ভালোবাসার_ফোড়ন_২ #মিমি_মুসকান #পর্ব_৫৬

0
679

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৫৬

অনেকদিন পর আজ ভার্সিটিতে এলাম। উনার দেখা নেই কে জানে কোথায় গেল। আমি ব্যাগ থেকে আমার ডায়রি বের করে তাতে সেই শুকিয়ে যাওয়া ফুলটা দেখতে। এখানে আরো একটা ফুল আছে সেটা হলো কাঠগোলাপ। এটাও উনি দিয়েছিলেন আমায় কিন্তু সেটা আজ শুকিয়ে গেছে কিন্তু উনার সাথে কাটানো সেই স্মৃতি ভুলে যাই নি। ডায়রির পাতায় লেখা আছে সে দিন কাল। অতঃপর পৃষ্ঠা উল্টাতে আরেকটা ফুল দেখলাম। এটা কয়েকদিন আগেই দিয়েছে উনি। এটা হলো সেই জবা ফুলটা! জবা ফুল’টার নিচে কালো কালি দিয়ে কিছু লেখা আছে। আমি তা পড়তে নিলাম তখন’ই কেউ বলে উঠল,

“আমার সবচেয়ে বড় উপহার যে আপনি আহিয়ান। নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করি আপনাকে পেয়ে”

আমি দ্রুত ডায়রি বন্ধ করে পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখি ইতি দাঁড়ানো। ও এসে হুট করেই আমার হাত থেকে ডায়রি টা কেড়ে নিতে চাইলে আমি সরিয়ে ফেলি।ইতি বলে উঠে,

“আরে বন্ধ করলি কেন, দেখি দেখি কি লেখা আছে।

“আরে কিছুই নেই।

“তা বললে হবে নাকি। আমি একটু আগেই তো দেখলাম কিছু লেখা ছিল।

“কিছু না। ওটা এভাবেই ছিল।

“তুই আমার থেকে লুকাচ্ছিস।

“লুকাবো কেন?

“তাহলে দেখতে দে!
বলেই আমার হাত থেকে ডায়রি টা কেড়ে নিয়ে নিল। আমি চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। ইতি আমার পাশে বসে পুরোটা বই পড়ল। অতঃপর আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল,

“ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার! তোমাদের #ভালোবাসার_ফোড়ন তাহলে ফুটেই গেল।

“রাখ তোর আজাইরা কথা, এমন কিছু না।
বলেই ওর হাত থেকে ডায়রি টা নিয়ে ব্যাগে রাখলাম।

ইতি বলে উঠে,
“হাউ রোমান্টিক! বাসর রাতে দুজনেই পালিয়ে গিয়ে বাইরে ঘুরলি, চা খেলি, আইসক্রিম খেলি আরো কতোকিছুই…

বলেই উঠে দাঁড়ালাম,
“থাম, শুধু চা আর আইসক্রিম’ই খেয়েছিলাম।

ইতি পেছন থেকে আমার ঘাড়ে দুই হাত রেখে বলে,
“হ্যাঁ এখন তো তাই বলবি না!

“আমি তোকে কিছু্ই বলছি না যা সত্যি তাই বলছি।

ইতি এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থিতুনিতে হাত রেখে বলে,
“আহারে, আমার বান্ধবী লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।

“😒

“এমনভাবে তাকানোর মানে কি?

“এর মানে এটাই, যে আমাদের মাঝে এমন কিছু নেই।

“সত্যি নেই।

“হ্যাঁ রে আমার জানেমান সত্যি কিছুই নেই।

“তাহলে কর!

“কিহহ?

“মানে তোদের মাঝে কিছু একটা হওয়া দরকার।

“তুই কি বলছিস, মাথা কি খারাপ হয়ে গেল নাকি তোর। ইতি মন দিয়ে একটা কথা শোন ‌। না উনি আমাকে ভালোবাসে আর না আমি উনাকে ভালোবাসি।

“তাহলে বাস!

“ভালোবাসাটা এতোটা সহজ না ইতি।

“ভুল! ভালোবাসা না সহজ না কঠিন। এটা এমনেই হয়ে যায়।

“হ্যাঁ এখন তো এই কথা বলবিই। তোর তো আবার অভিজ্ঞতা আছে।

উনি আমার গা ঘেঁষে বলে,
“সেইজন্য তো বলছি , তোমাদের #ভালোবাসার_ফোড়ন ফুটে গেছে! সেটার ঘ্রাণ আমি পেয়ে গেছি।

“বাহ সারাদিন কি এগুলো শুকিস নাকি।

বলেই ওখান থেকে চলে এলাম। সোজা ঢুকলাম ক্লাসরুমে। ইতিও আমার পিছন পিছন এলো বক বক করতে করতে। তার কথা কানেই দিলাম না। কিন্তু ওই মেয়েটা থামবার নয়। ক্লাস চলাকালীন ও আমার গুন গুন করে আমার মাথা খেল।
.
ভার্সিটি ছুটি হবার বের হলাম। ওর মুখ এখনো চলছে। আচ্ছা ও কি ক্লান্ত হয় না এতো কথা বলতে বলতে। হাঁটতে হাঁটতে হুট করেই থেমে গেলাম। ইতির মুখ এখনো চলছে। কিন্তু এখন বলল অন্যকথা। জিজ্ঞেস করল,

“কিরে থেমে গেলি কেন?

“সামনে তাকা!

ইতি আমার কথায় সামনে তাকাল। একটু চমকালো কারন সামনে আহিয়ান ছিল। এতোক্ষণ তার ব্যাপারেই বক বক করেছিল। তাই আচমকা তাকে দেখে চমকানোর’ই কথা। আহিয়ান মনে হচ্ছে কিছু বোঝে নি। বোঝার কথাও না। মহাশয় ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানে উনার পুরো মন টাই ফোনের দিকে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করব তার আগেই উনি বলে উঠেন,

“তুমি কিছুক্ষণ ক্যাম্পাসে থাকো, আমাকে টিচার রুমে ডাকা হয়েছে। দেখা করে আসছি!

বলেই উনি চলে গেলেন। ইতি আমার হাত চেপে ধরে বলে,
“এই ভাইয়া কিছু শুনে ফেলল নাকি।

“আমি কিভাবে বলল।

“আরে বল না। ইশ্ কি হবে শুনে ফেললে। ছিঃ ছিঃ আমার মাথা কাটা যাবে।

“আরে হাইপার হস না, মনে হচ্ছে কিছু শুনে নি।

“এতো সিউরলি কিভাবে বলছিস।

“আরে দেখলি না ফোনের ভেতর কেমন ঢুকেছিল।
বলতে বলতে ক্যাম্পাসের দিকে চলে গেলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জবা দেখছিলাম। কি চমৎকার শুভ্রতা এই ফুলে, এক ধরনের স্নিগ্ধতা আছে যা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। আমি চোখ ভরে এই স্নিগ্ধতা অনুভব করছিলাম। কিন্তু ইতি এসে আমার দৃষ্টি সরিয়ে দিল। বলে উঠলো,

“এতোক্ষণ কি বললাম শুনলি তো।

“হ্যাঁ শুনেছি কিন্তু তবুও আমি বলবো ভালোবাসা এতো সহজ না।

“আচ্ছা আমাকে এটা বলো ভাইয়া কে তোর ভালো লাগে তো ‌।

ইতির কথায় চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অতঃপর শীতল গলায় বলে উঠি,
“খারাপ না লাগার তো কোন কারন নেই।

“এর মানে তুই ভাইয়া কে ভালোবাসিস। আমার কাজ হয়ে গেছে।

“ইতি,‌ভালোলাগা আর ভালোবাসা এক না।

দুই হাত বাহুতে গুঁজে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা পার্থক্য বল!

“শোন, ভালোলাগা আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য হলো, ভালোলাগা হলো ফুল ফোটার পর তার ঝড়ে যাওয়ার সময় অবদি। যতদিন ফুল ফুটন্ত থাকে ততোদিন’ই ভালো লাগে। আর ঝরে লেগে তার মায়াও চলে যায়। ভালোলাগা ঠিক তেমন!

“আচ্ছা, আর ভালোবাসা!

আমি মুচকি হেসে জবা ফুল টার দিকে তাকিয়ে বলি,

“ভালোবাসা হচ্ছে একটা ফুল গাছের মতো। যতদিন গাছটা বেঁচে থাকবে ততোদিন’ই সে ফুল ফুটিয়ে যাবে।‌ নতুন নতুন ফুল উপহার দিবে প্রকৃতিকে! কিন্তু গাছ টা যখন মারা তখন তার শোকে সে গাছের পাতা আর ফুল সব ঝরে যাবে। আর পক্ষান্তরে ভালোবাসা’টা ঠিক এমনই! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে তার প্রিয় মানুষটিকে ভালোবেসে যাবে।

ইতি হেসে দিয়ে বলে,
“আমি ভাবিনি তুই এতোটা ভেবে বলবি। কথায় কথায় বলিস তো ভালোবাসিস না আর এতো কিছু জেনে গেলি।

“আমার যা মনে হল তাই বললাম।

“নিহা, আমিও জানি কাউকে ভালোলাগা মানে ভালোবাসা না। কিন্তু একসময় কিছু ভালোলাগা ভালোবাসাই রুপ নেয় বুঝলি।

“হতে পারে।

“হতে পারে, এটাই হয়। মানুষ ভালোলাগার জিনিসটা অনেক আগলে রাখে, অনেক যত্ন করে, দিনরাত তাকে নিয়েই ভাবে। তার জন্য এক ধরনের সূক্ষ্ম অনুভূতি জায়গা নেই তার মনে আর এক সময় সেই ভালোলাগা টা ভালোবাসা হয়ে যায়। আর মজার ব্যাপার হলো কখন যে এটা ভালোবাসা হয়ে যায় সেটা বোঝা দায়।

আমি হেসে ইতির গালে দু হাত রেখে বলি,
“বুঝেছি, আমার বান্ধবী টা ভালোবাসায় পিএইচডি করে ফেলেছে। কিন্তু তবুও আমি বলবো আমাদের মাঝে ভালোবাসা নেই।

“তুই এখনো এক জায়গায় আটকে থাকলি। আচ্ছা বল তোদের মাঝে ভালোবাসা কেন থাকবে না। একটা কারন বল!

“তোকে একটা না হাজার টা বলবো। শুনবি!
বলেই ওর হাত ধরে আমি বট গাছের নিচে বসলাম। অতঃপর উনার গুনগান করতে লাগলাম,

“শোন, উনি! উনি হচ্ছে আস্ত একটা অভিযোগ বাক্স। উনার জন্য আমার অভিযোগ বলে শেষ করা যাবে না। উনি একটা সুযোগ ছাড়ে না আমাকে হেনেস্তা করার। এমনকি সেদিন, যেদিন আমরা ঘুরতে গিয়েছিলাম সেদিন ও উনি আমাকে নিয়ে মজা করেন। যখন তখন আমাকে নিয়ে মজা করবে। আমাকে হেনেস্তা করবে। তুই এটা জানিস উনি ইচ্ছে করে আমাকে ঝামেলার মাঝে জরিয়ে দিবে। কিন্তু সেখান থেকে ছুটাবে না। আমার নিজে যেখান থেকে ছুটে আসতে হবে। তুই জানিস উনি আর কি কি করেন..

অতঃপর আমি বলতেই থাকলাম, ইতি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল বলে কথা বলা শেষ’ই হলো না। এক সময় আমি থেমে গিয়ে শ্বাস নিয়ে বলি,
“বুঝলি তো!

মিটিমিটি হেসে,
“হুম বুঝলাম!

“হাসছিস কেন? আমি তোকে যা বলেছি সব সত্যি!

“আমি কি মিথ্যে বলেছি নাকি। কিন্তু বলার সময় ( আমার ঠোঁটের কোনে হাত দিয়ে ) তোর এখানকার হাসি কি মিথ্যে ছিল

“মানে!

ইতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে বলল,
“কারো সকল অভিযোগে থাকাও কিন্তু এক প্রকার ভালোবাসা যা সবার প্রতি গ্রাহ্য করা যায় না। এটা জরুরি না তুই যাকে ভালোবাসিস সে সবসময় তোর আবদার মেনে নিবে। তুই তাকেই ভালোবাসবি যার প্রতি তোর অভিমান বেশি। অভিযোগ শুধু তার প্রতিই আসে যাকে নিয়ে তুই সবসময় ভাববি আর ভাবনা তার প্রতিই আসে যাকে তুই ভালোবাসবি।

আমি অবাক দৃষ্টিতে ওর কথা শুনছিলাম। ইতি কিঞ্চিত হেসে আমাকে বলল,
“এখন বুঝলি তো, তোর মানে ভাইয়ার জন্য এক অনুভূতি আছে। আর সেই সূক্ষ্ম অনুভূতির নাম হচ্ছে ভালোবাসা। এই ভালোবাসাকে যত্ন করে রেখে দে হারিয়ে ফেলিস না। হারিয়ে ফেলল নিজেকেও হারিয়ে ফেলবি!

ইতির কথার অর্থ আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমার মাথা পুরো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো তখন’ই উনি চলে এলেন। আর কথা হলো না আমাদের মাঝে। আমি ইতি কে বিদায় নিয়ে উনার সাথে পা বাড়ালাম।

কানের কাছে কেন জানি মনে হচ্ছিল ইতির কথা গুলোই বাজছিল। আমি এক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলাম। উনার দৃষ্টি ফোনের মাঝেই। আমি হাঁটছি উনার পাশাপাশি। হঠাৎ করেই কয়েকটা ছেলে পিছনে থেকে দূরে আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। আমি একটু চেপে দাঁড়ানো সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল তারা আমার গা ঘেঁষেই যাবে। হুট করেই উনি তখন‌ পেছন থেকে আমার এপাশে হাত রেখে নিজের দিকে টানলেন।

আমি তখন উনার ছোঁয়া অনুভব করছিলাম। ছেলে গুলো যেতেই উনি আমাকে ছেড়ে আমার হাত খানা শক্ত করে ধরে হাঁটতে লাগলেন। উনার দৃষ্টি এখনো ফোনের স্ক্রিনে। আর আমার দৃষ্টি উনার উপর। রোদের উজ্জ্বল আলো এসে উনার মুখে পড়ছিল। রোদের আলোয় উনার চুল গুলো চিক চিক করছিলো।‌ থিতুনির কাছে কিছু দাড়ি ছিল তবে তা বেশ ছোট ছোট। উনি প্রতিদিনই এগুলো কাটেন। কেন জানি উনাকে দেখতে ক্লান্ত লাগছিল না।

গাড়ির কাছে এসে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে গাড়ির দরজা খুললেন। ইশারায় আমাকে গাড়ির ভেতর যেতে বললেন। আমি কিঞ্চিত হেসে গাড়ির ভেতর বসলাম। উনি ফোন হাতে নিয়েই গাড়ির ভিতর বসলেন। সিট বেল বেঁধে আমার দিকে তাকালেন । আমি তাকিয়ে আছি উনার দিকে। উনি কয়েকবার কিছু বললেন কেন জানি কথা গুলো আমার কানেই আসছিল না। হঠাৎ করেই আমাকে চিমটি মারলেন। আমি আঁতকে উঠলাম। উনার কথা কানে এলো। উনি বলেন,

“কখন থেকে বলছি সিটবেল্ট বাঁধ, তোমার মন কোথায় ভূতনি। কথা শুনছো না আমার।

“হুহ!

বিরক্ত হয়ে বলেন,
“কিছু না!

অতঃপর নিজেই আমার সিটবেল্ট বাধার জন্য সামনে এগোলেন। উনার এতো কাছে আসাতেই আমার অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। আমি শ্বাস রোধ করে চুপচাপ বসে আছি। উনি সিটবেল্ট বেঁধে নিজের সিটে এসে বসলেন। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচের দিকে তাকালাম। গাড়ি স্টার্ট দিলেন উনি!

কোথায় ছিলাম আমি এতোক্ষণ, মনে হচ্ছিল এক অজানা জগতে। যেই জগতে শুধু উনি আছেন আর কেউ নেই। ঘোরের মাঝে ছিলাম সন্দেহ নেই তবে কেন জানি এই ঘোর টাই ভালো লাগতে শুরু করল। উনাকে ভালো লাগতে শুরু করল। তবে কি এই ভালোলাগার শেষ পরিনতি ভালোবাসাই হবে। তবে শুধু কি আমি ভালোবাসলেই হবে, উনি কি আদৌও ভালোবাসবেন আমায়!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here