#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-৪০
সময়টা মাঝরাত। আকাশে থালার মতো বড় চাঁদ উঠেছে। চারদিকে এক মায়াবী আলো। সেই মায়াবী আলোতে মাটির রাস্তা ধরে হাঁটছে রবিন। তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।শক্ত মুখে সিগারেটে টান দিয়ে ধোয়া ছাড়ছে সে। তালুকদার বাড়ির গেটে এসে আরেকটা লম্বা টান দিয়ে সিগারেটটা ফেলে দিলো। গেট পেরিয়ে বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করলো। আস্তে আস্তে হেঁটে সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। আজ আর দরজা খোলা পেলো না, ভেতর থেকে লাগানো দরজা। সে কলিং বেল চাপলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই খুলে গেলো দরজা। দরজায় রুবিনা বেগমকে দেখে রবিন কিছুটা বিস্মিত হলো। মায়ের দিকে এক পলক দৃষ্টি দিয়ে সে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলো। রুবিনা বেগম ছেলের গায়ে সিগারেটের গন্ধ টের পেলেন কিন্তু কিছু বললেন না। দরজালাগিয়ে এসে বললেন-
“হাত মুখ ধুইয়া আয়, টেবিলে খাবার দিতাছি।”
রবিন ডায়নিং এ গিয়ে নিজেই এক গ্লাস পানি নিয়ে খেলো। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি খাইয়া আসছি।তুমি মামা বাড়ি থাইকা চইলা আসলা যে!”
রুবিনা বেগম সোফায় এসে বসে বললেন-
“তোরা দুই বাপ বেটার লাইগাই তো বাপের বাড়ি গিয়া থাকতে পারি না।”
রবিন হাসলো কিছুটা। তারপর এগিয়ে এসে সোজা রুবিনা বেগমের কোলে শুয়ে পড়লো। ছেলের আদুরে ভাব দেখে রুবিনা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর কন্ঠ ছোট করে বললেন-
“সিয়াম ছেলেটারে পিডাইলি কেন এইভাবে?”
রবিন বিস্মিত হয়ে তারা মায়ের দিকে তাকালো। রুবিনা বেগম বললেন –
“এই ধরনের কাজ যে আমার ছেলে ছাড়া আর কেউ করতে সাহস পাইত না তা আমি জানি। বিয়ে বাড়িতে এই অঘটন কেন ঘটাইলি বাপ?”
“এই ছেলে মেয়েদের সাথে অসভ্যতা করছে।”
রুবিনা বেগম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
“কার সাথে? এই কথা তো জানতাম না।”
“চারুর সাথে।”
“তাই নাকি? চারু তো কাওরে কিছু জানাইলো না।”
“তোমার ভাতিজি একটা বেক্কল। সে নিজে মাতাব্বরি করতে গেছিলো। যদি খারাপ কিছু ঘটতো তখন এর দায় কে নিতো?”
রবিনের কন্ঠ অনেক রাগী শুনালো। সে রুবিনা বেগমের কোল থেকে উঠে বসলো।কিছুক্ষন বসে দাঁড়িয়ে থেকে বললো –
“অনেক রাত হইছে মা,শুইয়া পড়ো।আমি ঘরে গেলাম।”
বলেই বড় বড় পা ফেলে সিড়ি বেয়ে ঘরে চলে গেলো। রুবিনা বেগম শ্বাস ফেললেন। তার এই ছেলের মেজাজ এক্টুতেই চড়ে যায়। সিয়াম ছেলেটাকে তিনি দেখেছেন। যারা ছেলেটাকে মেরেছিলো তাদের কাউকেই ছেলেটা চিনতে পারে নি অন্ধকারে।সবার মুখেই রুমাল বাঁধা ছিলো। রুবিনা বেগমের তখনি সন্দেহ হয়েছিলো যে এই কাজ তার ছেলের দ্বারাই সম্ভব। এখন তিনি নিশ্চিত হলেন।
রবিন ঘরে এসে জামা কাপড় ছেড়ে গোসল করে আসলো। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা হার বের করলো।হারটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে হারটা সাম্নের দিকে ধরলো। হারটায় কেমন জানি চারু চারু ভাব,দেখেই যেন বুঝা যায় এই হার চারুর। রবিন হারটা নাকে ধরে জোরে একটা শ্বাস টানলো।
আজ হলুদের অনুষ্টানের সময় সে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ডেকোরেশনের তদারকি করছিলো তখনি তার নজর পড়েছিলো ছাদের দিকে। চারু রেলিং ঘেষে ফোন উঁচু করে সেল্ফি তোলায় ব্যস্ত। খোঁপায় ফুল গোঁজা শাড়ি পরিহিত চারুকে দেখে সে চোখ সরাতে পারে নি। খানিকের জন্য তার মাথা শূন্য হয়ে গিয়েছিল। শাড়ি পড়লে কি এই দুই আংগুলের মেয়েটাকে একটু বড় বড় লাগে নাকি? রবিনের ঘোর কাটলো চারুর পাশে একটা ছেলের আগমনে।তার ভ্রু জোড়া কুচকে গেলো সিয়ামকে চারুর পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে। এরপর রবিনকে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিলো।কিন্তু যখন শুনলো সিয়ামকে চারু পিন দিয়ে আঘাত করেছে আর আঘাত করার আগে সিয়াম চারুর কোমড়ে হাত দিতে চেয়েছিলো তখন আর সে নিজের মেজাজ ধরে রাখতে পারে নি। সৈয়দ বাড়িতে এসে সেই বাড়ির মেয়ের সাথেই অসভ্যতা সে বরদাস্ত করে নি। অন্ধকারে সিয়ামকে ডাকিয়ে এনে ছেলেদেরকে দিয়ে পিটিয়ে হাত ভেংগে দিয়েছে। সেই সাথে শাসিয়েছে এই বাড়িতে থাকাকালীন কোনো মেয়ের দিকে যেন নজরও না দেয়।
রবিন ক্লান্ত ভংগিতে বিছানায় শুয়ে পড়লো। হারটা মুঠোয় ধরা অবস্থায়ই এক নিমিষে ঘুমিয়ে পড়লো।
_______
চারুর ঘুম ভাংলো বিয়ে বাড়ির চিৎকার চেচামেচিতে। আড়মোড়া ভেংগে ঘুম থেকে উঠলো সে।পাশে তাকিয়ে দেখলো রানি অনেক আগেই উঠে গেছে। চারুও দেরি না করে উঠে পড়লো।ব্রাশ করতে করতে ঘরের সামনে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। নিচে উঠোনে উঁকি দিয়ে দেখলো সবাই ব্যস্ত কাজে। এক পাশে সে সিয়ামকে দেখতে পেলো।বেচারা ভাংগা হাত নিয়ে চেয়ারে বসে আছে আর তার মা তাকে খাইয়ে দিচ্ছে।চারুর খুব খারাপ লাগলো।কাল রাতে সিয়ামের বাবা ছেলের এই অবস্থা দেখে খুব হম্বিতম্বি করেছে।শাহজাহান আলী তখন তাকে শান্ত করেছে এটা সেটা বুঝিয়ে এবং কথা দিয়েছে এই ঘটনার সাথে জড়িত সবার শাস্তির ব্যবস্থা তিনি করবেন। চারু জানে কারোর ই কোনো শাস্তি হবে না।এই ঘটনা যে ঘটিয়েছে সে অনেক গভীর জলের মাছ। তাকে ধরতে গেলে পানিতে ডুবে মরতে হবে। রবিনের চিন্তা মাথায় আসতেই চারু সচেতন হলো।গত রাতে রবিনের হাতে সে তার গলার হার টা দেখেছে। হারটা রবিন কি করেছে? কোথাও ছুড়ে ফেলে টেলে দেয় নি তো? হার টা যে তার বড্ড প্রিয়। একবার জিজ্ঞেস করবে কি রবিনকে? নাহ কক্ষনও না।সে তার বড় বাবাকে কথা দিয়েছে যে সে আর রবিনের সামনে যাবে না। তাছাড়া তার বড়বাবাও তো রবিনকে না করেছে চারুর সামনে আসতে। এখন যদি চারু নিজে থেকে রবিনের সাথে গিয়ে কথা বলে তাহলে কি আর মান সম্মান থাকবে? নাহ চারু এই কাজ করবে না ভুলেও।হার গেলে গেছে, এমন হার সে আরো কয়েকটা কিনে ফেলবে।
আস্তে আস্তে সৈয়দ বাড়িতে বিয়ের ধুম পড়ে গেলো।বর কনেকে সাজিয়ে ছাদের স্টেজে বসানো হলো,বাড়ির সাম্নের খোলা মাঠটায় খাওয়ার আয়োজন করা হলো। চারদিকে গমগম করছে মানুষ। চারু লেহেংগা উঁচিয়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। তার মজাই লাগছে বিয়ে বাড়ি। রানি যতই তাকে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে সে কোনোকিছুই কানে নিচ্ছে না। পুরো ছাদ জুড়ে সে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে।
বিয়ে বাড়িতে একটা সময় গুঞ্জন উঠলো স্মৃতি আর ফরহাদের হঠাৎ বিয়ে নিয়ে। অনেক মহিলারাই বিভিন্ন প্রশ্ন তুললো। সাজেদা বেগম আর রাজিয়া বেগম সুন্দর করে সবার প্রশ্নের উত্তর দিলেন। তবে কয়েকজনকে উত্তর দিয়েও সন্তুষ্ট করা গেলো না।তার আড়ালে কানাকানি করতেই থাকলো।
রবিন বিয়ে বাড়িতে তার আনাগোনা উঠোন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখলো। এর মাঝে মামীরা এসে অনেক টানাটানি করেছে ছাদে যেতে রবিন যায় নি।মামাদের সাথেও তার কথা হয়েছে।শাহজাহান আলীর সাথেও রবিন কুশল বিনিময় করেছে। শাহজাহান আলীও সাড়া দিয়েছে। আশে পাশের কেউ দেখে বুঝবে না যে এই দুজনের মাঝে একটা ঠান্ডা দ্বন্দ্ব চলছে। খানিক বাদে রবিনের খুব কফি খাওয়ার প্রয়োজন বোধ হলো। কিন্তু সে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো না। উঠোনে বসেই একজনকে কফি আনতে ভিতরে পাঠালো। কফি নিয়ে আসলো সারা। রবিনের পাশে বসে সে কফির মগ বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
“তোমার কফি।”
রবিন ঝুঁকে নিচের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছিলো। সারার কথায় ধ্যান ভেংগে সারার দিকে ফিরলো।সারার হাত থেকে কফি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“কে বানাইছে?”
“মামী বানাইছে, মানে তোমার মা।”
রবিন চুমুক দিয়েই আরামে চোখ বন্ধ করে ফেললো।চোখ বন্ধ রেখেই ধীরে সুস্থে আরো একটা চুমুক দিলো মগে। সারা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখলো সবটা। কি সুন্দর করেই না কফি খাচ্ছে। সারার ইচ্ছে করলো রবিন যেদিকে চুমুক দিয়ে কফি খাচ্ছে সেখানে চুমুক বসাতে।কিন্তু সম্ভব নয় বলেই সে তার মনের ইচ্ছা দমন করলো। হালকা সুরে রবিনকে জিজ্ঞেস করলো-
“কাল থেকে তোমার দেখা পাই নি, এই বাড়িতে রাতে থাকো নি বুঝি?”
“না”
“বর কনেকে দেখতে যাবে না?”
“না”
“আমি শাড়ি পড়েছি আমায় কেমন লাগছে?”
রবিন না তাকিয়েই জবাব দিলো-
“সুন্দর।”
রবিনের দায়সারা জবাবে সারার মন টা ছোট হয়ে গেলো।
অতিরিক্ত লাফালাফি করার কারনে চারুর মুখ ঘেমে গিয়ে সাজ কিছুটা নষ্ট হয়ে গেলো।সে ছাদ থেকে নিচে নেমে তার ঘরে এলো। সাজ ঠিকঠাক করে ছাদের সিড়ির দিকে যাওয়ার সময় তার চোখ গেলো নিচে উঠোনের দিকে।সেখানে রবিন কফির মগ হাতে বসে আছে চেয়ারে, আর তার পাশের চেয়ারেই বসে আছে সারা। সারার এমন একটা ভাব যেন তারা বিবাহিত। চারুর চোখ জ্বলে গেলো। কিন্তু মুহূর্তেই সে নিজেকে সামলে নিলো।মনে মনে নিজেকে বললো ” চুলোয় যাক ওরা দুজন।চুলোয় যাক রবিন্যা,চুলোয় যাক ডাইনি সারা।” সে মুখ ঝামটা দিয়ে ছাদের সিড়ির দিকে চলে গেলো।
সারা কিছুটা নড়ে চড়ে বসে প্রশ্ন করলো-
“ওইদিন হাসপাতালে করিডোরে চারুর সাথে তোমাকে রেগে কথা বলতে দেখলাম।দূরে ছিলাম বলে শুনতে পাইনি। চারুর সাথে কি হয়েছে তোমার?”
রবিন উঠে দাঁড়ালো, তার কফি খাওয়া শেষ।মগটা সারার হাতে দিয়ে বলল-
“এইটা তোর দেখার বিষয় না।”
রবিন গেট দিয়ে বাইরে খাওয়ার জায়গায় চলে গেলো।সারার মুখের ভাব কঠিন হয়ে গেলো। হাতে থাকা কাপটা সর্বশক্তি দিয়ে চাপ দিলো। রবিনের এমন তাচ্ছিল্য করা তার নরম মনটাকে কঠিন করে তুলছে।
রাতের দিকে বর কনেকে বাসর ঘরে দেয়া হলো।বাসর ঘরে ঢুকতে গিয়ে ফরহাদকে অনেক গুলো টাকার নোট দিতে হলো চারু আর রানিকে। চারু আর রানি ঘরে এসে সেই টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়াও করলো। সেই ঝগড়ায় জিতল চারু। সে বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে টাকা বেশি নিয়ে নিলো।চারুর খামছি খাওয়ার ভয়ে বেচারি রানি আর এটা নিয়ে দ্বিরুক্তি করলো না,চুপচাপ মেনে নিলো।
বিয়ের অনুষ্ঠানের পরদিন ই রবিন গ্রাম ছেড়ে ঢাকা চলে গেলো। বিয়ের কয়েকদিন পর ফরহাদ আর স্মৃতিও ঢাকায় চলে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে দিলো।তারা আগে থেকেই ঢাকায় বাসা নিয়ে থাকতো তাই আর নতুন করে বাসা খোজার ঝামেলা থাকলো না। কামরুজ্জামানও স্মৃতির উপর থেকে সব রাগ দূরে সরিয়ে মেয়েকে দোয়া করলেন। এত দিন পর বাবার স্নেহের ছোয়া পেয়ে স্মৃতি কেঁদে দিলো।
আস্তে আস্তে সময় বয়ে যেতে থাকলো।চারুর এসএসসি পরিক্ষাও এগিয়ে আসলো। তার সারাবেলা কাটে এখানে সেখানে উলটা পালটা কাজ করে। এত চঞ্চলতার মাঝেও চারু হঠাৎ হঠাৎ থমকে যায়।তার অবাধ্য হৃদয় এক শ্যামপুরুষের গান শোনায় তাকে। যেই শ্যামপুরুষ নিষ্ঠুর হয়ে সেই গানের সুর ছিনিয়ে নিয়েছে।চারু পাত্তা না দিতে চেষ্টা করে। কখনো কখনো সফল হয় আবার কখনো কখনো এক রাশ অভিমান নিয়ে সেই শ্যামপুরুষের কথা চিন্তা করে। কিশোরী হৃদয়ের অনুভূতির যে কি তীব্রতা!!এ যেন জ্বালার চেয়ে যন্ত্রনা বেশি!!
চলবে