#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস (২)
#পর্ব_০৪
#মোহনা_হক
-‘ইনিমা আপু বড় বাবা ডাকছে তোমায়।’
রুয়াতের নিচু কন্ঠস্বরে ইনিমা তার দিকে তাকায়। মাত্র দু’দিন থেকেছে আজ ফিরে যেতে হবে হোস্টেলে। এই নিয়ে মন খারাপ সবার। চাইলে ও বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে থাকতে পারে না। হুটহাট করে আসতেও পারে না বাড়িতে। সামনেই এক্সাম সেজন্য আবার ফিরে যেতে হবে। উপায় নেই থাকার। ব্যাগ গোছানো বাদ দিয়ে রুয়াতের সাথে ফজলুল চৌধুরীর রুমে যায়। তিনি বসে আছেন। সঙ্গে মায়া চৌধুরী ও আছেন। ফজলুল চৌধুরী ইনিমার হাত ধরে তার পাশে এনে বসায়।
-‘আজ তো চলে যাবে। ব্যাগ গুছিয়েছো?
মাথা নাড়ায় ইনিমা।
-‘জ্বী বাবা।’
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সুন্দর করে। রুয়াত এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এরকম কোনো মুহুর্তে তার বাবার কথা মনে পড়ে। নিজেকে সংযত রাখতে পারছে না। খারাপ লাগছে ভীষণ। বড় নিঃশ্বাস টেনে কষ্টগুলো বির্সজন দেয়।
-‘তুমি চিন্তা করো না। পরীক্ষা শেষ হোক তোমার। আমিই তোমাকে নিয়ে আসবো।’
ছোট্ট করে উত্তর দেয় ইনিমা।
-‘আচ্ছা।’
-‘ইনিমা রেডি হয়ে থাকিস। আমি দুপুরে বাসায় আসবো। তখন হোস্টেলে দিয়ে যাবো তোকে।’
পাঞ্জাবীর হাতের উপরের অংশ গুটিয়ে রাখছে আয়াজ। রুয়াত একটু তাকিয়েই চলে আসে রুম থেকে। আয়াজ একবার পিছন ফিরে তাকায় রুয়াতের দিকে। আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ফজলুল চৌধুরী আর মায়া চৌধুরীর সাথে টুকটাক কথা বলে। অতঃপর বাবা ছেলে বেরিয়ে যায়।
(*)
-‘আবার কবে আসবে ইনিমা আপু?’
মনটা খারাপ হয়ে গেলো নিমির। ইনিমা থাকার কারণেই এতোদিন বকা থেকে বেঁচে গিয়েছে। নাহয় তার বাবা মাহের চৌধুরী প্রতি পদে পদে বকা দিতো। এখনো ঠিক করে কথা বলে না। জেবা ও কথা বলে না। ইনিমা থাকার কারণে একটু ভালো লেগেছিল নিমির। এখন চলে যাওয়াতে খারাপ লাগছে। ইনিমা হেসে দেয় নিমির কথায়।
-‘আবার আসবো পরীক্ষার পর। তুই আর রুয়াত এতো মন খারাপ করিস না তো। আমার কিন্তু এসব মোটেও ভালো লাগছে না।’
রূয়াত চুপ করে শুধু দেখে যাচ্ছে। অবশ্য তার ও মন খারাপ। কিন্তু এখন মন খারাপ করে তো আর ইনিমা কে আটকে রাখা যাবে না বা ধরে রাখা যাবে না। আবার তো আসবেই সে। এখন এতো মন খারাপ করেই বা কি হবে? নিমি অবুঝের মতো সব প্রকাশ করে না রুয়াত। তার অনুভূতি, খারাপ লাগা, ভালো লাগা সব তার নিজের কাছেই রাখে। তবে নিমির মন প্রচুর খারাপ। ইনিমা যাওয়ার পর পরই তাকে রিমান্ডে নেওয়া হবে।
-‘আরও দু’দিন থেকে গেলে ভালো হতো ইনিমা আপু। তোমার পরীক্ষার তো আরও পনেরো দিন বাকি আছে। আজ দাদাভাই আর দাদু আসবে। তুমি দেখা করে যাবে না?’
-‘তারা আসবে সন্ধ্যার পর। ভাইয়া বলেছে দুপুরে আমায় রেডি হয়ে থাকতে। এবার আর দেখা হবে না রে নিমি।’
রুয়াত একবার নিমির দিকে তাকায়। নিমি যে কতো বেশি কথা ঘুরাতে পারে হয়তো তাকে না দেখলে কখনো জানাই হতো না।
-‘আপু বলেছে না সে এখন থাকতে পারবে না তাহলে কেনো বার বার এক কথা নিয়ে পড়ে আছিস বল তো নিমি? তোর বিরক্ত লাগছে না এক কথা বার বার বলতে?’
নিমি হাঁ করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইনিমা থামিয়ে দিলো।
-‘হয়েছে হয়েছে। এতো কথা বলতে হবে না৷ আমি আবার আসবো এক্সামের পর, তখন ভরপুর আড্ডা দিবো আর দাদাভাই দাদুর সাথেও দেখা করবো। এখন তোরা দু’জন চুপ হয়ে যা।’
রুয়াত নিমি চুপ হয়ে বসে যায়। নিমি আড়চোখে রুয়াতের দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটার বিরক্তির কারণ অঢেল হলেও ভালো আছে। অন্তত তার মনের খারাপ কথাগুলো যে রুয়াত শুনে এটাই বেশি। নিমি একটু চেপে বসে রুয়াতের দিকে। ইনিমা মুচকি হাসছে। দু’জনের মন মালিন্য সারাদিন লেগেই থাকবে আবার একজন আরেকজনের সাথে কথা না বলে থাকতে পারবে না।
(*)
মোটামুটি আয়াজের কাজ এখন অনেকটাই কম। এমন দিন ও যায় যে কাজ থেকে বাড়িতে ফিরতে প্রায় অনেক রাত হয়ে যায়। আয়াজ তার দলের লোকদের সাথে কথা বলছে। তার চাপ দাড়ি গুলো তে হাত বুলাচ্ছে কথা বলার মাঝে। প্রিতমের দিকে বেশ নজরদারি রেখেছে। কালকের ঘটনার পর থেকে এক বিন্দুও বিশ্বাস নেই। কখন না আবার তার প্রেয়সী কে নিয়ে পড়ে। শুধু পরিস্থিতির কারণে চুপ হয়ে যাচ্ছে। আয়াজ তার ল্যাপটপ প্রিতমের দিকে ফিরিয়ে দেয়। প্রিতম একটু ঠিকঠাক হয়ে বসে। একবার তার স্যারের দিকে আবার ল্যাপটপের দিকে তাকায়।
-‘এখানে আজ মেয়র যাবেন। আমার ও যাওয়ার কথা ছিলো। আমি যেতে পারবো না আমার দলের থেকে তুমি আর সাহেদ যাবে।’
প্রিতম শুধু চেয়ে থাকে। সাহেদ আয়াজের বিশ্বস্ত লোক। কখনো আয়াজ তার কোনো কাজে তাকে পাঠায়নি। আজ হঠাৎ তার হয়ে যাওয়ার কথা বলছে এই নিয়ে প্রিতমের একটু অন্য রকম লাগছে। সহজে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও সৌজন্যবোধক হাসি দিয়ে বলে-
-‘আচ্ছা স্যার।’
এক দৃষ্টিতে আয়াজ প্রিতম কে দেখে যাচ্ছে। গম্ভীর সুরে বলে-
-‘কাজের কোনো হেলাফেলা করো না প্রিতম। তোমার জন্য ভালো হবে না।’
কালকের ঘটনা নিয়ে আয়াজ ভালো মতোই রেগে আছে এটা কথাবার্তায় বোঝা যায়। প্রিতম ভুলে ও আর নজর দিবে না সেখানে। মুখ বুজে মাথা নাড়ায়। সাহেদ আর প্রিতম মিলে রওনা হয় সে জায়গায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
(*)
ইনিমা দুপুরের খাবার খেয়ে রেডি হয়ে যায়। আয়াজ এখনো আসে নি। আসবে একটু পর হয়তো বা। লিভিং রুমে ক্রমাগত ইনিমা হেঁটে যাচ্ছে আর বারবার উঁকি দিচ্ছে। হঠাৎ গাড়ির শব্দ শুনে বুঝে যায় এখন আয়াজ এসেছে৷ সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। শুভ্র পাঞ্জাবী পরিহিত লোক হেঁটে এখানেই আসছেন। ইনিমা কে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়াজ ভ্রু কুচকায়। কিছুটা থেমে আবার হাঁটা শুরু করে। সদর দরজায় পৌঁছাতেই ইনিমা সরে দাঁড়ায়। আয়াজ নম্রস্বরে বলে-
-‘কি ব্যাপার এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিলি? খেয়েছিস দুপুরে?’
-‘খেয়েছিলাম তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি এতক্ষণ। এতো দেরি হয়েছে কেনো?’
মায়া চৌধুরী আয়াজের স্বর শুনে তাড়াতাড়ি করে নিচে আসেন। মেহরুবা ও পিছন পিছন আসে। নিমি তার রুমে। আর রুয়াত শাওয়ার নিতে ঢুকেছে সবেমাত্র। আয়াজ তার শরীর সোফায় হেলিয়ে দেয়।
-‘আমি খাবার দিচ্ছি খেতে আয় বাবা।’
-‘এখন দিও না। ইনিমা কে দিয়ে আসি তারপর এসে খাবো।’
মায়া চৌধুরী চিন্তিত স্বরে বলে-
-‘না না দেরি হয়ে যাবে তখন। কোনো কথা নয় আমি খাবার দিছি তুই খেতে আসবি। মেহরুবা তুমি আমার সাথে আসো তো।’
মায়া চৌধুরী মেহরুবা কে নিয়ে চলে যায়। ইনিমা অধর কামড়ে ধরে তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আয়াজ তো চোখ বুঝে মাথা হেলিয়ে দিয়েছে সোফায়। চোখ খুলতেই আয়াজ দেখলো ইনিমা কিছু না বলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ ভ্রু উঁচিয়ে বলে-
-‘কি? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?’
-‘তোমার খারাপ লাগছে? তাহলে যাওয়ার দরকার নেই। আমাকে গাড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দাও। আমি চলে যেতে পারবো। মাত্র এক ঘন্টার পথ।’
আয়াজ বিরক্তিকর শব্দ করে। ইনিমা কে ইশারা করে তার পাশে বসার জন্য। কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ইনিমা আয়াজের পাশে বসে।
-‘আমার মাথার চুলগুলো একটু টেনে দে। ভালো লাগছে না।’
ইনিমা আয়াজের চুলগুলো টেনে দিচ্ছে। নিমি লিভিং রুমে এসেই দেখে আয়াজ এসেছে আবার ভয়ে নিজের রুমে ফেরত চলে গিয়েছে। দেখা হলে কি না কি বলে আবার অপমান করে দেয়। মায়া চৌধুরী খাবার এনে দেয় আয়াজ কে। অল্প একটু খেয়েই আয়াজ উঠে যায়। এ নিয়ে কতো বকাঝকা মায়া চৌধুরীর। এবার ইনিমার বিদায়ের পালা। রুয়াত ঝটপট শাওয়ার নিয়ে নিচে আসে। চুলের পানি ও ঠিক মতো নেয়নি। নিমির গলা শুনে বের হয়ে আসে তাড়াতাড়ি করে। ইনিমা সবাই কে একটু আধটু জড়িয়ে ধরে। রুয়াত আর নিমি কে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরে বলে-
-‘সাবধানে চলা ফেরা করিস দু’জন। তোদের রেজাল্ট দিলে তো মা বলবেই তারপরও কল দিস আমায়।’
দুজন একসঙ্গে উত্তর দেয়।
-‘আচ্ছা আপু।’
আয়াজ অনেক্ক্ষণ যাবত রুয়াত কে দেখে যাচ্ছে। নিমির দিকে একবার তাকাতেই নিমি মাথা নিচু করে ফেলে। কিন্তু রুয়াত একবার ও তাকায়নি আয়াজের দিকে।
-‘হয়েছে তোমাদের? ইনিমা আয় আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
ইনিমা রুয়াত আর নিমির কানে একটা কথা বলে গাড়িতে উঠে যায়। মায়া চৌধুরী চোখের পানি মুছে নিচ্ছেন আঁচলে। পাশে থেকে জেবা আর মেহরুবা স্বান্তনা দিচ্ছে। যদিও মায়ের মন। পড়াশোনার জন্য বাহিরে যাচ্ছে তাও কষ্ট হচ্ছে ওনার। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও গিয়ে দেখা করতে পারেন না।
(*)
রুয়াত তার দাদাভাইয়ের পাশে বসে আছে। সবাই মিলে নাস্তা করছে আর আড্ডা দিচ্ছে। এখন যেনো বাড়িটার প্রাণ ফিরে এলো। রুয়াত, নিমি, আরহাম, রূহান আর তাদের দাদাভাই আর দাদু সবাই বসে বসে কথা বলছে। তারা গ্রাম থেকে এসেছে কিছুক্ষণ আগে। নাতি নাতনি সবাই ধরে বসে আছে। জেবা অনেক বার বলেছে এখন তাদের রেস্ট দরকার কিন্তু কথাটি কেউ শুনলোই না যেনো। ফজলুল চৌধুরী অফিস থেকে এসেই সর্বপ্রথম তার মা বাবার সঙ্গে দেখা করে। তারপর তিনি ফ্রেশ হতে চলে যান। রাত দশটা বাজতে চললো কিন্তু কারো কথা শেষ হলো না। আরহামের হাস্যকর কথাগুলো নিয়ে সবাই হাসছে। যতো সব অযুক্তিক কথা আরহামের। রুয়াতের দাদাভাই রাহীম চৌধুরী অনেক মজার মানুষ। সবার সাথে কথা বলতে পেরে ভালো লাগছে তার। রাত সাড়ে দশটায় আয়াজ বাসায় আসে। বাড়িতে হাসিঠাট্টার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পরক্ষণেই মনে হলো আজ তার দাদাভাই আর দাদু আসার কথা। আগে ফ্রেশ হবে। তারপর দেখা করতে যাবে। দুপুরে বাসায় আসার পর তখন আর ফ্রেশ হয় নি। আয়াজ নিজের রুম থেকে বের হয়ে সে রুমে যাওয়ার পর অগ্রসর হয়। সবার কথার মাঝে আয়াজ রাহীম চৌধুরী আর আয়েশা চৌধুরী কে সালাম দেয়। সাথে সাথে সবাই চুপ হয়ে যায়।
-‘কেমন আছো দাদুভাই?’
আয়েশা চৌধুরী মুচকি হেসে আয়াজ কে জিগ্যেস করে।
-‘আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?’
-‘এইতো আল্লাহ রেখেছে কোনো রকম। তা আমাকে আর তোমার দাদাভাই কে কি সুখবর দিবে না?’
আয়াজ হেসে বলে-
-‘কি সুখবর শুনতে চাও তোমরা?’
রাহীম চৌধুরী বলে উঠে
-‘বিয়ে করবে না নাকি? এসব ভুলে গিয়েছো?’
নিমি আর রুয়াত খুব মনোযোগ সহকারে শুনছে। আয়াজ ভাইয়ের বিয়ের কথা শুনলেই কেমন যেনো লাগে তাদের। আয়াজ তার চুলে হাত বুলায়। একবার প্রেয়সীর পানে চেয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।
-‘আরো কয়েক বছর পর।’
-‘দাদুভাই কয়েক বছর পর করবে তখন তো আমরা নাও থাকতে পারি।’
-‘আরে থাকবে থাকবে। চিন্তা করো না।’
রাহীম চৌধুরী একটু মশকরা করার জন্য বলে-
-‘আমার ডার্লিং তো ততদিনে বুড়ি হয়ে যাবে দাদুভাই।’
-‘তাতে সমস্যা নেই। ম্যাডাম আরেকটু বড় হোক। আমি নিজেই প্রস্তাব পাঠাবো তার বাড়িতে।’
আয়েশা চৌধুরী হেসে উঠে। রুয়াতের হাত নিমি চেপে ধরে আছে। ভিতর ভিতর খুব মজা পাচ্ছে তারা। তাৎক্ষনিত রুয়াত চোখ নামিয়ে ফেলে। দৃষ্টি তার নখের দিকে।
-‘তোমার জায়গা যদি অন্য কেউ নিয়ে নেয় বা চলে আসে তখন কি করবে?’
আয়াজ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। রুয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে-
-‘সে সুযোগ কাউকে দেওয়া হবে না দাদু।’
#চলবে….