#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-৪
আকস্মিক কাঁচা কঞ্চির আঘাতে তীব্র যন্ত্রনায় হাউ মাউ করে উঠল চারু। তার মনে হচ্ছে তার শরিরে যেন আগুনের ছুড়ি দিয়ে কেউ আঘাত করছে। ফালা ফালা করে দিচ্ছে তার শরির। শিরা উপশিরায় আগুন দৌড়াচ্ছে যেন।
চারুর হঠাত হাউ মাউ চিৎকারে রবিন সহ শাহাজাহান আলী ও চোখ তুলে তাকালেন। তারা এতক্ষন অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলছিল। চারুকে মারতে দেখে রবিনের অন্তর কেঁপে উঠল। সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে চারুকে আড়াল করে ধরল। ততক্ষণে চারুর কয়েক ঘা কঞ্চির মার খাওয়া হয়ে গেছে। হাউ মাউ করে কাঁদছে সে।
রবিন তাকে এক প্রকার বুকের মাঝে আগলে রাখল। রাজিয়া বেগম আর সাজেদা খাতুন দৌড়ে আসলেন। এসেই রবিনের বুকে থাকা চারুকে আগলে ধরলেন। কামরুজ্জামান থামলেন না সে নিচু হয়ে চারুর পায়ে আঘাত করলেন। রাজিয়া বেগম স্বামী যেদিকে আছে সেদিকে চারুকে ধরে থাকায় তার উপর কিছু কঞ্চির মার পড়ল। রবিন তাড়াতাড়ি তার মেজ মামিকেও আগলে ধরল। চিতকার করে থামতে বলল কামরুজ্জাম কে। কামরুজ্জামান থামলেন, তবে সেটা রবিনের চিতকারে না। শাহ জাহান আলী এসে হাত ধরায় তিনি থেমে গেলেন।
শাহজাহান আলী আগুন গরম চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনি হাতের কঞ্চি ছুড়ে মারলেন দূরে। হুংকার দিয়ে বললেন-
“এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলছস তুই? আমার মা র গায়ে হাত তুলছস? আমি উপস্থিত থাকতে তুই এত সাহস দেখাইলি। সৈয়দ বাড়িতে কেউ বাড়ির মেয়ে বউ দের গায়ে হাত তুলে না। এই শিক্ষা পাইছস তুই হারা*জাদা।”
কামরুজ্জামান সরে গিয়ে হাঁপাতে লাগলেন তার রাগ এখনো কমে নি। চোখ থেকে যেন আগুন ঝড়ছে। চারুকে এখনো রবিন ধরে আছে। সাজেদা খাতুন আর রাজিয়া বেগম ও ওইভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে কাদছেন।
চারুর ফোপানোর শব্দ ও শোনা যাচ্ছে।
কামরুজ্জামান তাচ্ছিল্য সুরে বললে-
“সৈয়দ বাড়ির মান সম্মান কি আর আছে? এই মাইয়ার লাইগা মান সম্মান সব শেষ।”
শাহ জাহান আলী প্রতুত্তরে বললেন –
“সৈয়দ বাড়ির মান সম্মান অত ঠুনকো না যে সামান্য কারনে যাইব গা। বাড়ির মেয়ে বউ র গায়ে হাত তুলবি না। বইলা গেলাম।”
শাহজাহান আলী ধুপ ধাপ পা ফেলে ঘরে গেলেন। তার যাওয়া দেখে বুঝা গেল পুরো ব্যাপারটায় তার রাগ সীমা ছাড়িয়েছে। কামরুজ্জামান তার ভাইয়ের যাওয়ার পানে দেখলেন তারপর রবিন তার স্ত্রী আর সাজেদা খাতুনের মাঝ খানে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে ফোপানো চারুকে দেখলেন। তারপর হন হন করে হেটে এই ভর সন্ধ্যা বেলায় ই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
কামরুজ্জামান চলে যেতেই রবিন চারুকে তার বুক থেকে টেনে দাড়া করাল। মেয়েটার মুখ চোখের পানি নাকের পানিতে একাকার। মুখ লাল হয়ে আছে। নাক আর ঠোঁট কাপছে কান্নার দাপটে। রবিন তাকিয়ে দেখল তার বড় মামি মেজ মামিও গুন গুন সুর তুলে কাদছে। এখনি পরিস্থিতি সহজ না করলে কারো কান্নাই আর থামবে না। সে চারুর মাথায় হাত রেখে বলল-
“কাঁদিস না। মেজ মামা রাগের বশে মারছে। ”
চারুর কান্নার দাপট বেড়ে গেল। সাজেদা খাতুন “ও চারু রে ” বলে জাপটে ধরলেন আবারো। রাজিয়া বেগম ও যোগ দিবে তার আগেই রবিন রাজিয়া বেগম কে উদ্দেশ্যে করে বলল-
“মামি কান্নাকাটি পরে হইব। আগে চারুরে দেখেন। পিঠে কঞ্চির মার পড়ছে অনেক।”
রাজিয়ে বেগমের টনক নড়ল। তিনি চোখ মুছে সাজেদা খাতুন কে ধরলেন। বললেন-
“আপা, চারুরে ঘরে নিয়া যাই চলেন। মেয়েটা অসুস্থ হয়া যাইব।”
সাজেদা খাতুন এইবার মুখ চোখ মুছলেন। তিনি আর রাজিয়ে বেগম চারুকে নিয়ে হাটা দিলেন ঘরের দিকে। ভেতর ঘরের বারান্দার এক কোণায় রনি আর ফারহানা দাঁড়িয়ে কাদছিল তারাও চারুর পিছু পিছু গেল। চারুকে মারার সময় ফারহানা বের হতে চাইলেও রাজিয়া বেগম ইশারায় আটকে দিয়েছিলেন। এক মেয়ের গায়ে মার পড়ছে, আরেক মেয়ে বের হলে তার গায়েও পড়বে কিছু। তাই আর বের হতে দেন নি।
চারুকে ঘরে নিয়ে এসে বিছানায় বসিয়ে দিলেন সাজেদা খাতুন। রাজিয়া বেগম কে বললেন একটু গরম পানি নিয়ে আসতে। রনিকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলেন। চারুর পিঠের জামা তুলে আতকে উঠলেন তিনি। ফারহানা “চারু রে” বলে চারুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। আজ চারু তার জন্য মার খেয়েছে। কি হত সে যদি চিঠি গুলো মামির হাতে না দিত?
কঞ্চির মারের জায়গা গুলো হালকা রক্ত জমাট বেঁধে লাল হয়ে ফুল আছে। রাজিয়া বেগম খাটের সাথে হেলান দিয়ে বিছানায় বসে একটু পর পর নাকের পানি মুছচেন আঁচলে। মেয়ের আঘাতে হাত দেয়ার সাহস তিনি পাচ্ছেন না। সাজেদা বেগম ই গরম পানি দিয়ে সেক দিয়ে দিলেন। চারু ক্ষনে ক্ষনে আর্তনাদ করছে , ফারহানা তাকে ধরে আছে।
রবিন এতক্ষন বসার ঘরে চেয়ারে বসে ছিল। সাথে ছিল রনি। মেজ মামি তাকে এসে বলে গেলেন চারু সুস্থ আছে। শুনে সে চারুর ঘরের দিকে গেল। দরজায় নক করল। ফারহানা খুলে দিল দরজা। ভেতরে ঢুকে সে দেখল খাটের সাথে হেলান দিয়ে চারু বসে আছে। কান্না থেমেছে কিন্তু চোখ মুখ আগের মতোই ফোলা। অনেক শক্ত মার খেয়েছে মেয়েটা। রবিন গিয়ে ওর পায়ের কাছে বিছানায় বসল। জিজ্ঞেস করল-
“শরির কেমন লাগে চারু? খুব ব্যথা লাগছে না?”
আদরের সুর শুনে চারুর কান্না পেল। সে কান্না আটকে মাথা নেড়ে বুঝাল ব্যথা লাগে নি।
রবিন জিজ্ঞেস করল-
“কিছু খাবি? বল কি খাবি? আমি আইনা দেই।”
“আইস্ক্রিম খাইবাম।”
আইস্ক্রিম এর কথা শুনে রবিন মৃদু হাসল। রনি হো হো করে হেসে চারুকে ধরল। এতক্ষনে যেন ওদের মনে হচ্ছে সব কিছু ঠিক হয়েছে। রনি চারুকে ধরে বলল-
“চারুপুর জিবনের একমাত্র দুর্বলতা হইল আইসক্রিম। তাই না?”
চারু চোখ রাঙাল। রবিন ফারহানার দিকে চেয়ে বলল-
“তুই কি খাবি?”
ফারহানা মৃদু কন্ঠে বলল –
“তুমি যা আনবে তাই। ”
রবিন উঠে দাঁড়িয়ে রনিকে বলল ” আয়”। সে রনিকে সাথে নিয়ে নামল। বসার ঘরে দেখা হল রাজিয়া খাতুনের সাথে।উনার হাতে ট্রে। ট্রে তে নুডুলসের দুইটা বাটি। একটা চারুর জন্য আরেকটা রবিনের জন্য। রবিনকে দেখে বললেন-
“কই যাস? না খাইয়া যাবি না বাপ।”
রবিন তাড়াতাড়ি নুডুলসের বাটি হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে দুই চামচ মুখে দিয়ে উঠে দাড়াল।বলল-
“যাইতে হবে মামি। মা অনেক্ষন যাবত কল দিতাছে।”
বলেই সে রনিকে নিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। বাজারে গিয়ে সে আইস্ক্রিম চিপ্স কিনল সবার জন্য। মামিদের জন্য পান আর জর্দা কিনে দিল। তারপর রনিকে বাড়ির গেটে নামিয়ে দিয়ে নিজের বাড়ির দিকে পথ ধরল।
———
রুবিনা বেগম অনেক্ষন থেকে বসার ঘরে পায়চারি করছিলেন। বার বার বাপের বাড়িতে ফোন করেও কাওকে পাচ্ছেন না। কেউ ফোন তুলছে না। রানি ডায়নিং এ বসে খিচুড়ি খাচ্ছে আর মা কে দেখছে। তার মনোযোগ আপাতত খিচুড়ি তে। চারুর জন্য আজ সারাদিন না খাওয়া সে। একটু আগে ঘর থেকে বের হয়ে খেতে বসেছে।
এর মধ্যেই রবিন বড় বড় পা ফেলে ঢুকল। ঢুকে এক বার মায়ের দিকে আরেক বার বোনের দিকে তাকাল। রবিনের অস্বাভাবিক চোখ মুখ দেখে রানি আর রুবিনা দুজনেই ভয় পেল।
রুবিনা বেগম বল্লেন-
“এত কল দিলাম ধরলিনা যে! ও বাড়ি সব ঠিকঠাক?”
রবিন কিছু না বলে রানির দিকে এগিয়ে গেল। রানি ভয়ে হাতে থাকা মাংসের পিস আর মুখে তুলতে পারল না। রবিন তার হাতে থাকা আইস্ক্রিমের পলিথিন ডায়নিং এর উপর রানির সামনে ছুড়ে ফেলে সিড়ির দিকে এগিয়ে গেল। পিছনে রুবিনা বেগম বললেন-
“কিরে কথা কস না? কি হইছে কিছু ক? চারু ঠিক আছে?”
তিনি কোনো উত্তর পেলেন না। রবিন ততক্ষণে সিড়ি বেয়ে চোখের আড়াল হয়ে গেছে। রুবিনা বেগম আবারো ফোন লাগালেন। কিন্তু কেউই তুলছে না। এইবার তিনি আর বসে থাকলেন না অন্য ব্যবস্থা নিলেন।
———–
রবিন ছাদে এসে সোজা ছাদের অপর পাশে চলে এল।। এখানে একটা খড়ের ছাউনি দেয়া ঘর। চারপাশে খোলা, কোনো দেয়াল নেই। সেখানে একটা চৌকি । চৌকির উপর বিছানা পাতা সুন্দর করে। পাশে একটা বেড সাইড টেবিল রাখা। টেবিলের উপর তার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ও আছে। সে এসেই ধুম করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন। তারপর কপালের উপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করল। চোখে বন্ধ করতেই চারুর মার খাওয়ার দৃশ্য টা ভাসল। চোখ খুলে উঠে বসল সে। টেবিল এর ড্রয়ার খুলে সিগারেটে বের করে জ্বালাল। সিগারেটে এক টান দিয়ে দুই হাটুর উপর দুই হাত রেখে নিচের দিকে মুখ করে ধোয়া ছাড়ল। ওভাবে হাত রেখেই একের পর এক টান দিল সিগারেটে এ। আজকে চারুর মার খাওয়া তার মনে দাগ কেটেছে। তার বোনের সমান বয়স মেয়েটার। ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে। এমন না যে চারু আগে কোনো দিন মার খায় নি। খেয়েছে। মামি মেরেছে, সে নিজেও মেরেছে। কিন্তু এত শক্ত মার দেয় নি কেউ। তার উপর মেয়ে হয়ে তার বাবার হাতে মার খাওয়ার দৃশ্য অনেক অসহনীয়।
সে সিগারেট ফেলে নিচে নামল। নেমে দেখল তার মা এখনো বসার ঘরে। ডায়নিং এ তাকাল রবিন। রানি নেই এখন আর সেখানে। সাথে আইস্ক্রিম প্যাকেট টাও নেই। রবিন সন্তুষ্টির শ্বাস ফেলল। বোন টা কে আজ অনেক বকেছে সে। খারাপ লেগেছে খুব।
রুবিনা বেগম ছেলেকে দেখে সোফা থেকে উঠতে যাবেন তার আগেই রবিন এসে পাশ ফিরে তার কোলে শুয়ে পড়ল। রুবিনা বেগম ছেলের গায়ে হাত রেখে বলল-
“মন টা কি খারাপ বাজান?”
রবিন চোখ বন্ধ করে উত্তর দিল-
“মা, চারুরে মেজ মামা মারছে খুব।”
রুবিনা অবাক হলেন না। এমন কিছু হয়েছে তিনি বুঝতে পেরেছেন। রবিন চোখ বন্ধ করে রেখেই বলল–
“চারু খুব কান্না করছে মা।”
রুবিনা বেগম ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন-
” এতে কি তর খারাপ লাগতাছে বাপ?”
রবিন উত্তর দিল “হুম”।
রুবিনা হাসল। হেসে বলল-
” তুই ও ত চারুরে কত মারছস। তখন খারাপ লাগে নাই?”
চলবে