প্রেম_প্রার্থনা #তামান্না_আঁখি #পর্ব-৪১

0
526

#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-৪১

৪ বছর পর

চারু বাড়ির পিছনের মাটির রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। তার হাতে কয়েকটা খাবারের বক্স। তার গন্তব্য তালুকদার বাড়ি। সাথে রনিকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলো সে কিন্তু রনির স্কুলে পরিক্ষা থাকায় আর আনা হলো না। রনির ফিরতে অনেক দেরি হবে তাই চারু নিজেই রওয়ানা দিয়েছে। বাড়ির পিছনের রাস্তা দিয়ে তালুকদার বাড়ি কাছাকাছি হয় তাই এদিক দিয়েই সে যাওয়া আসা করে। আস্তে আস্তে তালুকদার বাড়ির গেটের কাছে চলে এলো।গেট দিয়ে ঢুকে আঙিনায় তাকাইতেই তার বুকটা ছলাৎ করে উঠলো।সেই চির পরিচিত বাইক টা পার্ক করা।বাইকের মানুষ টা গ্রামে না আসলে তো বাইকটা বের করা হয় না।তাহলে বাইকের মানুষটা কি এখন গ্রামে? চারু এদিক ওদিক তাকালো। বাইকের মানুষটা কি বাড়িতে আছে নাকি এখন? মনে মনে দোয়া করলো যেন সামনাসামনি দেখা না হয়। চারু আড়চোখে আরো একবার বাইকটাকে দেখে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপলো। কারো দৌড়ে আসার শব্দ শুনলো। দৌড়ে আসা ব্যক্তিটি দরজা খুলে দিয়ে গোমড়া মুখে বলল-

“এতক্ষনে আসছস? সেই কখন থাইকা কেক নিয়া বইসা আছি।”

চারু রানির দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল-
“তোর এত ঢং ভাল্লাগে না।প্রতি বছর জন্মদিন করার কি দরকার বুঝি না।”

রানি হাসি হাসি মুখে একটা ভেংচি দিয়ে চারুর পিছু পিছু তার ঘরে এলো।চারু খাবারের বক্সগুলো রানির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বলল-

“বক্সে আচার আছে। বের কইরা আমারে দে। বাড়িতে আম্মা আমারে একটুও খাইতে দেয় নাই।সব আচার নাকি তোর লাইগা।”

রানি বক্স খুলে একটা প্লেটে আচার ঢেলে চারুকে দিলো।চারু আয়েশ করে বসে খেতে লাগলো। রানি সব বক্স ডায়নিং এ রেখে এসে চারুর পাশে বসে বললো-
“এইবার ছাদে কেক কাটবাম। ছাদ সাজাইছি।”

চারু ভ্রু উঁচু করে বলল-
“একা একা সাজাইছস?”
“আমি সাজাইছি না তো।আব্বা লোক দিয়া সাজাইছে।”
“চল তাইলে যাই। কেক কাইটা তোর এইসব ঢং শেষ করি।”

রানি মুখ টা ছোট করে চারুর বাহু ধরে বলল-
“ইশশশ খালি রাগ করস। তুই ছাড়া কি আমার আর কেউ আছে? তুই ই তো আমার একমাত্র বান্ধবি, একমাত্র ভাবি।”

শেষের কথাটা বলেই রানি চোখ খিচে জিভে কামড় দিলো। চোখ মেলে আড়চোখে চারুর দিকে তাকালো। চারু চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। রানি অপরাধী মুখে বলল-
“মুখ ফসকে বাইর হইয়া গেছে।”

চারু রানির দুই গালে খামচি দিয়ে ধরলো। রানি ব্যথায় “আয়াহ” করে উঠলো।চারু দুইদিকে রানির গাল টানতে টানতে কিড়মিড় করে বলল-
“তোর সন্ত্রাসী ভাইয়ের বউ হইতে আমার ঠেকা পড়ছে।তোর ভাই একটা শয়তান,তুই একটা শয়তান, তোর চৌদ্দ গুষ্টি শয়তান।যাহ তোর জন্মদিনের কেক কাটাকুটিতে আমি নাই।”

চারু ধাক্কা দিয়ে রানিকে সরিয়ে দিলো। রানি খামছি খেয়ে গাল ডলতে লাগলো। কোন মুখে যে চারুকে এই কথা বলতে গেলো আল্লাহ জানে। সে ইনিয়ে বিনিয়ে বললো-
” আমার লক্ষী বইন রাগ করিস না। আমি সরি। আয়, আম্মার কাছে যাই। আম্মা দুপুরের লাইজ্ঞা কি রান্না করতাছে দেইখা আসি।”

চারু বিরস মুখে উঠে দাঁড়ালো। রানির পিছু পিছু রুবিনা বেগমের কাছে গেলো।রুবিনা বেগম ঘেমে নেয়ে রান্না করছেন। সাথে কাজের লোক থাকলেও তিনি নিজের হাতেই সব করতে পছন্দ করেন। চারুকে দেখে হাসলেন তিনি। বললেন-
“ডায়নিং এ বস।পায়েস করছি। পায়েস খা।”

পায়েসের কথা শুনে চারুর মন ভালো হয়ে গেলো।সে ডায়নিং এ না বসে রান্না ঘরে চলে এলো।খুশি খুশি সুরে জিজ্ঞেস করলো-
“কিসের পায়েস গো ফুপি?”
“খেজুর গুড়ের, সাথে নারকেল।”

চারুর মন খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। রুবিনা বেগম প্লেটে গরম গরম পায়েস ঢালছেন। চারু রুবিনা বেগমের কাঁধের পাশ দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি মেরে দেখতে লাগলো। রুবিনা বেগম প্লেটে ঢালা শেষ করতেই সে ছোঁ মেরে প্লেট টা নিয়া ডায়নিং এ বসে পড়ল খেতে। গরম গরম খেতে গিয়ে সে ঠোঁট পুড়ে ফেললো।রানি মানা করলো তাও কানে তুললো না।রুবিনা বেগম চারুর কান্ড দেখে রান্নাঘর থেকেই চেচাঁলেন-

“ঠান্ডা কইরা খা। গরম খাবার খাইতে নাই।”

চারু কথা শুনলো।সে পায়েসের বাটিতে জোরে জোরে ফু দিতে লাগলো।রুবিনা বেগম চারুর কান্ড দেখে হাসলেন।মেয়েটা বড় হলেও স্বভাব এখনো আগের মতোই আছে। বুক ছিড়ে একটা নিশ্বাস বের হলো তাঁর। এরকম মিষ্টি একটা মেয়েকে বকা দিতেও তো খারাপ লাগে আর তার ছেলে কিনা মেয়েটার সাথে জঘন্য সব খারাপ আচরন করেছে তাও আবার যখন চারু আরো ছোট ছিল তখন। মেয়েটার ছোট মনে নিশ্চয়ই এই ঘটনার দাগ পড়েছে।

রুবিনা বেগম ডায়নিং এ এসে রানির দিকে প্লেট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন-
” তোর পায়েস টা ঠান্ডা হোক। তুই গিয়ে তোর ভাইরে এই প্লেট টা দিয়ে আয়।”

রবিনের প্রসংগ শুনে চারুর ফু দেয়া থেমে গেলো। রানি আর রুবিনা বেগম দুজনেই আড়চোখে চারুকে পরখ করলেন। চারু নিজেকে সামলে নিয়ে আবারো ফু দিতে লাগলো।এবার আগের চেয়ে আরো জোরে জোরে ফু দিতে লাগলো।রুবিনা বেগম আর এখানে থাকলেন না তিনি রান্নাঘরে চলে গেলেন। রানি এদিকে একবার নজর দিয়ে প্লেট নিয়ে দুতলায় চলে গেলো। কিছুক্ষন পর ফিরে এসে জানালো রবিন ঘরে নেই।

চারু মনোযোগ দিয়ে পায়েস খাচ্ছে। রানির ওই জন্মদিনের পর গত চার বছর ধরে আর কখনোই জন্মদিনের অনুষ্ঠান করা হয় নি। তবে প্রতি জন্মদিনেই রানি চারুকে নিয়ে তালুকদার বাড়িতে
কেক কাটে। সৈয়দ বাড়ির গিন্নীরাও এটা ওটা করে পাঠায়। মাঝে মাঝে সৈয়দ বাড়ির কয়েকজন ও আসে চারুর সাথে। এই চার বছর চারু যতবার ই তালুকদার বাড়িতে এসেছে কোনোদিন রবিনের সাথে দেখা হয় নি। গত চার বছরে চারু রবিনের ছায়াও দেখে নি। সে নিজেও যে রবিনকে দেখতে চায় না এমন না। তার অবাধ্য মন বিভিন্ন ভাবে রবিনের দেখা পেতে চায়,তার নির্লজ্জ চোখ এদিক ওদিক উঁকি-ঝুকি দেয় রবিনকে দেখার জন্য। তার মন মস্তিষ্ক কোনোটাই আর তার বারন শুনে না।চারু রবিনকে না দেখলেও তার আশেপাশে রবিনের অস্তিত্ব চারু বুঝতে পারে। আর তার সবচেয়ে অস্বস্তি টা লাগে তখনি। তার মনে হয় রবিন আশেপাশে আছে তাকে দেখছে।অথচ চারু যখন আশেপাশে দেখে তখন সে কাউকেই দেখতে পায় না।

চারু পায়েস খেতে খেতে এদিক ওদিক দেখলো।ওর মনে হচ্ছে রবিন আশেপাশে আছে।চারু চোরাচোখে সবদিক খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো কিন্তু কাঙ্খিত মানুষটিকে দেখতে পেলো না। চারু মনে মনে নিজেকে অনেকগুলো গালি দিলো। কিন্তু তাতে কি? তার মন তার কথা শুনবে কেন? মন তো অন্যজনের কাছে বন্ধক দিয়েছে সে। আগের কিশোরী চারু এখন বড় হয়েছে।সেই সাথে কিশোরী মনের অনুভূতিও ডালপালা মেলে দিয়ে ফুল ফুটিয়েছে। যেটার নাম হয়েছে এখন ভালোবাসা।

সন্ধ্যার দিকে চারু আর রানি সেজেগুজে ছাদে আসলো। দুজনেই শাড়ি পড়েছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে দুজনেই শাড়ি পড়াটাও শিখে নিয়েছে।দুজনেই কেক সহ আরো অনেক কিছু এনে ছাদে রাখা টেবিলটা ভরিয়ে ফেললো।রানি গিয়ে লাইটের সুইচটা অন করে দিতেই চারদিক লাইটের আলোতে আলোকিত হয়ে গেলো। দুজনেই সেই লাইটের আলোতে দাঁড়িয়ে কেক নিয়ে অনেক অনেক ছবি তুললো। এইগুলো ফেসবুক স্টোরিতে দিতে হবে। রুবিনা বেগমকে তারা দুজনেই ছাদে আসতে অনুরোধ করেছিলো কিন্তু তিনি আসেন নি। মেয়ের জন্মদিনে ভাইয়ের স্ট্রোক হওয়ার পর থেকে জন্মদিনের যেকোনো অনুষ্ঠানের প্রতি তার ভয় কাজ করে। অগত্যা চারু আর রানিকে একা একাই জন্মদিনের অনুষ্ঠান টা পার করতে হবে। কেক কাটার সময় দেখা গেলো মোমবাতি আনতে ভুলে গেছে। রানি উর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিলো নিচে মোমবাতি আনতে।

চারু একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে রইলো তার চোখ গেলো ছাদের খড়ের ছাউনিটার দিকে। সেখানে এখনো আগের মতোই চৌকি পাতা। চৌকির উপর বিছানা দেখে মনে হচ্ছে একটু আগেই যেন কেউ এখানে বসে ছিলো। চারু ভ্রু কুচকালো। আরেকটু এগিয়ে এসে দেখলো বিছানার উপর সিগারেট আর লাইটার।ছোট টেবিল্টার উপর অ্যাশট্রে তে সদ্য ফেলে দেয়া সিগারেটের ছাই। চারুর বুক ছ্যাত করে উঠলো। সে আকুল নয়নে আশে পাশে খুজলো। ছাদের এদিক ওদিক দৌড় লাগালো। অস্থির হয়ে গেলো তার তনু মন। সে ছাদের আনাচে কানাচে খুজলো। কয়েকবার করে খুজলো।কিন্তু কাউকে পেলো না।চারু এক সময় থামলো। থেমে হাঁপাতে লাগলো। মুখ চোখ ছেয়ে গেলো তীব্র বিষাদে। নিজেকে শাসালো, ধমকালো। কেন তার এতো আকুলতা? কেন তার এত অস্থিরতা? “উফফফ,অসহ্য” বলে চারু মাথা চেপে ধরলো। নাহ, নিজের মনকে এইভাবে সে হাতছাড়া করবে না। এখন থেকে কঠিন শাসনে রাখবে।

খানিক বাদেই রানি মোমবাতি নিয়ে আসলো।চারুকে পরখ করে বলল-
“তোর চোখ মুখ এমন কেন? এত ঘামছস কেন?”

চারু হাতের উলটো পিঠ দিয়ে ঘাম মুছে বললো-
“অনেক গরম তো তাই।”

রানি ছাদে এতো বাতাসের মাঝে চারুর গরম লাগার কারন বুঝলো না। চারু তাড়া দিয়ে বলল-
“চল তাড়াতাড়ি, কেক কাটি। আমার বাড়িতে যাওয়া লাগব।”

রানি চোখ কপালে তুলে বলল-
“সেকি কেন? আজ না তুই আমার সাথে থাকবি!”
“নাহ, আজ থাকতাম না। ”
“কেন? চারু প্লিজ প্লিজ এমন করিস না। আজকের দিনটা থাক।”

চারু শক্ত মুখে বলল-
“না,আমি না করছি তার মানে না। আমি বাড়িত চইলা যাইবাম ব্যস।”

“আচ্ছা যাইস গা।এখন তেইলে আয় কেক কাটি।”

রানি আর চারুর সাথে কথা বাড়ানোর সাহস পেল না পাছে চারু রেগেমেগে চলে যায় যদি। এই মেয়ের মতিগতি বুঝা দায়। দুজনে মিলে কেক কাটলো। একজন আরেকজন কে খাইয়ে দিল। আরো এক দফা ছবি তুললো। এর মাঝে রানির ফোনে কল এলো। চারু উঁকি দিয়ে দেখলো স্ক্রিনে “ওড়না চোর” লেখা ভেসে উঠেছে। সে ঠোঁট বাঁকালো। রানি একটা লাজুক হাসি দিয়ে একটু দূরে গিয়ে ফোন কানে নিয়ে কথা বলতে লাগলো। চারু তাকিয়ে রইলো সেদিকে। এই চার বছরে অনেক কিছুই ঘটেছে।তার মধ্যে একটা ঘটনা হচ্ছে রানি আর তুহিনের প্রেম। এই প্রেম এখন আস্তে আস্তে বিয়ে পর্যন্ত গড়াচ্ছে। যেই রানি একসময় তুহিন কে সহ্য করতে পারতো না সেই রানি এখন তুহিনের জন্য পাগল।

__________

রাত ১০ টা পেরিয়ে গেছে। রাতের খাওয়া দাওয়া করে চারু রুবিনা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে পড়লো। রানি তাকে সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসে দাঁড়িয়ে রইলো। চারু গেটের দিকে এগিয়ে গেলো। সৈয়দ বাড়ি থেকে গাড়ি পাঠানো হয়েছে, গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি।চারু গেট পেরিয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে গাড়ির দরজায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। পিছন ফিরে চাইলো তালুকদার বাড়ির দিকে।তারপর উপরে ছাদের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ থম মেরে তাকিয়ে রইলো। একটু আগেই ছাদের লাইট জ্বালানো ছিলো এখন সবগুলো লাইট অফ করলো কে? নিকষ কালো অন্ধকার জমাট বেধে আছে ছাদে। সেই অন্ধকারেই কারো একটা অবয়ব দেখতে পাওয়ার আশা মনের কোণে উঁকি দিলো তার।। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলো না। সে গাড়ির দরজা খুলে উঠে বসলো। গাড়ির জানালা দিয়েও তাকালো ছাদের দিকে।গাড়ি তালুকদার বাড়ির সীমানা পার হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকিয়েই রইলো সে।

ছাদের অন্ধকারে দুহাত পকেটে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুঠাম দেহের পুরুষ অবয়বটি নড়ে উঠলো। ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়িটিকে দেখলো। চোখ দুটো এখনো নিবদ্ধ সেদিকেই। চারু আসার পর থেকেই এই চোখ দুটো তাকে আড়াল হতে দেয় নি। চারুর পায়েসে ফু দিয়ে খাওয়া থেকে শুরু করে ছাদের দৌড়াদৌড়ি কিছুই তার চোখ এড়ায়নি। এই চোখ থেকে চারুর আড়াল হওয়ার সাধ্য নেই,কোনোদিন ছিলো ও না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here