#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব- ৪২
সকালের মিষ্টি রোদের আলো এসে চারুর মুখের উপর পড়তেই ওর ঘুমন্ত মুখশ্রী কুচকে গেলো। রোদের আলো থেকে বাঁচতে মুখ সরিয়ে অন্য দিকে ফিরলো তাও শেষ রক্ষা হলো না।এদিকের জানালাও খোলা থাকার কারনে রোদ এসে এদিকটা দিয়েও ঘরে ঢুকেছে। চারু বিরক্ত মুখে হালকা চোখ খুলে তাকালো। চোখে আলো পড়তেই আবার চোখ বন্ধ করে নিলো। মুখ ঘুরিয়ে সোজা হয়ে ছাদের দিকে মুখ করে চোখ মেললো। চোখে আলো কিছুটা সয়ে যেতেই শুয়ে থেকে আড়মোড়া ভাঙলো। তারপর উঠে বসলো। বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে টাইম দেখতেই আঁতকে উঠলো। হায় হায়! ১০ টায় কলেজে ক্লাস আছে। চারু এক লাফে খাট থেকে নেমে বাথরুমে দৌড় দিলো। তারপর ফ্রেশ হয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এক ছুটে নিচে চলে আসলো। নিচে আসতেই চোখ পড়লো সোফার দিকে। ফরহাদ বসে আছে ফীহাকে কোলে নিয়ে। ফীহার মুখের আশপাশে খাবার লেপ্টে আছে। স্মৃতি বার বার তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সে মুখ এদিক ওদিক করছে। চারু হেসে এগিয়ে এসে ফরহাদের পাশে বসলো।ফীহা চারুকে দেখেই হাত বাড়িয়ে দিলো।সে চারুর কোলে যাবে। চারুও এক টানে কোলে নিয়ে নিলো।ফরহাদ চারুর কাছে ফীহাকে দিয়েই উঠে এক প্রকার পালিয়ে গেলো। স্মৃতি রাগী কন্ঠে বলল-
“এই যে,এখন তোর কোলে গেলে তো আর খাইতেই চাইব না। বাপ তো তোর কোলে দিয়াই খালাস।আমার হইছে যত জ্বালা।”
চারু ফীহার ফোলা গালে চুমু খেয়ে বলল-
“উফফফ আপু, তুমি খালি বকা দেও আমার মামনিটারে। এক বেলা কম খাইলে কিছু হইতো না।”
স্মৃতি হতাশ শ্বাস ফেললো। এই তিন বছরের মেয়ে তার হাড় মাংস জ্বালিয়ে খাচ্ছে। প্রতিদিন খাওয়া নিয়ে যুদ্ধ করতে হয় এই মেয়ের সাথে। ফীহা আধো আধো ভাষায় চারুকে বললো-
“মামন,তুমি ভালো।আম্মু পচা।খালি বকে।”
চারু হেসে ফীহাকে আরেকটা চুমু খেলো। ফীহাকে সে মামনি ডাকে।ফীহাও তার দেখাদেখি চারুকে মামনি ডাকতে চায়, কিন্তু সবটা উচ্চারন করতে পারে না।তাই মামন বলেই ডাকে চারুকে। স্মৃতি বুঝলো আর খাওয়ানো সম্ভব হবে না ফীহাকে। তাই ফীহার মুখ মুছিয়ে দিলো। সিড়ি বেয়ে গটগট করে নিচে নামলো রনি।চার বছরে অনেকটাই বড় হয়েছে সে।এইবার সে সিক্স থেকে সেভেনে উঠবে। রনি এসেই ফীহাকে চারুর কাছ থেকে নিয়ে নিলো। ফীহাও দাঁত বের হেসে রনির গলা জড়িয়ে ধরলো। চারু উঠে গিয়ে ডায়নিং এ খেতে বসলো।এখন না খেলে তার কলেজের দেরি হয়ে যাবে।
রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে বের হয়ে এলো সাজেদা বেগম। পিছু পিছু এলো সামিরা বেগম। তার হাতেও খাবারের বাটি। দুজনই টেবিল সাজাতে লাগলেন। সাজেদা বেগম রনিকে ডেকে বললেন-
“ও রনি, যা তোর বাপ চাচারে ডাইকা আন। বেলা পইড়া যাইতাছে তো।”
রনি ফীহাকে কোলে নিয়েই বাড়ির কর্তাদের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। চারু প্লেটে রুটি নিয়ে বায়না করে বলল-
“ও বড়চাচী, একটু আমসত্ত্ব দেও না। আমি একটুও খাইছি না৷”
চারুর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে রাজিয়া বেগমের গলা শুনা গেলো।তিনি সাজেদা বেগমকে ডেকে বললেন-
“আপা,ওরে আমসত্ত্ব দিও না।গত রাত থাইকা ওর পেট ব্যথা।”
চারু ঠোঁট ফুলালো। সাজেদা বেগমের দিকে তাকিয়ে মুখ নাড়িয়ে অনুনয় করলো।বিনিময়ে সাজেদা বেগম চোখ রাঙালেন। চারু বুঝলো তার আর আমসত্ত্ব খাওয়া হবে না।অগত্যা সে ঠোঁট ফুলিয়ে রুটি ছিড়তে লাগলো।
_____
চারু আর রানি দুজনেই রিক্সা করে কলেজ গেটে এসে নামলো। কলেজ গেটে ছেলেদের বেশ ভীড় দেখলো দুজনেই। কিন্তু তারা চিন্তিত হলো না।দুজনেই জানে গেটে যাওয়ার সাথে সাথে সব ছেলেরা দূরত্ব রেখে দাঁড়াবে। হলোও তাই।চারু আর রানি গেটের কাছে যেতেই সব ছেলেরা ধাক্কাধাক্কি করে দূরে সরে দাঁড়ালো। চারু আর রানি নির্বিঘ্নে কলেজে ঢুকলো। চারু মাঝে মাঝে একটা কথা চিন্তা করে অবাক হয়। রানির সাথে কোনো ছেলে কথা বলার সাহস পায় না কারন তুহিন সবাইকে শাসিয়েছে কেউ যেন রানির আশেপাশে না আসে।কিন্তু চারুর ক্ষেত্রেও এমন হয় কেন? চারুর সাথেও কোনো ছেলে কথা বলে না দরকার ছাড়া। প্রপোজ করা তো অনেক দূরের বিষয়। তার জন্য কি কেউ শাসিয়েছে ছেলেদেরকে? এসব কথা ভাবলে যার নাম টা চারুর মনে আসে সে হলো রবিন। চারু বুঝে সবই, সে বোকা না।কিন্তু রবিন তার সামনে কেন আসে না এটা ভেবে তার রাগ হয় অনেক। এতই যদি কেয়ার করবে মাঝে মাঝে একটু দেখা দিলে কি হয়। চারু না হয় সামনে না গিয়ে দূর থেকেই উঁকি দিয়ে দেখলো। তার বড়বাবা না করেছে মুখোমুখি হতে কিন্তু সে মুখোমুখি না হয়েও তো একটু চোখের তৃষ্ণা মিটাতে পারে তাই না!! চারু ঠোঁট কামড়ালো। তার নির্লজ্জ চিন্তাভাবনা নিয়ে তার বিড়ম্বনার শেষ নেই। সে মাথা থেকে চিন্তা ঝেড়ে ক্লাসরুমের দিকে এগিয়ে গেলো।
কলেজ ছুটির পর গেট পেরিয়ে রিক্সায় উঠতে নিতেই বাইকের হর্নে দুজনেই পিছনে তাকালো। তুহিন বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে সানগ্লাস, ঠোঁটে উপচে পড়া হাসি। রানির মুখ লাজুক লাজুক হয়ে গেলো। চারু আড়চোখে রানির মুখ দেখে চোখ উল্টালো। রানি মৃদু কন্ঠে চারুকে বললো-
“একটু দাড়া,আমি একটু শুইন্না আসি কি বলে।”
রানি ধীর পায়ে তুহিনের দিকে এগিয়ে গেলো। তুহিনের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। তুহিন চশমা খুলে রানির দিকে তাকিয়ে ৩২ পাটি দাঁত বের হাসলো। হাত নেড়ে নেড়ে গল্প জুড়ে দিলো সে।
অনেক্ক্ষণ পরেও রানি আসছে না দেখে চারুর বেশ রাগ পেলো। সে হাতের আংগুল ফুটালো আর মনে মনে অনেকগুলো গালি দিলো তুহিন আর রানিকে। তাকে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখে দুজনে প্রেমে ব্যস্ত। যেন অন্য এক দুনিয়ায় চলে গেছে তারা।নাহ এদেরকে এই দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনতে হবে নয়ত আজীবন এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে তাকে। চারু নিচের দিকে আশেপাশে তাকিয়ে একটা ছোট পাথর তুলে নিলো।তারপর ঢিল ছুড়লো রানি আর তুহিনের দিকে। পাথর গিয়ে আঘাত করলো তুহিনের বাইকের সামনের দিকে। শব্দ পেয়ে রানি আর তুহিন দুজনেই চমকে উঠলো।কি হয়েছে বুঝতে পেরে দুজনেই চারুর দিকে তাকালো।চারু কোমড়ে দু হাত রেখে মাথা দিয়ে ইশারা করে রানিকে তাড়াতাড়ি আসতে বললো। তুহিন রানির দিকে তাকিয়ে রসিক কন্ঠে বলল-
“তাড়াতাড়ি যাও, নইলে আমার শালিকা ঢিল দিয়া আমার মাথা ফাটায় দিব।”
রানি মুচকি হেসে হাঁটা ধরলো চারুর দিকে। তুহিন বাইক টান দিয়ে চারুর কাছাকাছি বাইক নিয়ে স্লো করলো। তারপর গলা নামিয়ে বললো –
“চালের নাড়ু, তোমার আশিক গ্রামে আইছে তো।দেখা হইছে নাকি?”
বলার সাথে সাথে একটা চোখ মেরে এক টানে বাইক নিয়ে চলে গেলো। চারু তুহিনের কথার মর্মোদ্ধার করতে পারলো।তার মানে সত্যিই রবিন এসেছে গ্রামে। গতরাত পর্যন্ত চারু কিছুটা দ্বিধায় ছিলো কিন্তু এখন তুহিনের কথায় সে নিশ্চিত হলো। সে একটু আশেপাশে নজর বুলালো, রবিন কি আশেপাশে আছে?রানি এসে রিক্সা ঠিক করে চারুকে নিয়ে উঠে বসলো। চারু রিক্সায় উঠেও এদিক ওদিক একটু দেখলো। সে জানে সে রবিনকে দেখতে পাবে না তারপরও তার অবাধ্য চোখ আর মন যে কোনো যুক্তি মানে না।
চারুর রিক্সা আস্তে আস্তে রাস্তা থেকে আড়ালে চলে গেলো। কলেজের পাশের একটা দোকানের চেয়ারে বসে চারুর কাঙ্খিত মানুষটি স্থির চোখে তাকিয়েছিলো তার দিকে এতক্ষন। চারু সেই কথা হয়ত কোনোদিন জানবে না। এই ক্ষুরধার দৃষ্টির প্রখরতায় যদি সে একবার চোখ রাখতো তাহলে হয়ত তার হৃদপিণ্ড অসাড় হয়ে যেত,মস্তিষ্কের নিউরন ক্ষণিকের জন্য তার কার্যক্রম থামিয়ে দিতো। চার বছর অনেক লম্বা সময়, সেই লম্বা সময়ে প্রেয়সীর প্রতি তৃষ্ণার্ত প্রেমিকের চোখের দৃষ্টি যে কতটা ভয়ানক হতে পারে তা চারুর জানা নেই।জানলে এই মেয়ে সেই প্রেমিকের দেখা পেতে এত ছটফট করতো না,বরং সেই ধ্বংসাত্মক দৃষ্টিতে চোখ না মিলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতো। কাঙ্খিত মানূষটি চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।চোখ বন্ধ করে মাথা পিছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিলো।দূর থেকে প্রেয়সীকে দেখতে ভালো লাগে না আর। কাছ থেকে দেখতে মন চায়,ছুয়ে দেখতে মন চায়,নিশ্বাসের গরম আভার ছোয়া পেতে মন চায়। বেহায়া মনটাকে চার বছর ধরে বেধে রাখতে পারলেও এখন আর পারা যাচ্ছে না। এই যন্ত্রনার শেষ কোথায়?
_________
সারা রান্নাঘরে রান্না করতে ব্যস্ত।আজ সে সকাল থেকে অনেক কাজ করছে। ফাতেমা বেগম রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ডাক ছুড়লেন-
“হ্যা রে আর কতক্ষন?”
“আর একটু মা। তুমি একটু বসো না গিয়ে।”
“ট্রেন মিস হইব তো তাড়াতাড়ি কর। ”
সারা চুলা বন্ধ করে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। হাত মুছতে মুছতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল-
“এমা!! তুমি এখনো রেডি হও নি কেন?”
“তুই আগে গিয়া রেডি হ।বেশি দেরি হইলে তোর ভাই চিল্লাইব পরে।”
“আচ্ছা যাচ্ছি।”
সারা তার নিজের ঘরে চলে এলো। লাগেজ আগে থেকেই গুছানো আছে এখন সে একটু সুন্দর করে রেডি হয়ে নিলেই হবে। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে মোবাইল টা নিয়ে ফটো এলবাম এ ক্লিক করলো। তারপর একটা গোপন ফোল্ডারে ঢুকলো।সেখানে রবিনের অগণিত ছবি।সব ছবিই লুকিয়ে তোলা হয়েছে। সারা রবিনের ছবির উপর হাত বুলালো।আর কয়েক ঘন্টা পর ই দেখা হবে রবিনের সাথে। গত চার বছরে রবিনের সাথে অনেক দেখা হয়েছে তার। যদিও বেশিরভাগ সময় সারাই তার মাকে দিয়ে রবিনকে ইমোশনাল কথাবার্তা বলে বাসায় এনেছে, রবিন বাসায় আসতে না চাইলে সে নিজেই বিভিন্ন উছিলায় বাইরে রবিনের সাথে দেখা করেছে। কিন্তু আজকের দেখা হওয়া টা সারার কাছে অন্যরকম।যতবার ই সারা রবিনের বাড়িতে গিয়েছে ততবার ই সারা স্পেশাল ফিল করেছে। এইবার চার বছর পর মামা বাড়ি যাচ্ছে। কারন চার বছর পর আবারো জমজমাট করে মেলা হচ্ছে। আর সব বারের মতো মেলার আয়োজক হচ্ছে তালুকদার পরিবার। সারা অনেক এক্সাইটেড। সে আলতো করে রবিনের ছবি ছুয়ে বললো –
“চার বছর কেন চার যুগ লাগলেও আমি তোমাকে চাই।তোমার মনে অন্য কেউ থাকলেও আমি তাকে টেনে হিচড়ে বের করে আনব তোমার মন থেকে।”
শেষের কথাটা বলার সময় সারার গলার আওয়াজ অনেক কঠিন শোনালো। ভালোবাসা আদায়ের জন্য একটু কঠিন হলে ক্ষতি নেই। Everything is fair in LOVE and WAR.
চলবে