#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-২৩
সারা রবিনের ঘরে এসে উঁকি দিলো। ঘর খালি, কেউ নেই। ঘরে ঢুকে বুঝতে পারলো রবিন বারান্দায়। বারান্দার দরজা খোলা, আর সেই দরজা দিয়ে ধোয়া আসছে ঘরে। সারা বুঝতে পারলো রবিন কি করছে। সে বড় বড় পা ফেলে বারান্দার দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। দেখলো রবিন বেতের চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছে। সারার খুব রাগ হলো। সে কন্ঠ গরম করে বলল-
“এসব কি করছো তুমি?”
মেয়েলি চিকন স্বর শুনে রবিন পাশ ফিরে তাকালো। দেখলো সারা কোমড়ে হাত রেখে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। রবিন মুখ নিচু করে বাম দিকে ফিরে ধোয়া ছাড়লো। তারপর হাতের সিগারেট টা একটু আড়াল করে বলল-
“কি করতাছি?”
“তুমি জানো না তুমি কি করছো?”
রবিন গম্ভীর মুখ করে মাথা নাড়লো সে জানে না। সারার রাগে সারা অংগ জ্বলে গেলো। এই দামড়া নাকি জানে না সে কি করছে? সে শ্বাস ফেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল-
“অসুস্থ অবস্থায় স্মোক করছো কেন তুমি?”
“একটাই খাব। ”
“তুমি জানো সিগারেট খেলে কত ক্ষতি হয় শরীরের?”
“আমার কি জানার কথা? আমি কি ডাক্তার?”
সারা অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো। সিগারেটের ক্ষতিকর দিক জানতে হলে কি ডাক্তার হতে হবে? সে বলল-
“ডাক্তার না হলেও জানা যায়।”
রবিন বিরস মুখে বলল-
“আমার জানার দরকার নাই। এখন যা। বিরক্ত করিস না।”
সারা অপমানিত বোধ করলো। কিন্তু দমে গেলো না। সে লম্বা একটা ভাষন দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বলল-
“সিগারেট মানুষের কিডনি থেকে শুরু করে শরীরের আরো অনেক ক্ষতি করে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে ফুসফুসের। আর আমাদের ব্রেইন………”
সারা তার ভাষন পুরোটা শেষ করতে পারলো না। রবিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল-
“সিগারেটের চেয়ে ফাস্ট ফুড বেশি ক্ষতি করে। দিনে দুইবেলা যে বার্গার পিৎজা খাস তখন হার্টের কথা মনে হয় না? সিগারেটের চেয়ে ওইসবের দাম তো আরো বেশি। আর রাস্তায় দাঁড়ায়া যে ফুচকা মামার হাতের ময়লা খাস তখন কই থাকে এসব বানী?”
সারা হতভম্ব হয়ে গেলো। কিসের সাথে কি মিলাচ্ছে এই ছেলে? রবিন আবারো বলল-
“বাইরে গিয়া ফাস্ট ফুড খাস তারপর বাসায় আইসা শসা খাইয়া ডায়েট করস। এই ডায়েটের কোনো মানে আছে? আর সবসময় মুখে এইসব রঙ চঙ মেখে থাকিস। এইসব যে স্কিন ক্যান্সার ঘটায় সেটা জানস?”
সারা কথা বলতে ভুলে গেলো। রবিন এখন তার মেকাপ আইটেম নিয়েও কথা শুনাচ্ছে। একটা কথা কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। রবিন কন্ঠ কঠিন করে বলল-
“দাঁড়ায় না থাইকা যা। আমার জন্য এক কাপ কফি পাঠা।”
সারা বিস্ময়ে আবিষ্ট দাঁড়িয়েই রইলো। রবিন ঘাড় ঘুরিয়ে সারাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হলো। সে একটা সিগারেট খেয়ে মন মেজাজ ঠিক করতে চেয়েছিলো কিন্তু এই মেয়ে এসে আরো মেজাজ খারাপ করে দিলো। সে একটা ধমক দিলো।-
“কিরে যা!”
ধমক খেয়ে সারা ছুটে বেরিয়ে এলো। রান্না ঘরে গিয়ে দেখলো বাসার কাজের খালা আছে। তাকে রবিনের ঘরে কফি পাঠাতে বলে সে নিজের ঘরে চলে গেলো। তার মেজাজ অনেক খারাপ হয়েছে। সে আর এই ছেলের বিষয়ে খবর নিবে না। সিগারেট না তো বিষ খাক তাতে তার কিছু যায় আসে না।
___________
তুহিন এক দৌড়ে মজুমদার বাড়ির গেটের সামনে এসে থামলো। ঝুঁকে দুই হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাতে লাগলো। বড় বড় শ্বাস ফেলে কিছুটা শান্ত হলো। তার সারা শরির ঘামে ভিজে জবজবে। পড়নের টি শার্ট গায়ের সাথে লেপ্টে আছে ঘামে ভিজে। সে গলায় ঝুলানো ওড়না টাকে গামছা মনে করে তা দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। মুছার সময় কেমন জানি খসখসে লাগলো গামছাটা তার কাছে। কিন্তু সে গুরুত্ব দিলো না। সে তাড়াতাড়ি গেট দিয়ে ঢুকে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ পিছনে তাড়া করে আসছে কিনা। কেউ নেই দেখে গেট লাগিয়ে উঠোন পেরিয়ে সদর দরজা দিয়ে বসার ঘরে ঢুকলো।
বসার ঘরে তুহিনের দাদী হোসনেআরা বসে সুপারি কাটছিলেন তুহিন কে ঢুকতে দেখে তাকালেন। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন-
“কিরে তুহিন, তোর এই অবস্থা কেরে? পইড়া গেছস নাকি?”
তুহিন তার নিজের ঘরের দিকে যেতে চাইছিলো, দাদীর কথায় থেমে দাঁড়ালো। দাদীর দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে তার আগেই হোসনেআরা বললেন-
“ওমা এইডা কি? ছেইড়ানের উন্না দিয়া তুই কি করস?”
তুহিন নিজের দিকে তাকালো। তার গলায় লাল জর্জেট একটা ওড়না ঝুলানো। সেই ওড়নায় আবার অনেক গুলা বিভিন্ন কালারের ছোট বড় ফুল।। তুহিন ক্যাবলাকান্তের মতো একবার ওড়নার দিকে আরেকবার তার দাদীর দিকে তাকালো। হোসনেআরা চোখ ছোট ছোট করে সন্দেহ চোখে তাকিয়ে আছেন। তুহিন পরিস্থিতি সামলানোর জন্য হেসে দিয়ে বলল-
“আরে কি কও মেয়েদের ওড়না হবে কেন এইটা তো আমার।”
হোসনেআরা হা হয়ে গেলো। তিনি বিস্মিত চোখে প্রশ্ন করলেন-
“তোর মানে? তুই কি এহন ছেইড়ানের জিনিসপাতি পিন্দা শুরু করছস নাকি। ও বউ! ও তুহিনের মা! দেইখ্যা যাও তোমার ছেড়ার কান্ড!”
তুহিন মাথা চুলকিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। তার দাদী তো এলাকার মানুষকে জানিয়ে দিবে মনে হচ্ছে।
আমেনা বেগম আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলেন। তিনি রান্না করছিলেন শ্বাশুড়ির হাক ডাক শুনে রান্না রেখেই আসতে হলো তাকে। হোসনেআরা আমেনা বেগম কে দেখে তুহিনের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে বললেন-
“দেখো, তোমার ছেড়ারে দেখো। কুন ছেড়ির উন্না লইয়া আইছে। ধরা খাইয়া এখন কয় এই উন্না নাকি তার নিজের।”
আমেনা বেগম তুহিনের দিকে তাকালেন। সত্যিই তুহিনের গলায় ফুল তোলা মেয়েদের একটা ওড়না ঝুলানো। তিনি বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন-
“মেয়েদের ওড়না কই থাইকা আনছস?”
তুহিন বুঝানোর সুরে বলল-
“আম্মা এইটা কোনো মেয়ের না, এইটা আমার ওড়না আমি কিনছি।”
“এরকম ওড়না দিয়া তুই কি করবি?”
“আরেহ এইটা এখন স্টাইল, বুঝছো। দেখো না হিন্দি সিনেমার নায়করা গানের ভিডিও তে নায়িকার ড্রেসের সাথে ম্যাচ কইরা গলায় ওড়না পড়ে।”
আমেনা বেগমে ছেলের কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলেন। হোসনেআরা ফোড়ন কেটে বললেন-
“তুই তো নায়ক না। এইবায় বাড়ির বাইরে গেলে মান ইজ্জত আর কিছু থাকতো না।”
তুহিন ভণিতা করে বলল-
“কিহ!! তোমার বিশ্বাস হয় না যে আমিও নায়ক হইতে পারি? তেইলে দেখো।”
বলেই তুহিন শাহরুখ খানের সিগনেচার স্টেপ কপি করে দুই দিকে হাত ছড়িয়ে চিকন কন্ঠে গাইলো-
“rang de tu mohe gerua
raanjhe ki dil se hai duaa
rang de tu mohe gerua”
আমেনা বেগম আর হোসনেআরা হা করে তাকিয়ে রইলো। তুহিন একটা লাজুক হাসি দিয়ে দাঁত দিয়ে ওড়না কামড়ে ঘরের দিকে চলে গেলো। হোসনেআরা আমেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন-
“ও বউ!! জামশেদ রে কইয়া কবিরাজ ডাকায়া আনো। এই ছেড়ারে তো জ্বীনে ধরছে।”
তুহিন ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। বিছনায় বসে ওড়না টা গলা থেকে খুলে হাতে নিলো। উত্তেজনা ভয়ে সে নিজের গামছা রানিকে দিয়ে রানির ওড়না সে নিয়ে চলে এসেছে। তুহিন ওড়না টার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো কেউ তাকে দেখছে কিনা। তারপর খুব সাবধানে নাকের কাছে ওড়না টা এনে লম্বা করে শ্বাস নিলো। মেয়েলি মিষ্টি ঘ্রাণে তার নাসারন্ধ্র ছেয়ে গেলো। তুহিন নাক থেকে ওড়না সরিয়ে তড়িৎ গতিতে পাশে রেখে দিলো ওড়না টা। সে নড়ে চড়ে বসলো।অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকালো। এইভাবে একটা মেয়ের ওড়নার ঘ্রাণ নেয়া টা তো ঘোর অপরাধ। পরক্ষনেই তার মনে পড়লো তার গামছাও রানির কাছে আছে। রানি নিশ্চয়ই তার গামছা থেকেও ঘ্রাণ নিচ্ছে। শুধু ঘ্রাণ কেন রানি নিশ্চয়ই আজ গামছা বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে। তাহলে তুহিনের ঘ্রাণ নেয়াতে দোষ হবে কেন।সে ওড়না টা হাতে তুলে নিলো। আজ সে ওড়না বুকে চেপে ধরে ঘুমাবে। নাহ!! সে ওড়না গায়ে জড়িয়ে ঘুমাবে। তুহিন আর অপেক্ষা করতে পারলো না সে তখনি পা থেকে মাথা পর্যন্ত ওড়না টেনে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো।
_______
রানি নাক কুচকে তার সামনে ময়লার ঝুড়িতে ফেলা গামছাটার দিকে তাকিয়ে আছে। যতই তাকিয়ে থাকছে ততই রাগ বাড়ছে। কেমন বেয়াক্কেলের মানুষ!!! তাকে একা ফেলে রেখেই দৌড় দিলো? সাথে নিয়ে গেলো তার ওড়না আর তাকে গছিয়ে দিয়ে গেলো এই গামছা। রানি যে কত কষ্টে লুকিয়ে বাড়ি ঢুকেছে এই গামছা নিয়ে তা একমাত্র সে ই জানে। আরেকটু হলেই সে তার বাবার দলের ওই লোকটার চোখে পড়ে যেতো৷ ভাগ্যিস লোকটা আর বেশি দূর এগিয়ে এসে দেখেনি। নয়ত তার আর রক্ষে ছিলো না। তার উপর এই গামছার বিশ্রি গন্ধে তার বমি আসার জোগাড় হয়েছিল। মানুষের গামছার গন্ধ এতো বাজে হয় কি করে? ধোয় না নাকি?
________
রাত এগারোটা বাজে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ঝি ঝি পোকা ডাকছে। একটানা কান পেতে শুনলে কেমন জানি ঘোর লেগে আসে এই ডাকে। চারু কিছুক্ষন কান পেতে এই ডাক শুনলো। তারপর ছোট একটা হতাশ শ্বাস ফেললো। সে অনেক্ষন থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে। বার বার ভিডিও কলে চাপ দিতে গিয়েও দিচ্ছে না। আজকেও কি অন্য কেউ ধরবে? চারু অনেক্ষন ভেবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলো সে এবার কল দিবেই। রবিন বেশিকিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে রবিন সকালে কল দিয়েছিলো তখন সে স্কুলে ছিলো ধরতে পারে নি তাই এখন কল ব্যাক করছে। আর এম্নিতেও সে তো কত বার ই রবিনের সাথে ভিডিও কলে বাড়ির সবার সাথে মিলে কথা বলেছে তো আজ এতো সংশয় কেন? একা কথা বলবে বলে? চারু দুম করে ক্লিক করে বসলো। ভিডিও কল চলে গেছে। সে তাড়াতাড়ি আয়নায় একটু নিজেকে দেখে নিলো। আজ তো একটুও সাজলো না। পেত্নী পেত্নী লাগছে কি?
রবিন এতো রাতে চারুর কল দেখে অবাক হলো না। সে জানতো তার দেয়া কল দেখে অবশ্যই চারু কল দিবে। সে গম্ভীর মুখে কল রিসিভ করলো।স্ক্রিনে ভেসে উঠলো চারুর বাচ্চা বাচ্চা চেহারা টা। রবিন কে দেখেই সে তড়িঘড়ি করে বলল-
“রবিন ভাই কেমন আছো?”
রবিন ছোট করে উত্তর দিলো-
“ভালো ”
“তোমার হাতের ব্যথা ভালো হইছে?”
রবিন তার ব্যান্ডেজ করা হাতের দিকে তাকালো তারপর ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল-
“হুম, হইছে।”
চারু চুপ মেরে গেলো। সে আর কথা পাচ্ছে না। এইভাবে চুপ করে বসে থাকতেও তার অস্বস্তি হচ্ছে আবার কি বলবে খুঁজেও পাচ্ছে না।
রবিন ফোন টা টেবিলের উপর হেলান দিয়ে রেখে নিচের দিকে তাকিয়ে কাগজ পত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে লাগলো। ভাবখানা এমন যে চারু যে কলে আছে তাতে তার কিছু যায় আসে না।চারু হাসফাস করতে লাগলো। কল টা কি কেটে দিবে সে? এইভাবে কেটে দেয়া কি ঠিক হবে? বেয়াদব ভাবে যদি? এসব ভাবনায় এতো বিভোর হয়ে গেলো যে আনমনে সে এক অঘটন ঘটিয়ে ফেললো। একটা শব্দবোম মেরে দিলো। দিয়েই চমকে গেলো। রবিন কি শুনে ফেললো নাকি। এটা ভেবে ফোনের দিকে তাকাতেই দেখলো রবিন স্থির চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চারু শক্ত হয়ে বসে রইলো।
রবিন একটা শ্বাস ফেলে বলল-
“এসব শুনানোর জন্য আমাকে এতো রাতে কল দিছস?”
চারু দুপাশে প্রবল বেগে মাথা নেড়ে জানালো “না”.
রবিন বলল-
” যা ঘুমা। আর মাঝে মাঝে একটু হাটাহাটি করবি গ্যাস কম হবে।”
বলেই রবিন কল টা কেটে দিলো। চারু স্তব্ধ হয়ে ওভাবেই বসে রইলো। তার ইজ্জতের ফালুদা টা কি রবিনের সামনেই হওয়ার ছিলো?
চলবে