#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-৩৭
রবিন বাম হাত দিয়ে ঘাড় চেপে ধরলো। চোখ বন্ধ করে মাথা পিছনে হেলিয়ে শ্বাস টানলো। তারপর স্বাভাবিক হয়ে চারুর দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি তোরে ভালবাসি। শুনছস? এইবার যা।বাড়িতে অনেক লোকজন। ”
চারু এমনি এমনি ছেড়ে দিলো না। সে জেদি গলায় বলল-
“তাহলে এক্ষুনি ফুপিরে আর বাড়ির সবাইরে গিয়া বল এই কথা টা। সাথে সারা আপুরেও বলবা।”
রবিন চোয়াল শক্ত করে তাকালো। যথাসম্ভব রাগ সংবরণ করে বলল-
“আমি তোরে এইখান থাইকা যাইতে কইছি চারু।এইটা নিয়া আর একটা সাউন্ড করবি না। ভদ্রভাবে নিচে যাবি।”
“না, আমি যা বললাম তুমি তাই করবা।আর এক্ষুনি করবা।”
রবিন মনে মনে প্রমাদ গুনলো। চারু অবুঝের মতো আচরন করছে। এই অবস্থায় কোনো ভুল পদক্ষেপ দুই পরিবারের জন্যই অসম্মানজনক হবে। রবিন দুই আংগুলে কপাল ঘষে বললো-
“দেখ এখন এইসব বলার সময় না। এইটা তোর আবেগের বয়স কিন্তু আমি এই আবেগে সায় দিয়া অঘটন ঘটাইতে চাই না।আমি তোরে পরে সব বুঝায়া কইবাম।তুই এখন যা।”
“আমি যাব না,ব্যস।
রবিনের ফোনে কল আসলো। রবিন ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ফোন কেটে দিলো। তারপর চারুর দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে বুঝিয়ে বললো-
” মেঝ মামা স্মৃতির উপর রাগ কইরা আছে এখন তুইও যদি এরকম অবুঝের মতো আচরন করস তাইলে মামা কষ্ট পাইব।”
“আমি কোনো অবুঝের মতো আচরন করতাছি না। আমি যা বললাম তুমি তাই করবা। আর এক্ষনি করবা। আর এইটাতে আব্বার কষ্ট পাওয়ার কোনো কারন নাই।”
রবিন কিছু বলতে নিবে তার আগেই আবার কল আসলো ফোনে। এইবারের কল আর রবিন অগ্রাহ্য করতে পারলো না।সে রিসিভ করে কানে ধরলো কিন্তু হ্যালো বলার আগেই চারু ক্ষিপ্ত হয়ে এগিয়ে এসে ফোন কেড়ে নিয়ে মেঝেতে ছুড়ে মারলো।বিকট শব্দে ফোন ভেঙেচুড়ে চারপাশে ছড়িয়ে গেলো। রবিন ফোনের ভাংগা টুকরো গুলোর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চারুর দিকে তাকালো। প্রচন্ড ক্রোধে তার ধারালো চেহারা যেন আরো শক্ত হয়ে গেলো। ভ্রু জোড়া কিছুটা কুচকে গিয়ে চোখ কিছুটা সরু হয়ে গেলো। সে হিংস্র দৃষ্টি দিয়ে তাকালো চারুর দিকে। সেই দৃষ্টি দেখে চারু কিছুটা ভয় পেলো।কিন্তু সাহস হারালো না।রবিন ডান হাতে চারুর চুল টেনে ধরে কিছুটা এগিয়ে আনলো, চিবিয়ে চিবিয়ে বললো-
“তোর সাহস দেইখা আমি অবাক হইলাম।আর একটা আওয়াজ করবি তো এইখানেই তোরে আমি মাইরা দিবাম।”
চারু প্রচন্ড ভয় পেলো। ঢোক গিলে কাঁপা কন্ঠে বলল-
“আমি কিন্তু সৈয়দ বাড়ির মেয়ে, তুমি… তুমি যদি….”
রবিনের মেজাজ চড়ে গেলো।কিড়মিড় করে বলল-
“চূপ বেয়াদব, স্মৃতিরে নিয়া কত ঝামেলায় আছে সবাই তোর ধারনা আছে? তোর বিয়ে করার শখ তাইনা? আয় আমার সাথে।”
রবিন চারুর চুল ছেড়ে দিয়ে শক্ত করে হাত ধরলো।হাতের চিনচিন ব্যথায় চারুর কঁকিয়ে উঠলো। রবিন পাত্তা দিলো না। সে টানতে টানতে চারুকে নিয়ে ঘরের বাইরে এলো।ঘরের দরজার বাইরে ভয়ার্ত মুখে রানিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। ওদেরকে দেখতেই রানি অস্ফুট স্বরে ডাকলো-
“ভাইয়া…”
রবিন কিছুই কানে নিলো না।চারু শুধু রানির দিকে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে একবার তাকালো।রবিন চারুকে টানতে টানতে বাড়ির পিছনের গেট দিয়ে বের হয়ে গেলো। মেইন রোড দিয়ে না গিয়ে শর্টকাটে চারুকে নিয়ে সৈয়দ বাড়ির দোরগোড়ায় এলো। সশব্দে গেট খুলে বাড়িতে ঢুকলো। চারুর হাত ধরে টান দিয়ে উঠোনের দিকে ঠেলে দিলো। টাল সামলাতে না পেরে চারু উঠোনের মাঝ বরাবর মাটিতে পড়ে গেলো। কনুইয়ের চামড়া ছিলে গেলো কিছুটা। রবিন অন্যদিকে তাকিয়ে কোমড়ে হাত রেখে বড় বড় নিশ্বাস নিলো।আজ তার মেজাজ সপ্তমে চড়ে আছে। চারু অস্ফুটে আর্তনাদ করলো কিছুটা।রবিনের কানে সেই আর্তনাদ যেন বিষ ঢেলে দিলো। চারুর দিকে ফিরে বাজখাই কন্ঠে একটা ধমক দিয়ে বলল-
“যা ঘরে যা।”
তখনি বারান্দা থেকে গম্ভীর কন্ঠে ভেসে আসলো-
“কি হইতাছে এইসব রবিন?”
রবিন বিস্মিত হয়ে বারান্দার দিকে তাকালো। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে শাহজাহান আলী।তার চোখ মুখে রাগ স্পষ্ট। চারু শাহজাহান আলীকে দেখে এইবার কেঁদেই দিলো।শাহজাহান আলী এগিয়ে এসে চারুকে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করালেন। তিনি রানির জন্মদিনে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলেন তখনি এই দৃশ্য তার চোখে পড়েছে। তিনি শক্ত দৃষ্টিতে রবিনের দিকে তাকালেন। চারুকে এক হাতে ধরে বললেন-
“চারুর সাথে এই ধরনের আচরন করার মানে কি রবিন?”
রবিন দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ালো।সে তার বড় মামাকে এইখানে আশা করে নি।সে চারুকে সৈয়দ বাড়িতে রেখে যেতে চেয়েছিলো যাতে চারু লোকজনের সামনে জেদের বশে কোনো ঝামেলা না করে। কিন্তু এখন তো অন্যরকম ভুল বুঝাবুঝি হয়ে গেলো। রবিন ঢোক গিলে কিছুটা শান্ত হয়ার চেষ্টা করে শাহজাহান আলীর দিকে তাকিয়ে বলল-
“বড় মামা আমায় ভুল বুঝবেন না। আমি চারুর সাথে এমন আচরন করতে চাই নাই।কিন্তু চারুর জেদ আমারে বাধ্য করছে এই ধরনের আচরন করতে।”
“সৈয়দ বাড়ির মেয়েদের উপর হাত তোলা তাদের সাথে খারাপ আচরন করা আমি পছন্দ করি না। কি এমন করলো চারু যে তুমি এই পদক্ষেপ নিলা?”
রবিন নিরুপায় হয়ে চারুর সবকিছুই খুলে বললো। শাহজাহান আলী সব শুনে ঠান্ডা মেজাজে বললেন-
“তার মানে তুমি কইতাছো চারু তোমারে ভালবাসে। ।তাই তো?
তারপর চারুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
” রবিন যা কইতাছে তা কি ঠিক চারু?”
চারু এদিক ওদিক তাকালো।একটু আগেই তার অসীম জেদ থাকলেও এখন তার মনে ভয়।সে কোনো উত্তর না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। চারুর নিশ্চুপ হয়ে থাকা রবিনের রাগে যেন ঘি ঢাললো।সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল-
“কয়েক মিনিট আগেই জেদ দেখাইছস, নির্লজ্জতার চরম সীমা পার করছস আর এখন চুপ কইরা আছস। কথা ক বেয়াদব।”
রবিনের ধমকে চারু কেঁপে উঠলো।শাহজাহান আলী উত্তপ্ত কন্ঠে বললেন-
“রবিইইইন, তুমি দ্বিতীয় বার এই ধরনের ব্যবহার করবা না চারুর সাথে।আমার বাড়ির মেয়ের সাথে আমারে কথা কইতে দেও।”
“আমারে ভুল বুঝবেন না মামা,কিন্তু আজ যেই ঘটনা ঘটছে এর পর অতিরিক্ত চিন্তিত অবস্থায় চারুর জেদ মেনে নিয়ে মেজাজ ঠিক রাখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।”
শাহজাহান আলী বিচক্ষন লোক। তিনি রবিনের মেজাজ সম্পর্কে যেমন জানেন তেমনি নিজের বাড়ির মেয়ে চারুর অবুঝ জেদ সম্পর্কেও জানেন। রবিন যে বিনা কারনে চারুর সাথে এরকম করে নি সেটা তিনি বুঝতে পারছেন।ছোট থেকেই চারু অনেক বার ই দুষ্টামির কারনে রবিনের হাতে অল্পবিস্তর মার খেয়েছে কিন্তু আজকের মতো কখনো এরকম মেজাজ খারাপ হয় নি রবিনের। সে বরাবর ই চারুর জেদ কে অন্যভাবে সামাল দিয়েছে।
শাহজাহান আলী চারুর দিকে ফিরে বললেন-
“যা বসার ঘরে গিয়া বস। ”
চারু রবিনের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এক পলক তাকিয়ে বসার ঘরে চলে গেলো।শাহজাহান আলী রবিনের দিকে তাকিয়ে বললেন-
“বলো কি এমন কারন যার কারনে তুমি মেজাজ হারাইয়া এই ধরনের আচরন করলা।”
রবিন একটা বড় শ্বাস ফেললো। শাহজাহান আলীর দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে মৃদু স্বরে বলল-
“মামা,স্মৃতি প্রেগন্যান্ট। ”
________
রানি বসার ঘরে সবার মাঝে চিন্তিত হয়ে বসে আছে। চারু আর রবিনের উধাও হয়ে যাওয়া এখনো বাড়ির কেউ খেয়াল করে নি।রানি ঘড়ি দেখলো আধা ঘন্টার উপরে হয়ে গেছে রবিন চারুকে নিয়ে গেছে। বাড়ির সবাই গল্পে মশগুল হয়ে আছে কিন্তু রানির ভয়ে, চিন্তায় গা গুলিয়ে আসছে।সে তার নিজের ভাইয়ের মেজাজ সম্পর্কে জানে। মেজাজ হারিয়ে চারুর সাথে না জানি কি করে বসে।আর চারুটাও হয়েছে এমন জেদি আর অবুঝ, তার যা চাই তাই ই লাগবে, স্থান,কাল,পাত্র কোনোকিছু বিবেচনা করে না সে।
রানির ভাবনার মাঝেই রবিন সদর দরজা দিয়ে বসার ঘরে ঢুকলো।কোনোদিক না তাকিয়েই বসার ঘরে গেস্টদের ভিড় ঠেলে সিড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। সারা রবিনকে দেখে উঠে গিয়ে পিছু নিলো। রবিনের সাথে সাথে সে ও সিড়ি ধরে উঠতে উঠতে বলল-
“কোথায় ছিলে তুমি? আম্মু আর মামী তোমাকে খুজছিলো।একটা ইম্পর্টেন্ট কথা আছে।মামা কখন আসবে? মামা আসলে কথা টা……”
সারা আর পুরো কথা টা বলতে পারলো না। রবিন সারার দিকে না তাকিয়েই সারার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো। সারা থম মেরে দাঁড়িয়ে গেলো।কি এমন হলো হঠাৎ? এতক্ষন তো সব ঠিক ই ছিলো। সারা বিক্ষিপ্ত মনে নিচে নেমে এলো।
রাজিয়া বেগমের হঠাৎ হুশ হলো যে চারু নেই কোথাও।তিনি কানে কানে সাজেদা বেগমকে জিজ্ঞেস করলেন চারুকে কোথাও দেখেছে কিনা।সাজেদা বেগম জানালেন দেখেন নি। দুজনেই খেয়াল করলেন অনেক্ষন থেকেই চারু নেই। রাজিয়া বেগম উঠলেন রানিকে জিজ্ঞেস করতে চারুর ব্যাপারে আর তখনি সৈয়দ বাড়ির কাজের ছেলেটা হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো।
সাজেদা বেগমের দিকে তাকিয়ে হাপাতে হাপাতে বললো-
“চাচী আম্মা, তাড়াতাড়ি চলেন চাচায় স্ট্রোক করছে।”
সাজেদা বেগমের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো।তিনি এক চিৎকার দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন,দৌড়ে গেলেন বাড়ির সামনে রাখা গাড়ির দিকে।মুহুর্তেই চারপাশে হুলস্থূল বেঁধে গেলো। রুবিনা বেগম ভাইয়ের এমন খবর শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না মাথা ঘুরিয়ে সেখানেই পড়ে গেলেন। রানি তার মা কে ধরলো। ফাতেমা বেগম তাড়াতাড়ি পানি এনে রুবিনা বেগমের মুখে ছিটিয়ে দিলেন।রানি তার মা কে রেখে ছুটলো রবিনের ঘরের দিকে। দরজায় করাঘাত করলো।কয়েকবার করাঘাত করার পর ও রবিন দরজা খুললো না।রানি সইতে না পেরে চিৎকার করে কেঁদে দিলো।রবিন সাথে সাথেই দরজা খুলে বের হলো।রানি রবিনকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ে বললো-
“ভাইয়া রে, বড় মামা স্ট্রোক করছে।”
রবিন এই কথা শুনে চোখ বুঝে ফেললো।এই একটা রাত সবকিছু এমন এলোমেলো করে দিচ্ছে কেন? এই অভিশপ্ত রাত কি কারো জীবন নিয়েই বিদায় হবে?
_________
হাসপাতালের করিডোরে সবাই বসে আছে। কেউ মাটিতে কেউ বা চেয়ারে। শাহজাহান আলীকে যেই ঘরে রাখা হয়েছে সেই ঘরের দরজায় মাথা হেলান দিয়ে বসে আছেন সাজেদা বেগম। কান্নার পানি গালে শুকিয়ে আছে।শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন নিচের দিকে। তার মনে বিভিন্ন ভয় দানা বাঁধছে, তিনি জোর করেও সরিয়ে দিতে পারছেন না ভয় গুলো।সাজেদা বেগমকে ধরে বসে আছেন রাজিয়া বেগম। সামিরা বেগম এক পাশের চেয়ারে রনিকে কোলে নিয়ে বসে আছে।ছোট্ট রনি তার কোলেই এই অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে। চারু এক পাশের চেয়ারে ভাবলেশহীন ভাবে দুই পা তুলে হাঁটুর উপর মুখ রেখে বসে আছে। ক্ষণে ক্ষনে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।তার মনে এখনো সেই দৃশ্যটা ভেসে উঠছে। তার বড় বাবার মাটিতে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য। একা বাড়িতে চারু নিজেকে তখন অসহায় অনুভব করেছিলো।অজানা আশংকায় তার সারা শরির বরফের ন্যায় জমে গিয়েছিলো। শাহজাহান আলীকে উঠোনে একা রেখেই অন্ধকারে কম্পনরত অবস্থায় একা একা দৌড়ে গিয়েছিলো পাশের বাড়িতে। ওই অবস্থায় বাড়ির গাড়িটাও ছিলো না। সবার সাহায্যে সে তার বড় বাবাকে হাসপাতালে আনতে সক্ষম হয়েছে।
রবিন করিডোরের অপর পাশে এক হাঁটুতে হাত রেখে দেয়ালে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। তার চোখ দুটি বন্ধ। চিন্তায় মাথা ছিড়ে যাচ্ছে তার। নিজেকে বড্ড দোষী মনে হচ্ছে। রানি ভাইয়ের এমন অসহায় মুখ দেখে বুঝতে পারছে কি চলছে তার মনে। সে এসে চারুর পাশে বসলো। পানির বোতল টা চারুর দিকে এগিয়ে দিলো। কিন্তু আগের মতোই চারু অনড়। গত কয়েক ঘন্টা যাবত এক ফোঁটা পানিও সে খায় নি।
ভোরের দিকে শাহজাহান আলীর জ্ঞান ফিরলো। ডাক্তার রা সবাই আশ্বস্ত করলো তিনি এখন আশংকামুক্ত।অতিরিক্ত টেনশনে তিনি মাইল্ড স্ট্রোক করেছিলেন কিন্তু এখন বিপদ কেটে গেছে তবে সবাই একসাথে কেবিনে যেতে পারলেও রোগীকে বেশি কথা বলানো যাবে না।প্রথমেই সাজেদা বেগম কেবিনে ঢুকলেন।ডাক্তার কান্না করতে নিষেধ করার পরও তিনি শয্যাশায়ী স্বামীকে দেখে কেঁদে দিলেন। রুবিনা বেগম ও ভাইকে দেখতে পিছু পিছু ঢুকলেন। ভাইয়ের এই অবস্থায় তিনিও নিজেকে সামলাতে পারলেন না। শাহজাহান আলী অল্প অল্প কথা বলে স্ত্রী এবং বোনকে সান্ত্বনা দিলেন।
কান্নাকাটিতে রোগীর ক্ষতি হতে পারে তাই দুজনকেই কিছুক্ষনের জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিলো নার্স। নিজেদেরকে সামলে নিয়ে পরে সবাই একসাথে আসতে পারবে। শাহজাহান আলী নার্সকে ডেকে বললেন রবিনকে কেবিনে পাঠিয়ে দিতে।
নার্সের কাছে এই কথা শুনে রবিনে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে হেঁটে শাহজাহান আলীর কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলো। যাওয়ার পথে অনড় বসে থাকা চারুর দিকেও একবার দৃষ্টি দিলো। কেবিনে ঢুকতেই শাহজাহান আলীর চোখে চোখ পড়লো রবিনের। সে চোখ নামিয়ে নিলো। শাহজাহান আলি মৃদু কন্ঠে বললেন-
“বসো।”
রবিন টুল টেনে বেডের পাশে বসলো।মাথা তুলে বলল-
“আপনারে কষ্ট দেয়ার জন্য আমারে মাফ কইরা দেন মামা। আমি কথা টা আপনারে জানাইতে চাই নাই।কিন্তু…”
শাহজাহান আলী রবিনকে থামিয়ে দিয়ে বললেন-
“তুমি আর চারুর আশেপাশে কোনোদিন আসবা না।”
রবিন বিমূড় দৃষ্টিতে তাকালো।শাহজাহান আলি শক্ত কন্ঠে বললেন-
“এই পরিবারের সাথে আমার বইনের পরিবারের বিরোধ হোক আমি চাই না। জামান স্মৃতির ঘটনা শুনার পর কি করব আমি জানি না কিন্তু সে চারুর ক্ষেত্রেও এমন কিছু শুনলে আর ঠিক থাকতে পারব না। স্মৃতির উপর রাগ কইরা সে চারুর বিয়ে দিতে চাইছিলো।এখন এইসব শুনলে….”
“মামা চারুরে আমি ভালোবাসি, ছোট থাইকা ভালোবাসি।”
রবিনের অকপট স্বীকারোক্তিতে শাহজাহান আলী কিছুটা বিস্মিত হলেন। রবিন চোয়াল শক্ত করে বলল-
“স্মৃতির ব্যাপার আর চারুর ব্যাপার আলাদা আপনি দুইটা এক করবেন না। গত রাতে চারুর সাথে করা আচরনের জন্য আমি লজ্জিত কিন্তু এইটাও ঠিক আমি চারুরে চাই।”
শাহজাহান আলী হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন-
“চারু এখন ছোট। আবেগের বশে তোমার প্রতি তার অনুভূতি আইছে বড় হইলে সে তার নিজের ভুল বুঝব। তখন দুই পরিবারের বিরোধ ঠেকানোর কেউ থাকতো না। তাই তুমি আর চারুর সামনে আসবা না।”
রবিনের দাঁতে দাঁত লেগে গেলো।সে অসুস্থ মামার সামনে নিজের মেজাজ বিগড়াতে চাইলো না। যথাসম্ভব ভদ্রতার সুরে বললো-
“মামা আপনি যা খুশি বলেন মেনে নিব কিন্তু আমার থাইকা চারুরে দূরে সরানোর কথা বলবেন না।আমি সহ্য করব না।”
শাহজাহান আলী মৃদু হাসলেন। বললেন-
“আবেগের বয়স গেলে চারু নিজেই তোমার থাইকা মুখ ফিরায়া নিব। তোমাদের দুজনের এই অনুভূতির কথা আমি আগে জানলে সবকিছু এক কইরা হইলেও আমি ঠেকাইতাম।”
রবিন উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। শাহজাহান আলীর চোখে চোখ রেখে বলল-
“আপনি আমারে ছাড়া অন্য কোথাও চারুর বিয়ে দিতে পারবেন না।আজ না হয় কাল আপনার ভাতিজিরে আমি বিয়ে করবাম, পারলে ঠেকান।”
বলেই রবিন ঘুরে বের হতে নিলো তারপর আবার ফিরে বললো-
“আমি চারুর সামনে আসতাম না কথা দিলাম কিন্তু আপনার ভাতিজি যদি আমার সামনে আসে তখন?”
ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে রবিন বের হয়ে গেলো। শাহজাহান আলী সেই হাসি দেখে চিন্তিত হলেন। সবকিছু তো ঠিক ই ছিলো নতুন করে এই ঘটনার সূত্রপাত কিসের ইংগিত। আবারো সৈয়দ বাড়ি আর তালুকদার বাড়ির ঠান্ডা দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যাবে না তো?
রবিন বের হয়ে আসতেই করিডোরে দাঁড়ানো সকলে আস্তে আস্তে কেবিনে ঢুকে গেলো।রানিও চারুর পাশ থেকে উঠে চলে গেলো তার বড় মামাকে দেখতে। পুরো করিডোরে চারু একা বসে রইলো।রবিন এগিয়ে এসে চারুর বাহু ধরে টেনে চারুকে দাঁড় করালো।আকস্মিক আক্রমনে চারু হতভম্ব হয়ে তাকালো। রবিন চারুর বাহু ধরে টেনে একদম কাছে নিয়ে আসলো। চারু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে রবিনের ক্ষিপ্ত চোখ মুখের দিকে তাকালো। ক্ষিপ্ত হয়ে থাকায় শ্যামবর্নের ধারালো চেহারায় কিছুটা হিংস্রতার ছাপ পড়েছে।চারু ঢোক গিললো। সে তো এমন কিছু চায় নি। তার অবুঝ জেদ এ কেমন পরিস্থিতিতে এনে ফেললো তাকে?
রবিন চারুর মুখের কাছে মুখ নামিয়ে এনে হিসহিস করে বললো-
“তোর বড় বাবা আমারে তোর থাইকা দূরে থাকতে কইছে। তোর সামনে আসতে না করছে। আমিও রাজি হইছি। আমি তোর সামনে আসতাম না।কিন্তু তুই যদি আমার সামনে আসোস তখন আমার কি করা উচিত ক?”
চারু মিনমিন করে বলল-
“রবিন ভাই ছাড়ো,আমার হাতে ব্যথা লাগতাছে।”
রবিন আরো শক্ত করে ধরে আরো কাছে আনলো।তার উত্তপ্ত শ্বাস চারুর চোখে মুখে আচড়ে পড়লো।দাঁতে দাঁত ঘষে বললো-
“এতদিন খালি রবিন ভাই রে দেখছস আজ থাইকা রবিন তালুকদাররে দেখবি। আজকে থাইকা তোর একটা শ্বাসের শব্দ ও আমার কান মিস করত না।তোর পায়ের নখ থাইকা শুরু কইরা চুল পর্যন্ত সব খবরই আমার কাছে আসব। এত দিন ছোট ছিলি বইলা ছাড় দিছিলাম কিন্তু এখন যেহেতু সব এলোমেলো কইরা দিছস তেইলে আর ছাড় দেয়ার প্রশ্ন ই আসে না।”
রবিন একটা ঝাড়ি দিয়ে চারুর বাহু ছেড়ে দিলো।চারু টাল সামলাতে না পেরে চেয়ারে বসে পড়লো।রবিন হন হন করে করিডোর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। চারু সেদিকে তাকিয়ে শক্ত হয়ে বসে রইলো।
চলবে