প্রেম_প্রার্থনা #তামান্না_আঁখি #পর্ব-২৪

0
568

#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-২৪

রুবিনা বেগম রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় পার করছেন।৷তিনি কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে দরজার দিকে তাকাচ্ছেন। সকাল ১০ টার উপর বাজে। এখনো তার ভাতিজা- ভাতিজি রা আসছে না। তিনি রান্না ঘরে কাজ করতে করতে হাঁক ছেড়ে রানিকে ডাকলেন-

“রানি, একটু খবর নিয়া দেখ তো ওরা এখনো আসে না কেন?”

রানি ডায়নিং এ বসে মোবাইল টিপছিলো। মায়ের ডাকে সে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেললো। তার মা তাকে সকাল থেকে পাগল করে ফেলেছে চারুরা কখন আসবে সেই খবর নেয়ার জন্য। রানি এই নিয়ে ৭-৮ বার কল দিয়ে ফেলেছে। লাস্ট যখন কল দিলো তখন জেনেছে যে সবাই রওয়ানা দিয়েছে। যেহেতু দুই বাড়ির দূরত্ব তেমন না তাই সে ধারণা করেছিলো যে বেশিক্ষন লাগবে না। কিন্তু তার মা পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই আবারো খবর নিতে বলছে। রানি গলা উঁচিয়ে বলল-

“আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো আম্মা। এখনি আইসা পড়ব।”

রান্নাঘর থেকে রুবিনা বেগমের কোনো উত্তর শোনা গেলো না। সত্যিই ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় গেটের সামনে গাড়ির আওয়াজ শোনা গেলো। রুবিনা বেগম হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর ছেড়ে বের হয়ে এলেন। ব্যস্ত হয়ে ছুটলেন সদর দরজার দিকে। পিছু পিছু রানিও গেলো। সদর দরজা খুলতেই ফরহাদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখা গেলো। তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে স্মৃতি, ফারহানা, রনি আর চারু। ফরহাদের হাত ভর্তি প্যাকেট। সে প্যাকেট গুলো নিচে রেখে রুবিনা বেগম কে জড়িয়ে ধরলো। রুবিনা বেগম ও আগলে নিলেন ভাইপো কে। পর পর স্মৃতি ও এসে দাঁড়ালো রুবিনা বেগমের কাছে। রুবিনা বেগম ফরহাদ কে ছেড়ে স্মৃতি কে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে দুইজনের কান মলে দিয়ে বললেন-

“এই বয়সে তোদের এত রাগ কিসের? বাড়িতে এতদিন কেউ না আইসা থাকে?”

রনি মাঝখানে বলল-

“এখনো বাড়িতে আসতো না ফুপি। মেলার ঘটনা শুইনা আসছে। রবিন ভাই যে গুলি খাইলো তাই দৌড়ায়া আসছে দুইজন ই।”

স্মৃতি রনির দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালো।রুবিনা বেগম মন খারাপ করে বললেন-

“সে কি!! রবিন তো ঢাকা চইলা গেছে।”

ফরহাদ বলল-

” জানি ফুপি। রবিনের সাথে গতকাল আমার কথা হইছে। ঢাকা গিয়া ওর সাথে দেখা করবাম ইন শা আল্লাহ।।আর এখন আসছি আমার একমাত্র ফুপুজান রে দেখতে।”

শেষের কথা টা ফরহাদ এক্টু আদরের সুরে বলল।
রুবিনা বেগম হেসে দিয়ে বলল-

“আয়,ঘরে আয়।”

সবাই ঘরে ঢুকলো। মূহুর্তেই তালুকদার বাড়ির বসার ঘর হাসি আড্ডায় জমজমাট হয়ে গেলো। রুবিনা বেগম এক থালা সিংগারা আর পেয়াজু নিয়ে আসলেন। স্মৃতি লম্বা করে শ্বাস টেনে বলল-

“আহ!! কত দিন পর তোমার হাতের সিংগারা খাব। এত দিনে স্বাদ ই ভুইলা গেছি।”

টেবিলে রাখতেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লো সিংগারা আর পেয়াজুর উপর। খেতে খেতে গল্পে মেতে উঠলো।

দুপুরের খাওয়ার পর সবাই যে যার মতো বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত। রানি আর ফারহানা স্মৃতিকে ঘিরে ধরেছে ভার্সিটির গল্প শোনার জন্য। রানি ফরহাদের আনা চকলেট একের পর এক মুখে পুরছে আর গল্প গিলছে। চারু বসে থেকে বিরক্ত হচ্ছিলো। সে উঠে এলো সেখান থেকে। ধীরে ধীরে হেটে রবিনের ঘরের সামনে এলো। দরজায় ধাক্কা দিলো। ধাক্কা দিতেই দরজা টা শব্দ করে খুলে গেলো। ভিতরে ঢুকতেই আবছা অন্ধকার দেখতে পেলো। জানালা সব বন্ধ করে পর্দা টেনে দেয়া। চারু আবছা অন্ধকারেই ঘরটায় ঘুরতে লাগলো। ছোট থেকে অনেকবার সে এই ঘরে এসেছে। কতবার যে রবিনের দৌড়ানি খেয়েছে তা বলার বাইরে।সময়ের সাথে সাথে এই ঘরের অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। চারু রবিনের পড়ার টেবিলের চেয়ারে বসল। পড়ার টেবিল টা পুরনো। কাঠের তৈরি। চারু ছোট থেকেই দেখে আসছে এটাকে। টেবিলের সাইডের দুইটা বই সরালো। সেখানে জ্বলজ্বল করছে একটা লেখা-

“রবিন বাই পছা।”

চারু লেখা টা দেখে হেসে ফেললো। ছোটবেলা রবিন তার ঘরে আসতে নিষেধ করতো বিধায় সে আর রানি এই নিষিদ্ধ ঘরেই বেশি বেশি আসতে চাইতো। একবার রবিন তাদের দুজনকেই ক্রিকেট ব্যাট হাতে নিয়ে দৌড়ানি দিয়েছিলো। তখন চারু পড়তো ক্লাস টু তে। তারপর রবিন যখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো তখন চুপি চুপি এসে সে এই লেখা লিখেছিলো। কলম দিয়ে এক প্রকার খোদাই করে ইয়া বড় বড় অক্ষর দিয়ে লিখেছিলো।।রবিন বানান টা সে রবিনের খাতার উপর লেখা নাম টা থেকে দেখে দেখে লিখেছিলো। কিন্তু ভাই বানানে ঝামেলা করে ফেললো। পচা বানান লিখতে গিয়ে আরো ঝামেলা করে ফেললো সে। বানান করে লিখতে গিয়ে পচার জায়গায় লিখেছিলো “পা*ছা” । অর্থাৎ বাক্যটা হয়েছিলো-

“রবিন বাই পা*ছা।”

কিন্তু সে তখন ওটা ঠিক না করেই দৌড়ে পালিয়ে এসেছিলো। পরবর্তীতে রবিন দেখে খুব হম্বিতম্বি করেছিলো। কিন্তু চারু একবারের জন্যও স্বীকার করে নি যে এটা সে করেছে। রবিন তখন “প” এর “আ” কার টা কেটে দিয়েছিলো।কিন্তু চারু এমন ভাবেই লিখেছিলো যে পুরো লেখা টা কেটে দিলেও দেখা যাবে আর রবিনের শখের টেবিলে কালির দাগ পড়বে। তাই আর রবিন লেখাটা কিছু করে নি। কিন্ত সেখানে সবসময় ই বিভিন্ন স্টিকার লাগিয়ে রাখতো। এখন হয়ত আর ওইসব ঝামেলায় যায় না তাই বই দিয়েই ঢেকে রেখেছে।

চারু ঠোঁট কামড়ে দুষ্টুমির হাসি দিলো। সে রবিনকে অনেক জ্বালিয়েছে। বিনিময়ে অনেক দৌড়ানিও খেয়েছে। আর এখন সেই ছেলের প্রেমে পড়ে বসে আছে। প্রেমের কথা মনে আসতেই সে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। দুই গালে দুটো চড় দিয়ে উচ্চারণ করলো “তওবা, তওবা”। এসব ভাবনা আবারো এসেছে তার মাথায়? কঞ্চির মার খাওয়ার পর থেকে তার মাথাটা গেছে। কিন্তু কঞ্চির মার তো খেয়েছে শরীরে তাহলে মাথায় গোলমাল হলো কি করে? চারু চোখ ঘুরিয়ে রবিনের ঘরটাকে দেখলো। চারদিকে রবিনের জিনিসপত্র ছড়ানো। নাহ, এই ঘরে আর বেশিক্ষন থাকলে আরো বেশি ভয়ংকর চিন্তা মাথায় আসবে। চারু এক ছুটে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

________

সারা বারান্দায় বসে পড়ন্ত বিকালের আকাশ দেখছে আর চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক বসাচ্ছে। তার বেশ ভাল লাগছে সময় টা। সাম্নের মাঠে কিছু পিচ্চি ছেলে ফুটবল খেলছে। সারা সেদিকে তাকালো। গোল হয়েছে একটা।এইজন্য এক দলের উল্লাসের শেষ নেই। বিপক্ষ দলের ছেলেগুলো মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার চোখ গেলো তাদের বাসার নিচের রাস্তায়। চার তালার বারান্দা থেকে বেশ ভালোই দেখা যায় রাস্তাটা। রবিন হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। এমা! এই ছেলে না একটু আগেই ঘরে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলো, এখন আবার বাইরে বের হলো কখন।

সারা ভালো করে রবিনকে পরখ করলো। গুলি লাগা হাতটা ঝুলিয়ে হাঁটছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে হাত টা নড়াচড়া কর‍তে কষ্ট হচ্ছে। সারার বেশ রাগ হলো। হাত টা বেল্ট দিয়ে ঝুলিয়ে নিলেই তো আর এই কষ্ট টা হতো না। কি বেপরোয়া ছেলে!! অবশ্য সারা তো রবিনের বেপরোয়া স্বভাবের অনেক প্রমান ই ইতোমধ্যে পেয়ে গেছে।
একদিন সে কলেজের ক্লাস বাঙ্ক দিয়ে বান্ধবিদের এটা সেটা বুঝিয়ে রবিনের ভার্সিটিতে চলে এলো ফুচকা খেতে। এখানকার ফুচকা নাকি বেস্ট। অথচ তার আসল উদ্দেশ্য ছিলো রবিনের সাথে দেখা হওয়া। হয়েওছিলো দেখা। দূর থেকে সে রবিনকে দেখে একটু এগিয়ে গেলো। গিয়ে দেখলো রবিন বাইকের উপর এক হাতে ভর দিয়ে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে। তার চোখে কালো চশমা, হাতে সিগারেট। পুরাই ভার্সিটির বড় ভাই গেটাপে আছে সে৷ তার সামনে একটা ছেলে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে কিসব যেন বলছে। রবিন র‍্যাগ দিচ্ছে ছেলেটাকে। রবিনের আশে পাশে কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে এগুলা তার সাঙ্গপাঙ্গ। হুট করে রবিন উঠে বসে একটা চড় মারলো সামনের র‍্যাগিং হওয়া ছেলেটাকে। বেচারা চড় খেয়ে উলটে পড়েছিলো। কিন্তু রবিন নির্বিকার। সে আবারো আগের মতো বাইকে আধশোয়া হয়ে সিগারেটে টান দিয়ে বামদিকে মুখ করে ধোয়া ছাড়লো। এই দৃশ্য দেখে সারা আর আগায় নি এক দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলো। পরে যদিও সে শুনেছিলো ছেলেটাকে চড় দেয়ার কারন হচ্ছে ছেলেটা একটা মেয়েকে বাজে কথা বলেছিলো।

সারার ভাবনার মাঝেই রবিন ছেলেগুলো যেখানে ফুটবল খেলছে সেই মাঠের পাশের একটা চায়ের দোকানে এসে চা এর অর্ডার করে বেঞ্চিতে বসলো। তারপর চা চলে এলে নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে কাপে চুমুক দিলো। সারা বিভোর হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো।তার নিজের চা ঠান্ডা হয়ে গেলো। হঠাৎ করে গলা খাকারি দেয়ার শব্দে সারার ঘোর কাটলো। পাশে তাকিয়ে দেখলো তার মা মুচকি হেসে তার পাশ ঘেসে দাঁড়িয়ে আছে।

ফাতেমা বেগম রাস্তার দিকে উঁকি মেরে না জানার ভান করে বললেন –

“কি দেখস?”

“কই কিছুনা তো।”

ফাতেমা বেগম ঠোঁট টিপে হেসে বললেন-

“রবিন তো কাল হলে চইলা যাইব। ”

সারা তার মায়ের দিকে তাকালো।বলল-

“সত্যিই?”

“হুম”

সারা অনুনয় করে বলল-

“রবিন ভাই তো এখনো অসুস্থ।আর কিছু দিন রাখো না মা!! তুমি বললে থাকবে।”

“দেখি কি করা যায়।”

সারা দোকানের দিকে তাকালো। রবিন এর চা শেষ। একটা বাইক এসে সামনে দাঁড়ালো।রবিন বাইকের পিছনে উঠে বসলো। তারপর হারিয়ে গেলো দৃষ্টির আড়ালে। সারা সবটা দেখলো।

ফাতেমা বেগম মনোযোগ দিয়ে মেয়ের হাবভাব দেখলেন। তারপর আনমনে বললেন-

“ভাবতাছি তোর ভাইয়া বিদেশ থাইকা আসলে তোর বিয়েটা দিয়ে দিব।”

সারা অবাক হয়ে তাকালো।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-

“এখন বিয়ে? আমি তো এখনো পড়াশোনা শেষ করি নি মা।”

“তাতে কি!! ভাল পাত্র পাইছি হাত ছাড়া করবাম নাকি।”

সারা চুপ হয়ে অন্যদিকে তাকালো। তার কেমন জানি চারপাশ বিষাক্ত লাগছে। ফাতেমা বেগম আবারো বললেন-

“পাত্র তোর পছন্দ না হইলে বিয়ে ক্যান্সেল।”

সারা আশার আলো পেলো।পাত্র যে-ই হোক সে এক বাক্যে না করে দিবে। কিন্তু না করার জন্য ও ত পাত্রটা কে সেটা জানতে হবে। সে ফরমালিটি করে জিজ্ঞেস করল-

“পাত্র কে মা?”

“আমাদের রবিন। তবে তোর অমত থাকলে আমি আর এই বিষয়ে চিন্তা করব না।”

সারা কি বলবে ভেবে পেলো না। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here