প্রেম_প্রার্থনা #তামান্না_আঁখি #পর্ব-২৬

0
589

#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-২৬

রাত ১২ টার কাছাকাছি। তুহিন তার বিছানার উপর থম মেরে বসে আছে। তার মুখ চোখ কাঁদো কাঁদো। যেন এক্ষুনি কেঁদে ভাসিয়ে দিবে। দুই হাত একটা ওড়না সে বুকে চেপে ধরে আছে।
তুহিনের দুই রুমমেট মিজান আর শাহীন বিছানার উপর পা তুলে মুখ কুচকে তুহিনের দিকে তাকিয়ে আছে। মিজান শাহীনের কানের কাছে হালকা মুখ বাড়িয়ে বলল-

“ওর সমস্যা কি? সন্ধ্যা থাইকা এমন ভং ধইরা আছে।”

শাহীন উত্তর করল-

“কি জানি!! কোন মেয়ের ওড়না নিয়ে আসছে আল্লাহ জানে। যতদূর জানি ওর তো কোনো গার্লফ্রেন্ড নাই।”

শাহীন গলা পরিষ্কার করে তুহিনকে ডাকলো-

“তুহিন,কিছু সমস্যা হইছে নাকি?”

তুহিন ফ্লোর থেকে চোখ তুলে শাহীনের দিকে তাকালো। কিছু না বলে করুণ চোখ করে তাকিয়ে রইলো। শাহীন আর মিজান মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তারা আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না।তুহিন হলে আসার পর থেকে এই ওড়না গায়ে জড়িয়ে ঘুমায়। তীব্র গরমেও সে এই কাজ করেছে। ওড়নার নিচে সে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়েছে তাও ওড়না ছাড়ে নি। আজ সন্ধার পর হঠাৎ করে ওড়না হাতে নিয়ে কি যেন দেখে একটা চিৎকার দিলো। তারপর থেকেই এইভাবে বসে আছে। মিজান প্রশ্ন করল-

“এই ওড়না টা কার? এইভাবে নিয়ে বইসা আছস কেন?কোনো সমস্যা থাকলে শেয়ার কর।”

তুহিন একটা লম্বা হতাশ শ্বাস ফেললো। বলল-

” আমার অনেক বড় ক্ষতি হইয়া গেছে।”

শাহীন মিজান দুজনেই একটু ঝুঁকলো।দুজনেই চোখে মুখে আগ্রহ ফুটিয়ে বলল-

“কি ক্ষতি?”

তুহিন ওড়না টার একটা নির্দিষ্ট অংশ এগিয়ে দিলো। তারপর বলল-

“দেখ, ওড়না টার এই জায়গায় সুতা উইঠা গেছে।”

মিজান শাহীন দুজনেই ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো। মিজান জিজ্ঞেস করল-

“সুতা উঠলে উঠছে। এতে হইছে টা কি?”

তুহিন ওড়না টা বুকে চেপে ধরে কান্না কান্না কন্ঠে বলল-

“আমার মহারানির ওড়নার সুতা উইঠা গেছে এটা তো আমার গায়ে কাঁটার আঘাতের সমান।”

শাহীন মিজান দুজনেই বুঝলো এইবার ঘটনা। দুজনেই অনেক বিরক্ত হলো।শাহীন তুহিনের হাত পায়ের দিকে ইশারা করে বলল-

“তোর যেই জংলির মতো বড় বড় নখ, এই নখ দিয়া আমাদের ই চামড়া তুইল্লা ফেলস তুই আর এইটা তো সামান্য সুতা।”

তুহিন এই কথা শুনে তড়িঘড়ি করে তার হাত পা দেখলো। আসলেই নখ অনেক বড়। নখ কাটতে আলসেমি লাগে বলে সে কাটে না।হাতের নখ কোনোমতে কাটলেও পায়ের নখের দিকে সে ফিরেও তাকায় না। সে পায়ের বুড়ো আংগুলের নখে লাল সুতার কিছু অংশ দেখতে পেলো। বুড়ো আংগুলের নখের মাঝ বরাবর খানিক টা ফেটে গেছে, তাতে লেগেই এই কান্ড হয়েছে। তুহিনের বেজায় রাগ হলো। তার মহারানির কাছ থেকে পাওয়া উপহারের এত বড় অসম্মান সে মেনে নিবে না। তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পরে সে নেইল কাটার খুজতে লাগলো।

মিজান এসব আর আমলে নিলো না সে চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। শাহীন ভ্রু কুচকে বিরক্ত মুখে তুহিনের হাবভাব দেখতে লাগলো।তুহিন ড্রয়ার খুজে একটা নেইল কাটার বের করলো। তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো নেইল কাটার পাওয়ার আনন্দে।সে বিছানার উপর এসে আয়েশ করে বসলো।তার মহারানির ওড়নাকে আহত করার অপরাধের শাস্তি হিসেবে সে তার হাত পায়ের সব নখ কেটে দিবে এখনি।

শাহীন বিরক্ত মুখে বলল-

“এই মাঝ রাতে এখন নখ কাটতে বসবি? ভাই, আল্লাহর দোহাই লাগে লাইট অফ কইরা যা খু্শি কর। আমার কালকে ৮ টায় ক্লাস।”

তুহিন শাহিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো বেচারা অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। তার মায়া লাগল। সে উঠে গিয়ে লাইট অফ করে দিলো তার পর টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে নখ কাটতে বসলো।
লাইট অফ করার পর ও শাহীন মিজান কেউই তুহিনের নখ কাটার শব্দে ঘুমাতে পারলো না। তুহিন কুটুস কুটুস শব্দ তুলে আয়েশ করে নখ কাটছে। মাঝ রাতে বন্ধ ঘরে সেই শব্দ বিকট হয়ে কানে বাজছে।

_________

দিন টা শুক্রবার।সৈয়দ বাড়ির সবাই সকালের খাবারের পর যার যার কাজে ব্যস্ত। বাড়ির মহিলারা রান্নাঘরের পাট চুকিয়ে বারান্দায় পাটি বিছিয়ে কিছু টুকিটাকি কাজ করছে আর গল্প করছে। বাড়ির মেয়েরা আড্ডা দিচ্ছে।কিছুক্ষন পর পর তাদের হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে।বাড়ির পুরুষরা আপাতত সবাই বাড়িতে।ছুটির দিনে ব্যবসা পাতি সব কিছুই বাদ দিয়ে তারা পরিবারের সাথে সময় কাটায়।

সৈয়দ মোস্তফা কামাল এক বাটি সরিষার তেল নিয়ে এসে জলচৌকি টেনে উঠোনে রোদে বসলেন।তিনি খালি গায়ে রোদে বসে এদিক ওদিক শরীর মোচড় দিলেন। তারপর সরিষার তেলের বাটি থেকে তেল নিয়ে গায়ে মাখতে লাগলেন।সামিরা বেগম বারান্দা থেকে স্বামীর এহেন কাজ কর্মে নাক কুচকালেন। প্রতি শুক্রবার ই মোস্তফা কামাল শরীরে সরিষার তেল ঘষে গোসল করেন।তার ধারনা এইভাবে গায়ের রঙ সোনার মতো চক চক করে।

ফরহাদ ঘর থেকে বের হয়ে মোস্তফা কামালের কান্ড দেখে হাসলো।সে ছোট থেকে এই কান্ড দেখে অভ্যস্ত।সে একটা জলচৌকি নিয়ে এসে বারান্দায় বসে জিজ্ঞেস করলো-

“চাচ্চু,আজ তো রোদ অনেক কড়া।গায়ে তাপ লাগে না?”

ফরহাদের কথা শুনে মোস্তফা কামাল ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিয়ে আবার দ্বিগুন জোরে তেল দিয়ে হাত ঘষতে ঘষতে বললেন-

“কড়া রোদ ই ভালো।রোদ আর সরিষার তেল এক হইয়া একটা সোনার মতো কালার হইব শরিরে।”

ফরহাদ বলল-

“উফফফ চাচ্চু, তোমার সোনার মতো কালার করার দরকার কি।এই রোদে জ্বর বাঁধাইতে চাও নাকি।”

সামিরা বেগম টিপ্পনী কেটে বললেন-

“জ্বর বাঁধাইলে তোমার চাচ্চুর তো কিছু হয় না সে তো আরামেই শুইয়া থাকে।সারা রাত জাইগা সেবা তো করি আমি।”

মোস্তফা কামাল পায়ে তেল ঘষতে ঘষতে উত্তর করলেন-

“স্বামীর সেবা করা স্ত্রীর কর্তব্য। এতে অত ঢোল পিডানোর কিছু নাই।”

সামিরা বেগম একটা মুখ ঝামটা দিলেন।সাজেদা বেগম আর রাজিয়া বেগম দুজন ই মুখ টিপে হাসলেন। মোস্তফা কামাল কে কথায় হারানো অসম্ভব ব্যাপার।

“স্বামীর সেবা” ফরহাদ কয়েকবার মনে মনে কথা টা উচ্চারন করলো।তারপর দুতলায় চারুর ঘরের দিকে তাকালো। সেই ঘরে থাকা অভিমানীর কাছ থেকে কি সে আদৌ ‘স্বামীসেবা’ পাবে? সে যে এই সুখ টুকু পাওয়ার জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে।

রানির ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছে।খালি মনে হচ্ছে কি যেন একটা নেই। সে ঘর জুড়ে কিছুক্ষন পায়চারী করলো। কিন্তু তাতেও কিছু হলো না, তার অস্থিরতা ভাব বেড়েই গেলো।ফোন টা হাতে নিয়ে মেসেজ বক্স থেকে শুরু করে সব কিছুই চেক করলো। নাহ তুহিনের কোনো মেসেজ নেই,কল নেই।আশ্চর্য!! এই লোক তার ওড়না চুরি করে এখন যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। রাত বিরাতে তাকে বাইরে ডেকে নিয়ে যাওয়ার মতো কান্ড ও ঘটিয়েছে। তাও কোনো হেলদোল নেই। রানির খুব রাগ পেলো। সে আর ঘরে থাকতে পারলো না।দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামলো।

বাড়ির পিছনের দিকে ময়লার ঝুড়িগুলো রাখা। রানি এগিয়ে গেলো সেদিকে।সে জানে তার কাঙ্খিত জিনিস টা কোথায়।সে কয়েকবার এসে দেখে গেছে কিন্তু নেয়ার সাহস পায় নি। এইবার সে কোনোদ্বিধা করবে না।রানি তার ঘরের ময়লার ঝুড়িটার সামনে দাঁড়ালো।সকাল বেলা কখন যে কাজের মহিলা এসে ঘর পরিষ্কার করে গেছে সে টের পায় নি।একটু আগে তুহিনের গামছা টা ধুয়ে দিবে ভেবে ময়লার ঝুড়ি খুজতে গিয়ে দেখে সেটা এখানে। রানি এদিক ওদিক তাকিয়ে থাবা মেরে গামছা টা নিয়ে এক দৌড়ে ঘরে চলে এলো। তারপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে গামছা টা সামনে ধরলো।ঘামের বোটকা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠলো। তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে গিয়ে সাবান পানিতে ভিজিয়ে রাখলো। তারপর বাইরে এসে মোবাইল টা হাতে নিলো।রাগের চোটে তুহিনের নাম্বার সেভ করলো “ওড়না চোর” লিখে।

_____

রাতের খাওয়ার পর চারু এসে বিছানায় আয়েশ করে বসল।স্মৃতি ছাদে আছে তাই চারু রবিনের আইডিতে ঢুকলো চুপি চুপি। নতুন কোনো পোস্ট হয়েছে কিনা দেখল।নাহ হয়নি। ইশশ ওইদিন যদি ভিডিও কলে ওই কান্ড টা না ঘটত তাহলে এখন কল করে জানা যেত রবিনের এখন কি অবস্থা। তা তো আর হবে না।

তখনি রানির মেসেজ আসলো মেসেঞ্জারে। রানি লিখেছে-

“কাল স্কুলে যাব না।তুই একা যাইস। ”

মেসেজ টা দেখে চারু নাক কুচকালো।আয়নায় নিজেকে দেখলো।চুলে তেল দিয়ে বেণি করা। মুখ তেল তেল হয়ে আছে।কাজের মেয়ে সখিনা টাইপের একটা লুক হয়েছে তার। এই অবস্থায় একটা বিরক্তিকর ছবি তুলে রানির মেসেজের উত্তর দেয়া যেতে পারে।

সে কিছুক্ষন আয়নার সামনে মুখের বিভিন্ন ভংগি করলো। কোনো টাই মনমতো হলো না।এইবার দাঁত বের করে চোখ উলটে দেখলো নিজেকে। পারফেক্ট লুক! যথেষ্ট বিশ্রি লাগছে দেখতে।এই অবস্থায় ছবি পাঠালে রানি নিশ্চয়ই বিরক্ত হবে। চারু তাই করলো।ফ্রন্ট ক্যামেরা দিয়ে এইভাবে কয়েকটা ক্লিক করলো। তারপর গ্যালারিতে গিয়ে সিলেক্ট করতে লাগলো কোন ছবিটা সব থেকে বিশ্রি হয়েছে। তারপর বিশ্রি দেখতে ছবি টা সিলেক্ট করে রানির আইডি তে এক ক্লিক দিয়ে পাঠিয়ে দিলো। পাঠিয়ে দিয়েই বিছানায় শুয়ে কিটকিট করে হাসতে লাগলো।

মেসেজের শব্দে চারু উঠে বসলো। হাসি হাসি মুখে দেখতে নিলো রানি তার এই লূক দেখে কি রিপ্লাই দিয়েছে।কিন্তু রানি তো কোনো রিপ্লাই দেয় নি।রিপ্লাই তো এসেছে রবিনের আইডি থেকে।সেখানে লেখা-

“ছোট বেলা পোলিও টিকা দেয়ার পরেও তোর মুখের এই হাল? এই রাতের বেলা আমার হার্ট এটাক করাতে চাস নাকি?”

মেসেজের সাথে অনেক গুলো এংরি ইমুজি।চারু মেসেজ দেখে বোকা বনে গেলো। ভাল করে খেয়াল করে দেখলো রানি আর রবিনের আইডির নাম আগে পিছে থাকায় টাচ লেগে ছবিটা রানির পরিবর্তে রবিনের আইডিতে চলে গেছে। তাও আবার এমন একটা ছবি?হায় রে মান ইজ্জত!!!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here