হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস (২) #পর্ব_১০

0
299

#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস (২)
#পর্ব_১০
#মোহনা_হক

রুয়াত অস্ফুট স্বরে ‘বিশেষ কেউ’। আয়াজ অধর কামড়ে চারপাশটায় তাকায়। রাগের কারণে সত্যি কথা বের হয়ে এসেছে। এবার রুয়াত কিছু জিগ্যেস করলে কি উত্তর দিবে? কথা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আয়াজ বলে-

-‘নিচে চলো। এতো রাতে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না।’

সহসা রুয়াত বলে উঠে,
-‘বিশেষ কেউ কথাটি ক্লিয়ার করুন আগে। আমি শুনতে চাই।’

দু’হাত বুকে গুঁজে আয়াজ। ছাদের রেলিং এ শরীর হেলিয়ে দেয়। এই মেয়ে কে এখন অন্য কিছু বলে বুঝ দিতে হবে, নাহলে কি থেকে কি ভেবে বসবে কে জানে! ভ্রু উঁচিয়ে বলে-

-‘কি শুনতে চাও? বিশেষ কেউ কথাটির মানে? এটা নিয়ে এতো গভীর চিন্তা-ভাবনা কেনো তোমার? কে বলেছে এভাবে ভাবতে? তুমি, এই পরিবারের প্রতিটি মানুষই আমার বিশেষ কেউ। তো এখন বলো তুমি কি ভেবেছিলে?’

রুয়াত থতমত খেয়ে যায়। আয়াজের মুখ থেকে এই কথাটি একদম বিস্ময়কর ছিলো। মানে এই দু’টি শব্দের মানে এটাই শুধু? রুয়াত চুপ হয়ে যায়। দ্রুত নিঃশ্বাস ছাড়ে। রুয়াতের অগোচরে আয়াজ মুচকি মুচকি হাসে। তাহার প্রেয়সীর দৃষ্টি অন্যদিকে। আজ যদি মুখ থেকে সেরকম কিছু বের হয়ে যেতো তাহলে কি হতো?

-‘তুমি কি ভেবেছিলে আমি বিশেষ কেউ বলতে অন্য কিছু বুঝিয়েছিলাম? মেয়ের মানুষের কাজ কারবার। শুনো এখন যে আমি তোমার সাথে দাঁড়িয়ে আছি বা তুমি আমায় এতো রাতে ডেকে এনেছো কথা বলার জন্য ছাদে, আমার ম্যাডাম জানলে কি বলবে? বলবে তার হবু বরের বোনগুলো কতো খারাপ। তোমাদের জন্য তো আমি তার কাছে খারাপ হয়ে যাবো।’

আশ্চর্য হয়ে রুয়াত আয়াজের দিকে তাকায়। মানে লোকটা এখন তার সামনেও এসব শুরু করেছে? সারাদিন রাহীম চৌধুরীর কাছে বলে বেড়ায় সেটা হয় না এখন রুয়াত কে ও বলছে। কেমন বিরক্তিকর লাগে যখন আয়াজের মুখ থেকে ম্যাডাম শব্দটা শুনে। নাক মুখ কুচকে ফেলে রুয়াত। তাচ্ছিল্য হেসে বলে-

-‘ভাইইইই আপনার হবু বউ প্লাস ম্যাডাম এসব আপনার কাছেই রাখুন। আর শুনুন আপনার সেই ম্যাডাম কে বলে দিবেন আমরা মোটেও খারাপ না। যত্তসব চিন্তাধারা আপনার ম্যাডামের।’

বলেই রুয়াত চলে আসে সেখান থেকে। আর পিছন ফিরে একবার ও তাকালো না। আয়াজ হেসেই যাচ্ছে। মানে কি পরিমাণ ক্ষেপেছে রুয়াত। নিজের দাঁড়ি গুলোতে হাত বুলায় আয়াজ। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে। সেটাতে আগুন ধরিয়ে মুখ নেয়। ধোঁয়া উড়িয়ে দেয় আকাশের পানে। আপন মনে বলতে শুরু করে,

-‘তুমি নিজেই নিজেকে এগুলো বলে গেলে প্রেয়সী। আর কেউ না জানুক আয়াজ জানে সবটা। যেখানে তার হৃদয়ে বহমান সেই গোপন প্রেমটির কথা। এতো রাগ আমার প্রেয়সীর প্রতি তোমার?’

(*)

নিমি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসে দেখে রুয়াত শুয়ে গিয়েছে। কাঁথা মুড়ে বকবক করছে। এমন শোনা যাচ্ছে যেনো কাউকে বকছে। কিছুটা বোকার মতো চেয়ে থাকে নিমি। শব্দ ছাড়া হেঁটে রুয়াতের পাশে দাঁড়ায়। মুখ থেকে কাঁথা সরিয়ে দেয়। রুয়াত ভূত দেখার মতো চমকে যায়। দাঁত কেলিয়ে নিমি বলে-

-‘কি রে ভয় পেয়েছিস?’

-‘তুই আমার সাথে কথা বলবি না বে’য়া’দ’ব মেয়ে। তোর জন্য আমি আয়াজ ভাইয়ার কাছে খারাপ হয়েছি আজকে। মানে কিসব কথা শুনিয়ে দিয়েছি। তার কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে তো আমিও তোকে বোঝালাম। তখন বুঝিস কেনো? ওনি কিছু বলে বুঝ দিয়েছে আর বুঝে গেলি? আবার জড়িয়ে ও ধরেছিস। ভালো ভালো। আমার কথার দাম নেই আজকাল।’

নিমি হেসে দেয় রুয়াতের কথায়। তার পাশের জায়গাটুকু তে বসে পড়ে। রুয়াতের হাত টেনে তার কোলে রাখে। আহ্লাদী স্বরে বলে-

-‘রাগ করেছিস রুয়াত? মানছি বুঝিয়েছিস তাই বলে তো ভাইয়ার মতো করে বুঝিয়ে বলিসনি। ওনি কি সুন্দর করে বুঝিয়েছেন। আগে আমাকে এমন করে বোঝালে ঠিকই আমি বুঝে যেতাম। পরে আর এমন করতাম না।’

-‘হয়েছে ছাড় আমায়। কিন্তু একটা কথা তুই কি সত্যিই সব মন থেকে বলেছিস? ভাইয়ার কথা শোনার পর ভুলে গিয়েছিস তোর সেই ভালোবাসা?’

মুখটা ছোট হয়ে এলো নিমির। ছাদ থেকে নেমে আসার পর ওয়াশরুমে গিয়ে কেঁদেছিলো। একদম মন থেকে বলেছে সব কিছু ভুলে যাবে। আর কষ্ট পাবে না। যেখানে সেই মানুষটি ও বলেছে নিমি কে ভুলে যাবে। তার থেকে দূরে চলে যাবে। সেখানে নিমির অযথা এরকম আচরণ নিতান্তই পাগলামো ছাড়া আর কিছু নয়। সেই থেকে নিজেকে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে শাফী কে ভুলে যাওয়ার জন্য সে সব কিছু করবে। আর মুখেও আনবে না সেই মানুষটির কথা। তবে রুয়াতের এরূপ কথায় আবারও মনে পড়ে গেলো সেই মানুষটি কে। নিজের মন কে শান্ত করে নিমি বলে-

-‘অতীত নিয়ে ভাববো না আর। আমি শাফী কে ভুলে থাকার যথাসম্ভব চেষ্টা করবো। আর কারো কাছে খারাপ হবো না। আর কার জন্যই বা হবো? যে মানুষটি আমাকে না জানিয়ে আমার থেকে দূরে চলে গিয়েছে? বাদ দে ওসব। আমি এই মুহুর্ত থেকে বলছি আর কখনো শাফী কে আমি মনেও করবো না। আর ভাববো না তাকে নিয়ে৷ আর কষ্ট পাবো না। ভাইয়া আমায় প্রমাণ দেখিয়ে ভালোই করেছে নাহলে আমি কোনো কারণ ছাড়া পাগলামো করতাম তার জন্য।’

রুয়াত শুয়ে শুয়ে নিমির কথাগুলো শুনছে শুধু। শুধুমাত্র বেকারত্বের জন্য কিভাবে মানুষ ভালোবাসা এভাবে বিলিয়ে দেয়। নিমির কাঁধে হাত দিয়ে বলে-

-‘আচ্ছা শুয়ে পড়। রাত হয়েছে অনেক।’

নিমি কিছু না বলে শুয়ে পড়ে রুয়াতের পাশে।

(*)

আজ এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল জানানোর তারিখ। এর আগের রাতে রুয়াত নিমি কেউই ঘুমায়নি। তারা খুব টেনশনে ছিলো। না জানি রেজাল্ট কি আসে। ভোরে ফজরের সময় উঠে গিয়েছে রুয়াত। তার আর শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। শুধু পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে টেনশন করছে। তার মা কতো স্বপ্ন দেখেছে তাকে নিয়। সেই অনুযায়ী পড়াশোনাও করেছে। পরীক্ষাও খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু তার ভিতর অস্থিরতা বেড়েই চলছে। নিমির জ্বর উঠে গিয়েছে চিন্তায়। জেবা আর মাহের চৌধুরী নিশ্চিত রেজাল্ট খারাপ হলে বকবে তাকে। তীব্র জ্বরে চোখ বুজে শুয়ে আছে শুধু।

সকালে রুয়াত আর নিমি খেতে যায়নি নিচে। তাই মায়া চৌধুরী খাবার নিয়ে এসেছেন উপরে। এসেই দেখে দু’জন ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে।

-‘খেতে যাসনি কেনো নিচে?’

রুয়াত মাথা তুলে তাকায় মায়া চৌধুরীর দিকে। উঠে সেখানেই যায়। হাত থেকে খাবারের বাটি গুলো নেয়।

-‘তুমি এতো কষ্ট করে এগুলো নিয়ে এসেছো কেনো? আমি তো ভেবে রেখেছি রেজাল্ট দেখার পর তারপর খাবো। আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না এখন।’

-‘কোনো কথা নয়। এখনই দু’জন খেয়ে নিবি। আর আশাকরি তোদের রেজাল্ট ভালো আসবে। এতো চিন্তার কিছু নেই। নিমি উঠ। খেয়ে আবার শুয়ে থাকিস।’

নিমি উঠে বসলো। শরীরে জ্বর কিন্তু তারপরেও ক্ষিদে পাচ্ছে তার। এ কেমন জ্বর আসলো? সে সময় তো মুখে রুচি থাকে না। মায়া চৌধুরী চলে যায়। রুয়াত আর নিমি কিছুটা খেয়ে আবার সেগুলো রেখে দেয়। রুম থেকেও বের হলো না আজ। নিরবতা ভেঙে রুয়াত বলে-

-‘তুই মেডিসিন খাবি না?’

-‘হু। খাবো। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে রে রুয়াত। না জানি কি হবে। মান সম্মান জড়িয়ে আছে রেজাল্টে।’

রুয়াত চুপচাপ শুনে গেলো শুধু। কিছু বললো না। এই রেজাল্ট নিয়ে প্রতিটি স্টুডেন্টদের মনেহয় এরকম অবস্থা হয়।
রুয়াত নিমির এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। নিমির তুলনায় রুয়াতের রেজাল্ট ভালো এসেছে। সবাই ভীষণ খুশি দু’জনের রেজাল্টে। নিমি কে বকা দেওয়ার বদলে বরং তাকে আরও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। মাহের চৌধুরী ও তার মেয়ে কে কিছু বললো না। একটা রেজাল্টের উপর ভিত্তি করে তো আর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা যায়না। তাই মাহের চৌধুরী বা জেবা কেউ নিমি কে কিছু বললো না। রুয়াত খুব খুশি। তার রেজাল্ট দেখার পর একদম কেঁদে দিয়েছে। তার সকল পরিশ্রম সফল হয়েছে। তাড়াতাড়ি করে মেহরুবা কে গিয়ে দেখায়। অতঃপর ইনিমার কাছে কল দেয়। কারণ ইনিমা আগেই বলে রেখে দিয়েছে রুয়াত আর নিমি যেনো রেজাল্ট দেখার পর তাকে কল দেয়। ইনিমার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে দু’জন। নিমির জ্বরটাও এখন কিছুটা কম। তাই রুয়াত তাকে নিচে নিয়ে এসেছে। মায়া চৌধুরী আজ অনেক আইটেম রান্না করছে শুধু রুয়াত আর নিমির জন্য। নিমি কে বসিয়ে রুয়াত মায়া চৌধুরীর কাছে আসে। তাকে একটু হেল্প করার জন্য।

.

সন্ধ্যায় সবাই বসে বসে চা খাচ্ছে আর কথা বলছে। সবাই উপস্থিত সেখানে। আয়াজ ও এসেছে আজ তাড়াতাড়ি। সে আপাতত বাসার বাহিরে গিয়ে ফোনে কথা বলছে। ফজলুল চৌধুরী হান্নান চৌধুরীর বন্ধু নাইমুর রহমানের সাথে কথা বলছেন। হান্নান চৌধুরীর কাছের একজন মানুষ ছিলেন তিনি। আজ হঠাৎ করে ফজলুল চৌধুরীর কাছে কল দেয়। জানায় গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে। তাই তাকে বাসায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ফজলুল চৌধুরী। মায়া চৌধুরী আর জেবা দাঁড়িয়ে আছেন একপাশে। মেহরুবা আর আসেনি নিচে। সে তার রুমেই আছে। রুয়াত বারবার চোখের পানি মুছে নিচ্ছে। তার খুশির দিনে এসব শুনবে ভাবেনি কখনো। পাশেই নিমি দাঁড়িয়ে স্বান্তনা দিচ্ছে তাকে।

-‘ফজলুল সাহেব এখন আমার বন্ধু বেঁচে নেই, রুয়াতের বর্তমান অভিভাবক আপনি ছাড়া আর কেউ নয়। আশাকরি আমার প্রস্তাবে রাজি হবেন। আমার বন্ধুর ও ইচ্ছে ছিলো। সেই আমাকে বলে গিয়েছে। এতে আর দ্বিমত পোষণ করবেন না।’

ফজলুল চৌধুরী তার চশমা ঠিক করে। সেই মুহূর্তে আয়াজ উপস্থিত হয় সেখানে। একবার রুয়াতের দিকে তাকায়। মেয়েটা কাঁদছে। কেনো? হঠাৎ কাঁদার মানে কি? চেয়েও আয়াজ একান্ত ভাবে রুয়াত কে তার কারণ জিগ্যেস করতে পারছে না। দৃষ্টি সরিয়ে সোজা তার বাবার পাশে বসে। হান্নান চৌধুরীর বন্ধু নাইমুরের দিকে তাকায়। মায়া চৌধুরী একটু আধটু ভয়ে আছে আয়াজ আবার সবার সামনে কি বলে ফেলে সেটা নিয়ে।

-‘দেখুন নাইমুর সাহেব আমি তো আর এটা বলতে পারছি না যে রুয়াত রাজি আছে কিনা। আর এখন ওর মা আছে। ওর মায়ের সাথেও কথা বলতে হবে। তারপর ওর নানার পরিবারের সাথে কথা বলা লাগবে। হুট করে তো আর সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়না।’

আয়াজ ভ্রু কুচকায়। ঘটনাটি জানার জন্য জিগ্যেস করে-
-‘কিসের সিদ্ধান্তের কথা বলছো বাবা?’

ফজলুল চৌধুরীর আগে নাইমুর রহমান বলে উঠে,
-‘হান্নান আর আমি ঠিক করেছিলাম আমার ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়েটা। প্রথমে সেই আমাকে প্রস্তাব দেয়। এতোদিন আমি বলিনি কারণ রুয়াত ও ছোট ছিলো আর ওর পরীক্ষা ছিলো তাই বলিনি। আর আমার ছেলে ইউএসএ থেকে এসেছে কয়েক মাস হলো। বলেছিলো বিয়ে করবে না এখন। তাই আমিও জোর করিনি। অপেক্ষা করেছিলাম শুধু। এখন রুয়াতের পরীক্ষা শেষ, রেজাল্ট ও দিয়েছে আর আমার ছেলেও এখন বিয়ের করার জন্য রাজি হয়েছে। এজন্য আমিও এসেছি প্রস্তাবটা নিয়ে। আমি চাই রুয়াত কে আমার ছেলের বউ করে নিয়ে যেতে। যেহেতু রুয়াতের আগে তার আরও দু’বোন আছে তাই আমি চাচ্ছি বাগদান সম্পন্ন করে রাখতে। তারপর ওদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর নাহয় রুয়াতের সাথে আমার ছেলের বিয়েটা হবে। কি বলেন আপনি এমপি সাহেব?’

আয়াজ রাগে চোখ মুখ বুজে। প্রেয়সীর বিয়ে তাও কিনা অন্য কোনো ছেলের সাথে? বিয়ে শব্দের ‘ব’ ও সহ্য করতে পারছে না সে।

#চলবে…

[আসসালামু আলাইকুম। অসুস্থ তাও আপনাদের জন্য কষ্ট করে গল্প লিখেছি। আজ আর কেউ ছোট পর্ব বলবেন না প্লিজ। সবাই দয়া করে রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন। আর সুন্দর সুন্দর কমেন্ট উপহার দিবেন। তাহলেই কালকে বড়সড় একটা ধামাকা পর্ব উপহার পাবেন🥺। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here