প্রেম_প্রার্থনা #তামান্না_আঁখি #পর্ব-৫২

0
588

#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-৫২

তুহিন দুই হাত মাথার নিচে দিয়ে বিছানায় শুয়ে থেকে পা নাচাচ্ছে। তার মুখ হাসি হাসি।যেন খুশি উপচে পড়ছে।ছাদের দিকে তাকিয়ে থেকে সে গতরাতে তার বিড়াল মারার কথা চিন্তা করছে। তারপর নিজেই লজ্জা পেয়ে দাঁত কামড়ি দিয়ে ঠোঁট চেপে হাসছে। ফোনের টুং শব্দে তুহিনের ভাবনায় ছেদ পড়লো।মাথা ঘুরিয়ে পাশে তাকালো।রানির ফোনে মেসেজ এসেছে।তুহিন উঠে বসে বেডসাইড টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিলো।চারু মেসেজ পাঠিয়েছে।লক খুলে মেসেজ টা ওপেন করলো।সেখানে লেখা-

“তোমার কোন কোন জায়গায় ব্যথা গো বান্ধবি ললিতা?”

সাথে অনেক গুলো চুমুর ইমোজি।ব্যাপারখানা এই যে চুমু দিয়ে ব্যথা সারিয়ে দিবে।তুহিনের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।সে এদিক ওদিক ভাবুক নয়নে তাকালো।তার মোটা মাথায় প্রথমে যেটা এলো সেটা হচ্ছে রানির ব্যথার কথা রানি তাকে না বলে চারুকে বললো কেন? তুহিন ফোন রেখে বিছানা থেকে নেমে দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে রানিকে ডাকলো। তারপর ঘরের মাঝ বরাবর এসে দাঁড়ালো।চোখেমুখে ফুটে উঠলো রাগ। রানি মাথায় ঘোমটা টেনে ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে বললো –

“আমারে ডাকছেন?”

তুহিন প্রবল বেগে ঘুরে তাকালো।রানির কাছাকাছি গিয়ে গাল ফুলিয়ে প্রশ্ন করলো-

“আমি তোমার স্বামী হইয়া একঘরে থাইকা তোমার ব্যথার খবর জানতে পারলাম না আর আরেকজন আরেক বাড়িত থাইকা ঠিক ই জাইন্না গেলো।”

রানি চোখের পাতা ঝাপটালো।বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো-
“কিসের ব্যথা?”

“কিছু কারনে ব্যথা হইতেই পারে এইটা স্বাভাবিক। তাই বইলা তুমি এইটা নিজের স্বামীরে না বইলা আরেকজনরে বলবা?”

রানি হা হয়ে গেলো। তুহিন রানির মুখের ভাবভঙ্গী দেখে মোবাইলের মেসেজটা ওপেন করে রানির সামনে ধরলো। মেসেজ দেখে রানির চোখ রসগোল্লার মতো হয়ে গেলো।মুখে ছি উচ্চারণ করে ছোঁ মেরে তুহিনের কাছ থেকে মোবাইলটা নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো।তড়িঘড়ি হাতে ডিলেট করে দিলো মেসেজ। তুহিন নাক দিয়ে অভিমানী শ্বাস টেনে গর্বের সাথে বললো-

“স্ত্রীর ভুল ক্ষমা করা স্বামীদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এইবারের মতো মাফ করলাম।এইবার বলো মলম আনবো নাকি ঔষধ?”

“ছিঃ! চুপ করেন।”

তুহিন অবাক দৃষ্টিতে তাকালো।রানি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে।তুহিন মাথা ঝাঁকিয়ে বললো-
“আরে আশ্চর্য, ঔষধ ছাড়া ভাল হইবা নাকি। গলার লালচে দাগগুলার………”

“ছিঃ!!অসভ্য!”

বলেই রানি একহাত ঘোমটা টেনে নাক মুখ কুচকে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে।তুহিন অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো।অসুখ নিয়ে রানির খামখেয়ালি তার পছন্দ হলো না। এতদিন যা হয়েছে তা হয়েছে কিন্তু এখন যেহেতু তুহিন রানির স্বামী তুহিন কিছুতেই এসব বিষয়ে রানির খামখেয়ালি বরদাস্ত করবে না।সে নিজেও বড় বড় পা ফেলে রানির পিছু নিলো।রানি ঘর থেকে বের হয়ে দু পা এগোতেই তুহিনকে আসতে দেখেই থতমত খেয়ে আবার অন্যদিকে হাঁটা দিলো।তুহিন রানির পিছু আসতে আসতে বললো –

“এসব নিয়া অবহেলা আমার পছন্দ না রানি। কামড়ের ক্ষত গুলা থাইকা দাগ….”

রানি তুহিনকে পিছু ছাড়াতে তড়িঘড়ি করে হাঁটতে হা্টতে বসার ঘরের দরজায় চলে এসে থেমে গেলো। বসার ঘরে তার ননদ আর ননদের স্বামীরা বসে আলাপ করছে। রানি তাড়াতাড়ি পিছন ঘুরলো।তুহিনের কথা শেষ করতে না দিয়ে অসহায় মুখে বলল-

“আল্লাহর দোহাই লাগে আপনি চুপ করেন।এইখান থাইকা যান।”

তুহিনও ঘুরে রানির পিছু পিছু যেতে বললো –

“আরে খোদা,তুমি এইরকম দৌড়াইতাছো কেন? শরীরের ব্যথা বাড়ব তো।”

রানি তুহিনের পাল্লায় পড়ে দিক দিশা হারিয়ে বসলো। সোজা গিয়ে ঢুকে পড়লো রান্নাঘরে। রান্নাঘরে ঢুকেই থম মেরে দাঁড়িয়ে গেলো। তুহিনের মা আর দাদী রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে রান্না করছেন আর গল্প করছেন।তারা এখনো রানিকে খেয়াল করেন নি।

তুহিন রানির পিছু রান্নাঘরে ঢুকে এক হাত দিয়ে আরেক হাতে চড় দিয়ে জোরে জোরে বললো –

“এসব বিষয়ে আমি কোনো ছাড় দিতাম না।ব্যথা সারাইতে হইব। বল মলম আনব নাকি ঔষধ।”

“কিসের মলম রে?”

মহিলা কন্ঠের বাজখাই আওয়াজ শুনে তুহিন ভ্যাবাচেকা খেয়ে পাশে তাকালো।দেখলো তার দাদী আর তার মা দাঁড়িয়ে আছে।তুহিনের দাদী হোসনেআরা সরু চোখে তাকিয়ে আছেন।আবারো প্রশ্ন করলেন-
“কিসের ব্যথা?হ্যা?”

তুহিন অস্বস্তি নিয়ে একবার তার মায়ের দিকে আরেকবার দাদীর দিকে তাকালো।মা আর দাদীকে সে এখানে আশা করে নি। রানি লজ্জায় এক হাতে ঘোমটা হাত দিয়ে আঁকড়ে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। তুহিন তোতলিয়ে বললো-

“ক্ক-কই, কিসের ব-ব্যথা?”

হোসনেআরা জহুরি চোখে তাকালেন।রানির দিকে তাকিয়ে চোখ উপর নীচ করলেন।তুহিনের মা তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি সামলাতে বললেন-

“আম্মা বাদ দেন। এই যা তোরা ঘরে যা।”

তুহিন সেকেন্ডের গতিতে ছিটকে বের হয়ে গেলো রান্নাঘর থেকে।সাথে সাথে আবার ফিরে এসে রানির হাত ধরে হ্যাচকা টান দিলো। রানি পড়তে পড়তে কোনোমতে তুহিনের পিছু দৌড় দিলো। হোসনেআরা এসব দেখে মুখ ভেংগিয়ে বললেন-

“শরম লজ্জা কিছুই নাই।বেহায়া!!”

_________

চারু বিছানায় হেলান দিয়ে ফোন ঘাটছে।তার চোখেমুখে দুষ্টু হাসি।একটু আগেই সে রানিকে মেসেজ পাঠিয়েছে। যদিও রানি কোনো রিপ্লাই করেনি কিন্তু তাতেও বিশেষ ক্ষতি নেই।রবিন চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। চারুর দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। চারু এখনো বিয়ের শাড়িই পড়ে আছে।গয়নাগুলো শুধু খুলে চুলটা ছেড়ে দিয়েছে।মেকাপ ও তুলে নি ভারী শাড়িও পালটায় নি।সকালে ঘুম থেকে উঠে বালিশ নিয়ে আধশোয়া হয়ে যে শুয়েছে আর উঠার নামগন্ধ নেই।

রবিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আরেকবার চারুর দিকে তাকালো।ফুলে ফুলে সাজানো বিছানায় এক লাল টুকটুকে মেয়ে বসে আছে।দৃশ্যটা খুব মনোরম।যেকোনো পুরুষের হৃদয় থামিয়ে দিতে যথেষ্ট। পুরুষরা বোধহয় এমন দৃশ্যের সাক্ষী হতেই যুগ যুগ অপেক্ষা করে।রবিন গভীর চোখে তাকালো তার বউ এর দিকে।চুল হালকা এলোমেলো কিন্তু গোছানো।শাড়ির আঁচল কুচকে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে গত রাতে বেচারা আঁচলের জীবন নিয়ে টানাটানি হয়েছিলো।কোনো মতে সেফটিপিনের সাথে লেগে আছে।রবিন এলোমেলো চারুকেই মুগ্ধ চোখে পর্যবেক্ষণ করলো।এলোমেলো হয়ে থাকলে মেয়েদেরকে কি বেশি সুন্দর লাগে নাকি? চারু হুট করে মুখ তুলে সরাসরি আয়নায় থাকা রবিনের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো।মুহুর্তেই চোখাচোখি হলো। এহেন কান্ডে রবিন চোখ সরিয়ে নিলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। চারু ঠোঁট কামড়ে হাসলো।মনে মনে বললো “লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা?”

রবিন হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে বললো –

“অনেক বেলা হইছে এবার উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে যা।”

চারু ভ্রু কুচকালো।মোবাইলে টাইম দেখে বলল-

“মাত্র তো সাড়ে আটটা বাজে।”

রবিন চারুর দিকে ফিরে বললো-
“আর বেশি লেট কইরা বের হইলে তোর ই লজ্জায় পড়তে হইব।আর এইসব রঙ চঙ মুছে আয়।আর কখনো এইসব দিবি না।”

বলেই রবিন দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো।চারু মুখ হাত দিয়ে উঠে এসে আয়নায় দাঁড়ালো। মুখ টা এদিক ওদিক করে দেখলো।নাহ মেকাপ তো ছড়িয়ে যায় নি।ভালোই তো দেখা যায়। চারু নিজের ভারী শাড়ির দিকে তাকালো। সিদ্ধান্ত নিলো এই ঘরেই সে শাড়ি বদলাবে।এত ভারী শাড়ি ওয়াশরুমে চেঞ্জ করতে গেলে পানিতে ভিজে যাবে। সে তার বিয়ের শাড়িতে কোনো খুত লাগতে দিবে না।চারু দরজা লাগিয়ে শাড়ির পিন খুলায় মনোযোগ দিলো।

_______

রবিন ঘর থেকে বের হয়ে সিড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।ফাতেমা বেগম ব্যাগ হাতে সিড়ির দিকে আসছেন। রবিন ডেকে বলল-

“ফুপু, কই যাও?”

ফাতেমা বেগম কোনো কথা বললেন না। কঠিন মুখ করে ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে গেলো। রবিন ফাতেমা বেগমের যাওয়া দেখলো।সারাও বের হয়ে এলো। রবিনকে সামনে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। রবিন ঘাড় ঘুরিয়ে সারার দিকে ফিরল।সারাকে দেখে তার ভ্রু কুচকে গেলো। সারা নিজেকে সামলে এগিয়ে গেলো সিড়ির দিকে। রবিন সারাকে পর্যবেক্ষণ করে বলল-

“কই যাস?”

“ঢাকায়।”

“ঢাকায়?এত সকালে? আর আজকেই কেন?”

“এমনি।আসি”

“সারা”

রবিনের ডাক শুনে সারা ঘুরে তাকালো।রবিন সারার সামনে এসে দাঁড়ালো।সারা নিচ দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রবিন স্নেহের সাথে সারার মাথায় হাত দিলো।রবিনের হাতের ছোয়া পেয়ে সারার বাঁধ ভেংগে গেলো।চোখ উপচে পানি পড়তে চাইলো।রবিন কোমল গলায় বলল-

” তোর মন ভাংগার ক্ষতিপূরণ আমি দিতে পারব না কিন্তু তোর জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করতে পারব। অনেক ভাল কাওকে তোর জীবনে তুই পাবি ইন শা আল্লাহ।”

সারা মুখ তুলে তাকালো।ছল ছল বেদনাবিধুর চোখে
রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল-

“আমার জীবনের সেই ভালো মানুষটা তুমি কেন হলে না রবিন ভাই?”

রবিন এই কথা শুনে হাত সরিয়ে নিলো। সারার চোখ বেয়ে ঢল নামলো।নিজেকে আটকালো না। বললো –

“তোমার হৃদয়ে আমি কেন থাকলাম না? যদি নাই ই ভালোবাসবে তাহলে আমার অনুভূতির কারন কেন হয়েছিলে?আমার প্রেম প্রার্থনা যদি নাই ই মঞ্জুর করবে তবে আমার আরাধ্য কেন হয়েছিলে? ”

রবিন নিচের দিকে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে আবার খুললো।সারার দিকে তাকিয়ে বললো-

“সব প্রার্থনা মঞ্জুর হইতে নাই।কিছু জিনিস ধরা ছোয়ার বাইরেই সুন্দর। আশা করব এইসবের জন্য তুই চারুরে দোষী করবি না। ও অনেক চঞ্চল কিন্তু সহজ সরল। ওর উপর রাগ করিস না।সাবধানে যাইস।”

রবিন সারাকে পাশ কাটিয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে গেলো।সারা রবিনের যাওয়ার দিক তাকিয়ে হাসলো।শেষ সময়েও চারুর জন্য চিন্তা।পাছে সারা অভিশাপ না দিয়ে দেয় চারুকে এজন্য এত চিন্তা। এত প্রেম?সারা বুক চেপে ধরলো।ওর বুকেও তো প্রেমের সমুদ্র। যেই সমুদ্রে রবিনের নামে ঢেউ উঠে।এখন এই সমুদ্র সে শুকাবে কেমন করে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here