#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-১৮
“চারু”
ভাংগা ফিসফিসানি কন্ঠে নিজের নাম শুনে চারু পিছনে ফিরে চাইলো। রবিনের আধখোলা চোখের সংগে চোখাচোখি হলো। রবিন চোখ বন্ধ করে একটা ঢোক গিললো তারপর আবারো চোখ টেনে তাকালো। আবারো ফিসফিসানি কন্ঠে ডাকলো-
“চারু?”
চারু পা টেনে টেনে এক প্রকার ছুটে গেলো রবিনের দিকে। রবিনের পাশে বসে রবিনের দিকে ঝুঁকে পড়লো।ব্যস্ত কন্ঠে বলল-
” রবিন ভাই? তোমার জ্ঞান ফিরছে? আমারে চিনতে পারতাছো? আমি চারু।”
রবিন কিছুক্ষন আধখোলা চোখে তাকিয়ে রইলো। সে চারুকে চিনতে না পারলে নাম ধরে ডাকলো কিভাবে?এই মেয়ের বুদ্ধি বরাবর ই তাকে অবাক করে। চারু আরো ঝুঁকে পড়লো। জিজ্ঞেস করলো –
“রবিন ভাই? আমার কথা শুনতে পারতাছো?”
রবিন আগের মতো ক্লান্ত ফিসফিস কন্ঠে বলল-
“সরা।”
“হু?”
“সরায়ায়ায়া।”
“কি সরাব?”
“তোর চুল।”
চারু দেখলো ঝুঁকে থাকার কারনে রবিনের নাকে মুখে তার খোলা চুলের কিছু গিয়ে পড়েছে। সে তৎক্ষনাৎ সোজা হয়ে বসলো। রবিন ক্লান্ত কন্ঠে বললো-
“আমারে ধইরা তোল।”
চারু পিটপিট করে চেয়ে রইলো। রবিন আরেকবার তাড়া দিলো-
“আমারে ধইরা তোল চারু। শুইয়া থাকতে ভাল লাগতাছে না।”
চারু এগিয়ে এসে রবিনকে ধরে তোলার চেষ্টা করলো। রবিন একটু উঠলো কিন্তু অসাবধানতাবশত রবিনের গুলি লাগা হাতে চাপ পড়লো। রবিন যন্ত্রণায় শব্দ করে গুঙিয়ে উঠলো। চারু রবিনকে ছেড়ে দিয়ে হাত দুটো মুঠো করে বুকের কাছে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। সে অপরাধীর চোখে তাকিয়ে রইল রবিনের দিকে। রবিন চোখ মুখ কু্ঁচকে দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করে নিলো। তারপর চোখ খুলে মুখ গোল করে শ্বাস ফেললো। চারুর দিকে তাকিয়ে বলল-
“এই পাশে ধইরা তোল।”
চারু ভয়ার্ত কন্ঠে মাথা দুই পাশে নেড়ে বলল-
“আমার ভয় লাগে রবিন ভাই। আবার যদি ব্যথা পাও তুমি।”
রবিন অধৈর্য গলায় বলল-
“ব্যথা লাগবে না। এইদিকে আয়। এইপাশে ধইরা তোল।”
চারু আস্তে আস্তে রবিনকে ধরলো তারপর ধীরে ধীরে রবিনকে তুললো। রবিন বললো –
“পিঠের পিছনে একটা বালিশ দে।”
চারু পাশ থেকে একটা বালিশ নিয়ে রবিনের পিঠের পিছনে দিলো। রবিন বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাস ফেললো। চোখ খুলে চারুর দিকে তাকিয়ে বলল-
“আলমারি থেকে একটা শার্ট বের করে আন।”
চারুর এতক্ষনে রবিনের খালি গায়ের দিকে চোখ পড়লো। সে খুব লজ্জা পেলো।লজ্জা মিশ্রিত বদনে সে পা টেনে টেনে আলমারির কাছে গেলো। আলমারি খুলে সে বিপাকে পড়ে গেলো। কোন শার্ট টা নিবে বুঝতে পারলো না। সে এক বার রবিনের দিকে তাকালো। পরে আবার শার্ট গুলোর দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগলো কোন শার্টটায় রবিনকে ভাল মানাবে। রবিন ভ্রু কুচকে চারুর দিকে তাকালো। চারুর আলমারি খুলে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে খুব ই বিরক্ত হলো। দূর্বল গলায় একটা ধমক লাগালো।
” খাম্বার মতো দাঁড়ায় না থাইকা একটা শার্ট আন।”
চারু ধমক শুনে কয়েকটা শার্ট ঘেটে একটা ডার্ক কালার শার্ট নিয়ে রবিনের কাছে আসলো। রবিন উঠে বসে বললো-
“নে শার্টটা পড়া।”
চারু বোকার মত বললো –
“আমি?”
রবিন একটা বিরক্তির চাউনি দিয়ে বলল-
” তুই ছাড়া এইনে আর কেউ আছে নাকি? থাকলে তারে ডাক।”
চারু দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো আর কেউ নেই। রবিন সোজা হয়ে বসে গুলি লাগা হাত টা একটু উঁচু করে ধরলো। হালকা ব্যথা অনুভব করলো তাতে। চারু এগিয়ে এসে আস্তে করে শার্টের ডান হাতা গলিয়ে দিলো তারপর রবিন নিজেই বাম হাত গলিয়ে শার্ট পড়ে নিলো। তারপর চারুর দিকে চেয়ে বললো-
“বস।”
চারু অস্বস্তি নিয়ে বিছানার এক কোণায় বসলো। রবিনকে খালি গায়ে শার্ট পড়াতে গিয়ে তার অনেক লজ্জা লেগেছে। সেই লজ্জা এখনো কাটে নি। রবিন খাটে হেলান দিয়ে নরম স্বরে বলল-
“অসুস্থ শরির নিয়ে উপরে আসছস কেন?”
“বড় বাবার ঘরে আসছিলাম। তখন তোমার ঘরে আসলাম।ফুপি আমারে তোমার কাছে থাকতে বইলা গেছে।”
রুবিনা বেগমের কথা মনে হতেই চারু তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেলো। তারপর ব্যস্ত হয়ে বলল-
“ইয়া আল্লাহ!! তোমার যে জ্ঞান ফিরছে এইটা তো ফুপিরে বললাম ই না এখনো। যাই বইলা আসি।”
বলেই চারু পা বাড়াতে নিবে তখনি আবার রবিন ধমক দিলো-
“অই দাঁড়া। চুপচাপ বস এইনে।”
চারু আবারো বসে পড়লো। রবিন গরম সুরে বললো-
“এত ছুটাছুটি করস কেন? আমি তোর মতো দূর্বল না।আমার রাতেই জ্ঞান ফিরেছিলো। বাড়ির সবার সাথেই আমার দেখা হইছে। আমারে ঘুমের ওষুধ দেয়া হইছিলো তাই এতক্ষন ঘুমাইছি।”
চারু কিছুটা বিস্মিত হলো।এই লোক গুলি খেয়ে গত রাতেই জ্ঞান ফিরে পেয়েছিলো। আর সে পুরো একদিন অজ্ঞান ছিলো। রবিন ক্লান্ত গলায় আবারো বলল-
” জংগলে আমি তোরে দৌড় দিতে কইছিলাম, তুই দৌড় না দিয়া রাতের আঁধারে আমারে নিয়া টানা হিচড়া করলি। ভয় লাগে নাই? এত সাহস কই পাস তুই?”
চারু চুপ থাকলো। ঠোঁট কামড়ে ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে নখ দিয়ে ফ্লোর ঘষতে লাগলো।
“দলের লোকেরা যদি ঠিক সময় আইসা ছেলেগুলারে না ধরতো তাইলে ছেলেগুলা ঠিক ই আমাদের খুইজা বাইর করতো। এমন হইলে তুই আর আমি এতক্ষনে গুম হইয়া যাইতাম। আর নয়ত আমারে গুম কইরা তোরে ধইরা নিয়া যাইতো। তোর অবস্থা কি হইত এইটা তোর ছোট মাথায় ঢুকব না। তাই এর পর থাইকা বড়দের কথার বাইরে কাজ করবি না।মনে থাকব?”
চারু ঠোঁট কামড়ে ঠায় বসে আছে। তার বড্ড রাগ পাচ্ছে। এই ছেলেকে বাঁচানোর জন্য সে কত আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়লো কত জায়গায় চামড়া উঠে গিয়ে রক্ত বের হলো, কোথায় এই ছেলে কৃতজ্ঞতাবশত তার হাতে চুমু খাবে তা না! তাকে উপদেশ দিচ্ছে, ধমকাচ্ছে। চারু তখন এই ছেলেকে জংগলে ফেলে আসলে এখন এইভাবে উপদেশ দেয়া টা বের হয়ে যেতো।হাহ!
চারুর কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে রবিন একটা ধমক দিলো-
“কি? মনে থাকব?”
চারু মাথা কাত করে জানালো তার মনে থাকবে। তখনি রানি চারুকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকলো। ঘরে এসে তার ভাইকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে আবারো দৌড়ে সিড়ির মুখে গিয়ে তার মা কে জানিয়ে এলো। তারপর ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলো। রবিনের কি কি লাগবে না লাগবে তা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। চারু থমথমে মুখে রবিনের ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসলো। এই অকৃতজ্ঞ ছেলের কথায় তার মেজাজ গরম হয়ে গেছে। সে পা টেনে টেনে তার বড় বাবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।
সাজেদা বেগম মাত্রই ঘর থেকে বের হচ্ছিলেন চারুকে এভাবে খুড়িয়ে খুড়িয়ে আসতে দেখে তার চোখ কপালে উঠে গেলো। তিনি ছুটে এলেন চারুর কাছে। চারুর বাহু আকড়ে ধরে বললেন-
“তোর জ্ঞান ফিরল কখন? আর এইভাবে অসুস্থ শরির নিয়া হাটতাছস কেন?”
চারু তার বড় চাচীর ব্যাকুলতা দেখে হাসলো কিছুটা। সে জড়িয়ে ধরলো সাজেদা বেগমকে। তারপর বললো-
“আমার শরির ঠিক হইয়া গেছে চাচী। আমি বড় বাবারে দেখতে আইছি। ”
সাজেদা বেগম চারুকে ধরে ধরে শাহজাহান আলীর কাছে নিয়ে গেলেন। শাহজাহান আলী সবে উঠে বসে বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন।তার দূর্বলতা এখনো কাটে নি। তখনি চারুকে নিয়ে সাজেদা বেগম ঢুকলেন। শাহজাহান আলী চোখ খুলে তাকিয়ে চারুকে দেখে বিস্মিত হলেন। চারু হাসি মুখে তার বড় বাবার কাছে গিয়ে বসলো। তার বড় বাবার হাত ধরে বলল-
“তুমি ভালো আছো বড় বাবা?”
শাহজাহান আলীর হৃদয় আনন্দময় বিষাদে ছেয়ে গেলো। যে মেয়েটির দিকে তাকালে তিনি তার জনম দুঃখি মা কে দেখতে পান সেই মেয়েটিকেই গত রাতে হারাতে বসেছিলেন। তিনি হেসে দিয়ে বললেন-
“ভালো আছি মা। তোরে দেইখা আমার সব রোগ দূর হইয়া গেছে। অসুস্থ শরির নিয়া উপরে উঠছস কেন? বড় বাবারে খবর দিতি আমি চইলা যাইতাম।”
“তুমি যেমন আমারে দেইখা ভালো হইয়া গেছো আমিও তেমনি তোমারে দেইখা সুস্থ হইয়া গেছি।”
ভাতিজির ছেলেমানুষী কথায় শাহজাহান আলী হেসে দিলেন।
বিকেলের দিকে রবিন মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলো, চারুও আগের চেয়ে ভাল অনুভব করছে। সৈয়দ বাড়ির সবাই বিকেল গড়াতেই ফিরে আসলো সৈয়দ বাড়িতে। চারু বাড়ি এসেই তার ঘরে গিয়ে হাত পা মেলে শুয়ে পড়লো। শুয়ে শুয়ে সে রবিনের কথা চিন্তা করতে লাগলো। কি বজ্জাত একটা ছেলে!! কতগুলা কথা শুনালো তাকে। কই সুন্দর করে একটা ধন্যবাদ দিবে, একটু ভালমন্দ কথা বলবে, তা না!! তাকে কতগুলা ধমক দিলো, উপদেশ দিলো। চারু এক্টা মুখ ভেংচি দিলো। তারপর পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো।
________
বিকেল গড়িয়ে অনেক আগেই সাঁঝ নেমেছে ধরনীতে। রানি নিজের ঘরে এসে ঢুকলো। সে এতক্ষন রবিনের ঘরে ছিলো। গতকাল কিভাবে বাড়ি ফিরেছে, তুহিনের সাথে কিভাবে দেখা হল এসব নিয়ে রবিন তাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করেছে। এতক্ষনে রানি হাঁফ ছেড়ে বিছানায় বসলো। তুহিনের কথা মনে হলো তার। লোকটা যে তাদেরকে ভ্যানে তুলে দিয়ে গেলো পরে তার কি হলো? সে ত শুনেছে তুহিনের বাবা ই নাকি এই হামলার আদেশ দিয়েছিলো তাহলে তুহিন তাদেরকে বাঁচালো কেন।
রানি আর বেশিদূর ভাবতে পারলো না তার আগেই টুং শব্দ হল মোবাইলে। সে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল মেসেঞ্জারে কেউ মেসেজ পাঠিয়েছে। আইডির নাম দেখেই তার কপাল কু্ঁচকে গেলো। আরে এটা তো তুহিনের আইডি। রানি মেসেজটা সিন করলো। তুহিন একটা মেসেজ পাঠিয়েছে-
“মহারানি, গত কালের ঘটনাটার জন্য আমি সরি। ওই ঘটনা টা একটা দুঃস্বপ্ন মনে কইরা ভুইলা যাও।”
এর পরেই তুহিন একটা ছবি পাঠালো। ছবিটাতে কান্না কান্না ভাব করে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে সে । রানি লক্ষ্য করলো তুহিনের ঠোঁটটা কাটা। ওষুধ লাগানো হয়েছে তারপর ও হালকা রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তুহিন আরেকটা মেসেজ পাঠালো-
“দেখো তোমরারে সাহায্য করার অপরাধে আব্বা চড় দিয়া আমার ঠোঁট কাইটা দিছে। এখন আমার কি হইব? আমারে ত সবাই ঠোঁট কাটা তুহিন ডাকব। কে বিয়ে করব আমারে এই কাটা ঠোঁট নিয়া।”
রানি হেসে ফেললো তুহিনের ছেলেমানুষী মেসেজ দেখে। সাথে সাথে আরো একটা মেসেজ আসলো।সেখানে ভয়ংকর এক বার্তা লিখা-
“মহারানী, একটা চুমুর ইমোজি পাঠায়া এই ঠোঁট কাটা তুহিনের কষ্ট টা কমায়া দাও তো।”
রানির চোখ বড় বড় হয়ে গেলো মেসেজ দেখে। সে সাথে সাথে নেট কানেকশন অফ করে ফোন ছূড়ে মারলো। এই লোক তো প্রচুর বেহায়া। এইভাবে মেসেজ দিয়ে এইসব কথা বলছে। ছি! ছি! রানির কান গরম হয়ে গেলো।
চলবে