#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-২০
“হ্যালো। কে? চারু?”
চারু কোনো উত্তর করলো না। চুপ করে স্ক্রিনের দিকে চেয়ে রইলো। স্ক্রিনে থাকা মেয়েটির গলা আবার শোনা গেল-
“চারু? শুনতে পাচ্ছ? কেমন আছো? ”
চারু গোমড়া মুখে ছোট করে বলল-
“ভালো।”
চারু মেয়েটিকে চিনে। মেয়েটির নাম সারা। তার থেকে বয়সে বছর দুয়েক বড়। সারা রবিনের ফুপাতো বোন। তার মানে কি রবিন তার ফুপির বাসায়?
সারা হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠে বলল-
“অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম। তোমাকে দেখতে সুন্দর লাগছে।”
“রবিন ভাই কই?”
“রবিন ভাই তো ঘুমাচ্ছে। এই দেখো”
বলেই সারা ক্যামেরা টা রবিনের দিকে ঘুরালো। রবিনের উন্মুক্ত পিঠ ভেসে উঠলো স্ক্রিনে। সে উদোম গায়ে পিঠ পর্যন্ত কাথা টেনে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার হাতের ব্যান্ডেজ দৃশ্যমান।
চারু প্রশ্ন করল-
“রবিন ভাইয়ের ফোন তোমার কাছে ছিল?”
সারা রবিনের ফোন নিয়ে রুমের সাথের বারান্দায় এলো।তারপর বললো –
“না চারু। আমার রুমের পাশেই রবিন ভাইয়ের রুম। ফোন বাজছিলো রবিন ভাইয়ের ঘুম ভেংগে যাবে ফোনের সাউন্ডে এইজন্য আমি এসে কল ধরলাম।”
চারু আর কিছু বলার খুঁজে পেলো না। সারা জিজ্ঞেস করলো –
“এত রাতে কল দিলে। কোনো প্রয়োজন আছে কি?”
“রবিন ভাই ঠিক মতো গেছে কিনা এইটা জানার লাইগা কল দিছি।”
“রবিন ভাই ঠিকঠাক ই এসেছে। মেলার ঘটনা শুনেছি। তুমি আর রবিন ভাই নাকি হারিয়ে গিয়েছিলে। গুন্ডারা নাকি পিছু নিয়েছিলো তোমাদের। তারপর তুমিই নাকি রবিন ভাইকে কাঁধে করে নিয়ে এসেছো। তুমি অনেক সাহসী মেয়ে চারু। রবিন ভাইকে বাঁচানোর জন্য তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। ”
চারুর খুব রাগ লাগলো। সারা এমনভাবে বলছে যেন রবিন তার খুব আপন কেউ আর চারু বাইরের একটা মেয়ে সে রবিনকে বাঁচিয়েছে বলে তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। সে বিরস মুখে বলল –
“কাল সকালে রবিন ভাইরে বইলো আমি কল দিছিলাম। এখন রাখি আপু।গুড নাইট।”
“গুড নাইট চারু। আমাদের বাসায় বেড়াতে এসো কেমন।”
চারু মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে কল কেটে দিলো। তার ফুরফুরে মনটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। হাতের দিকে তাকিয়ে চুড়িগুলোকে দেখলো। খুব অস্বস্তি হলো তার। এক টানে সব গুলো চুড়ি খুলে ড্রেসিংটেবিলে এক প্রকার ছুড়ে ফেলল।তারপর শব্দ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
_______
রবিন ঘুম ঘুম চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করছে। তার ঘুম ভেংগে গেছে। কারো ডাকে ঘুম ভেংগেছে। কে ডাকছে দেখার জন্য সে তাকাতে চাইলো কিন্তু চোখের পাতা সহজে খুলছে না। সে শুনার চেষ্টা করলো কে ডাকছে। শুনতে পেলো একটা মেয়ের রিনঝিন কন্ঠ। আকুল হয়ে ডাকছে মেয়েটা তাকে
“রবিন ভাই,…. রবিন ভাই…. চোখ খুলো।”
রবিন আধো আধো চোখ খুলে তাকালো। চোখে ভাসলো চারুর মুখ। মেয়েটা আকুল হয়ে তাকে ডাকছে। মেয়েটা কাঁদছে নাকি? চারপাশে এত গাছপালা কেন, অন্ধকার কেন? এই মেয়ে জংগলে কি করছে? এই মেয়ের হাতে রক্ত কেন? আবার কি কান্ড বাঁধিয়েছে এই মেয়ে? রবিন ফিসফিস করে ডাকলো-
“চারু।”
আবারো রিনঝিন কন্ঠে ভেসে আসলো-
“রবিন ভাই… কি বলছো? তোমার কোথাও কষ্ট হচ্ছে?”
রবিন এর ঘুম পুরোপুরি ছুটে গেলো এইবার। সে চোখ মেলে দেখলো সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা সারা।আর আশেপাশে কোনো জংগল তো নেই। ও কি সেদিনের ঘটনাটাই স্বপ্নে দেখলো? রবিন মাথা চেপে ধরে উঠে বসলো। বার কয়েক মাথা ঝাড়া দিলো।কড়া ডোজের এন্টিবায়োটিক নেয়ার কারনে তাকে ঘুমের ওষুধ ও নিতে হয়। তাই ঘুম থেকে উঠার পর মাথা ভার হয়ে থাকে।। সারা আবার জিজ্ঞেস করল-
“তোমার কি কোথাও কষ্ট হচ্ছে?”
রবিন মাথা হালকা তুলে সারার দিকে তাকালো।মাথা নেড়ে জানালো তার কষ্ট হচ্ছে না। সারা বললো-
“ফ্রেশ হয়ে নাও। আম্মু তোমার জন্য আলাদা ব্রেকফাস্ট বানিয়েছে। আমি তোমার জন্য নিয়ে আসছি।”
“ঠিক আছে। একটা শার্ট দে।”
সারা এগিয়ে গিয়ে রবিনের লাগেজ খুললো। খুলে একটা শার্ট বের করে এনে রবিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
“নাও। ”
রবিন মাথা চেপে চোখ বন্ধ করে বসেছিলো। সারার ডাকে চোখ তুলে চাইলো। সারার বাড়িয়ে দেওয়া শার্টের দিকে চেয়ে চারুর কথা মনে পড়ে গেলো। একটা শার্ট বাছাই করতেই এই মেয়ে কয়েক মিনিট লাগিয়েছিলো। ধমক দেয়ার পর সে তাড়াতাড়ি করে শার্ট এনে এইভাবেই বাড়িয়ে ধরেছিলো। রবিন মাথা থেকে চিন্তা সরিয়ে সারার হাত থেকে শার্ট নিলো। গুলি লাগা হাতে শার্ট পড়তে গিয়ে অসাবধানতাবশত লেগে গেলো। যন্ত্রনায় নাক মুখ কুচকে ফেললো রবিন।
সারা ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসলো। শার্টের হাতাটা ধরে বললো –
“তুমি ছাড়ো আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।”
রবিন যন্ত্রনা সহ্য করে নিলো। শার্টের হাতা থেকে সারার হাত সরিয়ে ভারী কন্ঠে বলল-
“লাগবে না।”
রবিন নিজেই শার্ট পড়ে বিছানা থেকে নেমে সোজা বাথরুমে চলে গেলো। সারা ওইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলো। তার মন টা অনেক খারাপ হয়ে গেলো। কি এমন হত শার্টটা পড়িয়ে দিলে। রবিন ভাই সবসময়ই তার সাথে দূরত্ব রাখে। এক শহরে থেকে পড়াশোনা করে তারপর ও তাদের বাড়িতে না থেকে হলে থাকে। সারা মন খারাপ করে ডায়নিং রুমে চলে গেলো।
ফাতেমা বেগম সারার মলিন মুখ দেখে ভ্রু কুচকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন-
“মুখ টা এমন করে রাখছস কেন? কি হইছে?”
সারা ডায়নিং এ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো –
“তোমার ভাইয়ের ছেলে এত ভাব নেয় কেন? এমন ভাব যেন প্রেসিডেন্ট। ”
ফাতেমা বেগম হেসে দিলেন।বললেন-
“কি করছে রবিন তোরে?”
“কিছুই করে নি। ”
বলে সারা মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বললো
“কিছু করলে তো ভালোই হত।”
রবিন ফ্রেশ হয়ে বের হলো। চোখে মুখে পানি দেয়ায় ভালো লাগছে কিন্তু মাথা টা এখনো ভার হয়ে আছে। মাথা টা টিপে দিলে ভালো লাগত। সে বিছানার কিনারে বসে হাঁটুর উপর হাতে ভর দিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল, তর্জনি আর মধ্যম আংগুল দিয়ে কপাল চেপে ধরলো। মায়ের কথা মনে পড়ছে তার। মা থাকলে মায়ের কোলে শুয়ে পড়তো আর তার মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই এসব মাথা ব্যথা উধাও হয়ে যেত।
এসব ভাবনার মাঝেই সারা হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে ঢুকলো। রবিন হাত নামিয়ে সারার দিকে তাকালো। সারা এসেই রবিনের পাশে বসে পড়লো। একটা ছোট টেবিল টেনে ট্রেটা সামনে রাখলো। তারপর স্যুপের বাটিটা হাতে নিয়ে চামচ দিয়ে নাড়তে নাড়তে বললো –
“আম্মু বলেছে তোমাকে খাইয়ে দিতে। নাও হা করো।”
বলেই রবিনের দিকে চামচ বাড়িয়ে দিলো। রবিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। চোখে ভাসলো চারুর মুখ টা। চারুও তাকে খাওয়াতে এসে এভাবে খাবার মুখের কাছে বাড়িয়ে দিয়েছিলো। বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে এমনভাবে বলেছিল “রবিন ভাই, হা করো হা!”
চারুর হা করা মুখটা ভেসে উঠতেই রবিন মাথা নিচু করে হালকা হেসে দিলো। সারা চোখ বড় বড় করে চাইলো।সে কখন থেকে চামচ বাড়িয়ে বসে আছে আর এই ছেলে কিনা একা একা পাগলের মতো হাসছে। হাতে গুলি খেয়ে এর কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি?
সারা শব্দ করে ডাকলো-
“কি হলো? হা করো!”
রবিন হাসি থামিয়ে সারার দিকে চাইলো। কিছু একটা ভেবে বললো –
“এক কাজ কর। খাবার টা নিয়ে ডায়নিং এ যা। আমি ওইখানেই আসতাছি। ফুপির সাথে বসে খাব আর আমার ডান হাত ঠিক আছে আমি খাইতে পারব।”
বলেই রবিন পাশ থেকে ফোন টা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সারা হাত নামিয়ে ঠায় বসে রইলো। তার মন টা আরো খারাপ হয়ে গেলো। কত শখ করে এসেছিলো রবিনের অসুস্থতার সুযোগে রবিনকে খাওয়াবে বলে। কিন্তু হলো না!!
রবিন ফোন খুলে ভ্রু কুচকে চেয়ে রইলো। গত রাতে চারু ভিডিও কল দিয়েছিলো? সে অডিও কল ব করলো। কিন্তু ঢুকলো না। সারা রবিনকে কল করতে দেখে বলল-
“রবিন ভাই, গত রাতে চারু কল দিয়েছিলো। তুমি ঘুমিয়েছিলে তাই আমি রিসিভ করেছিলাম।”
” কি বললো চারু?”
“বলল তুমি ভালভাবে পৌছেছো কিনা জানতে কল দিয়েছে।”
“ঠিক আছে৷ তুই যা।”
বলে রবিন আবারো কল দিতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। সারা শুকনো মুখে ট্রে নিয়ে উঠে চলে গেলো। রবিন সোজা চারুর নাম্বারে কল দিলো। ফোন বন্ধ দেখালো। তখনি রবিনের মনে পড়লো চারু এই সময় স্কুলে থাকে তাই ফোন বাড়িতে রেখে গেছে।
_______
সৈয়দ বাড়ির সামনে একটা রিক্সা এসে থামলো। রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়ালো ২৪ বছর বয়সী এক তরুণ । তার সাথে নেমে দাঁড়ালো ২১ বছর বয়সী একটা তরুণী। তাদের সাথে ব্যাগ, লাগেজ। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে দুজনেই প্রবেশ করলো সৈয়দ বাড়িতে।
রনি উঠোনে বল নিয়ে খেলছিলো ফরহাদ আর স্মৃতিকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে সে হাতের বল ফেলে “ভাইয়া” বলে চিৎকার করে দৌড়ে গেল ফরহাদের দিকে। ফরহাদ এক টানে রনিকে কোলে তুলে নিলো। রনির চিৎকার শুনে সাজেদ বেগম বের হয়ে আসলেন। বারান্দায় এসে তিনি আনন্দে আত্নহারা হয়ে গেলেন। আনন্দে চিৎকার করে বললেন-
“তোরা আসছস? একটা খবর দিলি না তো।”
বলেই উঠোনে নামলেন। স্মৃতি এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো তা বড় চাচীকে।তারপর ছেড়ে দিয়ে বলল-
“কেমন আছো চাচী?”
“তোরা অভিমান কইরা দূরে থাকলে কেমনে ভাল থাকবাম ক?”
ফরহাদ রনিকে কোল থেকে নামিয়ে তার মা কে জড়িয়ে ধরলো।তারপর সাজেদা বেগমের দুই বাহুতে হাত রেখে বলল-
“আর দূরে থাকতাম না আম্মা। এইবার দূরে গেলে তোমারেও নিয়া যাইবাম। আমার আম্মা ছাড়া আমি এক মুহুর্ত ও থাকতাম না আর।”
বলেই চমৎকার করে হাসলো। সাজেদা বেগম ও ছেলের হাসিতে সায় দিলেন। রাজিয়া বেগম আর সামিরা হই হুল্লোড় শুনে বের হয়ে আসলো। রাজিয়া বেগম স্মৃতিকে দেখে ছুটে এলেন। স্মৃতি মা কে দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। এক নিমিষেই বাড়িটা ভরে উঠলো মান অভিমানের আনন্দে। সামিরা এগিয়ে এসে বললো-
“আপা ছেলে মেয়ে দুইটা অনেক দূর থাইকা আসছে। আগে এদেরকে ঘরে ঢুকতে দাও।”
সাজেদা বেগম আর রাজিয়া বেগমের টনক নড়ল। তারা ফরহাদ আর স্মৃতিকে নিয়ে ঘরে ঢুকতে উদ্ধত হলেন। কিন্তু ঘরে ঢুকার আগেই বসার ঘর থেকে এক গমগমে কন্ঠস্বর ভেসে আসলো। ফরহাদ আর স্মৃতিকে উদ্দেশ্য করে বলল-
“দাঁড়াও।। কার অনুমতি নিয়া তোমরা দুইজন এই বাড়িতে আসছো।”
চলবে