#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস (২)
#পর্ব_১২
#মোহনা_হক
-‘আসবো বাবা?’
সন্ধ্যায় ফজলুল চৌধুরী তার রুমে শুয়ে আছেন। হঠাৎ কারো কন্ঠস্বর শুনে উঠে বসে। আয়াজ এসেছে। তার বাবার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথার বলার জন্য। যা একেবারে না বললেই নয়। মায়া চৌধুরী কে আগেই বলে রেখেছে। শুধু এখন ফজলুল চৌধুরী বাকি রয়েছে। ভেবেছিলো কয়েক বছর পর জানাবে। কিন্তু তার বাবা আজকাল যা শুরু করেছে, জানাতেই হবে।
-‘এসো।’
রুমের ভিতর প্রবেশ করে আয়াজ। তার বাবার সামনে চেয়ার টেনে বসে। ফজলুল চৌধুরী জিগ্যেস করে,
-‘কিছু হয়েছে? তোমার না আজ মন্ত্রিসভায় যাওয়ার কথা ছিলো? গেলে না?’
-‘যাবো। সেটা কাল। তার জন্য আগে ঢাকায় যেতে হবে। দুদিন থাকতে হবে ওখানে।’
ফজলুল চৌধুরী তার চোখের চশমা ঠেলে ঠিক করলেন। একবার তার ছেলে কে ভালো পর্যবেক্ষন করে নিলেন। অনেক বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।
-‘তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?’
স্বাভাবিক হয়ে আয়াজ উত্তর দেয়,
-‘আমি একটা কথা বলতে মুলত এখানে এসেছি।’
ফজলুল চৌধুরী আর ভাবলেন না। তিনিও ছেলের এমন অবস্থার কারণ জানতে চায়। তাই বলে উঠলেন,
-‘বলো।’
-‘আমি রুয়াত কে পছন্দ করি। এ কথাটি আজ বলার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু তুমি যেভাবে কাল ওর বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলে তাই বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে। ওকে আমি পছন্দ করি এক দু মাস নয়। এর মাঝে কতগুলো বছর চলে গিয়েছে। কথাটি শুধু মা জানতো। আমিই প্রথম প্রথম মা কে বলেছি। অবশ্য বলার ও কিছু কারণ ছিলো। সেগুলো নাহয় নাই বলি। আচ্ছা তুমি কিভাবে কাল ওনার কথা বিশ্বাস করে নিলে? রুয়াতের জায়গায় যদি এমন হতো যে ইনিমার সাথে ঠিক একই কাহিনী হতো তুমি মেনে নিতে বুঝি? আমার তো মনে হয়না কখনো এসব যাচাই বাচাই না করে এভাবে মেনে নিতে। তাহলে ওর বেলায় এমন করলে কেনো? আবার ছোট মা কে সবার সামনে জিগ্যেস করেছো যেহেতু নাইমুর রহমান প্রস্তাবটা নিয়ে এসেছেন তুমি রাজি হয়ে যেতে পারো। মানে তুমি কথাটা একবার ভেবে দেখো। ওনার বংশগত পরিচয় জানো? ওনার ব্যাপারে কোনো খোঁজ নিয়েছো? ওনার ছেলের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়েছিলে কিছু? হুট করে বলে দিলে চাইলে রাজি হয়ে যেতে পারো। তুমি একবার ভাবো তো লোকটার কথা একদম মিথ্যে হলো। যদি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতো? আর যে বললো ছেলে ইউএসএ থেকে এসেছে এটা যদি মিথ্যে হতো? তখন কি করতে? আর রুয়াত তোমার নিজের মেয়ে হলে এমনটা করতে পারতে? তাকে আমি পছন্দ করি বলে এটা বলো না যে ওর ব্যাপারে এসব নিয়ে কথা বলছি। এখন যদি ওর জায়গায় নিমি বা তোমার মেয়ে হতো আমি ঠিক এগুলোই বলতাম। শুধু ভাগ্যক্রমে রুয়াত পড়েছে। যাই হোক আমি এখন এটা বলবো না তুমি জোর করে ওর সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দাও। শুধু এটাই বলবো অন্তত আর কখনো ওর বিষয়ে তুমি এমন কোনো কথা বলবে না। বিয়ে একদিন হবে। আর সেই একদিন আমার সাথেই হবে। তাই এর আগে তুমি ওর জন্য কোনো বিয়ের পাত্র দেখবে না। আর কখনো এমন সিদ্ধান্ত নিবে না। ব্যাস এটুকুই বলার ছিলো।’
ফজলুল চৌধুরী কিছুটা চমকে যায় তার ছেলের কথায়। রুয়াত কে পছন্দ করে? এ কথাটি শোনার পর আরও বেশি চমকে গিয়েছিলো। কিভাবে ছেলে তার বাবার সামনে এসব বললো। আয়াজের একটু সংকোচ বোধ থাকা উচিৎ ছিলো। রুয়াতের ব্যাপারে ফজলুল চৌধুরী অনেক কঠোর। তিনি কোনো মতেই চাননা আয়াজের সাথে রুয়াতের বিয়ে হোক। কারণ তার ছেলের জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে ঝুঁকি রয়েছে। আর সেখানে কিভাবে সেই ঝুঁকিতে রুয়াত কে নিজ ইচ্ছায় ফেলে দিবে? রইলো তখনকার কথা। নাইমুর রহমান কে খুব ভালো করেই চিনতেন। কারণ এ বাড়িতে তার যাতায়াত ছিলো খুব বেশি। লোকটার কথা মিথ্যে মনে হয়নি। এরকম স্বাভাবিক বন্ধুর কাছে বন্ধু বলতেই পারে। হয়তো তাদের মধ্যে এমন কথোপকথন ও হয়েছিলো। অবিশ্বাস না করার ও কোনো কারণ নেই। আর নাইমুরের ছেলে কে ও চেনে। কথাটি মোটেও মিথ্যে বলেনি তিনি। আয়াজের বোঝার ভুল। কারণ সে কোনো মতেই এটা মেনে নিতে পারেনি। আর অবশ্যই তিনি আরও একবার খোঁজ খবর নিতেন। যদি রুয়াতের সাথে নাইমুরের ছেলের বিয়ে ঠিক হতো। যতোই হোক রুয়াত তার ভাইয়ের মেয়ে। কখনো একেবারে হুট করে সিদ্ধান্ত নিতেন না। ভালো মন্দ বিচার করে তারপর এই প্রস্তাবটা গ্রহণ করতেন।
-‘ওর জন্য নয়। বরং আমি তোমার জন্য পাত্রী খোঁজা শুরু করবো। তুমি কিভাবে ভেবেছো যে আমি তোমার মায়ের মতো সবটা মেনে নিবো? তোমার লাইফ রিস্ক রয়েছে। আর রুয়াতের সাথে তোমার বিয়ে দিয়ে তার লাইফটাও রিস্কি করে দিবো ভাবছো?’
আয়াজ শব্দ করে হেসে উঠে,
-‘তাই! তাহলে যখন কোনো খোঁজ খবর না নিয়ে অচেনা একটা ছেলের সাথে রুয়াতের বিয়েটা ঠিক করে নিতে যাচ্ছিলে? তখন কথাটি মনে পড়েনি বাবা?’
ফজলুল চৌধুরী ধমকে উঠে। একটা সামান্য জিনিসে তার ছেলে বুঝি তাকে এভাবে বলবে?
-‘চুপ করো। তুমি জানো না কিছু। নাইমুর কে আমি চিনি। হয়তো রুয়াতের বাবা কোনো এক সময় এরকম প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলো। তাই তিনি কাল বাসায় এসেছেন। যেটা জানো না সেটা নিয়ে কথা বলবে না।’
-‘আচ্ছা সেটা নাহয় মানলাম। কিন্তু বাবা তুমিও একটা কথা ভুলে যেও না। আমার রাজনীতি করার জন্য তুমিই সবার বিরুদ্ধে গিয়েছিলে। তুমিই আমাকে একপ্রকার জোর করেছিলে। কথাগুলো মনে আছে তো?’
কিছুটা ভড়কে যায় ফজলুল চৌধুরী। এক সময় তিনিও রাজনীতি তে জড়িত ছিলেন। তার শখ ছিলো তার ছেলেও রাজনীতি করবে। কথাটি ভুল নয়। আয়াজের রাজনীতি তে যোগ দেওয়ায় সবচেয়ে বড় হাত ছিলো ফজলুল চৌধুরীর। তিনিই উৎসাহ দিয়েছেন। যার কারণে আয়াজ এখন এই জায়গায়। আয়াজের জন্যই ফজলুল চৌধুরীর আজ এতো নাম ডাক। এ কথা তিনি কখনো ভুলবেন না। কিন্তু রুয়াত কে এসবের সাথে জড়াতে দিবেন না। তার ভাইয়ের আদরের মেয়ে ছিলো। আর সেই মেয়ের কিছু হলে ফজলুল চৌধুরী নিজেকে ক্ষমা করবেন কিভাবে? ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বলে-
-‘আমি ভুলিনি কিছুই। যখন হান্নান ছিলো তখন দেখেছো তো সে তার মেয়ে কে কতো বেশি ভালোবাসতো। আমি কিভাবে আবার সেই মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে দিবো? তুমি ভালো করেই জানো তোমার জীবনে ঝুঁকি আছে।
আয়াজ থামিয়ে দিলো ফজলুল চৌধুরী কে।
-‘আচ্ছা তাহলে জেনে বুঝে আমাকে কেনো রাজনীতি করার জন্য জোর করেছো? আমি তো চাইনি। কেনো করেছো? বলো। তার মানে তুমি আমার ভালো চাও না। সেটাই বলো। আমি সব সময় বলি কোনো বাবা মা তার সন্তানের খারাপ চায় না, ভালো চায় সব সময়। কিন্তু এখন দেখছি তুমিই আমার ভালো চাও না। নাহলে কোনো বাবা মা তার সন্তান কে এভাবে ঝুঁকির মধ্যে নিজ হাতে ঠেলে দেয়?আজ পর্যন্ত যা হয়েছে সব তোমার ইচ্ছায় হয়েছে। এখন যা হবে সব আমার ইচ্ছায় হবে। যদি তুমি আমার জন্য কোনো মেয়ে দেখো সত্যি বলছি আমি মা আর ছোট মায়ের অনুমতি নিয়ে রুয়াত কে বিয়ে করে ফেলবো। আবার সেই তোমার বাসায়ই উঠবো। আমি বেশি কিছু চাই নি। তুমি যদি আমার কথা না রাখতে পারো সেটা তোমার ব্যর্থতা বলে ধরে নিবো। আসছি।’
ফজলুল চৌধুরী চুপ হয়ে গেলেন। তখনকার ভুলের মাশুল এখন দিতে হচ্ছে। আয়াজ ভুল বুঝেছে। ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। তবুও প্রকাশ্যে নিজের কঠিন রূপ ধরে রেখেছেন। এই প্রথম এতো ভালো প্রস্তাবে তিনি চেয়েও রাজি হতে পারছেন না। কত শত কারণ আছে। কি করে বোঝাবেন তার ছেলে কে? আয়াজ চলে যায় রুম থেকে।
-‘রুয়াত কে কখনো তোমার হাতে তুলে দিবো না আয়াজ। সব রকম ভাবে চেষ্টা করবো আমি। এর কারণ অজানা থাকুক। তুমিও ভালো থাকো। রুয়াত ও ভালো থাকুক। আমি তোমাদের ভালো চাই সব সময়।’
(*)
পাঁচ দিন ধরে আয়াজ বাসায় নেই। সবার কাছে বলেছে মন্ত্রিসভায় যাবে। সেখানে নাকি তার কাজ আছে। বাসা থেকে বের হয়ে এখনো পর্যন্ত কাউকে কল দেয়নি। এমনকি তার মা কে ও না। ফজলুল চৌধুরীর সাথে সেদিন ঝামেলা হওয়ার আর কথা বলেনি আয়াজ। যাওয়ার সময় ও বলে যায়নি। বিষয়টা নজর এড়ায়নি মায়া চৌধুরীর। কিন্তু ছেলের চিন্তায় আর জিগ্যেস ও করা হয়নি কারণ।
মাত্রই রুয়াত মায়া চৌধুরীর রুম থেকে এলো। তার ভীষণ খারাপ লাগছে আয়াজের জন্য। এই পাঁচদিনে আয়াজের শূন্যতা পুড়িয়ে মারছে তাকে। লোকটার প্রতি কেনো এতো মায়া জন্মেছে তার। তবে এর নাম কি ‘ভালোবাসা’? ব্যালকনিতে বসে আয়াজ কে কল দিচ্ছে। মোবাইল বারবার বন্ধ বলছে। চিন্তায় আছে রুয়াত। আয়াজের কিছু হয়নি তো? কল দিচ্ছে না বলে যেনো চিন্তায় পা’গ’ল হওয়ার উপক্রম হয়েছে। একবার একটু কথা বলতে পারলে হৃদয় শান্ত করতে পারতো। কেনো এতো অস্থির লাগছে তার? হাঁটুতে হাত দিয়ে ভর দেয়। সেখানটায় মুখ গুঁজে কাঁদছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। হঠাৎ রিংটোন বেজে উঠে। রুয়াত তড়িঘড়ি করে মাথা তুলে। আয়াজ কল দিয়েছে। চোখের পানি দ্রুত মুছে কল রিসিভ করে। মানুষটার শান্ত স্বরের আওয়াজ ভেসে আসছে,
-‘কল দিয়েছিলে?’
কথা বলার শক্তি নেই রুয়াতের। এমন অনুভূতি হচ্ছে যেনো কয়েক বছর পর আয়াজের কন্ঠস্বর শুনেছে। অধর কামড়ে কান্না থামায় সে। বৃথা চেষ্টা তার। একটু আধটু আওয়াজ আয়াজের কানে পৌঁছায়।
-‘কান্নার আওয়াজ শোনাতে নিশ্চয়ই কল দাওনি। কি জন্যে কল দিয়েছো সেটা বলো। একটু পর আবার মোবাইল বন্ধ করে দিবো।’
বড় নিঃশ্বাস টানে রুয়াত। ঢোক গিলে। অতঃপর বলে,
-‘আপনি কোঁথায়? বাসায় আসছেন না কেনো? পাঁচদিন হয়ে গেলো বাসায় আসেননি। বড় মা চিন্তা করছে। কেউ কল দিলেও মোবাইল বন্ধ বলে। কেনো এমন করছেন? বড় মা সারাক্ষণ কাঁদে আপনার জন্য। দয়া করে বাসায় আসুন।’
বলেই কেঁদে দেয় রুয়াত। গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে প্রেয়সী এরূপ কন্ঠস্বরে হাসছে আয়াজ। আগে কখনো এমন হয়নি। বরং তার প্রেয়সী কাঁদলে বক্ষে জ্বালাপোড়া শুরু হতো। আর আজ হেসেই যাচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার!
-‘সবচেয়ে বড় কথা তুমি কাঁদছো কেনো?’
-‘আপনি জানেন না আমি কেনো কাঁদছি। মানুষ কে কষ্ট দিতে ভালো লাগে আপনার?’
উচ্চস্বরে হেসে উঠে আয়াজ। রুয়াত একটু চমকায়। কানের পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে আসে। আবার সেই জায়গায় রাখে। বেশ আগ্রহ নিয়ে কানে নিয়েছে আয়াজের কথা শোনার জন্য।
-‘তোমার কাঁদার কারণ কি আমি প্রেয়সী?’
নির্দ্বিধায় রুয়াত বলে উঠে,
-‘হ্যাঁ আপনি। কেনো বাসায় আসছেন না? বড় মায়ের কষ্ট সহ্য হচ্ছে।’
-‘শুধু কি বড় মায়ের কষ্ট হচ্ছে? আমার প্রেয়সীর কষ্ট হচ্ছে না?’
-‘হচ্ছে।’
-‘তো বাসায় আসলে কি কষ্ট কমে যাবে প্রেয়সী?’
-‘হু। আসুন না বাসায়।’
-‘তাহলে কষ্ট কমানোর জন্য যাবো।’
কান্নাভরা মুখশ্রী তে খুশির ঝলক দেখা যাচ্ছে। রুয়াত তড়িঘড়ি করে বলে উঠে,
-‘কবে আসবেন?’
সিটে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে আয়াজ।
-‘আসবো যেদিন প্রেয়সী ভালোবাসি বলবে সেদিন।’
বলেই কল কেঁটে দেয় আয়াজ। রুয়াত কে কিছু বলার সুযোগ ও দেয়নি।
#চলবে…
[আসসালামু আলাইকুম। ফজলুল চৌধুরী ভিলেন হলে কেমন লাগবে?😂 অনেকেই বলেছেন রুয়াত সব সময় এমন করে। এবার রুয়াতকে পছন্দ হয়েছে? আর হ্যাঁ আমি এখনো সুস্থ নই। শুধু আপনাদের জন্য এতো কষ্ট করে লিখেছি। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]