হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস (২) #অন্তিমপর্বের_শেষাংশ #মোহনা_হক

0
753

#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস (২)
#অন্তিমপর্বের_শেষাংশ
#মোহনা_হক

ঠান্ডা কনকনে একটি রাত। শীতের রাতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ডুবে আছে চৌধুরী পরিবার। কেউ কেউ তো খুশিতে আত্মহারা আর কারো মনে বিষাদে ছেয়ে গিয়েছে। মন খারাপ নিয়েও ফজলুল চৌধুরী, মাহের চৌধুরী আর আয়াজের বক্তব্যগুলো ক্রমাগত শুনে যাচ্ছে। নেই কোনো সম্পর্ক তবু মন কেনো বারবার অহেতুক কথা ভাবছে? এটার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না নিমি। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রুয়াত। জেবা, মেহরুবা সবাইকে চা দিয়ে এক কোণায় দাঁড়ায়। মায়া চৌধুরীর শরীরটা বেশি সুস্থ না থাকায় আসতে পারেননি এখানে। আয়াজ স্বাভাবিক স্বরে বললো,

-‘নিমির যদি কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে কাল সে পাত্রপক্ষের সামনে যাবে। আমরা এখনই কিছু ঠিক করিনি। সব দেখেশুনে তারপর ঠিক করা হবে। নিমির সামনে যেতে তো কোনো সমস্যা নেই?’

কথা বলার মাঝে আয়াজ একবার রুয়াতের দিকে তাকায়। তার প্রেয়সী ভীষণ রাগ করে আছে। এটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নিমি হাত কচলাতে শুরু করে। মাহের চৌধুরীর ভয়ে কিছু বলছে না কিংবা সাহস পাচ্ছে না। তার যে এখন বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। তবে এ কথা বলার মতোও সাহস নেই তার। জেবা একটু স্বর উঁচিয়ে বললো,

-‘নিমি সামনে যাবে। ওর কোনো আপত্তি নেই।’

অসহায় দৃষ্টিতে নিমি তার মায়ের দিকে তাকায়। তার যে আর কিছু বলার নেই। প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে অথচ এখনো নিজের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাটুকু হয়নি। মাহের চৌধুরী আরও কিছু কথা বলে চলে গেলেন। এক এক করে সবাই যে যার মতো মতামত দিয়ে চলে গেলো। রুয়াত নিমির কাঁধে হাত দিয়ে বললো,

-‘চিন্তা করিস না। আমি ওনাকে বুঝিয়ে বলবো। আর এখন তো কিছু ঠিক হয়ে যাচ্ছে না তাইনা! রাত হয়েছে অনেক শুয়ে পড়। কালকেরটা কাল দেখা যাবে।’

নিমি মাথা নেড়ে চলে যায়। তার এসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না। যেখানে তার কথার কোনো মূল্য নেই সেখানে কথা বলে কোনো লাভ আছে কি? শীতের রাতে সবাই আগে আগেই খেয়ে ফেলেছে। তাই বেশিক্ষণ কাউকে অপেক্ষা করতে হয়নি। খাওয়ার পর আলোচনা করছিলো সবাই। আলোচনা শেষে সবাই এক এক করে রুমে চলে গিয়েছে। তবে আয়াজের উপর অভিমান করে রুয়াত রুমে যায়নি। প্রথমত নিমির ব্যাপারে আয়াজের এরূপ বক্তব্য। দ্বিতীয়ত কোনো একটা ঝামেলা নিয়ে রুয়াতের এতো অভিমান। সময় স্বল্পতার জন্য আয়াজ সে অভিমান ভাঙাতে পারেনি। রূহান আর রুয়াত একই কম্বলের নিচে শুয়ে রাজ্যের আলাপ আলোচনা জুড়ে দিয়েছে। কয়েক বছরের ব্যবধানে অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে রূহান। যথেষ্ট জ্ঞান বুদ্ধি হয়েছে এখন।

অনেক্ক্ষণ যাবত অপেক্ষা করার পর ও রুয়াত রুমে আসছে না দেখে এবার আয়াজ প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে রুম থেকে বের হলো। প্রতিদিন এই এক কাহিনী ভালো লাগছে না আর। মেয়েটা বড় হয়েছে অথচ এখনো পাগলামো কমেনি। গায়ে চাঁদর পেচিয়ে আয়াজ বের হয় রুম থেকে। রূহানের রুম থেকে রুয়াত গলার স্বর আসছে দেখে সেদিকটায় পা বাড়ায়। তার ধারণা ভুল হয়নি রুয়াত রূহানের সাথে হাসছে কথা নিয়ে। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে আয়াজ বললো,

-‘রুয়াত মাথা ব্যাথা করছে ভীষণ, এক কাপ কফি বানিয়ে দিবে?’

শত রাগ অভিমান করার পর ও এই সামান্য নরম স্বরের কথা শুনে রুয়াতের বক্ষ বিভাজন কেঁপে ওঠলো। কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে আয়াজ কে। রুয়াতের মায়া হলো। সে আর এক মিনিট ও শুয়ে থাকতে পারলো না। হুড়োহুড়ি করে ওঠে পড়লো। গায়ে থাকা চাঁদর ভালো করে টেনে নিলো। কোনো রকম কথা না বলেই বের হয়ে গেলো রুম থেকে। সে মুলত কফি বানাতে যাবে এখন। লোকটার উপর যতো অভিমান করে থাকুক এমন আবদার ফেলার মতো ক্ষমতা নেই তার।আয়াজ মুচকি হেসে রুমের লাইট বন্ধ করে বললো,

-‘আমার একমাত্র শালাবাবু এখন তোমার ঘুমানোর সময়। ঘুমিয়ে যাও। বেশি রাত জেগো না বুঝেছো?’

বলেই আয়াজ উচ্চস্বরে হেসে বের হয়ে আসে। রূহান বোকাবোকা ভাব নিয়ে চেয়ে আছে। হুটহাট এমন কথা তার বোধগম্য হলো না। সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার কারণে পুরো বাড়ি অন্ধকার হয়ে আছে। তবে রুয়াত যে সোজা হেঁটে রান্নাঘরের দিকেই যাচ্ছে এটা আয়াজ ভালোই টের পাচ্ছে। দ্রুত পায়ে সামনে এগিয়ে আয়াজ রুয়াতের হাত ধরে ফেলে। কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কোলে করে রুমে নিয়ে আসে। রুমে এসেই রুয়াত কে নামিয়ে দেয় কোল থেকে।

কিছুটা রাগ করে রুয়াত বললো,
-‘আমায় কোলে নিয়েছেন কেনো? বাচ্চা মনেহয়? আর আপনি না বলেছেন কফি খাবেন? তাহলে রুমে নিয়ে এসেছেন কেনো?’

আয়াজ তার গায়ে থাকা চাঁদর বিছানার উপর রাখে। সরু চোখে রুয়াতের দিকে তাকায়।

-‘কোলে নিয়েছি তোমাকে রুমে নিয়ে আসার জন্য। ঘড়ি দেখেছো কয়টা বাজে? আসছিলে না কেনো রুমে?’

ঘাবড়ে যায় রুয়াত। আয়াজ রাগ দেখাচ্ছে তার সাথে। নিজেকে সামলে রুয়াত বললো,

-‘রাগ দেখাবেন না। আমার রুমে না আসার কারণ আপনার অজানা নয়।’

স্বাভাবিক স্বরে আয়াজ বললো,
-‘সেসব বাদ দাও। এখন তাড়াতাড়ি আমায় জড়িয়ে ধরো। ঠান্ডা লাগছে ভীষণ।’

-‘সরুন। আমি রূহানের কাছে যাবো। আপনার সাথে থাকার কোনো মানে হয় না। আপনি তো শুধু নিজের স্বার্থ বুঝেন। যাকে সহজসরল বাংলা ভাষায় বলে স্বার্থপর।’

আয়াজ হেসে দেয় রুয়াতের এমন কথা শুনে। কি কারণে রুয়াত এমন রাগ ঝাড়ছে এটাও বুঝে গিয়েছে। মেয়েটা রুম থেকে বের হওয়ার আগে পেছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। কাঁধে মাথা রেখে বললো,

-‘তুমি জানো না তোমার উপরে আমার অধিকার বেশি? রাগ করা ভালো। তবে সেটা সব সময়ের জন্য না। কিছু কিছু সময়ে রাগ করার আগে অবশ্যই বুঝে শুনে করতে হবে। আমি দেখেই তো তুমি সারাদিন রাগ করতে পারো। অন্যকেউ হলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতো। বুঝেছো আমার প্রেয়সী?’

পুরো কথাটি শুনে রুয়াত পেছন ফিরে আয়াজের দিকে তাকায়।

-‘আমার রাগ করাটা অস্বাভাবিক নয় কি?’

-‘সেটা একবারও বলিনি। সারাদিন আমার প্রেয়সীকে সময় দিতে পারি না। সে তার মতো একা একা দিন কাটায়। ইভেন কল দিয়েও খোঁজ নিতে পারিনা। এই ব্যাপারে যদি রাগ করো তাহলে খুব বড় করে একটা সরি। তুমি তো জানো সবটা। আর জেনে রাগ করছো প্রেয়সী? এতো অবিচার করছো আমার উপর?’

রুয়াত শেষের কথা শুনে খানিকটা হেসে দেয়। একে তো আয়াজ ঝাপটে ধরে আছে। আবার এসব বলছে। এখন তো মনেহচ্ছে আয়াজ অবিচার করছে রুয়াতের উপর। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য রুয়াত বললো,

-‘হয়েছে এবার তো ছাড়ুন আমায়। রাত অনেক হয়েছে ঘুমোতে হবে।’

-‘আমাকে দেখলে তোমার ঘুম আসে? কিন্তু আমার তোমাকে দেখলে বড্ড ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।’

আয়াজ রুয়াতের থেকে সরে আসে। চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। রুয়াত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে দেখে যাচ্ছে সবটা।

-‘তাড়াতাড়ি বুকে আসো রুয়াত। ভীষণ শীত করছে। আর শীতের রাতে একা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। অবশ্যই বরকে জড়িয়ে ধরে একটা দূর্দান্ত ঘুম দেওয়া উচিৎ।’

রুয়াত হকচকিয়ে যায়। মূহুর্তের মধ্যেই আবার ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। এসব কথা আয়াজ আজ আর কাল বলেনি। সে চার বছর ধরে রুয়াত এসব শুনে আসছে। আজকাল এসব কথা বলতে আয়াজের মোটেও খারাপ লাগে না। অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। রুয়াত কোনো কথা না বলেই শুয়ে পড়ে। আয়াজ রুয়াত কে টেনে তার বক্ষে জড়িয়ে ধরে। রুয়াতের গালের দু’পাশে হাত রেখে অধরজোড়ায় চুমু খায়। কয়েক মিনিট বাদেই আবার ছেড়ে দেয়। রুয়াত বালিশে মুখ চেপে মিনমিন করে বলে,

-‘বুড়ো হয়েছে তাও তার এসব পাগলামো কমেনি।’

দূর্ভাগ্যবশত আয়াজ কথাটি শুনে। শুয়ে থাকা অবস্থায় নিজের টি-শার্ট টেনে ঠিক করে। অতঃপর বেশ গর্ব করে বলে,

-‘এক কথা বারবার শুনতে ভালো লাগে না প্রেয়সী। পরেরবার থেকে নতুন কিছু বলার চেষ্টা করবে। আর আমি যে বুড়ো হয়ে যাইনি এটা তুমি প্রতিরাতেই টের পাও। তবুও একই কথা বারবার বলে কেনো শক্তি খরচ করো বলো তো?’

-‘নির্লজ্জ।’

-‘শুধু তোমার জন্য প্রেয়সী।’

আয়াজ এটা বলে নিজেই হেসে দেয়। লজ্জায় রুয়াত আর সেদিক ফিরতে পারেনি। কোনো একটা কথা বললেই এভাবে লজ্জা পেতে হয় প্রতিনিয়ত। মুখ বালিশ চেপে অন্যদিকে মুখ রেখে ঘুমায় রুয়াত। পেছন থেকে আয়াজ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। এবার তার শান্তি শান্তি অনুভব হচ্ছে। ফের আয়াজ আবারও বললো,

-‘বউ মানেই শান্তি।’

(*)

আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ইনিমা। হাঁটা চলায় ভীষণ কষ্ট হয় আজকাল। বাসায় শুধু সায়হান আর ইনিমা একাই থাকে। সায়হানের বাবা মারা গিয়েছেন বছর খানেক আগে। এখন ইনিমার দেখভাল করার জন্য শুধু সায়হান আছে। আর অন্য কোনো বাহিরের মানুষ কে বাড়িতে ঢোকার অনুমতি দেয়নি সায়হান। সারাদিন অফিস করার পর টুকটাক হেল্প করে ইনিমা কে। মাঝেমধ্যে চৌধুরী বাড়ি থেকে কেউ কেউ এসে থেকে যায় ইনিমার কাছে। আজ নিমি কে দেখতে আসবে শুনেও বাবার বাড়িতে যেতে পারেনি ইনিমা। একটাই সমস্যা তার শারীরিক অবস্থা বেশি একটা ভালো না। সকালে ঘুম থেকে উঠে ইনিমা সায়হান কে দেখলো না। আজ শুক্রবার তাই আজ আর অফিস যাবে না সে। রান্নাঘর থেকে টুকটাক আওয়াজ আসছে। ইনিমা বুঝে গিয়েছে সায়হান সকালের নাস্তা বানাচ্ছে। আস্তেধীরে বিছানা ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। তার ধারণা ভুল হয়নি সায়হান পরোটা ভেজে তুলে রাখছে অন্য পাত্রে।

সায়হানের পিঠে হাত রেখে দূর্বল স্বরে ইনিমা বললো,
-‘তুমি এতো কষ্ট করতে গিয়েছো কেনো? আমি তো করতে পারতাম। তুমি সরো আমি করছি।’

-‘আমি কষ্ট করছি যেনো আমার বাবুর আম্মুর কষ্ট না হয়। তুমি বিশ্রাম করো। এদিকটা আমি সামলে নিতে পারবো মিসেস বিউটিফুল।’

-‘যেটুকু করেছো এখন এটা রাখো।’

ফ্রাই ফেনে পরোটা দিয়ে সায়হান হাসিমুখে পিছন ফিরে।
-‘উফ আমার মিসেস বিউটিফুল একটু বেশি বেশিই করছে। বলেছি না তোমাকে বিশ্রাম করতে? তুমি গিয়ে বসো সোফায়।’

ইনিমা সায়হানের পিঠে মাথা রাখে।
-‘ভালো লাগছে না সায়হান।’

-‘আজ তোমার বাড়িতে যেতে পারছো না বলে মন খারাপ তাইনা? মন খারাপ করো না। আমার বাচ্চাটা একবার পৃথিবীতে আসলে তুমি সে বাড়িতে সারাক্ষণ আসা যাওয়া করো আমি কিচ্ছুটি বলবো না। আমি এই কাজটা শেষ করেই আসছি তুমি গিয়ে বসো। তারপর একদম মন ভালো করে দিবো।’

সায়হান কাজের ফাঁকেও টুপ করে চুমু খায় ইনিমার গালে। বউকে একটু হাসিখুশি আর ভালো রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইনিমা হেসে মাথা দুলিয়ে চলে আসে সেখান থেকে।

(*)

গাঢ় খয়েরী রঙের শাড়ি রুয়াত নিমি কে পড়িয়েছে অনেক যুদ্ধ করে। মা বাবার সামনে একদম ভদ্র সুশীল মেয়ে অথচ রাগ দেখায় রুয়াতের সাথে। মেহরুবা একটা শাড়ি দিয়ে গিয়েছিলো নিমি পড়ানোর জন্য। সেটাই এক প্রকার যুদ্ধ করে নিমি কে পড়িয়েছে। মোটামুটি হালকা করে সাজিয়েও দিয়েছে তাকে। পাত্রপক্ষের লোকেরা চলে এসেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই। আয়াজ রুয়াত কে ডেকে নিয়ে যায়। তার ফোন খুঁজে পাচ্ছে না বলে। এসব ব্যাপার খুব বিরক্ত লাগে রুয়াতের। বিয়ে হওয়ার পর থেকে আয়াজ বড্ড ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে। আগে সে মোটেও এমনটি করতো না। বরং নিজের দরকারী জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে দিতো।

-‘আপনি ফোন খুঁজে পাননি এটা আমি কিভাবে খুঁজে দিবো বলুন? কতক্ষণ থেকে ডাকাডাকি শুরু করেছেন। সবাই শুনলে কি বলবে?’

-‘আমি তোমাকে রুয়াত নামে ডেকেছি। বউ, প্রেয়সী, জান, ভালোবাসা এসব বলে একবারও ডেকেছি বলো? অযথা এগুলো বলো না। ফোন খুঁজে দাও আমার।’

অনেক খোঁজাখুঁজির পর রুয়াত আয়াজের ফোন খুঁজে পেলো। দ্রুত তার হাতে ফোন দিয়ে বললো,

-‘শুনুন একটা মেয়ের নিজের জীবন নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। কেউ কেউ প্রকাশ করে তো কেউ আবার করে না। নিমির যদি এই ছেলে কে পছন্দ না হয় আপনি কিন্তু একদম ভুলেও আর জড়াবেন না এসবে। সাথে সাথে মানা করে দিবেন। আর যদি আপনি জোরপূর্বক কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিন তাহলে আপনাকে এবার সত্যি সত্যিই স্বার্থপর বলবো। ভুলে যাবেন না আপনার জন্য সে তার ভালোবাসা কে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আপনি তো ভালোবেসেই বিয়েটা করেছেন তাইনা! তাহলে কেনো অন্যের বেলায় এমন করেছেন এমপি সাহেব? শেষ অনুরোধ রাখছি এই ব্যাপারে আপনি কোনো কথা বলবেন না। ওর বিষয়ে কথা বলার জন্য এখন ওর বাবা মা রয়েছে।’

এক দমে রুয়াত কথাগুলো শেষ করে। আয়াজ ভাবলেশহীন হয়ে রুয়াতের দিকে তাকায়। এমন ভাব করছে কথাটি যেনো আয়াজ শুনেনি। রুয়াতের হাত ধরে আয়াজ বললো,

-‘নিচে চলো এমপি সাহেবের বউ। তোমার আর নিমির জন্য বড়সড় ধামাকা অপেক্ষা করছে।’

রুয়াত প্রথমে বুঝেনি। আয়াজ কি বোঝাতে চেয়েছে। আয়াজের কথাটি এতো বেশি গুরুত্ব দিলো না। চুপচাপ পা মিলিয়ে হাঁটা শুরু করলো। বড় করে মাথায় ঘোমটা টেনে নেয়। নিচে নামতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। একদম অপ্রস্তুত একটা ঘটনা। যার জন্য রুয়াত অন্তত মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। এমনকি ভাবতেও পারেনি এমন কিছু যে হবে। শাফী গুটিশুটি মেরে বসে আছে। তার দু পাশে দু’জন মহিলা আর দু’জন পুরুষ। এদেরকে রুয়াত ভালো করেই চেনে। শাফীর মা বাবা আর তার ভাই বোন। কিন্তু এরা এখানে কি করছে? তাহলে কি এরাই পাত্রপক্ষের লোকজন ছিলো? রুয়াত সবাই কে সালাম দেয়। পরক্ষণেই অবাক হয়ে আয়াজের দিকে তাকায়। আয়াজ কিছু না বোঝায় মতো ভান ধরেছে। রুয়াত সবচেয়ে বেশি অবাক হয় মাহের চৌধুরী আর ফজলুল চৌধুরী কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে তাদের সাথে। আয়াজ ও তার ব্যতিক্রম কিছু করছে না। সবার সাথে খুব সুন্দর করে কথা বলে চলেছে। একে একে মায়া চৌধুরী, জেবা আর মেহরুবা এসে দেখা করে। সব শুনে রুয়াত বুঝেছে শাফীর বাড়ির লোকজন নিমি কে দেখতে এসেছে। কার অনুভূতি কি রকম সেটা রুয়াত জানে না। তবে মন থেকে সে সত্যিই খুব খুশি হয়েছে। আর এই ধামাকার কথাই আয়াজ বলেছিলো। এবার বুঝেছে রুয়াত। আয়াজ তাহলে রুয়াতের কথা ফেলে দেয়নি। আবার ফজলুল চৌধুরী আর মাহের চৌধুরীর কান্ডেও বেশ অবাক হয়। মানে সবাই সবটা মেনে নিয়েছে? খুশিতে আত্মহারা রুয়াত। বারবার আড়চোখে আয়াজের হাস্যজ্জ্বল চেহেরাটি দেখে যাচ্ছে।

.

বারংবার চোখ বেয়ে পানি উপচে পড়ছে নিমির। এতোদিন পর শাফী কে দেখে মনের মধ্যিখানে এক প্রকার ঝড়ের সৃষ্টি হয়। নিমি আর শাফী কে আলাদা কথা বলার জন্য পাঠানো হয়েছে একটা রুমে। নিমি তো কথা বলছে না উল্টো অনেক্ক্ষণ যাবত কেঁদে চলছে। তার এতদিন গোপনে রাখা শাফীর জন্য ভালোবাসা, মায়া যেনো একটু একটু করে প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। টিস্যু দিয়ে নিমি চোখের পানি ক্রমশ মুছে নিচ্ছে। শাফী হাত কচলাতে শুরু করে। সে জানে আজকের নিমির এই কান্নার পেছনে সেও দায়ী। তবে মেয়েটা কে বোঝাতে পারছে না সবটা। এক মুহুর্তে সব সংকোচ বোধ কাঁটিয়ে শাফী বলে উঠে,

-‘আমি কি চলে যাবো এখান থেকে?’

নিশ্চুপ নিমি। ফের শাফী আবারও বললো,
-‘তুমি রাজি না হলে এই সম্মন্ধ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানে হয় না নিমি। কান্না থামাও। আর আমাকে অনুমতি দাও কিছু বলার। আমার সত্যিই তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে।’

বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ে নিমি। একটু দূরত্ব বজায় রেখে বসে। তার কান্না থেমে যায়। যা দেখে শাফীর মন আহত হয়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিমি বললো,

-‘বলো কি বলবে।’

শাফী ঢোক গিলে। অতঃপর বলা শুরু করে,
-‘যখন আয়াজ ভাই আমার সাথে দেখা করা নিয়ে তোমাকে আর রুয়াত কে মেরেছিলো তখন তোমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার পর আয়াজ ভাই আমাকে দেখা করতে বলেছিলো পরেরদিন। আমিও দেখা করি ওনার সাথে। ওনি আমাকে একদম সরাসরি বলে দিয়েছিলো যাতে আমি তোমার সাথে কোনো রকম যোগাযোগ না করি। আমি একদম চুপিসারে ভাইয়ের কথাগুলো শুনে গিয়েছিলাম। আমিও তখন ওনার সামনে বলেছিলাম তোমাকে আমি ভালোবাসি না। কথাটি বলার একমাত্র কারণ ছিলো আমি শুধু তোমার ভালো চাই। আর সেজন্য কথাটি বলতে বাধ্য হয়েছি। আয়াজ ভাইয়ের সামনে বলেছিলাম তোমার থেকে আমি দূরে চলে আসবো। তোমার অজান্তেই হবে সেটা। ঠিক তাই করেছিলাম যাতে কেউ অন্তত আমার কারণে তোমাকে খারাপ না বলে। সবার সামনে আয়াজ ভাই থাপ্পড় মেরেছিলো তোমাকে আর রুয়াত কে। চেয়েও কিছু বলতে পারিনি। এরপর শত কষ্ট হওয়ার পর ও তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছিলাম। জানো তখন আমি চারপাশে অস্থিরতা, অন্ধকার বলতে আর কিছুই দেখিনি। তুমি ও আমার মতো ঠিক এভাবে কষ্ট পেয়েছো জানি আমি সেটা। কষ্ট পাওয়াটা আমাদের কপালে ছিলো। আমরা দু’জন পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে মুখ বুজে সবটা সহ্য করেছিলাম। হঠাৎ একদিন আয়াজ ভাই আবারও আমাকে ডেকে পাঠায়। আমিও দেখা করতে যাই। তারপর ওনি আমাকে সবটা বুঝিয়ে বলেন। ওনার কথায় সম্পূর্ণ যুক্তি ছিলো। আমরা সমবয়সী। তোমার বয়স যা আমারও ঠিক তাই। তখন সবেমাত্র এইচএসসি দিয়েছি। আমার ইনকাম করার কোনো সোর্স ছিলো না। আর সে বয়সে কোনো ভালো চাকরিও পাওয়া যায় না। তোমার সাথে তখন আমার বিয়ে হলে কে আমাদের সংসার চালাতেন? আমার বাবা ভাই? এসব কথা আয়াজ ভাই আমাকে বুঝিয়েছেন। আমি তখনই সবটা বুঝি। ওনি বলেছিলেন এমন ভাবে নিজেকে তৈরী করতে যাতে তোমাদের পরিবার কখনো না বলে। আর তোমার জন্য আমিই ঠিক ছিলাম। আয়াজ ভাই নিজে ঠিক করেছে। তবে তোমাকে জানাতে মানা করেছিলো। আমিও ওনার কথা মেনে চলেছি। তাই আজ এখান পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আয়াজ ভাই কাল কল দিয়ে বললো আমার বাবা মা ভাই বোন নিয়ে তোমাকে দেখতে আসার জন্য। সবাই কে বলার পর তারা একদম রাজি হয়ে যায়। আর আজ যে আমরা আসবো এটা এক প্রকার উপহার হিসেবে রাখা হয়েছে তোমার জন্য। তোমার বাবা মা সবাই রাজি। এখন যতটুকু সামর্থ্য আছে তা দিয়ে অন্তত তোমাকে কারো ভরসায় চলতে হবে না। তুমি একজন দায়িত্ববান পুরুষের যোগ্য বউ হবে। দিনশেষে আমিও চিৎকার করে বলতে পারবো আমিই সে পুরুষ যে কিনা প্রেমিকার জন্য আজ প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছি।’

এবার সম্পূর্ণ কথাটি পরিষ্কার হয়ে গেলো নিমির কাছে। আয়াজের উপর তার আর কোনো চাপা অভিমান নেই। সে তো ভালোর জন্য নিমি আর শাফী কে আলাদা করেছিলো। নাহলে কি তারা দু’জন দু’জনের মর্ম বুঝতো? আর তাদের শেষ পরিণতি কি এতো বেশি সুন্দর হতো? নিজের সব রাগ অভিমান ঝেড়ে নিমি শাফীর হাতে মাথা রেখে কেঁদে দেয়। এতো এতো সুখের মাঝেও তার ভীষণভাবে কান্না পাচ্ছে। তবে এ কান্নায় নেই কোনো দুঃখ। আছে শুধু একরাশ সুখ আর সুখ।

-‘তোমাকে আবারও পাবো ভাবিনি। ঠিক এভাবে পেয়ে যাবো কখনো কল্পনা করিনি। সে মুহূর্তে মনে হয়েছিলো সব বোধহয় শেষ এখানেই। শেষ থেকে আবার শুরু হয়েছে এখন।’

শাফী অধর মেলে হাসে। নিমির হাতে অধর ছুঁয়ে দেয়।
-‘এবার বলো বিয়ে করবে তো আমায়? নাহলে কিন্তু তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলবো শ্বশুড় শ্বাশুড়ির অনুমতি নিয়ে।’

নিমি দু দুবার মাথা ঝাকায়। তার অদ্ভুত রকমের শান্তি লাগছে। নতুন করে যে আবার ভালোবাসা ফিরে পাবে এটা একবারের জন্যও ভাবেনি। তৃপ্তিমূলক হেসে নিমি বললো,

-‘ভালোবাসি শাফী। খুব বেশি ভালোবাসি।’

-‘আমি তোমার প্রাক্তন হয়ে নয়। ভবিষ্যৎ হয়ে থাকতে চাই নিমি। অনেক বেশি ভালোবাসি তোমায়।’

পারিবারিক ভাবে আলাপ আলোচনা করে নিমি আর শাফীর বিয়ে ঠিক করা হয়। মুলত এখন আকদ করে রাখা হবে। বিয়েটা তাদের অনার্স শেষ হলে তবেই হবে। মাহের চৌধুরী ভীষণ খুশি হয়। বাড়ির প্রত্যেকটি সদস্য ও খুশি হয় এমন সংবাদে। অতঃপর নিমি আর শাফীর ভালোবাসা পূর্ণতা পায়। সব শেষে নিমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আয়াজের প্রতি।

(*)

ব্যালকনিতে আয়াজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে কারো সাথে ফোনে। পুরো রুম অন্ধকার করে রেখেছে। রুয়াত ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। আস্তেধীরে পা ফেলে পেছন থেকে আয়াজ কে জড়িয়ে ধরে। চারপাশে ঠান্ডা বাতাস বইছে। আর এইদিকে প্রেয়সী এভাবে জড়িয়ে ধরেছে। কথা বলার মাঝেও আয়াজ মুচকি হাসে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর কলটা কেটে রুয়াত টেনে সামনে আনে। ভ্রু কুচকে তাকায় তার দিকে।

-‘স্বার্থপর বলবে না?’

কোনো কথা না বলে রুয়াত আয়াজ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

-‘বলবো না। কারণ আপনি সেরকম কোনো কাজ করেননি।’

-‘এতো রূপ নারীর? আমি বলেছিলাম নারী ভয়ংকর প্রেয়সী। আজ মিলে গেলো।’

রুয়াত মাথা তুলে আয়াজের দিকে তাকায়। দাঁড়িভর্তি দু’গাল চেপে ধরে। পা উঁচু করে আয়াজের মাথাটা একটু নিচে এনে ক্রমশ অধর ছুঁয়ে দেয় কপালে। বেশ কয়েক মিনিট পার হয়ে গিয়েছে তাও রুয়াত ছাড়ছে না। আর আয়াজ ও একইভাবেই আছে।

-‘এরকম ভালোবাসার কারণ কি প্রেয়সী? নিমি আর শাফী কে মিলিয়ে দিলাম সেজন্যে?’

-‘নাহ্ এমপি সাহেব। এটা আপনার প্রাপ্য।’

-‘তা শুনতে চাইবে না কিভাবে ওদের মিল হলো?’

-‘উহু।’

-‘এখন আমি ভালোবাসলে কিন্তু তা সহ্য করতে পারবে না রুয়াত। ছাড়ো আমায়। বেসামাল হয়ে পড়েছি অলরেডি।’

রুয়াতের থেকে আয়াজ নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। মেয়েটার দু হাত আবদ্ধ করে তার এক হাত দ্বারা। আরেক হাত কোমড়ের পাশে রাখে।

-‘বলেছিলাম ছেড়ে দিতে ছাড়োনি। এবার প্রস্তুত হও আমার ভালোবাসার জন্য।’

মুহুর্তের মধ্যেই আয়াজ রুয়াতের অধর জোড়ায় তার অধর ছুঁয়ে দেয়। রুয়াত আঁকড়ে ধরে আয়াজের কাঁধের পাশের অংশ। গভীর চুম্বনে কেঁপে ওঠে সমস্ত শিরা উপশিরা। তৈরী হয় এক অদৃশ্য অনুভূতি। যা শুধু অনুভব করা যায়। মিনিট কয়েক বাদে আয়াজ রুয়াত কে ছেড়ে নরম স্বরে বললো,

❝ আমার এই #হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস।❞

#সমাপ্ত

[আসসালামু আলাইকুম। সবশেষে আমি আপনাদের সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমি পারিনি এই সিজনটা ভালো করে লিখতে। যদিও কথা দিয়েছিলাম ভালো করে লিখবো। তবে আমি ব্যর্থ। স্যাড এন্ডিং দেওয়াতে আপনাদের মন খারাপ হয়েছিলো তাই এটা হ্যাপি এন্ডিং দিয়েছি। কোনো কথা না রাখতে পারলেও এটা রেখেছি। অনেকেই চেয়েছিলেন যাতে গল্পটা আমি বড় করি। কিছু কারণে এখানেই ইতি টানতে হলো। কেউ রাগ রাখবেন না আমার উপর। শেষের দিক দিয়ে বড্ড খাপছাড়া লাগতে পারে তার জন্য আমি ভীষণ ভাবে দুঃখিত। গল্পটা তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য এমনটা করেছি। আবারও বলছি আমি ক্ষমাপ্রার্থী আপনাদের কাছে। বরাবরের মতো আমার ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। এই ক্ষুদ্র লেখিকার ভুলগুলো ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ হাফেজ সবাইকে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here