#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-১৭
সজোরে একটা চড় পড়লো তুহিনের গালে। তুহিন কিছুটা হেলে গেলো। জায়গা থেকে খানিক সরে পড়লো। তারপর আবারো সোজা হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো। জামশেদ মজুমদার রাগে ফুসছেন। তিনি পিছন ফিরে লম্বা শ্বাস নিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হলো না।রাগ আরো দ্বিগুন হলো। তিনি আবারো তেড়ে আসলেন কিন্তু আর চড় বসালেন না ছেলের গায়ে। কিছুক্ষন আগুন গরম চোখে চেয়ে থেকে কাঠের নকশা করা রাজকীয় চেয়ারে গিয়ে বসলেন। তার সাম্নের চেয়ারে বসে আছে সবুর আলী। তার মুখে প্রসন্নতা ছেয়ে আছে। তুহিনকে জামশেদ মজুমদার চড় দেয়ায় তার গায়ের জ্বালা কিছুটা হলেও মিটেছে।
জামশেদ মজুমদার ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললেন-
“আমার ছেলে হইয়া তুই রবিন্যারে সাহায্য করলি কোন সাহসে? জামশেদ মজুমদারের পোলা হইয়া তুই শত্রুরে সাহায্য করলি?”
তুহিন কোনো কথা বলল না। সে নীরব ভূমিকা পালন করলো। জামশেদ মজুমদার সাড়া না পেয়ে দ্বিগুণ জোরে গলার স্বর উঁচিয়ে বললেন-
“কথা কস না কেন হারাম*জাদা? তোর একটা ভুলের লাইগ্যা রাজনীতির ময়দানে আমার কত বড় ক্ষতি হইছে জানোস?”
তুহিন মাটি থেকে চোখ তুলে চাইলো। শক্ত কন্ঠে উত্তর করলো-
“আপনি আজ যেইটা করলেন এইটা রাজনীতি না আব্বা। এইটা নোংরামি। আপনি রবিন রে একা পাইয়া আক্রমণ করছেন পিছন থাইকা।এমনকি ওদের মেয়েদের ও রেহাই দেন নাই। এইটা কাপুরুষের কাজ।”
জামশেদ মজুমদার ছেলের দিকে গরম চোখে চাইলেন। হুংকার দিয়ে বললেন-
“কি কইলি?”
তারপর ক্ষিপ্র বেগে উঠে দাঁড়ালেন। তুহিনের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো –
“বাপের দলে যোগ দেস না, রাজনীতির কোনো খবর রাখস আর এখন আইছস আমারে রাজনীতি শিখাইতে। বাপ রে কস কাপুরুষ । হারাম*জাদা”
বলেই তুহিনের গালে অনেক জোরে একটা চড় বসালেন। আগের চড়ের রেশ ই এখনো তুহিনের কাটে নি। তার উপর আবারো এক ই গালে চড় পড়াতে তুহিন টাল সামলাতে না পেরে এক হাঁটু গেঁড়ে মাটিতে বসে পড়লো।পড়তে পড়তে চেয়ারের হাতল ধরে নিজেকে সামলালো।
ছেলের পড়ে যাওয়া দেখে আমেনা বেগম পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে মুখে আঁচল চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। একটা মাত্র ছেলে তার। এত সাধনার পর আল্লাহ তাকে পুত্রসন্তানের মা বানিয়েছেন। সেই ছেলেকে এভাবে আঘাত পেতে দেখে কষ্টে কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে তার।
তুহিন চেয়ার ধরে নিজেকে সামলালো। তার ঠোঁট কেটে গেছে। মুখের ভেতর নোনতা রক্তের স্বাদ পাচ্ছে। ঠোঁটের রক্ত মুখে টেনে পাশ ফিরে “থু” শব্দ করে মাটিতে ফেললো তারপর বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়ালো। জামশেদ মজুমদারের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখলো। সেই চোখে ক্ষোভ। তুহিন আস্তে শব্দ করে ধীরে ধীরে বলল-
“এই যদি হয় আপনার রাজনীতি করার কায়দা তাইলে আমি জীবন থাকতে সেই রাজনীতিতে নাম লিখাইতাম না। রাজনীতির সিংহাসন রাজার জন্য, যে বুকে বল নিয়ে সামনাসামনি লড়াই করব, পিছন থেকে আঘাত করা রাজনীতির রাজার ধর্ম না।”
তারপর সবুর আলীর দিকে এক পলক চেয়ে আবারো জামশেদ মজুমদারের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে বললো –
“আপনি কাদের কথায় এই পথে গেছেন তা আমি জানি। কিন্তু এই পথে থাকলে রাজনীতির ময়দানে আপনি বেশিদিন টিকতে পারবেন না। মজুমদার বংশের পুরুষরা কোনোদিন কাপুরুষের মতো রাজনীতি করে নাই। আমিও করতাম না।”
বলেই তুহিন হনহন করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। পথে তার মায়ের দিকে একবার আড়চোখে তাকালো। তারপর ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। আমেনা বেগম ছেলের দরজায় আঘাত করে ডাকলেন-
“তুহিন দরজা টা খোল। তোর ঠোঁট কাইটা গেছে। আমারে দেখতে দে বাপ।”
তুহিন দরজা খুললো না।দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দুই হাঁটুতে মাথা চেপে বসে রইলো। সে আজ গিয়েছিলো রানির সাথে একটু দুষ্টুমি করতে, রবিনকে এক্টু বিরক্ত করতে। সবার সাথে একটু সুন্দর সময় কাটাতে চেয়েছিলো সে। কিন্তু তার বদলে একটা বিভীষিকাময় স্মৃতি নিয়ে ফিরে গেলো সবাই। এই স্মৃতির রূপকার তার বাবা। তুহিন আর কিছু ভাবতে পারলো না দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো।
_________
দিনের আলো চোখে পড়তেই চারুর চোখ মুখ কুচকে গেলো। অল্প অল্প করে তাকালো সে। দেখলো বাতাসে জানালার পর্দা সরে যাওয়ায় রোদ এসে তার চোখে পড়েছে। সে বেশ বিরক্ত হলো। আরো একটু চোখ খুলে আশেপাশে দেখলো। এটাত তার নিজের ঘর না।কেমন জানি চেনা চেনা লাগছে তাও চিনতে পারছে না। পরক্ষনেই মনে পড়লো এটা রানির ঘর। কিন্তু সে এত সকালে এখানে কি করছে? চারদিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল না দুপুরের কাছাকাছি সময়। এ সময় সে ওদের বাড়ি ছেড়ে রানিদের বাড়িতে কি করছে? তারপর মনে পড়লো আজ দুপুরে তো মেলায় যাওয়ার কথা। রবিন ভাই আর রানি কি চলে এসেছে? মেলার কথা মনে হতেই চারুর গতকাল মেলার সব ঘটনা মনে পড়ে গেলো। প্রতিটা ঘটনা এক এক করে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। রবিনের গুলি খাওয়া, চারু আর রানির হাত ছুটে যাওয়া, রবিন আর তার জংগলে আশ্রয় নেয়া সব মনে পড়ে গেলো। চারু তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসলো। রাজিয়া বেগম চেয়ারে বসে ডাক্তারের দেয়া ঔষধগুলো উলটে পালটে দেখছিলেন, চারুকে বসতে দেখে এগিয়ে এসে চারুকে ধরলেন। ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন-
“চারু? শরীর খারাপ লাগতাছে?”
রানি আলমারি থেকে কাপড় নামাচ্ছিলো রাজিয়া বেগমের কথা শুনে চারুর দিকে ফিরলো। পরক্ষনেই দরজা খুলে বাইরে গেলো সবাইকে জানাতে।
চারু তার মায়ের পানে চেয়ে মৃদু দরদভরা কন্ঠে ডাকলো-
“আম্মা!”
রাজিয়া বেগম কেঁদে দিলেন। তার মনে হলো কতদিন পর মেয়ের মুখ থেকে “আম্মা” ডাক শুনলেন।
দরজা খুলে একে একে সবাই ঢুকলো ঘরে।কামরুজ্জামান মেয়ের পাশে বসে মেয়ের হাত ধরে কেঁদে দিলেন। ফারহানা রনি সহ বাড়ির আর সবাই এসে চারুর আশেপাশে ভীড় জমালো। সবার চোখেই অল্প বিস্তর পানি। গত রাতের ঘটনার পর সৈয়দ বাড়ির সবাই ই এই বাড়িতে থেকে গেছে।
আস্তে আস্তে সবাই ই ঘর ছেড়ে চলে গেলো।রাজিয়া বেগম মেয়ের পাশে বসে মেয়েকে অল্প বিস্তর খাইয়ে দিলেন । চারু তার হাতের স্যালাইনের দিকে তাকিয়ে বললো-
“আম্মা, রবিন ভাই কেমন আছে?”
“ভালো আছে রবিন। বাড়িতেই আছে। আল্লাহ এই যাত্রায় পোলাটার প্রাণ ভিক্ষা দিছে। তোর ফুপি গত রাত থাইকা এক বার ও ছেলের পাশ থাইকা উঠে নাই। তোর ফুপাও বিছানায় পইড়া গেছে।”
“বড় বাবা আর বড় চাচী কই আম্মা?”
রাজিয়া বেগম প্লেটে হাত ধুয়ে মেয়ের মুখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন-
“ভাইজান তোর চিন্তায় পইড়া অনেক অসুস্থ হইয়া গেছে।উনার প্রেশার লো । দু তলার ঘরে আছে ভাইজান। তোর বড় চাচীও ওইনেই। তুই যখন অজ্ঞান ছিলি তখন আপা তোর কাছে ছিলো। তুই একটু সুস্থ হ তারপর ভাইজানের কাছে নিয়া যাইবাম তোরে।”
বলেই রাজিয়া বেগম প্লেট গ্লাস নিয়ে উঠে গেলেন। চারু আধশোয়া থেকে সোজা হয়ে বসলো। হাতে লাগানো স্যালাইনের সুই টা আস্তে টান দিয়ে খুলে ফেললো।তারপর পা রাখলো ফ্লোরে। প্রথম অবস্থায় দাঁড়াতে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে বসে পড়লো বিছানায়। কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে ওভাবেই বসে রইলো। তারপর আবারো আস্তে আস্তে উঠে দাড়ালো। ব্যান্ডেজ করা জায়গা গুলোতে টান পড়তেই যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো। তারপর দেয়াল ধরে ধরে ঘর থেকে বের হলো। বাইরে তেমন কেউ নেই। তার মা রান্না ঘরে । বাকি সবাই বসার ঘরে আলাপে মগ্ন। সে আস্তে করে সিড়ি বেয়ে দোতলায় আসলো। সিড়ির ডান পাশে রবিনের ঘরটার দিকে তাকালো। পরে বামপাশ হয়ে অন্য ঘর গুলোতে উঁকি দিতে থাকল। শেষের ঘরটার সামনে এসে থামল। এই ঘরটায় তার বড় বাবা শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। পাশেই তার বড় চাচী বসে হাতের আংগুল টেনে দিচ্ছেন। চারু পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসলো। তারপর আস্তে আস্তে পা টেনে টেনে এগিয়ে গেলো ডান পাশের ঘরটার দিকে। দরজা ঠেলে সে ধীর পায়ে ভিতরে ঢুকলো।
রুবিনা বেগম ফ্লোরে বসে বিছানায় মাথা রেখে শুয়ে আছেন। ঘুমাচ্ছেন কিনা বুঝা গেলো না। রবিনের গুলি লাগা হাত টা আলতো করে ধরে রেখেছেন। চারু আর দূর্বল শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না ।সে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসলো। কারো বসার আভাস পেয়ে রুবিনা মাথা তুলে তাকালেন। চারুকে দেখে কিছুক্ষন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। তার চোখ অশ্রুতে ভরে গেলো। কান্নাভেজা কন্ঠে জানতে চাইলেন-
“কখন উঠছস? শরির ঠিক হইছে?”
চারু মাথা নেড়ে জানালো সে ঠিক আছে। রুবিনা বেগম কিছুক্ষন চারুর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর রবিনের দিকে এক পলক চেয়ে চারুর দিকে ফিরে বললেন-
“রবিনের কাছে বোস। আমি একটু তোর ফুপারে দেইখা আসি। আর একা একা নিচে নামিস না। আমি রানিরে পাঠাইতাছি।”
বলেই রুবিনা বেগম ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। চারু পুরো ঘরে নজর বুলালো। তারপর রবিনের দিকে তাকালো। খালি গায়ে রবিনকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বুক পর্যন্ত কাঁথা টেনে দেয়া হয়েছে। হাতে স্যালাইন লাগানো, রক্তের ব্যাগ থেকে টুপটুপ করে রক্ত নল বেয়ে রবিনের শরীরে প্রবেশ করছে। গুলি লাগা হাত টা ব্যান্ডেজ করা। নিরাপত্তার জন্য রবিনকে হাসপাতালে নেয়া হয় নি। বাড়িতেই প্রয়োজনীয় সব নিয়ে এসে ডাক্তার ডেকে চিকিৎসা করা হয়েছে।
চারু রবিনের মুখের দিকে তাকালো। কি নিষ্পাপ দেখতে! কে বলে দেখতে কালো ছেলেরা সুন্দর না। এই যে এই শ্যামবর্নের পুরুষকে আহত অবস্থায়ও কত সুদর্শন লাগছে। চারুর জংগলের চিত্রটা চোখের সামনে ভাসলো। রবিন গাছের সাথে হেলান দিয়ে তাকে একাই দৌড়ে পালাতে বলছিল। চারু জোর করে রবিনকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে পথ চলেছে। পথে রবিন কে নিয়ে যে সে কত বার পড়ে গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে রবিন দূর্বল গলায় চারুর কাছে পানি চেয়েছিলো। চারু আশেপাশে কোথাও একটু খাবার পানি পায় নি। অসহায় হয়েই রবিনকে নিয়ে সে পথ চলেছে।
কিছুক্ষণ রবিনের পানে চেয়ে থাকলো চারু। তারপর চোখ সরিয়ে নিলো। আস্তে করে উঠে ধীরে ধীরে দরজার কাছে এগিয়ে গেলো। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার আগেই পিছন থেকে দূর্বল ভাংগা কন্ঠের ফিসফিসানি আওয়াজ ভেসে আসল-
” চারু।”
চলবে