#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-৭
আজ দুই দিন পর চারু স্কুলের যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। সে এইবার এস এস সি দিবে। সে তার ব্যাগ গুছাচ্ছে। এমন সময় ব্যাগের সাইড পকেটে একটা গোলাপ পেল। শুকিয়ে পাপড়ি ঝরে গেছে। গোলাপের দিকে তাকিয়ে চারুর রাগ গর্জে উঠল। গোলাপ টা নাজমুল দিয়েছিল। সে হাতের মুঠোয় গোলাপ টাকে নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে পড়ার টেবিলের পাশে ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ছুড়ে মারল। তারপর পড়ার টেবিলের ড্রয়ার খুলে নাজমুলের “SORRY” লেখা কাগজ বের করল। তারপর ছিড়ে কুটি কুটি করে ওইটাও ময়লার ঝুড়িতে ছুড়ে মারল। নিচ থেকে রানির জোরে জোরে কথা ভেসে আসছে, সে আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখে ব্যাগ নিয়ে নিচে নামল। রানি তাকে দেখেই বলল-
“কালকেই না জ্বর থাইকা উঠলি, আজ ই স্কুলে যাবি?”
“হুম। ভাল রেজাল্ট করতে হইব। আব্বা আম্মা আমার উপর রাগ কইরা আছে।”
রাজিয়া বেগম হাতে একটা টিফিন বক্স নিয়ে বের হলেন। চারুর হাতে দিয়ে বল্লেন-
“রানির জন্য ও দিয়া দিছি। দুইজন মিল্লা খাইস।”
চারু আর রানি স্কুলের পথ ধরল। অন্য দিন চারু যাওয়ার পথে নিয়ে যায় রানিকে আজ রানি চারুকে নিতে এসেছে। রানি চারুর হাত বগলদাবা করে জিজ্ঞেস করল-
“আমার উপর রাগ কইরা আছস এখনো?”
চারু একটা মুড নিয়ে বলল-
“নাহ, আমি এসব ছোটা খাটো বিষয়ে এত্ত পাত্তা দেই না।”
রানি কিছুটা দুঃখ পেল কিন্তু দমে গেল না। সে আবারো বলল-
“আর জীবনে মইরা গেলেও তোর সাথে করা কসম ভাংতাম না। এই যে দেখ মাথায় হাত দিয়া কসম খাইলাম।”
চারু রানির দিকে বিরস মুখে তাকাল। রানি মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারু মুখ বাঁকিয়ে বলল-
“আচ্ছা যা মাফ করলাম। এখন বল আমারে দেখতে কেমন লাগতাছে? চুলে নতুন একটা ক্লিপ লাগাইছি।”
রানি চারুকে পরখ করল। চারু যেই সাজ দিয়েছে এই সাজ দিয়ে বিয়ে বাড়ি ঘুরে আসা যাবে। অন্য দিন হলে সে কিছু বলত কিন্তু আজ বলবে না।সে মধুর সুরে বলল-
“অনেক সুন্দর লাগতাছে!! ”
চারু বলল-
“তাহসান এর নতুন ছবি দেখলাম ফেসবুকে। কি যে সুন্দর!”
রানি চারুর চুলে টান দিয়ে বলল-
“তুই না বলিউডের টাইগার শ্রফ রে ভালবাসিস। এখন আবার তাহসান কই থেকে আসলো?”
“আরে আল্লাহ!! টাইগার শ্রফ রে কি আমি বিয়ে করতে পারবাম? তাহসান ত আমার দেশের ছেলে তারে ত বিয়ে করতে পারবাম এইজন্য আমি তাহসান রে ভালবাসি।”
“তাহসান বয়সে তোর কত বড় তুই জানস?”
“শোন ভালবাসায় বয়স কোনো ব্যাপার না।”
“তুই একটা চরিত্রহীন মেয়ে।”
রানির কথা চারুর গায়ে লাগল না। তার ভালবাসা পবিত্র। সে অনেক আগেই তাহসান কে মন দিয়েছে। মাঝখানে নাজমুল এসে ঝামেলা করে ফেলল।
কথা বলতে বলতে ওরা বড় রাস্তায় উঠল। দূর থেকে দেখতে পেল বড় রাস্তার পাশের মাঠে গাছ পালার নিচে রবিন তার সাঙ্গ পাঙ্গ দের নিয়ে বাইকের উপর বসে আছে। রানি তাড়াতাড়ি মাথার স্কার্ফ আরেকটু টেনে দিল। চারু তাড়াতাড়ি গলার স্কার্ফ মাথায় দিল, টিস্যু বের করে ঠোঁটের লিপ্সটিক মুছে ফেলল। তার ব্যাগে লিপ্সটিক আছে, স্কুলে গিয়ে বাথরুমের আয়নায় দেখে আবার দিয়ে দিবে। প্যারা নাই চিল!!
লিমন বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে রবিন কে বলল-
“ভাই, দেখো তোমার বউ যাইতাছে।”
রবিন সিগারেটের ধোয়া ছেড়ে লিমনের কথায় ওইদিক তাকাল। রানি আর চারুকে আসতে দেখে হাতের সিগারেট লুকিয়ে ফেলল। ভাল করে পরখ করল দুজনকে। দুজনের ই মাথায় ঘোমটা দেয়া আর ভদ্রভাবে হাটাচলা দেখে সন্তুষ্টির শ্বাস ফেলল। তারপর লিমনের দিকে চেয়ে বলল-
“বউ মানে?”
“চারুর মা ত তোমারে জামাই কইয়া ডাকে !! তেইলে ত চারু তোমার বউ ই।”
রবিন একবার চারুর দিকে তাকাল। মেয়েটা আড়চোখে তাকে দেখছে একটু পর পর। সে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল-
“সেসব অনেক আগের কথা। ছোটবেলায় মজা কইরা ডাকত। সিরিয়াস কিছু না।”
চারু লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে রবিনের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। মাঝ খানে একবার চোখাচোখি ও হয়েছিল। চোখে চোখ পড়তেই চারুর অইদিনের ঘটনা মনে পড়ে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠল রবিনের তাকে বুকে আগলে নেয়ার দৃশ্যটি। তার কানে এখনো রবিনের হার্টবিট স্পষ্ট বাজছে। রবিনের গায়ের উষ্ণতা আর ঘামের গন্ধ ও তার স্মরণে আছে। চারু লাজুক হেসে ফেলল। তারপর হুট করে শরীর ঝাড়া দিয়ে সচেতন হল। আশ্চর্য!! সে রবিনকে নিয়ে এসব ভাবছে কেন?৷ আগে ত কোনোদিন ভাবে নি। সে নিজেকে শাসাল
“চারু, রবিন ভাই কে নিয়ে এসব ভাব্বি না!! তুই কি আসলেই চরিত্রহীনা?”
_______
স্কুলে এসে চারুর একটুও শান্তি হল না। ক্লাস টেস্টে ফেল করার জন্য এদিক ওদিক থেকে অনেক কথা শুনতে হল তাকে। সবার এমন ভাব যেন সে এস এস সি তে ফেল করেছে। তার উপর নাজমুল কে হাসি হাসি মুখে দেখে তার আরো মেজাজ বিগড়ে গেল। ওর ইচ্ছা হলো নাজমুলের ঠোঁট দুইটা চুলের কাঁটা দিয়ে এফোড় ওফোড় করে দিতে। চারু অনেক চেষ্টা করল ক্লাস না করে মাঠের পাশে ঘুরে বেড়াতে কিন্তু সে রানিকে মানাতে পারল না। বাধ্য হয়ে সে ক্লাসে বসে রইল। ছুটির ঘন্টা পড়তেই সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
স্কুল ছুটির পর আচার খেতে খেতে বাড়ি ফিরছিল দুজন। স্কুলের মোড়ে আসতেই দেখল তিন চার টা বাইকের উপর কয়েক্টা ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ছেলেগুলোকে দেখে রানির ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। সে খুব নরম প্রকৃতির মেয়ে। চারু তেমন ভয় পেল না। সে রানিকে অভয় দিয়ে বলল-
“ভয় পাইস না। আমি আছি। আজকে কিছু বললে খবর আছে। এতদিন বাড়িতে জানাইছি না এখন জানাইবাম।”
চারু রানিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকল। ছেলেগুলোর সামনে যেতেই একটা ছেলে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে সামনে এসে দাঁড়াল। রানি আড়ষ্ট হয়ে নিচের দিকে চেয়ে রইল। ছেলেটি বলল-
“কি গো মহারানি!! দেইখাও না দেখার ভান কইরা চইলা যাও যে!! চোখে পড়ে না নাকি আমার মত দামড়া রে?।”
চারুর সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল তুহিনের কথা শুনে। সে ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল-
“দেখো তুহিন ভাই এতদিন বাড়িতে বলছি না এইসব। এখন কিন্তু সব বইলা দিমু বাড়িতে”
“আরে চালের নাড়ু যে! শুনলাম ফেইল করছো নাকি। পড়াশোনা ভাল্লাগে না ? প্রেম টেম করো নাকি?”
চারুর রাগের মাত্রা তরতর করে উপরে উঠল। তুহিন বিশ্রি ভাবে কাঁধ নাড়িয়ে হাসতে লাগল,, যেন সে খুব মজার কিছু বলেছে।
চারু রানির হাত ধরে চলে যেতে নিলেই তুহিন আবারো হাত উঁচু করে বাঁধা দিল। চারু রাগের মাত্রা সামলাতে না পেরে তুহিনের বুকে জোরে একটা ধাক্কা মারল। তুহিন হঠাৎ ধাক্কায় এক পা পিছিয়ে রাস্তায় থাকা ইটের টুকরায় পা বেঁধে রাস্তায় পড়ে গিয়ে বসে পড়ল। সে অবাক হয়ে গেল এই ঘটনায়।
চারু রানির হাত ধরে টেনে নিয়ে সামনে আগালো কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না তার আগেই তার হাতে টান পড়ল। তুহিন উঠে এসে রানির হাত টেনে ধরেছে। ক্ষিপ্ত কন্ঠে চারুকে লক্ষ্য করে বলল-
“চালের নাড়ু তোমার সাহস অনেক বেশি। এই তুহিন রে ধাক্কা দেয়ার সাহস কেউ করে না। তুমি ভবিষ্যৎ শালী তাই মাফ কইরা দিলাম।”
রানির অবস্থা হল বাঁশের চিপায় পড়ার মত। সে চারু আর তুহিনের মাঝ খানে দাঁড়িয়ে। দুইজন তার দুই হাত ধরে দুই দিক থেকে টানছে। সে মাঝ খান থেকে দুই ভাগ না হয়ে যায়।
চারু ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল-
“তোমার শালী হয়ার কোনো ইচ্ছা নাই আমার। রানির হাত ছাড়ো নয়ত ভাল হইব না।”
“কি ভাল হইব না একটু দেখি তাইলে!”
বলেই তুহিন জোরে টান দিল রানির হাতে। এত জোরে টান সামলাতে না পেরে চারুর হাত থেকে রানির হাত ফসকে গেল। রানি গিয়ে পড়ল তুহিনের বুকের উপর। তুহিন প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেল। সে ভাবে নি এক টানেই বাজিমাত হবে। সে খেক খেক করে হেসে উঠল। রানি ছিটকে সরে গেল তুহিনের থেকে। তুহিন কৌতুকের কন্ঠে তার সাথে থাকা ছেলেগুলো কে বলল-
“এই তোরা দেখলি, তোদের ভাবি কেমন নিজে থাইকা উপরে পড়ল। ”
ছেলে গুলা হৈ হৈ করে সম্মতি জানিয়ে তারাও হাসতে লাগল। কেউ কেউ সিটি বাজাল। রানি লজ্জায় অপমানে কেঁদে ফেলল। চারু রাগে সাপের মত ফোঁস ফোঁস করছে। তুহিন কে সে একটা শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে। সে রাস্তা থেকে একটা বড় ইটের টুকরা নিয়ে ছুড়ে দিল তুহিনের দিকে। ইটের টুকরা গিয়ে পড়ল তুহিনের কাঁধে। তুহিন যন্ত্রনার শব্দ করে রানির হাত ছেড়ে কাঁধ চেপে ধরল। নাক মুখ ব্যথায় কুচকে গেল তার। চারু এই সুযোগে রানির হাত ধরে দৌড়ে চলে গেল। তুহিন দাঁত চেপে কিড়মিড়িয়ে বলল-
“শালী”
——–
রবিন তীব্র গতিতে বিপজ্জনকভাবে বাইক ছুটিয়ে যাচ্ছে। পিছনে আরো কতগুলো বাইক আসছে। বাইকের ছেলেগুলো চিৎকার করে তাকে থামতে বলছে, কিন্তু সে থামছে না।সে রাস্তা থেকে দেখতে পেল ক্ষেতের অই পাশের রাস্তায় তুহিন গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছেলে পেলে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। রবিন বাইক নিয়ে রাস্তা থেকে সোজা ক্ষেতে নেমে পড়ল। টাল সামলাতে না পেরে বাইক নিয়ে শুকনো ক্ষেতে পড়ে গেল। পড়ে গিয়ে সে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল-
“ওই তুহিন, ওই, ওইনেই দাঁড়ায় থাক।”
তুহিন এই পড়ন্ত বিকেলে বাবার গাড়ি নিয়ে একটু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বেরিয়েছে। হঠাৎ চিৎকারে তাকিয়ে দেখল রবিন তার নাম ধরে চিৎকার করে এদিকেই দৌড়ে আসছে, তার পিছনে আরো অনেক গুলো বাইক।সেগুলো রাস্তা থেকে ক্ষেতে নেমে এসেছে। সে ঘটনা কিছু বুঝল না। সে ভ্যাবলার মত এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকল।
তুহিনের সাথে থাকা সজল একটু নিচু হয়ে রবিনকে পরখ করে চিৎকার করে বলল-
“রবিন্যা রাম*দা লইয়া কূ*পাইতে আসতাছে।”
এই কথা বলার সাথে সাথে সবাই দিক বিদিক হয়ে দৌড় লাগাল। তারা রবিন কে চিনে। ছেলে টা শান্ত শিষ্ট হলেও সে তালুকদার বাড়ির ছেলে। রাম*দা দিয়ে কু*পানো তার ক্ষেত্রে অসম্ভব কিছু না। সজল গাড়ির দিকে দৌড়ে গিয়ে পিছনে ফিরে দেখল তুহিন হা করে রবিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সে তাড়াতাড়ি আবার ফিরে এসে তুহিনকে টেনে গাড়িতে বসিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। কিন্তু সে গাড়ি স্টার্ট করতে পারছে না। সামনে রবিনের বিশাল বহর দেখে হাত পা কাঁপছে
। তারা মাত্র গাড়িতে দুজন। রবিন ধরতে পারল এইখানেই কাহিনি শেষ। তুহিন কিছুটা হুঁশে এল। খুব কষ্ট করে বলল-
“গাড়ি টান দে সজইল্যা।”
সজল গাড়ি টান দেয়া ত দূরের কথা স্টার্ট ও করতে পারল না। রবিন গাড়ির একদম কাছে চলে আসল। তুহিন দেখল রবিন গাড়ির কাচের উপর দিয়েই হাত উঁচু করে রাম*দা দিয়ে তার উপর কো*প বসাচ্ছে।
চলবে