#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-৫৩ (শেষ পর্ব)
চারু ছাদের রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার দৃষ্টি বাড়ির সামনের বাগানে। সেখানে রবিন বসে আছে। চারু তার হাতে থাকা আচারের বাটি থেকে একটু একটু করে আচার খাচ্ছে আর রবিনকে দেখছে।বাগানের মাঝে একটা খড়ের ছাউনি করে সেটায় চেয়ার টেবিল পেতে রাখা হয়েছে।রবিন সেখানে চেয়ারে বসে রাশভারী ভাব নিয়ে ফাইল পত্র দেখছে।তার পড়নে সাদা পাঞ্জাবি। তার আশেপাশে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা ছেলে। রবিন একটা করে ফাইল দেখা শেষ করছে আর একটা করে লোক বিদায় হচ্ছে।পরক্ষণেই আরো একটা ফাইল তুলে নিচ্ছে।বাম হাতে ঠোঁট ঘষতে ঘষতে গভীর মনোযোগ দিয়ে ফাইল দেখছে। ভাবখানা এমন যেন সে কোনো রাজা – মহারাজা।চারু আচার চাটতে চাটতে একটা মুখ ভেংচি দিলো। মুখে বলল “ঢং”। তারপর রেলিঙ থেকে সরে এসে ছাউনির নিচে চৌকিটায় বসলো।
আজ সকালে গোসল করে সে নরমাল সালোয়ার কামিজ পড়েই বের হতে চাচ্ছিলো।কিন্তু মাঝখান থেকে রুবিনা বেগম এসে তাকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে। সেই থেকে সে শাড়ি পড়েই আছে। শাড়ি পড়ে বের হয়ে তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে।মেয়েরা সব তাকে ঘিরে ধরে অসভ্য অসভ্য কথা জিজ্ঞেস করেছে।এমন সব কথা যে লজ্জা শরম কম থাকা চারুরও তখন লজ্জায় মাটি ফাঁক করে তার ভিতরে ঢুকে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিলো।রবিন কি কি করেছে জানার জন্য মেয়েরা হামলে পড়েছিলো।এসব কথা মনে পড়তেই চারু লজ্জা মাখা হাসি দিলো।আসলেই তো রবিন কখন তার সাথে এসব করবে?চারু সাথে সাথে জিভ কাটলো।কিসব কথা ভাবছে সে।মনে পড়লো রানিরও গতকাল বাসর হয়েছে।তাকেও নিশ্চয়ই এসব কথা শুনতে হয়েছে।রানির কথা মনে হতেই খানিক আগে রানির দেয়া কলের কথা মনে পড়ল চারুর। রানি কল দিয়ে কি ঝাড়িটাই না দিলো চারুকে।ওই মেসেজের জন্য তুহিন নাকি জ্বালিয়ে মেরেছে।তারপর যখন রানি বলেছে যে এটা একটা গানের লাইন তখন শান্ত হয়েছে।তারপরেও শেষ রক্ষা হয় নি তাকে ওষুধ আর মলম দুটোই এনে দিয়েছে। চারু হেসে ফেললো। রানি আর তুহিন এই দুটো মানুষ তার খুব পছন্দের। তুহিনের প্রতি আগে রাগ কাজ করলেও আস্তে আস্তে রাগ পড়ে গিয়েছে।কিন্তু ঝগড়া বিবাদ কমে নি।চারু আচারের বাটিটা সবটা চেটেপুটে খেয়ে উঠে দাঁড়ালো নিচে যাওয়ার জন্য। বিয়ের পরেরদিন ই নতুন বউ এর এত দৌড়াদৌড়ি করা উচিত না। হাজারটা মেহমান আসবে। এখন তার মেহমানদের সঙ্গ দিতে হবে।
______
রাতের খাওয়ার পর চারু একা একা ঘরে আর বসে থাকতে পারলোনা। রানি না থাকায় সে খুব ই বোর ফিল করছে।এর আগে যতবার তালুকদার বাড়ি এসেছে ততবারই রানি ছিলো।সে তখন রানির সাথে থেকেছে।এখন হুট করে রানিকে ছাড়া চারুর বড্ড একা লাগছে।আজ সারাদিন দুপুরের পর রবিনের দেখা পায় নি সে। রাত দশটার উপরে বাজে এখনো তার আসার নামগন্ধ নেই।চারুর বড্ড রাগ হলো।নতুন বউ রেখে কোন বেক্কল এতক্ষন বাড়ির বাইরে থাকে? থাকে তো, রবিন বেক্কল থাকে!চারু শাড়ি টেনে টুনে ঠিক করে উঠে দাঁড়ালো। আঁচল হাতে প্যাচাতে প্যাচাতে ছাদের দিকে রওয়ানা দিলো। ছাদে এসে তার মন টা শান্ত হলো।চারদিকে শীতল মিষ্টি বাতাস একটু পর পর শরীর ছুয়ে যাচ্ছে।আকাশে ইয়া বড় চাঁদ। পৃথিবী যেন জোছনায় স্নান করছে।চারু চোখ বন্ধ করে নাক টানলো। হঠাৎ কানে ভেসে আসলো গম্ভীর অথচ শান্ত এক কন্ঠস্বর-
“জোছনার কোনো গন্ধ নাই।”
চারু ফিরে তাকালো।রবিন দাঁড়িয়ে আছে পকেটে হাত দিয়ে। তার পরনে টি শার্ট আর টাউজার। মহাশয় তাহলে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়েই ছাদে এসেছে।রবিন আস্তে আস্তে এগিয়ে আসলো। কিন্তু চারুর কাছে আসলো না বরং এগিয়ে গেলো ছাদের পাশে ফুলগাছগুলোর দিকে।সেখান থেকে টকটকে লাল এক গোলাপ ছিড়লো।গোলাপটা আধবোজা হয়ে আছে। রবিন ফুলটা চারুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
“ফুলে গন্ধ আছে।শুঁকে দেখ।”
চারু ফুলটা নিলো। নাকের কাছে নিয়ে শ্বাস টানলো। নাক কুচকে বলল-
“গন্ধ নাই তো।”
রবিন কপাল ঘষলো। রোমান্টিক হওয়া আর হলো না বোধহয়।চারুর দিকে তাকিয়ে বললো –
“আচ্ছা,পরেরবার গন্ধওয়ালা ফুল আইনা দিব।”
চারু ফুলটা দুই হাতে বুকের কাছে ধরে ঘুরে সামনের দিকে ফিরলো।রবিন চারুর পিছনে ছুই ছুই হয়ে দাঁড়ালো।হাত বাড়িয়ে চারুর হাতে থাকা ফুলটা স্পর্শ করলো।ফুলটা নিতে চাইলো কিন্তু আসলো না।আরো জোরে টান দিলো হলো না।চারুও ওইপাশ থেকে জোরে টান দিয়ে ধরে আছে।রবিন অধৈর্য গলায় বলল-
“ফুলটা ছাড়,চুলে গুজে দেই।”
“এত ঢং করা লাগব না।”
চারুর কথায় অভিমানের আভাস স্পষ্ট। রবিন মাথা বাঁকিয়ে ভ্রু কুচকে চারুর মুখের দিকে তাকালো। চারু গাল ফুলিয়ে আছে।রবিন অসচেতন কন্ঠে প্রশ্ন করলো-
“কোনো সমস্যা?”
“যেই লোক বাসর ঘরে আমারে ফ্লোরে শুইতে বলে তার সাথে কথা নাই।”
রবিনের ভ্রু উঁচু হয়ে গেলো।ন্যাকারানির রাগের কারন বুঝলো সে। সাথে এটাও বুঝলো তার ভবিষ্যৎ সংসার জীবন খুবই কঠিন হবে। অর্ধেক জীবন পার করতে হবে এই মেয়ের ঢং দেখতে দেখতে।রবিন মৃদু হেসে চারুর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল-
“উমম..তাইলে আজ তুই আমার বুকে শুইলে কেমন হয়?”
চারু এমন কথায় থম মেরে গেলো।তার সমস্ত অভিমান ঝরে পড়লো।বুকে শুবে মানে? তার মানে কি আজ……লজ্জায় চারুর গাল গরম হয়ে গেলো।কানে রবিনের উত্তাপ শ্বাস পড়ছে।চারু আইসক্রিম হলে এতক্ষনে গলে যেত।কিন্তু আজ যাই হয়ে যাক না কেন চারু গলবে না।আজ সে ভাজা মাছ উলটে খেতে না পারার ভান ধরে থাকবে।যতক্ষন পর্যন্ত না রবিন নিজ হাতে ভাজা মাছ উলটে তাকে খাওয়াচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সে মাছ উল্টাবে না।চারুর নিস্তব্ধতায় রবিন অধৈর্য হলো তবে তাল হারালো না।সে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো।কৌতুকপূর্ণ কন্ঠে বললো-
“লাল,নীল বাতি দেখবি?”
চারু ভ্রু কুচকালো।মনে পড়লো রবিনের অনেক আগে বলা লাল নীল বাতির কথা।আশ্চর্য!এমন সময়ে এই লোক এইসবের কথা তুলছে কেন?নাকি এইটাতেও কোনো রোমান্টিক কিছু আছে?এরকম হলে শুধু লাল নীল বাতি কেন আজ রবিন যা যা দেখাবে চারু সব ই দেখবে। কোনোকিছুই মিস দিবেনা।আসন্ন ঘটনার জন্য নিজেকে শক্ত করে মৃদু স্বরে উত্তর করলো- “হুম,দেখবো।”
রবিন এই কথা শুনে এক সেকেন্ডে চারুকে কোলে নিলো।আকস্মিক ঘটনায় চারু মৃদু চিৎকার দিয়ে রবিনের গলা জড়িয়ে ধরলো।ভয় ভয় চোখে রবিনের দিকে তাকালো। রবিন মোহময় দৃষ্টিতে চারুর চোখে চোখ রাখলো।মুখ এগিয়ে এনে চারুর মুখে ফুঁ দিলো।ফিসফিস করে বলল-
“চল তাইলে তোরে লাল নীল বাতি দেখাই।”
রবিন চারুকে নিয়ে তার ঘরে এলো।চারুকে বিছানায় বসিয়ে সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে ঠাস করে সুইচ অফ করে দিলো।অন্ধকারে চারু আতকে উঠলো।কাঁপা কন্ঠে বললো-
“লা-লাইট অফ করছেন কেন?”
রবিন উত্তর করলো না।আরেকটা সুইচ টিপার আওয়াজ এলো।সাথে সাথেই ঘরের চারদিকে জ্বলে লাল নীল সবুজ আর সাদা রঙের বিভিন্ন আকারের ফেইরি লাইট। এত সুন্দর সাজসজ্জা দেখে চারু হা হয়ে গেলো।সহাস্যে চারদিকে তাকিয়ে বলল-
“ওয়াও!! কি সুন্দর!!”
রবিন প্রেয়সীর আনন্দভরা মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো।কত সহজেই মেয়ে মানুষকে খুশি করা যায়।সামান্য ফেইরি লাইট দেখে কতই না খুশি।সেই খুশিতে কোনো কৃত্রিমতা নেই শুধুই আছে সারল্য। রবিন দেয়ালে হেলান দিয়ে দুই হাত বুকের কাছে ভাঁজ করে চারুকে দেখছে।চারু বিছানা থেকে নেমে ঘর জুড়ে ঝুলে থাকা লাইটগুলো ছুয়ে ছুয়ে দেখছে।তার খুব শখ ছিলো ফেইরি লাইটের।কিন্তু কারেন্টে শক খাওয়ার ভয়ে তার মা তাকে কখনোই ঘরে এসব লাগাতে দেয় নি।চারু রবিনের দিকে ফিরে প্রশ্ন করলো-
“এইগুলো সবসময় থাকব এই ঘরে?”
“হুম।”
“সত্যিই?”
রবিন হেঁটে চারুর কাছে আসতে আসতে বললো-
“এই ঘরের মালিক চাইলে থাকব সবসময়। সে চাইলে আরো কিছু নিয়ে আসতে পারে।”
চারু রবিনের দিকে তাকালো।রবিন শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে কিন্তু চোখের ভাষা অন্যরকম।মেয়ে হয়ে এই চোখের ভাষা ঢের বুঝতে পারছে সে। চারু ঢোক গিললো। একটু আগের সমস্ত সাহস তার উবে গেলো।মনে উঁকি দিলো ভয়,সেই সাথে যোগ হলো লজ্জা।রবিন ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো।বড় সুন্দর সেই হাসি।তবে হাসির অর্থ এই যে আজ চারুর নিস্তার নেই। রবিন আরেকটু চারুর কাছে আসলো চারু আনমনেই কিছুটা পিছিয়ে গেলো।চারুর পিছিয়ে যাওয়া দেখে রবিন মজা পেলো।সে অল্প আরেকটু এগুলো।এইবার চারু আরো বেশি পিছিয়ে গেলো।বিছানায় পা লেগে বসে পড়লো বিছানায়।এই পর্যায়ে রবিন ঝড়ের বেগে চারুর কাছে চলে আসলো।এত তাড়াতাড়ি রবিনকে কাছে আসতে দেখে চারুর দম আটকে গেলো। ভয়ার্ত চোখে তাকালো।রবিন চারুর দুই দিকে দুই বাহু বিছানায় রেখে চারুর দিকে ঝুঁকে আছে। তার উত্তাপ শ্বাস পড়ছে চারুর চোখে মুখে।চারু আর সহ্য করতে পারলো না সে হাতে ভর দিয়ে বিছানার মাঝখানে চলে গেলো।রবিন হাসলো। সে ও চারুর কাছে এসে মুখোমুখি হলো।দুই হাত দিয়ে চারুর মুখ ধরে চারুর কপালে কপাল ঠেকালো।দুজনেরই চোখ বন্ধ।রবিন মাতাল করা কন্ঠে বললো-
“চারু,আমার চারুলতা।তুই শুধুই আমার।”
চারুর সমস্ত কায়া কেঁপে উঠলো। তার মন মস্তিষ্ক অন্য কিছু ইংগিত দিলো।তার হৃদয় ইংগিত দিলো এক ভয়ংকর অনুভূতির। যে অনুভূতি সে আজ রাতে অনুভব করতে চলেছে। যে অনুভূতিতে রাজত্ব চালাবে কেবল রবিন।যে অনুভূতি চলে একান্ত রবিনের ইশারায়।
__________
তিন মাস পর
রবিন পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে বাড়িতে ঢুকলো। শীত পড়েছে তারপরেও অতিরিক্ত কাজের চাপে তার গরম লাগছে। গায়ের শাল অনেক আগেই খুলে ফেলেছে। বসার ঘরে ঢুকেই সে অবাক হলো।সৈয়দ বাড়ির সবাই বসার ঘরে।টেবিলের উপর মিষ্টির ছড়াছড়ি। সাথে রানি আর তুহিনকেও দেখলো।তুহিন তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি মুখে দিয়ে চিবাচ্ছে আর হাসছে। রবিন এগিয়ে এসে শাহজাহান আলী সহ সবাইকে সালাম দিলো। কুশল বিনিময় করলো। মহিলারা সবাই তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। রবিন এদিক ওদিক চারুকে খুজলো।পেলো না।তার খটকা লাগলো।বাপের বাড়ির লোক এসেছে অথচ চারু এদিক ওদিক লাফাচ্ছে না তা তো কোনোদিন হয় না।রবিন রুবিনা বেগমের দিকে তাকালো। রুবিনা বেগম হাসছেন। রবিন উঠে দাঁড়ালো। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল-
“আমি একটু ফ্রেশ হয়ে তারপর আসছি।”
শাখাওয়াত তালুকদার ঘরে গিয়েছিলেন একটু আগে।ঘর থেকে বের হয়ে রবিনকে দেখে হৈ হৈ করে উঠলেন।এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে তারপর ছেড়ে দিয়ে রবিনের দুই বাহু ঝাঁকিয়ে বললেন-
“আমার ছেলে বাঘের বাচ্চা!!হা হা এই খুশির দিনে তুই যা চাইবি তাই পাইবি।চাইলে আগামী নির্বাচনে আমার বদলে তুই দাঁড়াইবি।”
রবিন অবাক হয়ে গেলো।তার বাবা তো নির্বাচন ছেড়ে দেয়ার মানুষ না। শাখাওয়াত তালুকদার রবিনকে ছেড়ে দিয়ে কামরুজ্জামানের পাশে বসলেন।কামরুজ্জামানও হেসে দিয়ে শাখাওয়াত তালুকদারের হাত ধরে গল্প শুরু করলেন। তুহিন উঠে এসে রবিনের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল-
“শালা, আমি জানতাম তুই সবার আগে ছক্কা মারবি।সবসময় একটা আঁতেল ভাব লইয়া থাকোস, আসলে তো তুই পাক্কা খেলোয়াড়। ”
রবিন চোখ গরম করে তাকালো।তুহিন তেমন পাত্তা দিলো না।সে হাতে থাকা পুরো মিষ্টিটা মুখে পুরে চিবাতে লাগলো।রবিন কিছু না বুঝে সিড়ির দিকে রওয়ানা করলো।রুবিনা বেগম উঠে গিয়ে রবিনকে আটকালেন।রবিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-
“চারুর সাথে সুন্দর কইরা কথা কইবি, একদম বকাঝকা করবি না।”
রবিন হতাশ শ্বাস ফেলে বলল-
“তোমার আহ্লাদী ভাতিজিরে ধমক দিলে ও কি আমারে আস্ত রাখব?ঘুমের মধ্যে পানি ঢাইলা দিব আমার উপরে।”
রুবিনা বেগম হাসলেন।রবিনের কথা মিথ্যা না।তিনি রবিনের কাছে মুখ নিয়ে বললেন-
“এখন আর পানি ঢালতো না।এখন তার গায়ে পানি ঢালার লোক আসতাছে।দেখবি একটু পরে পরে কাঁথা চেঞ্জ করব।”
রবিন ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো।তার বোধগম্য হলো না।রুবিনা বেগম ছেলের মুখ দেখে সহাস্যে বললেন-
“আমার আহ্লাদী ভাতিজি প্রেগন্যান্ট। আর আমার বাঘের বাচ্চা বাবা হইব।”
রবিনের মুখ শিথিল হয়ে গেলো।অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল সে।চোখের মণির আকার বড় হলো।রুবিনা বেগম মাথা নেড়ে সায় জানালেন।ইশারা করে রবিনকে উপরে যেতে বললেন।রবিন ঘোর লাগা অবস্থায় উপরে আসলো।ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে চারুর দিকে নজর পড়লো তার।বিছানায় হেলান দিয়ে আচার খাচ্ছে।রবিনের মনে হলো তার গায়ে শক্তি পাচ্ছে না। সে পা টেনে টেনে ঘরে ঢুকলো।চারু রবিনকে দেখে আচার খাওয়া বন্ধ করে দিলো।লজ্জায় আটশাঁট হয়ে গেলো।রবিন কোনোমতে এসে বিছানায় বসলো।দুই হাঁটুর উপর হাত রেখে মাথা নীচ দিকে দিয়ে লম্বা শ্বাস নিলো।ধরা গলায় বলল-
“যা শুনলাম তা কি সত্যি?”
“হুম।”
রবিন মুখ তুলে চাইলো চারুর পানে। তার চোখের ভাষা অন্যরকম। গভীর কন্ঠে জানতে চাইলো-
“হুট করে এরকম…….মানে….কেমনে হইলো?”
এমন কথা শুনে চারুর রাগ পেলো।কেমনে হইলো মানে?একে তো দেরি করে এসেছে আর এখন এসব প্রশ্ন করে।সে কঠিন কন্ঠে বললো-
“বাতাসে হইছে।”
রবিন থতমত খেলো। বাতাসে হইছে?কোন কথার পৃষ্ঠে কি কথা বলছে এই মেয়ে?জিজ্ঞেস করলো-
“বাতাসে হইছে মানে?”
“মানে আমার জ্বীনের বাতাস লাগছে।এই বাতাসে আমি প্রেগন্যান্ট হইছি।”
রবিনের কপাল টানটান হয়ে গেলো।এই মেয়ে তো চরম বেয়াদব।স্বামীর সাথে এইসব বলছে তাও আবার এরকম একটা বিষয়ে। তারপর রবিনের মনে হলো আসলে অতিরিক্ত ঘোরে তার এরকম প্রশ্ন করা উচিত হয় নি।রবিন গলা খাকারি দিলো।চারুর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ফ্লোরে তাকিয়ে বলল-
“না মানে প্ল্যান তো ছিলো না।তুই…..”
“হুহ ঢং!!লাল নীল বাতি দেখানোর সময় তো তোমারই হিসাব থাকে না।”
রবিন থমকানো চোখে তাকালো।তারপর দরজার দিকে তাকালো কেউ আশে পাশে আছে কিনা দেখলো।এই মেয়ে মান ইজ্জত কিছু রাখবে না। সে সিদ্ধান্ত নিলো আর কোনো কথা বলবে না।অতিরিক্ত শকে সে আর নিজের মাঝে নেই তাই আবলতাবল বলছে।রবিন বিছানা থেকে উঠতে নিলে চারু ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
“তুমি খুশি হইছো কিনা বললে না তো।”
রবিন চারুর দিকে গভীরভাবে তাকালো।প্রচন্ড বেগে চারুর কাছে চলে আসলো। চারু আর এখন রবিনের হুটহাট এরকম করায় চমকে যায় না।রবিন এক হাতে চারুর গাল স্পর্শ করলো,নাকে নাক ঘষলো।পরক্ষনেই চারু এক উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করলো তার কপালে।সেই স্পর্শ নেমে এলো নাকে।চারু হাসলো এখন স্পর্শ কোথায় নামবে সে জানে।সে সারাজীবন শুনে এসেছে মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না।কিন্তু এখানে তো উলটো হচ্ছে।রবিনের বুক ফাটছে কিন্তু মুখে কিছু বলছে না।
________
তুহিন মুখ গোমড়া করে বসে আছে।রানি আয়নার সামনে বসে থেকে চুলে বেণি করছে।আড়চোখে আয়নায় তুহিনের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো। তুহিনের গোমড়া মুখ দেখে তার হাসি পেলো।এত বড় ছেলে কিন্তু এখনো ম্যাচুরিটির ছিটেফোঁটা নেই।রানি শব্দ করে হাসলো হালকা।তুহিন হাসির শব্দ শুনে রানির দিকে তাকিয়ে বলল-
“আর কত সাজুগুজু করবা।এখন আসো।”
রানি বেণি করা শেষ করে বিছানায় এসে বসলো।তুহিনের দিকে তাকিয়ে বললো –
“কি হইছে?”
“রবিন আমার আগে বাপ হইয়া গেলো।আর আমি মাছিই মারতাছি খালি।”
রানি হেসে দিয়ে বলল-
“সবুরে মেওয়া ফলে।”
তুহিন ছ্যাত করে উঠে বললো-
“সেই মেওয়া আমার এখন ই চাই।”
রানি বড় বড় চোখ করে বলল-
“এসব কি কথাবার্তা।”
তুহিন এগিয়ে এসে রানির হাত ধরে ইনিয়ে বিনিয়ে বললো –
“শোন মহারানি, রবিনের ছেলে হইলে আমরা আল্লাহর কাছে একটা মেয়ে চাইবাম। পরে দুইটারে বিয়ে দিয়ে দিবাম।এজন্য ই আমরার এখন থাইকাই মাঠে নামতে হইব।বুঝছো!”
তুহিন আগ্রহী চোখে তাকালো রানির দিকে।রানি হতাশ শ্বাস ফেলে বলল-
“ভাইয়ার বাচ্চার সাথে বিয়ে দিতে হইব এমন তো কথা নাই।আর ভাইয়ার যদি প্রথম বাচ্চা মেয়ে হয় তখন?”
তুহিন হাতে কিল দিয়ে বলল-
“এখন না হইলে পরে হইব।কিন্তু আমি তো রবিনরে আমার বেয়াই বানাইয়া ছাড়বাম।নাইলে আরেকটা কাজিন লভ স্টোরি সৃষ্টি হইব কেমনে।”
রানি তুহিনের পাগলামিতে হাসলো।তুহিন ও হাসলো।কিন্তু বেশিক্ষন হাসলো না এত হাসাহাসির সময় নাই তার।তার এখন অনেক কাজ। ভালোভাবে কাজ না করলে তার প্ল্যান সাকসেসফুল হবে না।
___________
শীতের রাত,চারদিক কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে। দূরের বাতিগুলোকে দেখতে রহস্যময় কোনো আলোর মতো লাগছে।রবিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই আলোর দিকে তাকিয়ে আছে।তার হাতে সিগারেট, এখনো ধরানো হয় নি। অনাগত অতিথির আগমনের খবরে সবকিছুই বদলে গেছে। সেই সাথে নিজেকেও বদলাবে রবিন।এক নতুন সত্তার দায়িত্ব নিতে হবে তার।বাবা হওয়ার অনুভূতি এখনো পুরোপুরি না পেলেও তার রেশ অনুভব করতে পারছে।সন্তানের আগমনের খবরেই যদি এত গভীর অনুভূতি খেলা করে তাহলে সন্তানকে আকড়ে ধরলে কেমন লাগবে তখন!!রবিনের বুকের ভেতরে কেমন জানি লাগলো।এক সুখময় ছন্দ অনুভব করলো।
চারু বারান্দায় উঁকি দিলো।রবিনকে এইভাবে কুয়াশায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাগী গলায় বলল-
“আশ্চর্য!! তোমার কি শীত লাগে না রবিন ভাই?”
রবিন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো চারুর দিকে। চারু মাথা টা শুধু দিয়ে রেখেছে দরজায়।রবিন বিরক্তিতে “চ” জাতীয় শব্দ করলো।হাজার বলেও এই মেয়ের মুখ থেকে “রবিন ভাই” শব্দ দূর করতে পারছে না।যেভাবেই হোক সে বলবেই।এখন বাচ্চার বাবা হতে যাচ্ছে এখনো “রবিন ভাই” ডাকলে তো সে বাবা হওয়ার পরিবর্তে মামা হয়ে যাবে।তাহলে এত পরিশ্রম করে লাভটা কি!! রবিন চারুর পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলো।চারু প্রায় সাথে সাথে দরজা লাগিয়ে দিলো।ঠান্ডা একদম সহ্য হয় না।রবিন আলমারি খুলে আরেকটা কম্বল বের করলো। বিছানায় রাখতে রাখতে বললো –
“আজ থেকে ডাবল কম্বল পড়বি।”
“কেন?এক কম্বলেই তো আমার হয়।”
“তোর হইলেও আমার হয় না।তুই আমার পাশের কম্বল টেনে নিয়ে যাস।তোর জন্য কালকের মিটিংয়ে আমি সর্দি নিয়া যাইতে চাই না।”
চারু একটা বিশ্রি মুখ ভেংচি দিলো।এমন ভাবে দিলো যে তার নিজেরই মুখ ব্যথা হয়ে গেলো।রবিন কৌতুক করে বলল-
“আয়নায় গিয়া দেখ কেমন দেখা যায়!”
চারু বিস্ফোরিত চোখে তাকালো।এত বড় অপমান রবিন করতে পারলো?মুখ ভেংচি দিছে বলে তার চেহারা খারাপ দেখা যায়? ভালোবাসার মানুষের সব ই তো সুন্দর।তাহলে চারুর মুখ ভেংচিটা কি একটু সুন্দর লাগতে পারে না রবিনের কাছে?চারু গাল ফুলিয়ে এক পাশ ফিরে বসলো। রবিন সহাস্যে ঠোঁট কামড়ালো। সারদিন বাইরের ক্লান্তি শেষে এই ন্যাকারানির ঢং না দেখলে তার ভালো লাগে না।মেয়েদেরকে বোধ হয় এভাবেই ভালো মানায়। এভাবেই হয়ত তারা পুরুষের ক্লান্তি দূর করার কারন হয়।রবিন উঠে গিয়ে লাইট অফ করে দিলো।জ্বালিয়ে দিলো ফেইরি লাইটগুলো।তারপর চারুর পিছনে বসে জড়িয়ে ধরলো চারুকে।নাক ছোয়ালো চারুর গালে।চারু চোখ বন্ধ করে ফেললো। এই প্রেমময় স্পর্শ উপেক্ষা করার সাধ্যি তার নেই।রবিন গভীর কন্ঠে বলল-
“তোর কাছে আমি ঋণী চারু।আমার জীবনের বেশিরভাগ খুশির কারন তুই। তোর সাথে আমি জনম জনম এক বসাতে কাটায় দিতে চাই।তুই…….”
“তুমি আমারে তুই কইরা ডাকবা না আর।”
রবিন চোখ খুললো।তার রোমান্টিকতার দফারফা করে দিয়েছে এই মেয়ে।এত দিনেও এই মেয়ের সময়জ্ঞান হলোনা।রবিন শ্বাস ফেলে বলল-
“এখন এই কথা বলার সময়?”
চারু চোখ পিটপিট করলো।তারপর বললো –
“বাচ্চার সামনে তুই ডাকলে কি আমার সম্মান থাকব?আমি তো আর…….”
চারু আর বলার সুযোগ পেলো না।রবিন এক অভিনব উপায়ে থামিয়ে দিলো তাকে।একসময় রবিন চারুকে আকড়ে ধরলো তার বুকে।এই জীবনে সে আর তাকে ছাড়বে না।সারাজীবন এভাবেই আকড়ে থাকবে।
সমাপ্তি
[গল্পটা আর বড় করলে সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে কাহিনিটার।তাই এখানেই শেষ করলাম।চারুবিন জুটির এখানেই সমাপ্তি।আপনারা চাইলে সিজন-২ আনার চেষ্টা করব ইন শা আল্লাহ। এতদিন পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ। শীঘ্রই নতুন গল্প পাবেন ইন শা আল্লাহ ]