ চৌধুরী। তবে বিয়ের দাওয়াতটা…”
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কলটা কেটে দিলো শিশির। রেগে নিজেই বলতে লাগলো,
-“অসহ্য পাগল লোক একটা।কাজের কাজ কিছুই না। শুধু লেকচারবাজি। আর কল দেয়াদেয়ি।”
বলেই নাম্বারটা ব্ল্যাক লিস্টে যোগ করে দিলো। বিছানা থেকে নামতে যাবে এমন সময় চোখ পড়লো তার বিপরীত পাশে থাকা গালে হাত দিয়ে ঘুমানো সুন্দরী তরুণীটির দিকে। এক হাতে সায়ানকে আগলে ঘুমিয়ে আছে সে। শিশিরের পলক পড়ছে না। রাতের চোখগুলো কেমন ফোলা। শিশিরের গত রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। ভাবলো,
-“নাহ!মেয়েটাকে এভাবে বলা উচিত হয়নি।হয়ত কান্নাও করেছে।”
পরক্ষনেই মিতালির করা কাহিনীর কথা মনে পড়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে বিরবির করে বললো,
-“নাহ,এরা সবাই একই রকম।এসব মেয়েদের বিশ্বাস করা যায় না।কখনো না।”
বলেই সে সেখান থেকে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো।৭ টা বাজতে চললো। তাকে কলেজে যেতে হবে।
দরজায় কারোর কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙলো রাতের। চটজলদি উঠে পড়লো সে।সায়ান হাত-পা ছুঁড়ে খেলছে।রাত মুচকি হেসে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।শিশিরকে ওয়াশরুম থেকে বের হতে দেখে বললো,
-” একটু সায়ুর মুখে ফিডারটা ধরুন তো। দরজায় কে যেন এসেছে। আমি দেখেই আসছি।”
শিশির কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
-“সায়ু?”
রাত বিরক্তির স্বরে বললো,
-“হ্যা!সায়ু।যান তো।”
শিশির আর কিছু না বলে সায়ানের পাশে শুয়ে ওর মুখে ফিডার ধরলো। দরজা খুলতেই সায়ানের ছোট বোন কেয়াকে দেখতে পেলো সে। কেয়া মুচকি হেসে বললো,
-” রাত আপু, মা তোমায় ডাকছে।”
-” আসছি কেয়া। সায়ানকে খাইয়ে আসছি।”
কেয়া সম্মতি দিয়ে চলে গেলো। রাত আবারো সায়ানের দিলে এগিয়ে গিয়ে শিশিরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-” এবার আপনি উঠতে পারেন।”
শিশির এবারও চুপ।রাত মনে মনে ভাবলো,লোকটা এত গম্ভীর কেন? অবশ্য কথা না বলাই তো ভালো।কথা বললেও কত বাজে বাজে কথা শুনায় সে রাতকে।রাত সায়ানকে ফিডার খাইয়ে কোলে তুলে নিলো।শিশির তখন রেডি হচ্ছে। রাত সায়ানকে নিয়ে বাহিরে চলে গেলো।সেদিকে তাকিয়ে শিশির ভাবলো,
-“মিতালি চলে গেছে আজ তিনদিন।রাত গতকাল বিয়ে করার আগের দুদিন আমি সায়ানকে এত শান্ত দেখিনি।সবসময় ছেলেটা কেঁদেছে।রাত এসে হয়ত ওর অনেকটা কষ্টই কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার কষ্টটা কমিয়ে দেয়ার ক্ষমতা হয়ত সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারোর নাই।”
ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।এদিকে নিচে নামতে নামতে চৈতী বেগম এসে সায়ানকে রাতের কোল থেকে নিয়ে বললেন,
-“গতকাল রাত থেকে সামলাচ্ছিস। এখন কিছু খেয়ে নে।”
-“খিদে নেই আন্টি।”
জোরপূর্বক হেসে বললো রাত।কেয়া টেবিলে বসেই বললো,
-” সে কি আপু!খিদে নেই মানে।চলে এসো।”
চৈতী বেগম কেয়াকে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
-“আপু কিসের?ভাবী বল।”
কেয়া কেবলা হেসে বললো,
-“আসলে অনেকদিনের অভ্যাস তো।”
-“সমস্যা নেই কেয়া।”
বলতে বলতে রাত গিয়ে কেয়ার পাশে বসে পড়লো।অল্প কিছু মুখে দিতেই আবারো সায়ান কেঁদে উঠলো। চৈতী বেগমও সামলাতে গিয়ে অস্থির। রাত উঠে সায়ানকে নিয়ে দুলতে দুলতেন বললো,
-“ইশ,আমার সায়ু বাবাটা কাঁদে কেন?এই দেখো তোমার মা তোমার সামনে।”
সায়ান ঠোঁট উল্টে বড় বড় চোখে তার নতুন মাকে দেখছে।সায়ানের সাথে রাতের বন্ধুত্বটা কিন্তু কম দিনের নয়। রাতের কাছে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখেই মিতালি গোসল করতে যেত,রান্না করত,বান্ধবীদের সাথে খোশগল্প করত। কারণ চৈতী বেগম থাকতেন গ্রামের বাড়ি। কেয়াও হোস্টেলে থাকত।কিন্তু চৈতী বেগমের বাসায় আসার দিনই মিতালি এভাবে পালাবে কখনো ভাবতে পারেননি চৈতী বেগম। উনিও তো নিজের মেয়ের মতই ভাবতেন।কিভাবে ছেলেটা কাঁদছিল একা রুমে!হয়ত ঘুম থেকে উঠে মাকে না পেয়ে!বুক কাঁপলো না মিতালির?ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন চৈতী বেগম।তারপর ব্যস্ত গলায় বললেন,
-“আমায় দে।তুই খেয়ে নে কিছু। আমি সামলে নিচ্ছি।”
রাত দিলো না। হাত ধুতে ধুতে বললো,
_”থাক না আন্টি। আমি পরে খেয়ে নিব।”
বলেই সে সোফায় বসে সায়ানকে হাসাতে মেতে উঠলো। চৈতী বেগম চোখের কোণায় জমে থাকা পানিটা মুছে নিয়ে ব্রেডে জেলি মাখতে লাগলেন। কেয়াও রাতের সাথে যোগ দিয়ে সায়ানের সাথে খেলছে। উপর থেকে দৃশ্যটা পর্যবেক্ষন করলো শিশির।মনে মনে ভাবলো,
-“রাতের জায়গায় তোমায় আশা করেছিলাম মিতালি।ছিলেও তুমিই।কিন্তু আজ তোমার একটা ভুলে তুমি আমাদের সবার কাছে কেবল ঘৃণা!”
ভেবেই তাচ্ছিল্য হাসলো শিশির।চৈতী বেগম ব্রেডটা জোর করেই রাতকে খাওয়ালেন। শিশিরকে নামতে দেখে বললেন,
-“কোথাও যাবি?”
-“হুম কলেজ।”
বলেই সে সায়ানকে রাতের কোল থেকে নিয়ে আদর করতে লাগলো।সায়ান বাবার আদর উপভোগ করছে। চৈতী বেগম ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
-” খাবি না?”
শিশির সায়ানকে কেয়ার কোলে দিতে দিতে বললো,
-“না মা!লেট হচ্ছে। আসি।”
বলেই সে প্রস্থান করলো।চৈতী বেগম চিন্তিত হয়ে বললেন,
-“গতকালই বিয়ে হলো আজই যাওয়াটা কি উচিত হলো?আমার ছেলেটার সাথে খারাপ যেন কিছু না হয়।মেয়েটা আমার আমার শিশিরের শরীরে কলঙ্ক লাগিয়ে গেল।”
এদিকে রাতের সময় কাটে সায়ানকে নিয়ে। একদম নিজের ছেলেই যেন!মা না হওয়ার আক্ষেপটা আর নেই। মনের এক কোণ থেকে বারবার কেউ বলছে,
-“সায়ানই তোর সন্তান রাত!তোর অংশ না হয়েও তোরই অংশ ও। ওকে আগলে রাখ। ওই তোর বেঁচে থাকার সম্বল।”
রাত সায়ানকে নিয়ে মেতে থাকে সার্বক্ষনিক। সায়ানও আস্তে আস্তে রাতকে মা ই ভাবছে হয়ত।কিন্তু সবটাই সময় বলে দেবে।
সন্ধ্যার পর টিউশনির শেষে বাসায় ফিরে শিশির। রুমে গিয়ে ছেলেকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে সে। হালকা হেসে ঘুমন্ত ছেলেকে আদর দেয়।তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে ভাবতে লাগে,
-“আজ কলেজে যেসব কথা শুনতে হলো!এসব কি আমায় সারাজীবনই বয়ে যেতে হবে?কেন মিতালি!এই কাজের জন্যে তোমায় আমি কোনোদিন ক্ষমা করব না।কোনোদিন না!এই দুধের শিশুর কষ্টটা কি আল্লাহ দেখেনি?আল্লাহ কি বিচার করবে না তোমার মিতালি?কতদিন পালিয়ে থাকো আমিও দেখব।নুশান তোমায় কতদিন রাখে সেটা আমি দেখতে চাই মিতালি!আর আজকের কলেজে ঘটা প্রতিটা কানাঘুষা তোমার বিরুদ্ধে আমার মনে যে প্রবল ঘৃণার সৃষ্টি করেছে সেটা কাটানো প্রায় অসম্ভব। আই সোয়ের!তোমায় সামনে পেলে জাস্ট পুঁতে ফেলব!”
ওয়াশরুমের দরজা ধাক্কানোতে হুঁশ আসে শিশিরের। শাওয়ার অফ করে দরজা খুলতেই রাতকে দেখতে পায় সে। রাত তাড়াহুড়া করে বলতে লাগে,
-“দেখুন,আমি আপনার পারসোনাল মেটারে নাক গলাচ্ছি না কিন্তু একজন মানুষের এভাবে রাতে এতক্ষণ শাওয়ার নেয়া….”
বলতে বলতে মাথা উঁচু করে শিশিরের দিকে তাকাতেই চিৎকার করে পিছনে ঘুরে গেল রাত। শিশির কোমড়ে এক হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।আর বলছে,
-“হোয়াটস রং উইথ ইউ? ”
চলবে….
(ভুলক্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। একটা সুন্দর মন্তব্য উপহার দিয়েন☺️💌)