#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-২৫
দুপুরের রোদ যখন পড়ে পড়ে অবস্থা তখন প্রকৃতিতে যেন এক অন্যরকম সৌন্দর্য ভর করে। কেমন জানি এক অলস সৌন্দর্য৷ বেশিক্ষন সেই সৌন্দর্য অবশ্য টিকে না। তার আগেই বিকেলের আগমন ঘটে। চারু সেই প্রকৃতির হালকা রোদ গায়ে মাখিয়ে হেটে হেটে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে। সাথে রানিও আছে। আরেকটু আসতেই নজর গেলো গাছপালা ঢাকা ফাঁকা জায়গাটার দিকে। সেখানে ছায়ায় কয়েকটা ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। চারুর সেদিকে তাকিয়ে মন টা খারাপ হয়ে গেলো। রবিন ও এই জায়গায় বসে আড্ডা দিত। মাত্র ৪-৫ দিন হলো রবিন গ্রাম ছেড়ে ঢাকা চলে গেছে কিন্তু চারুর মনে হচ্ছে সে যেন অনেক দিন রবিনকে দেখে না। চারু একটা লম্বা শ্বাস ফেলল।
রানি ভ্রু কুচকে চারুর দিকে তাকিয়ে বলল-
“কি হইছে তোর?”
“কিছুনা”
” এমন ভাবে শ্বাস ফেলছস যেন তোর জামাই মইরা গেছে।”
চারুর রাগ পেলো। জামাই মরবে কেন তার? তার কি জামাই আছে? সে রাগ করে বলল-
“এসব অলুক্ষুনে কথা কেমনে কস? মুখে বাঁধে না?”
রানি একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলল-
“ওরে আমার স্বামী সোহাগী রে! না হওয়া স্বামীর লাইগা এত দরদ। ”
চারু একটা মুখ ভেংচি দিলো। রানি টিপ্পনি কেটে বললো –
“তোর তো ক্রাশের অভাব নাই। মাঠে ঘাটে ক্রাশ খাস। জামাই মরলে তোর ই ভাল। একটা মরবো পরে ধইরা আরেকটারে বিয়ে করবি।”
চারু এদিক ওদিক চোখ ঘুরালো। তারপর দুষ্টু হেসে বলল-
“এসব জামাই মরার অভিশাপ দিস না পরে তুই ই কানবি। আমার জামাই কিন্তু তোর ভাই লাগে সম্পর্কে ।”
রানি ভ্রু কুচকালো। জিজ্ঞেস করল –
“আমি কান্না করব কোন দুঃখে? আর সম্পর্কে দুলাভাই হইব, ভাই না।”
“এখনি এত কিছু জানা লাগতো না।পরে জানিস।”
রানি ভ্রু কুচকে চিন্তা করতে করতে বাড়ির দিকে চললো। চারু রানিকে বিদায় দিয়ে নিজের বাড়ির দিকে চললো। বাড়ির একটু কাছাকাছি আসতেই লিজা ডাকলো চারুকে-
“এই চারু। দাঁড়া।”
চারু ঘুরে দাঁড়ালো। লিজাকে দেখে তার বিরক্ত লাগলো। সে কিছু না বলে দাঁড়িয়ে থাকলো। লিজা মুখে দুঃখ দুঃখ ভাব এনে ইনিয়ে বিনিয়ে বললো –
“তোর শরীর টা ভালো? তোরে দেখতে যাইতে চাইছিলাম।মেলার ঘটনা শুইনা আম্মা তোদের বাড়ি যাইতে দেয় নাই। তোরে দেখার জন্য অন্তর টা অনেক পুড়ছে।”
চারু লিজার কথায় পাত্তা দিলো না। বিরস মুখে বলল-
“কি বলবা বলো?”
লিজা একটু কাছে এসে চারুর বাহু আকড়ে বলল-
“তুই আর রবিন ভাই নাকি হারায় গেছিলি? রবিন ভাইয়ের নাকি গুলি লাগছে? রবিন ভাই এখন কই?”
চারুর মেজাজ বিগড়ে গেলো। লিজার এতক্ষনের ন্যাকামির কারন সে বুঝতে পারলো। সে লিজার থেকে তার হাত ছাড়িয়ে বললো –
“রবিন ভাই ঢাকা চইলা গেছে। ”
লিজার মুখ টা ছোট হয়ে গেলো। সে মনমরা হয়ে বলল-
“ইশশ!! অসুস্থ মানুষটারে একটু দেখতে যাইতে পারলাম না। আবার কবে আসব রে রবিন ভাই?”
“এক বছর পরে আসব।”
বলেই চারু হাঁটা ধরলো। এই মেয়ের ন্যাকামি দেখলে তার গা জ্বলে। তাই ইচ্ছা করে মিথ্যা বললো। রবিন আর এক মাস পরেই রানির জন্মদিনের সময় আসবে। কথা টা মনে হতেই চারুর মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেলো।
__________
সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগেই। সারা তারা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে মোবাইল দেখছে। মোবাইলের স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করছে রবিনের ফেসবুক আইডি। সে প্রত্যেকটা ছবি জুম করে দেখছে প্রতিটা কমেন্ট চেক করছে। কিছু বেহায়া মেয়ে লাভ ইমুজি দিয়ে কমেন্ট করেছে “ক্রাশ” “হ্যান্ডসাম লাগছে ভাইয়া” আরো হেন তেন কত কি। সারার রাগ পেলো। কিন্তু মুহুর্তেই রাগ টা চলে গেলো। মনে মনে বললো
“যত খুশি তত কমেন্ট করে নে, তোদের হ্যান্ডসাম ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে টা হয়ে নিক, তারপর তোদেরকে ঝেঁটিয়ে আইডি থেকে বিদায় করব।”
সারা পা নাচিয়ে আইডি ঘাটতে লাগলো। তখনি রবিনের ঘর থেকে আওয়াজ পেলো। সে কিচেনে কাজ করতে থাকা কাজের খালার কাছে চা চেয়েছে। সারা এক লাফ দিয়ে উঠে পড়লো। দৌড়ে কিচেনে গেলো। গিয়ে চা বানাতে নেয়া কাজের খালা কে থামিয়ে দিয়ে বলল-
“খালা তুমি অন্য কাজ করো। আমি চা বানাচ্ছি।”
সারা চা বানাতে লেগে গেলো। আগে থেকেই রবিনের কাজ গুলো সে নিজে করে অভ্যাস করে নিবে। কারন বিয়ের পর তো তাকেই করতে হবে সব। বিয়ের কথা মনে পড়তেই সারা লাজুক হাসলো।
তার মায়ের কথা রবিন ফেলতে পারে নি,আরো কিছুদিন থাকবে সে। এই কয়েকটা দিন সারা রবিনের সব কাজ নিজে করে দিবে বলে চিন্তা করলো। বিয়ের পর যেন কোনো অসুবিধা না হয় তাই রবিনের পছন্দ অপছন্দ এখন থেকেই সে জেনে নিবে। আবারো লাজুক হাসলো সে। আচ্ছা এই বিয়েতে তো সবাই নিশ্চয়ই রাজি হবে। অমত করার তো কিছুই নেই। কিন্তু রবিনের মত তো জানা হলো না। রবিন কি সারার প্রেম প্রার্থনা মঞ্জুর করবে নাকি তাকে ফিরিয়ে দিবে। ফিরিয়ে দেয়ার কথা মনে হতেই সারা মাথা ঝাড়া দিলো। কক্ষনোই রবিন ফিরাবে না তাকে। বউ হিসেবে তাকেই সে মেনে নিবে। মুখে লাজুক হাসি নিয়েই সে চা বানানোর কাজ শেষ করলো। তারপর সুন্দর করে কাপ সাজিয়ে চললো রবিনের ঘরের দিকে। যাওয়ার আগে বেসিনের আয়নায় নিজেকে একটু দেখলো। ক্লিপ দিয়ে আটকানো চুল টা ছেড়ে দিলো।
রবিন খাটে হেলান দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। তার নজর স্ক্রিনে। সারা কাপ নিয়ে দরজা নক করলো। রবিন আসার অনুমতি দিলো। সারা ধীর পায়ে লাজুক মুখে ঢুকলো। রবিনের দিকে তাকিয়ে তার মনে শিহরণ বয়ে গেলো। এই শ্যামপুরুষ একদিন পুরোটাই তার হবে? ইশশশ!! সে চা নিয়ে এগিয়ে ধরলো রবিনের দিকে। কন্ঠ যথাসম্ভব নরম করে নতুন বউ এর মতো বললো –
“তোমার চা।”
রবিন ল্যাপটপে তাকিয়ে থেকেই হাত বাড়িয়ে চা নিলো। সারা নাক কুচকালো। আশ্চর্য!! একটু তাকালে কি হয়? এই গরমে যে সে চুলগুলা ছেড়ে আসলো, এইটা কি এমনি এমনি?
রবিন চায়ে চুমুক দিলো। দিয়েই ফ্লোরের দিকে ঝুঁকে মুখ থেকে ছুড়ে ফেললো চা। আকস্মিক ঘটনায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো সারা।। রবিন হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরে ঘাড় বাকিয়ে সারার দিকে তাকালো। সারা থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“কি হয়েছে?”
রবিন জিজ্ঞেস করলো-
“চা টা কে বানাইছে?”
সারা উত্তর করলো-
“আমি”
রবিন সারার দিকে কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
” নে, তুই একটু খাইয়া দেখ। ধর।”
সারা কিছু বুঝলো না। সে বোকা বোকা চোখে চেয়ে চা এর কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিলো।মুহুর্তেই মুখ কুচকে ফেললো। রবিন বললো –
“চায়ে চিনি দিতে হয়, লবণ না।”
সারা ব্যস্ত হয়ে বলল-
“আমি আবার বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
রবিন ল্যাপটপের দিকে মনোযোগ দিয়ে বলল-
“আর বানাইতে হবে না। তুই এখন যা। আমি কাজ করতাছি।”
রবিনের বলার ধরন দেখে সারা আর কিছু বলার সাহস পেলো না। সে বের হয়ে আসলো। কিচেনে এসে দেখলো চায়ের কেতলির পাশে লবনের বক্স। তার হাত কপালে চলে গেলো। হায় রে!! সে তার বিয়ে নিয়ে ভাবতে ভাবতে চিনির পরিবর্তে লবন দিয়ে চা বানিয়েছে। সারার নিজেকে দুটো চড় দিতে ইচ্ছে হলো।হবু স্বামীকে সে লবন দিয়ে চা বানিয়ে দিয়েছে। এর চেয়ে লজ্জার আর কি আছে!! বিয়ের পর নিশ্চয়ই রবিন এটা নিয়ে তাকে ক্ষেপাবে। আবারো বিয়ের কথা মনে হয় গেলো। ইশশশ!! সারা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। বিয়ের পর সে তার মিষ্টি হাতে রবিনের প্রিয় খাবার গুলো রান্না করে রবিনের মন ভালো করে দিবে।
সারা ঘরে গিয়ে দুই হাত মেলে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে আবার খুললো। মায়ের মুখ থেকে রবিনের সাথে বিয়ের কথা শুনার পর থেকে সারার যেন হার্টবিট বেড়ে গেছে। সময়ে অসময়ে বিচিত্র সব অনুভূতি হচ্ছে তার। রবিন কি তার এই অনুভূতির কথা কি কোনোদিন জানতে পারবে? রবিন কি তার প্রেম প্রার্থনায় সাড়া দিবে?
_______
চারু বিছানায় হাত মেলে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। তার দৃষ্টি শূন্য। তার মন ও শূন্য। সেই মনে নাম না জানা সব অনুভূতিরা ঝেঁকে বসতে চাচ্ছে। চারু জোর করে সরিয়ে দিচ্ছে। তারপর ও কাজ হচ্ছে না। চোখ বন্ধ করলেই রবিনের সাথে কাটানো বিভিন্ন মুহুর্তের কথা চোখে ভাসছে। চারু জোর করে বিরক্তি ভাব আনতে চাচ্ছে কিন্তু হচ্ছে না। এক অদ্ভুত কারনে রবিনের কথা ভাবতে তার ভাল লাগছে। মনে মনে রবিনকে নিয়ে ছবি আঁকতে ভালো লাগছে। যখন ই রবিনের কথা মনে হচ্ছে তখনি পেটের ভিতর জানি কিসব উড়াউড়ি করছে। চারু চেষ্টা করেও আটকাতে পারছে না। কবে থেকে হলো তার এমন? এটা কি প্রেম? নাকি কিছুদিনের আবেগ? আর যদি প্রেম হয় তাহলে রবিন কিভাবে নিবে এই অনুভূতিকে? রবিন কি সাড়া দিবে তার প্রেম প্রার্থনায়? নাকি নিষ্ঠুর হয়ে নামঞ্জুর করে দেবে?
একই সময়ে দুটো তরুণী একই ছেলেকে নিয়ে ভাবছে। দুজনেই চাচ্ছে তাদের প্রেম প্রার্থনায় সাড়া দিক ছেলেটি। কার ডাকে সাড়া দিবে ছেলেটি?
চলবে