#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-৬
চারু আধবোজা চোখে তাকাল দরজার দিকে। বাইরের আধো আলোতে একটা পুরুষ অবয়ব দেখল। অবয়বটি তার চেনা লাগছে। আস্তে আস্তে অবয়বটি হেটে এসে চেয়ার নিয়ে তার বিছানার পাশে বসল। গায়ে কড়া গন্ধ এসে চারুর নাকে ধাক্কা খেল। নিমিষেই সে অচেনা আগন্তুক কে চিনে ফেলল। একটু পরেও খসখসে পুরুষালি হাতের ছোয়া টের পেল কপালে। চারু কিছু বলতে চাইল পারল না।জ্বরে ঘোর নিয়েই সে চেয়ে রইল। আগন্তুক টি তার জ্বরে তপ্ত হওয়া হাত টি নিয়ে আগন্তুকটির বুকে চেপে ধরল।
পরক্ষনেই হু হু করে কেঁদে দিল। চাপা কান্নার শব্দ অনেক টা বিষাদের সুরের মত শোনাল। কান্নার দাপটে আগন্তুকটির শরীর নড়ছে। সাথে চাপা স্বরে বলা কিছু কথা ভেসে এল। চারুর বোধগম্য হলো না কি বলল।
চারুর চোখ পড়ল দরজায়। সেখানেও একটা অবয়ব দেখতে পেল। অবয়বটি কোনো মহিলার। চারু হঠাৎ করেই তার মনে অনেক প্রশান্তি অনুভব করল । মনের শান্তির জন্য কি না জানা নেই তার চোখে রাজ্যের ঘুম চলে এলো। সে দূর্বল হাতে আগন্তুক টির হাত আকড়ে ধরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
রাজিয়া বেগম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মেয়ের প্রতি বাবার ভালবাসা দেখলেন। মানুষ টা কে তিনি কখনো কাঁদতে দেখেন নি। আজ মেয়ের গায়ে হাত তুলে মাঝ রাতে লুকিয়ে মেয়ের ঘরে এসে কান্না করছেন। বাবাদের ভালোবাসা কি এমনই?
_______________
চারুর জ্বরের কথা শুনে রুবিনা বেগম সহ রানি আর রবিন এল সকাল দশ টার দিকে। রানি চারু ঘরে আসতেই চারু মুখ ঘুরিয়ে নিল। রানি কাচুমাচু হয়ে বিছানায় বসল। মিন মিন করে বলল-
“কোনো উপায় ছিল না রে। ভাইয়া এমন ভাবে আমারে জেরা করছিল আমি ভয়ে সব বইলা দিছি। ”
“তোর কসমের কোনো দাম নাই আমি বুঝলাম। বই ছুইয়া কসম খাইছিলি মইরা গেলেও বলবি না। কসম যেহেতু ভাংছস এখন মর।”
রানির কিছুটা ভয় ভয় লাগল। সে আরেকটু এগিয়ে বসল। চারু আরো সরে গেল। রানি কণ্ঠে অসহায়ত্ব ঢেলে বলল-
“ভাইয়া বাড়িত গিয়া আমারে রুম থাইকা টাইনা বাইর কইরা এমন ধমক দিল যে আমি ভয়ে আর কসমের কথা মনে রাখতে পারি নাই।”
চারু কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুবিনা সহ তার মা আর রবিন ঢুকল ঘরে। রবিন স্থির চোখে চারুর দিকে তাকিয়ে রইল ত রইল ই। চারুর খুব লজ্জা পাচ্ছে কেন জানি। সে এম্নিতে লজ্জা শরমের ধার ধারে না। কিন্তু গত কাল রবিন যেভাবে তাকে বুকে আগলে নিল এর পর থেকেই রবিন এর কথা মনে হলেই তার কেমন জানি লাগছে। এর আগে কোনোদিন ই রবিনের এত কাছে যায় নি সে।
রবিন কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল-
“তোরে আইস্ক্রিম কিনে দেয়াটাই ভুল হইছে আমার। এত গুলা আইস্ক্রিম একসাথে কেউ খায়? তুই কি রাক্ষস?”
চারু খুব ই বিব্রত হল। এইভাবে খাওয়ার খোটা দিল? আবার রাক্ষস ও বলল। সে নিচের দিকে তাকিয়ে থেকেই পুরোটা সময় কাটিয়ে দিল।
রবিন তার মা আর বোন কে বাড়ির ভিতর রেখে বাইরে বের হল। উঠোন পেরিয়ে গেট দিয়ে বের হয়ার সময় আরেক্টুর জন্য ধাক্কা খেত লিজার সাথে। সে পিছিয়ে গেল। লিজা আর ঢুকল না, গেটের পাশে সরে গিয়ে রবিন কে যাওয়ার জায়গা করে দিল। ফাকা পেয়ে রবিন ভ্রু কুচকে বেড়িয়ে গেল। একটু দূরে রাখা তার বাইকের কাছে গিয়ে উঠে বসল। তার ফোনে কিছু একটা দেখে বসা থেকে একটু উঠে প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করল।
সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধরতেই লিজার হাত চলে গেল তার বুকে। লাইটার টা জ্বলে উঠতেই লিজার মনে হল তার হৃদপিণ্ডে আগুন ধরল যেন।
সিগারেটে টান দিয়ে মুখ নিচু করে বাম পাশে ঘাড় বাকিয়ে ঠোট গোল করে ধোয়া ছাড়ল রবিন। এক রাশ ধোয়া উড়ে গেল তার কাঁধের পাশ দিয়ে। লিজা হা করে রইল। ইশ! এইভাবে ধোয়া ছাড়লে ত ওর সুস্থ থাকা সম্ভব না। অজ্ঞান হয়ে যাবে তো!! রবিন ভ্রু কুচকে আরেকবার লিজার দিকে তাকাল। এমন এক দৃষ্টি দিল লিজার মনে হল ওর দিকে কয়েকটা মিসাইল ছুটে আসছে। ও এক ছুটে উঠান পেরিয়ে সিড়ি ভেংগে ঝড়ের বেগে চারুর ঘরে গিয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে একদম বিছানায় সটান শুয়ে পড়ে বুকে হাত দিয়ে হাঁপাতে লাগল।
আকস্মিক এই ঘটনায় চারু রানি দুজনেই “আয়ায়ায়া” বলে ছোট এক চিৎকার দিয়ে বসল। তার পর লিজার দিকে ঝুকে এল দুজনেই। লিজা ওদের দিকে তাকিয়ে বলল –
“আমি মনে হয় বেশি দিন বাঁচতাম না রে। হুজুর ডাকায়া দোয়া দরূদ পড়াইতে ক।”
চারু রানি দুজনেই বড় বড় চোখ করে তাকাল। রানি জিজ্ঞেস করল-
“লিজা আপু , তোমার হইছে টা কি?”
লিজা জানালার দিকে ইশারায় দেখিয়ে বলল-
“ওইদিকে তাকায়া দেখ।”
বলেই দুই হাত দিয়ে মুখে ঢেকে উপুড় হয়ে বিছানায় মুখ চেপে ধরল যেন বিরাট লজ্জার ব্যাপার ঘটে গেছে।
চারু আর রানি জানালার ধারে দিয়ে নিচে তাকাল। নিচে রবিন ঠোটে সিগারেট চেপে ধরে ফোন টিপছে। চারু আর রানি দুজন একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। তাকিয়ে দুজনেই ঠোঁট বাঁকাল। তারপর গিয়ে বিছানায় বসল। রানি বলল-
“এত ঢং কইরো না ত লিজা আপু। ভাইয়া এসব পছন্দ করে না।”
লিজা তড়াক করে উঠে বসল। রানির কথায় পাত্তা না দিয়ে আয়নার কাছে গিয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। তারপর ওদের দিকে ঘুরে বলল-
“আমারে কেমন লাগতাছে দেখতে? আসার সময় একটু রূপচর্চা করতে পারি নাই। ইশশ এত এত রূপচর্চার জিনিস কিনে লাভ কি যদি না ঠিক সময় কাজে লাগে।”
সে হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ল। চারু এতক্ষন পর বলল-
“রবিন ভাইরে দেখতে এত দৌড়ায়া আসছো? কালকেও ত দুইবার আসছিল তখন আসলা না কেন?”
লিজা কিছুটা বিব্রত হয়ে চারুর হাত ধরে বলল-
“না রে চারু আমি ত তোর জ্বরের কথা শুইনা আসলাম। সকালে ই নানা বাড়ি থাইকা আসছি। পরে শুনলাম তোর জ্বর। তাই দেখতে আসছি। ”
চারু কিছু বলল না। লিজা রানির দিকে তাকিয়ে বলল-
“রবিন ভাই কতদিনের জন্য আসছে এইবার? কত সুন্দর হইয়া আসছে। কি হ্যান্ডসাম!”
রানির মুখ তেতো হয়ে গেল। এই নির্লজ্জ মেয়েকে তার পছন্দ না। তার ভাইয়ের পিছনে অনেক দিন ধরে পড়ে আছে। তার ভাই জানলে এক ধমকে ভবলীলা সাঙ্গ করে দিবে।।
_______
রবিন বাইক নিয়ে সোজা বাজারে চলে এল। এসে তার আরো অনেক সাঙ্গ পাঙ্গ জুটে গেল। সে একটা চায়ের দোকানে ঢুকতে নিলে লিমন তার শার্টের হাতা টেনে বলল-
“ভাই ওইদিকে তাকায় দেখো। ”
রবিন লিমনের কথায় তার ডান পাশে তাকাল। একটু দূরে বটগাছের নিচে জামশেদ মজুমদার মিটিং করছেন। আশে পাশে অনেকেই চেয়ার নিয়ে গোল হয়ে বসে আছে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে কেউ আবার মাটিতেই বসে শুনছে তার কথা। জামশেদ মজুমদার হাত নেড়ে বক্তৃতার মতো করে কথা বলছেন।
রবিন সেদিকে দেখে চায়ের দোকানে ঢুকল। আড্ডা দেয়ার মাঝখানে সবুর আলী কয়েকজন সহ দোকানে এসে ঢুকল। তার পর রবিন কে দেখে এমন ভাব করল যেন সে জানতোই না রবিন এখানে আছে। পাশের টেবিলে বসে রবিনের দিকে তাকিয়ে পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলল-
“কেমুন আচো রবিন? তোমারে ত অহন গেরামে দেহা যায় না? শহরেই থাকো বেশি?”
“জী। পরিক্ষা ছিল তাই আসতে পারি নাই।”
“কবে আইলা গেরামে? আগে দেখলাম না ত তোমারে?”
“২-৩ দিন হইছে আসছি।”
“আর সপ্তাহ খানেক পরেই ত মেলা। মেলা দেইখা যাইবা নাকি আগেই যাইবা গা?”
“না মেলা শেষ কইরাই যাব। আমার পরিক্ষা শেষ। ভার্সিটিতে তেমন কাজ নেই।”
সবুর আলি গলা খাকারি দিলেন। বল্লেন-
“ভার্সিটিত রাজনীতি- টিতি করো নাকি?”
রবিন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল-
” জি, হাল্কা পাতলা করা হয়।”
সবুর আলী এইবার একটু ঝুঁকে এলেন রবিনের দিকে। এসে নিচু স্বরে বললেন-
“কি চিন্তা করলা বাপের রাজনীতিতে যোগ দিবা নাকি চাকরি বাকরি করবা?”
রবিন আড়চোখে দেখল সবুর আলির দিকে। সত্তরের কাছাকাছি বয়স। পাকা চুল,পাকা দাঁড়ি। এই বয়সে মসজিদে পড়ে থেকে আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়ার কথা কিন্তু উনি নোংরা রাজনীতিতে ব্যস্ত। রবিন চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল-
“আল্লাহ যেইখানে রিজিক রাখছে সেখানেই যোগ দিব। আসি দাদা।”
রবিনকে উঠে যেতে দেখে সবুর আলী ব্যস্ত কণ্ঠে বলল-
“হ হ রিজিকের মালিক ত আল্লাহ ই।”
রবিন চায়ের দোকান ছেড়ে দলবল নিয়ে বাইকের দিকে এগিয়ে গেল যাওয়ার আগে একবার বটগাছের দিকে চাইল। মিটিং এখনো চলছে। এখন বক্তৃতা দিচ্ছে দলের অন্য একজন। রবিন জামশেদ মজুমদারের দিকে তাকাল। চোখে চোখ পড়ে গেল। এতক্ষন রবিনকেই দেখছিল সে।
রবিন বেরিয়ে যেতেই সবুর আলি পাশের জনকে লক্ষ্য করে চাপা স্বরে বলল-
” তালুকদারের পোলা সে, রাজনীতি ছাড়ব না। ওর বাপ দাদাও ছাড়ে নাই। ”
পাশের জন উত্তর দিল-
“তালুকদারেরা যতদিন আছে ততদিন এই গেরাম ওদের দখলেই থাকব।”
সবুর আলী টেবিলে থাবা দিয়ে বলল-
“ওদের বংশ নির্বংশ কইরা দেওন লাগব। ওরে দিয়া ই শুরু করবাম। ওর দাদারে মারতে পারি নাই ওই আফসোস এখনো যায় নাই আমার। এইবার মেলাতেই রবিন্যার জীবন প্রদীপ নিভায়া দেওন লাগব।”
চলবে