আগস্টের প্রথম দিন।তপ্ত রোদ,আগুনঝরা গরম।পরিষ্কার নীল আকাশ।সেই আকাশে সাদা তুলোর মত মেঘ লেপ্টে আছে,তাকানো যায় না সূর্যের দাপটে, চোখে লাগে। রোদ যেন ঝলসে দিবে নরম গা। সেই রোদে দাঁড়িয়ে আছে ১৬ বছরের কিশোরী । এই আগুন রোদ যেন তাকে ছুতে পারছে না। মুখ লাল হয়ে আছে রোদের তাপে,ঘাম জমেছে মুখে, শরির থেকে টুপটুপ করে ঘাম ঝরছে তার। কিন্তু তাতেও তার কোনো বিকার নেই।সে নির্বাক তাকিয়ে আছে মাঠের দিকে। সেখানে কতগুলো ছোট ছোট ছেলে খেলছে। খেলছে বললে ভুল হবে রীতিমতো লাফালাফি করছে তারা। মেয়েটি বুঝে পেল না এই ভরদুপুরে এইভাবে লাফাচ্ছে কেন এরা।সে নাহয় পরিস্থিতির চাপে পড়ে দাড়িয়েছে এইখানে কিন্তু এরা কিসের জন্য এইভাবে রোদে তপ্ত হচ্ছে। এদের কি কষ্ট হচ্ছে না। পাশেই জংগল আছে, মেয়েটির একবার ইচ্ছে হল জংগলের ছায়ায় দাঁড়াবে। কিন্তু অই জংগলের কাছে যাওয়ার সাহস হল না তার। সে শুনেছে এই জংগলে জ্বিন আছে। পাশের বাড়ির এক মেয়ে এখানে এসেছিল লাকড়ি নিতে তারপরেই তাকে জ্বিনে ধরেছে।
সে ভয়ে ভয়ে একবার জংগলের দিক তাকাল। গাছ পালার ফাক ফোকরে ঘন কালো ছায়া দেখে কেপে উঠল। তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিল কিন্তু তারপরও ভয় কমল না। মনে হল এই বুঝি ছায়ার ভেতর থেকে কেউ এসে তার ঘাড়ে চেপে বসবে। সে আলগোছে আরেক টু দূরে সরে আসল। কড়া রোদেই দাঁড়িয়ে থাকল ঠায়। বিপদে পড়েছে বলেই সে এখানে এসে লুকিয়েছে নইলে সে এই জংগলের আশে পাশেও আসত না।
ভাবনার মাঝেই সে বাইকের শব্দ শুনলো। এখানে বাইক আসল কেন? এখানে ত সব ক্ষেত,চলাচলের রাস্তা নেই। তবে? পেছনে তাকালো সে। তাকাতেই চোখ দুটি বড় বড় হয়ে গেল। ক্ষেতের মধ্য দিয়েই জংগলের পাশ ঘেঁষে একটি কাল বাইক এগিয়ে আসছে। সেই বাইকের চালক এক শ্যামবর্ণ যুবক। দূর থেকে তার ঘর্মাক্ত মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে বেশ বিরক্ত। মেয়েটি বিস্ময় নিয়ে তাকালো। এই ছেলে এইদিকে আসছে কেন? সে ত এই ছেলেকে এড়াতেই এই ভর দুপুরে মাঠের এইখানে রোদের মাঝে এসে দাড়িয়েছে। এই ছেলে এত তাড়াতাড়ি তাকে খুজে পেল কেমন করে।
বাইক এসে কাছাকাছি থামল। বাইকে বসা শ্যামবর্ণ ছেলেটি বুকের সাথে কনুই ভাজ করে তাকিয়ে থেকে ঠায় বসে রইল। নামল না। সে দৃড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সাম্নের কিশোরীর দিকে। মেয়েটি আর চোখ তুলে তাকাল না। এই চোখে তাকানোর সাহস তার নেই।। সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ছেলেটির যেন আর এই নীরবতা সহ্য হল না। এইভাবে আগুন গরম রোদে সে অনেক্ষন যাবত এই মেয়েকে খুঁজেছে। অবশেষে এসে এই জায়গার সন্ধান পেল। সে ক্লান্ত অনেক এই রোদে খুজতে গিয়ে। ঘেমে নেয়ে একাকার। সে বাজখাই গলায় হুংকার ছাড়ল-
“কি রে! এইভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
মেয়েটি কি বলবে? তার মুখে কিছু আসছে না। সে যেই কাজ করেছে এর পরে আজ যে তার কপালে দুঃখ আছে এটা সে ঢের জানে। তাই সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করল। ছেলেটি আবারো বলল-
“কথা কানে যায় না??কি বলি শুনতে পাস না?”
ছেলেটি এইবার বাইক থেকে নেমে সামনে এসে দাড়াল। তার আকাশী রঙের শার্ট ঘামে লেপ্টে আছে তার শ্যামবর্ণ এর সুঠাম শরিরে। চুলের ঘাম কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে গলা ছাড়িয়ে শার্টের ভিতর হারিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি আড়চোখে সেই ঘামের চলাচল দেখল। ছেলেটা ঘর্মাক্ত কপাল থেকে দুই আংগুলের সাহায্যে ঘাম ঝাড়ল। তারপর দুই হাত কোমড়ে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছেড়ে মেয়েটির দিকে বক্র দৃষ্টি ফেলল।
“চারু দেখ, এইবার তুই মার খাবি। এই ভরদুপুরে কোনো ঝামেলা চাই না আমি।”
মেয়েটি এইবার নড়েচড়ে দাড়াল।কথা বলবে সে এইবার। নয়ত এইখানে মেরে টেরে দিলে তার মান সম্মান কি থাকবে নাকি? ছোট ছেলেগুলো বাইকের আওয়াজ শুনে এদিকেই দেখছে। সে মিন মিন করে বলল-
“আমি কিছু করি নাই রবিন ভাই।”
“তাই? কিছু করস নাই? তেইলে বাড়ি থেকে পালিয়েছিস কেন?”
মেয়েটির যেন দম আটকে আসল। কি বলবে এইবার?ছেলেটি এইবার অধৈর্য হল। কিন্তু মেজাজ হারাল না।সে জানে মেজাজ হারিয়ে লাভ নেই। এই মেয়েকে তার চিনা আছে। সে চোখ বুঝে শান্ত হল। নরম করল কন্ঠ। কোমড় থেকে হাত নামিয়ে ফোন বের করে কানে ধরে পর পর বলল –
“বাইকে উঠ।বাড়ি চল।মামি তরে খুজে।”
চারু তড়াক করে দূরে সরে গেল।দুপাশে মাথা নেড়ে বলল-“আমি যাব না রবিন ভাই। মা মারব।”
রবিন কি বলবে বুঝে পেল না।এই মেয়ে মারের ভয় পাচ্ছে! সে কাউকে ফোন করে বলল-
“হ্যা, পেয়েছি। আসছি।
বলে সে কান থেকে ফোন নামাল। সে চারুর দিকে বুঝানোর সুরে বলল –
“আমি থাকব তখন।মামি কিছু বলবে না চল।”
চারু কিছুটা ভরসা পেলেও বিশ্বাস করল না পুরোপুরি। সে জানে এই শ্যামপুরুষ তাকে নামিয়ে রেখেই বাইকে টান দিবে। তার এত সময় নেই চারুর জন্য। চারু জানের মায়া ত্যাগ করেই বাইকের দিকে এগুলো। এম্নিতেও সে সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকতে পারবে না। দিনের বেলা টা কাটালেও রাতে কই থাকবে সে। বাপ- চাচা রা জানতে পারলে তার খবর আছে। তাই তারা জানার আগেই বাড়িতে চলে যাওয়াই উত্তম।
–
–
বাড়ির সামনে এসে বাইক থামাল রবিন। এইটা তার মামাবাড়ি। তার তিন মামা। তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন তার মা। তিন ভাইয়ের ই বড় তার মা। এই বাড়ির একমাত্র ভাগ্নে সে। সে চারুর হাত ধরে বাড়িতে ঢুকল। চারু তার মেঝ মামার মেয়ে। উঠোনে ঢুকতেই দেখল তার মেঝ মামী রাজিয়া বেগম ঝাড়ু হাতে দাঁড়িয়ে আছেন । তিনি ঘর ঝাড় দিচ্ছিলেন, বাইকের শব্দ পেয়ে উঠানে এসেছেন। মেয়েকে দেখেই তার রাগ তরতর করে বাড়ল। অনেকটা চিল্লানোর মত করে বলল-
“আসছস বেয়াদব!এত বড় কান্ড ঘটায়া আবার বাড়ি ছাইড়া পলাইছস।আয় তুই আজকে!”
চারুর যেন ভয়ে আত্না উড়ে গেল।সে ভয়ে রবিনের পিছনে গিয়ে লুকালো। তার আশা আছে তার রবিন ভাই তাকে বাঁচাবে। রবিন ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে চারুকে দেখল। মেয়েটা তার দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে আছে। রবিন শ্বাস ফেলে রাজিয়া বেগমের দিক ফিরল। তত ক্ষনে রাজিয়া বেগম তাদের কাছে চলে এসেছেন। চারুকে এক প্রকার টেনে সামনে আনলেন। চারু ভয়ের চোটে রবিনের হাত আঁকড়ে ধরল। কিন্তু তাতেও হল না তার মা ঠিক ই তাকে তার সামনে দাড় করালেন। চারু তাও রবিনের শার্টের হাতা টেনে ধরে রাখল।
রবিন এক পলক তার হাতের দিকে তাকাল। তারপর মামিকে বুঝানোর জন্য কিছু বলবে তার আগেই রাজিয়া বেগম বল্লেন-
“তুই জানস ও কি করসে!!”
রবিন জানে না এখনো ঘটনা কি। সে ত তার বাড়িতে কাজ করছিল। তখনি তার মেজ মামি কল দিয়ে জানাল সকাল থেকে চারুকে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা ভেবেছিল চারু হয়ত কোনো বান্ধবির বাড়ি গেছে। কিন্তু এর পরেও যখন সকাল কেটে দুপুর হল তখন তাদের টনক নড়ল। বাড়ির কর্তাদের জানালে বড় কোনো ঘটনা ঘটবে ভেবে আগে রবিন কে বলল চারু কে খুজতে। রবিন এই ঘটনা শুনে সব কাজ ছেড়ে ছুড়ে বের হয়েছিল খুজতে। তার জান ছুটে গিয়েছিল এই খবরে। গ্রামে তাদের শত্রুর অভাব নেই, এই অবস্থায় বাড়ির কিশোরী মেয়ে লাপাত্তা। বিভিন্ন কুচিন্তা এসেছিল তার মনে। অনেক জায়গা খুজেও যখন পায় নি তখন এক টা ছোট ছেলে তাকে তথ্য দিল চারুকে জংগলের পাশে মাঠের দিকে যেতে দেখেছে। তখনি রবিন বাইক ছুটিয়ে ধরে এনেছে তাকে। সে জিজ্ঞেস করল রাজিয়া বেগম কে-
“কি করসে মামি?”
রাজিয়া বেগম চারুর দিক তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করলেন। তারপর রাগ ঝেড়ে বললেন-
“ফেল করসে পরিক্ষায়!”
রবিন যেন হতভম্ব হয়ে গেল।ফেল করেছে মানে? ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল হয়ে ফেল করেছে চারু? এত ভাল ছাত্রী সে। কিছুতেই ত হিসাব মিলছে না। সে ঠান্ডা চোখে কিন্তু শক্ত মুখে চারুর দিকে তাকাল। সে অবাক হল ভিতরে ভিতরে। কিন্তু এতেও যেন হল না। তাকে আরো অবাক করে দিয়ে রাজিয়া বেগম রাগী কন্ঠে বলে উঠল-
“শুধু এইটাই না রে বাপ।এই বেয়াদব মাইয়া প্রেম করতাছে!!”
“শুধু এইটাই না রে বাপ।এই বেয়াদব মাইয়া প্রেম করতাছে!!”
রবিনের অবাকের পাল্লা যেন কয়েক ডিগ্রি উপরে উঠে গেল। সে এসব কি শুনছে? এই দুই আংগুলের মেয়ে প্রেম করছে? সে ভ্রু কুচকে ক্ষিপ্ত চোখে চারুর দিকে তাকাল।
চারু সেই যে মাথা নিচে দিয়েছে আর তুলছে না। সে মনে মনে দোয়া করছে তার উপরে যেন বাজ পড়ে আর সে যেন ভস্ম হয়ে যায়। আর নয়ত কোনো এক উড়ন্ত দানব এসে তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাক, তার আপত্তি নেই।
রবিন প্রচন্ড রেগে গেল। সৈয়দ বাড়ির মেয়ে হয়ে প্রেম করছে চারু? সে আগুন গলায় জিজ্ঞেস করল-
“কি রে?এসব সত্যি?”
চারুর বলার আগেই বড় মামার মেয়ে ফারহানা এগিয়ে এসে বলল-
“হ্যা রবিন ভাই, সত্যিই।এই প্রেমের লাইগাই সে ফেল করছে। প্রমান ও আছে। ”
প্রমান স্বরূপ সে রবিনের দিকে কিছু কাগজ এগিয়ে দিল।এগুলো সে চারুর ডায়রির চিপায় আজ সকালেই পেয়েছে। চারুর প্রেমিকের দেয়া প্রেমপত্র।
রাজিয়া বেগম হায় হুতাশ করে বললেন
“মান সম্মান আর কিছু নাই রে বাপ। ওর আব্বায় জানলে আমারে কাইটা ফেলব। সৈয়দ বাড়ির মাইয়া হইয়া পরিক্ষায় ফেল করল। সাথে করল প্রেম।”
রবিন কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল” ছেলেটা কে?”
#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#সূচনা_পর্ব