প্রেম_প্রার্থনা #তামান্না_আঁখি #পর্ব-৩

0
770

#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-৩

‘আমার শিক্ষা পরে হইব। তোমারে চাচ্চু ডাকে। রবিন ভাই তোমার প্রেমিক রে ধইরা লইয়া আইছে। প্রেম কইরা ফেইল করছ, তাই তোমাদের বিয়ে পড়ায়া দিব”।

এই কথা কর্ণগোচর হতেই চারু লাফ দিয়ে বসা থেকে উঠে দাড়াল। তার প্রেমিককে নিয়ে এসেছে মানে?বিয়ে দিয়ে দিবে মানে? হায় আল্লাহ! এখন কি হবে তার? সে ভয়ার্ত চোখে রনির দিকে তাকাল।ঢোক গিলে বলল-

” মিথ্যা কথা কস আমার সাথে? চড়ায়া সোজা কইরা দিব একদম বান্দর। ”

রনির এতে কিছু এলো গেলো না। সে গা ঝাড়া দিয়ে বিছানায় লাফ দিয়ে উঠল। মুখের বিস্কুট গিলে ফেলে হাতে রাখা আধ খাওয়া বিস্কুট পুরোটা মুখে ঢুকিয়ে দিল। বিস্কুট চাবাতে চাবাতে চিত হয়ে শুয়েও পড়ল। তারপর বাম পা নাচাতে নাচাতে উদাস গলায় বলল-

“আপু গো তুমি চড়াইলেও আজ আমি কিছু বলব না। এম্নিই তুমি বিয়ে কইরা আজিবনের লাইগা চইলা যাইবা। খারাপ লাগতাছে আমার”।

বলেই রনি কান্নার মত ভান করে নাক টানল।

চারুর যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। সে ত এখনো এসএসসি পরিক্ষাই দিল না। এখন বিয়ে দিবে? চারু কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফারহানা এসে দাড়াল দরজায়। রনি কে শোয়া দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে এগিয়ে এসে রনির কান টেনে ধরে বসাল।পিঠে একটা চড় দিয়ে বলল-

” তরে চাচ্চু কি কাজে পাঠাইছে আর তুই এইনে আয়েশ করতাছস। উঠ বেয়াদব উঠ।”

চারুর দিকে তাকিয়ে বলল-

“এই যে প্রেমিকা বেডি, নিচে আপনার প্রেমিক বেডা অপেক্ষা করতাছে। চলেন।”

চারু বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল। সে ত এখন বিয়ে করতে চায় না। সে ত রান্না বান্না ঘরের কাজ কিছু পারে না। তার মা তাকে শিখতে বললেও সে শিখে না, তার এসব ভাল লাগে না। বিয়ে করলে তার মা চাচির মত এসব ই করতে হবে। সে ত ওসব করতে চায় না। সে সারাদিন ঘুরে ফিরে বেড়াতে চায়।

সে এগিয়ে এসে ফারহানার হাত দুটো ধরে আকুল হয়ে বলল-

“আপু সত্য কইরা কও না নিচে কে আইছে? আমার ভয় করতাছে আপু।”

ফারহানা ভাবলেশহীন ভাবে হাত ছাড়াল। নিরাসক্ত গলায় বলল-

“তুই সাথে চল, গিয়ে নিজের চোখে দেখ কে আইছে!।”

ফারহানা আবার তাড়া দিল। চারু ঢোক গিলে রনির দিক তাকাল। রনি তখন বিস্কুট গিলতে ব্যস্ত। সে পরপর ফারহানার দিক তাকাল। ফারহানা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। কোনো চোখেই সে ভরসা না পেয়ে মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ে মাথায় ওড়না চাপিয়ে বের হল।

চারু তার আত্না হাতে নিয়ে নিচে নামল। রান্না ঘরের পাশে পর্দার আড়ালে মা চাচি কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। তার আত্নায় কিছুটা পানি এল। কিন্তু উঠোনে আসতেই তার আত্না তার ছোট হাতের ফাক গলে উড়াল দিতে চাইল। সে শক্ত করে হাত মুঠো করে ধরল। একপাশের চেয়ারে বড় বাবা আর তার আব্বা বসে আছে। আর অন্য পাশে রবিন ভাই আর আরেকটা লোক। আর এই দুজনের মাঝখানে দাঁড়ানো নাজমুল।

নাজমুল কে দেখে তার ছোট প্রেমিকা হৃদয়ে অভিমান উঁকি দিল। সে ত অপেক্ষা করেছিল গত কাল স্কুল ছুটির পর নাজমুলের জন্য। কই সে ত এলো না। এখন বাড়িতে এসেছে বিয়ে কর‍তে। হাজার বার বললেও সে বিয়ে করবে না নাজমুল কে।

এইবার তার বাবার দিকে চোখ পড়ল। চোখে আগুন নিয়ে তাকিয়ে আছে তার বাবা। সে আস্তে করে হেটে গিয়ে সামনে দাড়াল। চোখ তুলে তাকাল তার বড় বাবার দিকে। গম্ভীর মুখে বসে আছেন তিনি।

সৈয়দ শাহজাহান আলী, এই সৈয়দ বাড়ির কর্তা উনি।
বাকি ছোট দুই ভাই সৈয়দ কামরুজ্জামান আর পরের জন সৈয়দ মোস্তফা কামাল। তিন ভাইয়ের সংসার। একজন বড় বোন ছিল। তাকে উত্তম হাতে পাত্রস্থ করেছেন তিন ভাই মিলে। বাবা মা অনেক আগেই গত হয়েছেন।এখন তারাই এই সৈয়দ বাড়ির হর্তাকর্তা।

শাহজাহান আলী চোখ তুলে তাকালেন। চশমা র কাচ দিয়ে ভাতিজির দিকে দেখলেন। তারপর শব্দ করে ডাকলেন-

“এদিকে এসো”

চারু মুখ তুলল। তার বড়বাবা তাকে তুমি করে ডাকছে? ‘মা’ বলেও ডাকল না। উনি ত মা ছাড়া তাকে ডাকে না। চারুর মনটা কেমন ভার হয়ে গেল। গলায় কিছু একটা আটকে আসল।

মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গর্জে উঠলেন কামরুজ্জামান।

“দাঁড়ায় আছস কেন? ভাইজান ডাকে শুনস নাই?”

ভাইয়ের রাগ দেখে বিরক্ত হলেন শাহজাহান আলী।বাইরের লোকের সামনে বাড়ির মেয়েকে বকাঝকা করা তার পছন্দ নয়। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন-

“আহ! জামান,তুই থাম। আমি কথা কইতাছি।”

পরক্ষনেই চারুর দিকে চেয়ে নরম স্বরে বললেন-

“আয় রে মা!আমার কাছে আয়”

আদরের ডাকে চারুর কান্না পেল। কাপা কাপা পায়ে কয়েক পা এগিয়ে তার বড় বাবা র চেয়ার এর পাশে দাড়াল।

শাহজাহান আলী চারুর বাহুতে আলতো করে ধরে বললেন-

“বলতো মা এই পোলাটারে তুই চিনস? ওর সাথে কি তর কোনো সম্পর্ক আছে?”

চারুর নিজের কৃতকর্মের কথা মনে পড়ে কান্না পেল। সে কি করে এমন কাজ করল। এক টা বার ও কি বড় বাবার কথা ভাবল না? সে মিনমিনিয়ে বলল-

“আমরা এক ক্লাসে পড়ি।”

শাহজাহান আলী রবিনের দিকে তাকালেন। এই ব্যাপারে রবিন তাকে জানিয়েছে। সৈয়দ বাড়ির সম্মানের ব্যাপার জড়িত বলেই সে ছেলে আর ছেলের বাবাকে ডেকে এনেছেন। যাতে বাইরে কিছু না রটে।

রবিন এতক্ষন শান্ত চোখে দেখছিল সব।সে এইবার মুখ খুলল-

” নাজমুল! তুই আমারে যা বললি ওইগুলা বল।”

নাজমুল নামের ছেলেটি ঘামছে।সে হাত দিয়ে নাকে মুখে ঘষে ঘাম মুছল তার পর মাথা নিচু করে আওড়াল-

“চারু আমারে মাফ কইরা দেও। তোমার পরিক্ষা খারাপ করনের লাইজ্ঞা আমি তোমারে চিঠি দিতাম। সোহেল আমারে এই কাজ করতে কইছিল,যাতে তোমার পরিক্ষা খারাপ হয় আর সে পরিক্ষায় ফার্স্ট হয়।”

চারু আকাশ থেকে পড়ল। মানে কি? তার মানে এত প্রেম সব অভিনয় ছিল? কত চিঠি কত কবিতা লেখা সব অভিনয়? সে ত মনে মনে সংসার পর্যন্ত সাজিয়ে ফেলেছিল আর এখন এসব কি শুনছে? সে হতবাক নয়নে তাকিয়ে রইল।

এইবার নাজমুলের বাবা হারাম*জাদা বলে রেগে তেড়েমেরে ছেলের দিকে এগিয়ে গেল। ছেলের গায়ে কয়েকদফা থাপ্পড় পড়ল। রবিন এগিয়ে গিয়ে ফিরাল না, মারতে দিল ।

নাজমুলের বাবা নিজে থেকেই থামল। তারপর ফের চেয়ারে বসল। শাহজাহান আলীর দিকে তাকিয়ে বলল-

“ভাই সাহেব, ছুডু মানুষ না বুইজ্জা ভুল করছে। মাফ কইরা দেন। আর হইত না। আমি নিজে দায়িত্ব নিলাম”।

শাহজাহান আলী এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের একজন। তার বাড়ির মেয়ের নামে কথা রটলে ভাল দেখাবে না। তার ই বদনাম। তিনি বিষয় টাকে এখানেই শেষ কর‍তে চাইলেন। তিনি সন্তুষ্টচিত্তে মাথা নেড়ে বললেন-

” এই ব্যাপার টা না বাড়ানোই ভাল। পাচকান হইলে এলাকায় খারাপ কথা রটব। তার চেয়ে আমরার মাঝেই থাকুক। পুলাপান ভুল করছে আমরা শাসন কইরা দিলেই তারা তাদের ভুল বুঝব আশা করি।”

শাহজাহান আলীর কথায় নাজমুলের বাবা হাফ ছেড়ে বাচলেন। তিনি ভেবেছিলেন সৈয়দ বাড়ির মেয়েকে প্রেমপত্র দেয়ার অপরাধে তার ছেলে না কয়েক দফায় মা*র খায়। কিন্তু কিছুই হল না। তিনি কৃতজ্ঞ হয়ে সৈয়দ বাড়ি থেকে প্রস্থান নিলেন।

নাজমুলের বাবা আর নাজমুল বেরিয়ে যেতেই কামরুজ্জামান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। তিনি উঠোনের অপর পাশে লাকড়ি ঘরের দিকে হেটে গেলেন। নিয়ে আসলেন কাঁচা বাঁশের একটা চিকন কঞ্চি। এই কঞ্চিটা তিনি একটা কাজের ছেলেকে দিয়ে বাড়ির পাশের বাশঝাড় থেকে আনিয়েছেন। উঠোনের পাশে রান্নাঘরের বারান্দায় পর্দার আড়ালে দাঁড়ানো সাজেদা খাতুন আর রাজিয়া বেগমের অন্তর কেঁপে উঠল কঞ্চি দেখে। কামরুজ্জামান হনহন পায়ে এসে কেউ কিছু বুঝার আগেই কঞ্চি দিয়ে মারতে লাগলেন চারুকে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here