#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৭
একটা রিক্সায় করে বাসায় চলে এলাম। ঘর তালাবদ্ধ! হয়তো মিতু আর মুন্নি আপু চলে গেছে। চাবি আমার ব্যাগে ছিল তা দিয়ে তালা খুললাম। অতঃপর ঘরে ঢুকে দু মিনিট শান্ত ভাবে বসে থেকে গোসল সেরে নেলাম। অতঃপর দাদা আর দাদি’র সাথে দেখা করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলাম। ঘরে কিছু নেই বলে খেতে পারি নি। তাই রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় একটা বিস্কিট কিনে সেটা খেতে খেতে হাঁটতে লাগলাম।
ভার্সিটিতে এসে দেখি ইতি একা একা বসে আছে। আমাকে দেখেই দৌড়ে আমার কাছে এসে জরিয়ে ধরল।
আমাকে দেখে অনেক খুশি সে। ইতি আমাকে টেনে নিয়ে চলে গেলো ক্যাম্পাসে। সেখানেই দুজন বসে ছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়ল দূরের এক কোনে। সেখানে নিতি ওরা বসে ছিল। মজার ব্যাপার ছিল নাহান আর আনাফ ভাইয়া ও ছিল। তারা আমাকে দেখে বেশ একটা চমক খেলেন। তারা হয়তো আমার আর আহিয়ানের বিয়ের সম্পর্কে জানে না। ভেবেছিল আজ আমার বিয়ে হবে আর দেখতে পারবে না। আফসোস! সেই আশা টা পূরন হতে দিলো না আহিয়ান! কেন জানি মনে হচ্ছে আমি না আসলে নিতি’ই সবচেয়ে বেশি খুশি হতো। এর কারন টা আমার অজানা নয়।
আসার পর থেকেই ইতি কথা বলে যাচ্ছে, মেয়েটা কথাও বলতে পারে বেশ। তবে হ্যাঁ কথা বলার সময় ওর চোখ দুটো বেশ সুন্দর লাগে। তার নানা চোখের ভঙ্গি অন্যের নজর কেড়ে নিতে সক্ষম।
এতোক্ষণ বাদে মনে পড়ল আহিয়ানের কথা। আচ্ছা কোথায় উনি? এখনো কি ঘুমিয়ে আছেন নাকি উঠে গেছেন। উঠলেও কি বাসায় চলে গেছে নাকি আমাকে খুঁজছে! খুঁজলে কি এতোক্ষণে এসে পড়তেন না তিনি। যাই হোক উনার সম্পর্কে এতো ভেবে আমার কাজ নেই।
মূহুর্তে’ই খেয়ার করলাম নিতি ওরা আমাকে নিয়ে কানাকানি করছে। হয়তো গ্রামে যা ঘটেছে সেটা নিয়েই কথা চলছে। একপর্যায়ে নিতি ওরা সবাই উঠে গেল। আমি নিশ্চিত এখন তারা আমার কাছেই আসবে। আর তাই হলো আমার দিকেই এগিয়ে আসছে তারা। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শক্ত করছি। অনেক কড়া কড়া কথা শুনতে হবে।
হঠাৎ মনে হলো ঝড়ের বেগে কেউ এলো। চোখ তুলে তাকিয়ে একটা চিরচেনা মুখ দেখলাম। তার মুখে একগাদা রাগের রেশ দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে তার এলোমেলো চুল গুলোর হাল। আমি তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠি,
“আপনি!
সে আমার কথার কোন উওর না দিয়ে হুট করেই আমার হাত ধরে ফেলল। আমি সবার আগে তাকালাম নিতির দিকে। বেচারার আমার থেকেও বেশি শক খেয়েছে লাগছে। আহিয়ান আমার হাত টেনে বাইরে নিয়ে গেল। ভার্সিটির সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। বাইরে আনার পর’ই আমাকে গাড়িতে বসিয়ে দিল। অতঃপর ওপাশ দিয়ে এসে ড্রাইভিং সিট বসল। আমি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। খুব জোরে ধরেছে হাত টা। ব্যাথা করছে খুব।
সিটে বসে গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তার চাহনির সাথে আমি পেরে উঠছিলাম না বলে চোখ সরিয়ে বাইরে তাকালাম। দেখি এখানে নিতি ওরা সবাই উপস্থিত! গাড়ির কাচ উঠানো তাই ভেতরের কিছুই তাঁদের কাছে স্পষ্ট না। তবে আমি এখান থেকে তাঁদের দেখতে পারছি।
আহিয়ান গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
“তুমি এমনটা কিভাবে করতে পারো!
চট করে উওর দিলাম,
“কি করেছি আমি!
“আমাকে ট্রেনে একা রেখে চলে এলে কেন?
“তো! কোন মেয়ে না তো আপনি যে পাচার করে দেবে।
“তাই বলে এভাবে রেখে চলে আসবে!
“হ্যাঁ আসবো! কিন্তু এসে লাভ কি হলো চলেই তো এলেন।
“মানে! তুমি চাইতে আমি আর না ফিরি।
“না এই কথা কখন বললাম!
“এই যে বললে!
“এই কথার অর্থ ছিল আমার জীবন থেকে সরে যাবেন।
“ভেবেছিলে রেগে গিয়ে তোমার সাথে আর দেখা করবো না।
আমি উনার দিকে তাকালাম। আসলেই আমি এটা ভেবেছিলাম। আহিয়ান সিটে আরাম করে বসে বলল,
“আহিয়ান নিজের মন মতো চলে! কখনো কেউ তার উপর প্রভাব ফেলতে পারে না তুমিও না।
আমি উনার থেকে মুখ সরিয়ে বলি,
“এভাবে আমাকে তুলে আনার মানে কি?
“অন্য কোন মেয়ে কে তো আর আনি নি।
“জোর করে বিয়ে করেছেন আমায়।
“বিয়ে তো হয়েই গেছে এখন আর এসব বলে লাভ নেই।
“দেখছেন ওরা কিভাবে তাকিয়ে আছে।
“ওদের চোখ ওরা তাকিয়েছে তোমার সমস্যা কি?
“আমাকে দেখছে এটাই সমস্যা!
“কে বললো তোমায় দেখছে? দেখছে আমার গাড়ি কে?
বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কেন জানি উনাকে বেশ ক্লান্ত লাগছিল। আমি বলে উঠি,
“গাড়িটা কোথা থেকে এলো।
“গাড়িটা স্টেশনে এসেছে। যদিও অনেক দেরি করে, জ্যামে ছিল বলে। ( অতঃপর আমার দিকে মুখ করে ) আজকের দিন টাই আমার খারাপ যাবে শুধু তোমার জন্য বুঝলে।
“আমি আবার কি করলাম?
“চলে যাচ্ছিল ভালো কথা একটা চিঠি তো লেখেই যেতে পারতা তাই না। ঘুম থেকে উঠে শুনি ট্রেন আবার ছেড়ে দেবে। এটা শুনেই বের হতে যাবো তার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিল।
“তাহলে আপনি কিভাবে নামলেন? লাফ দিয়ে?
“ভুতে কামরায় নাকি আমায়? নাকি আমাকে তোমার মতো ভাবো যে পাগলামি করবো!
আমি একটা ভেংচি কেটে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। উনি বললেন,
“ট্রেনের চেন টেনে তারপর থামিয়েছি। অতঃপর আমি নেমে রাস্তায় এসে দেখি গাড়ি এখনো আসে নি। ফোন বের করে দেখি চার্জ নেই। এতো রাগ হচ্ছিল বলার মতো না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর গাড়ি এলো। রাগের কারনে ড্রাইভার কে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে টাকা দিয়ে বললাম সিএনজি দিয়ে বাসাম চলে যাও।
গেলাম তোমার বাসায়, গিয়ে দেখি রুম তালা বন্ধ! দাদু’র কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন ভার্সিটি চলে গেছো।
“আর আপনি এখানে চলে এলেন!
“না! বাসায় গেলাম। ফোন চার্জে রেখে মা’র সাথে দেখা করলাম। তারপর এলাম ভার্সিটিতে!
“ফোন চার্জ দিতে বাসায় গেছেন আপনি।
“হ্যাঁ কেনো কি হয়েছে? তবে আরেকটা কারন ছিল, মা নিশ্চিত অনেক ফোন করেছিলো আমায়। কিন্তু ফোন তো বন্ধ ছিল তাই চিন্তা করছিলো তাই বাসায় গেলাম। কারন জানতাম ভার্সিটি থেকে তুমি তো আর পালিয়ে যাবে না।
“ভালো। আমি বের হলাম!
“কোথাও যাবে না তুমি।
“আপনি বলার কে? আমি তো যাবোই!
বলেই গাড়ির দরজা খুলতে গেলাম। কিন্তু তা খুলছেই না। বিরক্ত হয়ে বলি,
“আপনার গাড়ি কি খারাপ হয়ে গেল ।
“ভূতনি একটা! দরজা লক করা এটা এখনো বুঝতে পারো নি।
বলেই তিনি গাড়ি স্টার্ট দিলেন। আমি কিছুই করতে পারলাম না। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বলল,
“সিট বেল্ট বেঁধে নাও।
“আমার ক্লাস আছে।
“করা লাগবে না, এখন বাসায় যাবে আর ঘুমাবে
“এখন কি ঘুমানোর সময় নাকি।
“জানি ঘুমানোর সময় না কিন্তু তুমি কাল সারারাত ঘুমাও নি, তাই এখন বাসায় গিয়ে ঘুমাবা।
“আপনাকে কে বললো আমি ঘুমায় নি।
“তুমি ঘুমালে আমাকে রেখে যেতে পারতে না। তোমার যেই ঘুম!
“কি বললেন আপনি।
“সত্যি বলেছি!
বলতে বলতে একটা রেস্টুরেন্টে’র সামনে গাড়ি থামাল। কিন্তু আমার সিটবেল্ট না বাধায় গাড়ি ব্রেক করার সাথে সাথে আমি সামনের দিকে ঝুঁকে গেলাম। আহিয়ান আমার বাহু ধরে টেনে বসাল। অতঃপর বলল,
“দেখলে তো বড়দের কথা না শুনলে কি হয়!
“ছাড়ুন আমাকে।
“নাও ছেড়ে দিলাম!
“এখানে কেন গাড়ি থামালেন।
“ক্ষুধা লেগেছে খাবো তাই!
“ভালো!
“নামো।
“আপনার ক্ষুধা লেখেছে আপনি খেয়ে আসুন আমাকে কেন নামতে বলছেন
“বসে বসে দেখবে আমি কি খাবো। নামো জলদি!
উনার ধমক খেয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। অতঃপর দুজনেই রেস্টুরেন্টে গেলাম। উনি সত্যি সত্যি একজনের জন্য’ই খাবার অর্ডার করেছে। তাহলে কি সত্যি’ই উনি একা একা খাবেন আর আমি বসে বসে দেখবে। আজব লোক তো!
আমি হালকা কেশে বললাম,
“আপনি আমাকে এভাবে নিয়ে এলেন আপনার বন্ধুরা সব দেখেছে।
“চোখ কি তোমার একাই আছে নাকি। দেখেছি আমি।
“ওরা যখন জিজ্ঞেস করল আপনি এমন কেন করলেন তখন কি বলবেন।
“তুমি কি চাও!
“আপনার স্ত্রী হয়ে কখনো পরিচয় দিতে চাই না।
উনি হেসে বললেন,
“ঠিক আছে তাই হবে।
“আপনি হাসছেন। নিতি কি আপনাকে ছেড়ে দিবে ভাবছেন।
“আহিয়ান কাউকে কৈফিয়ত দেয় না। তাই নিতি ভুলেও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না। যদি ধরে এসে তোমাকেই ধরবে। তুমি বরং ভেবে নেও তখন কি বলবে!
আমি উনার কথায় ভ্যাবলার মত উনার দিকে তাকিয়ে আছি। কিছু বলতে যাবো এমন সময় ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো। আহিয়ান তাকে বলল খাবার গুলো আমার কাছে রাখতে। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি তার দিকে। জিজ্ঞেস করলাম,
“কি করছেন এসব?
আমার কথার পাত্তা না দিয়ে আহিয়ান ওয়েটার কে বলল,
“এক কাপ চা দিতে!
ওয়েটার চলে গেল। আমি বসে আছি। আহিয়ান বলে উঠে,
“খেয়ে নাও।
“না আমি খেয়েছি।
“খেয়ে থাকলেও খেয়ে নাও। কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাথা পড়ে যাবে
“আপনার মনে হলে আমি কি করতে পারি।
“কিছু না শুধু খেতে বলেছি খাও।
“না।
“তাহলে বসে থাকো।
“কেন?
“আমার ইচ্ছা।
“আজব তো সবকিছু কি আপনার ইচ্ছায় চলবে নাকি।
“হুম চলবে। নাও খেতে শুরু করো।
“আমি চলে যাবে।
“উঠে তো দেখো।
আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। আহিয়ান বলে উঠে,
“দেখো ভূতনি অনেক রাগানোর চেষ্টা করেছো আমায়। কিন্তু আমি যথেষ্ট ধৈর্য্য রাখছি। চুপচাপ খাওয়া নেও। শেষবারের মতো বলছি। এরপর আর বলবো না।
বলেই নিজের চেয়ারে আরাম করে বসে রইলেন। উনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে রাগ ধরে রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করছে সে। উনার এমন চেহারার ভঙ্গি দেখে কেন জানি ভয় পেতে শুরু করলাম। তাই আর কথা বাড়ালাম না। তবে খাওয়া শুরু করলাম না। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“আপনি খাবেন না!
“না এখন আর খাবো না। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবো তারপর ঘুমাবো।
“আবার ঘুমাবেন।
“আমি তোমার মতো ভূতনি না যে রাতেও জেগে থাকবো আবার সারাদিনও
“ভূতনি হবেন কেন? পেঁচা আপনি।
“কিন্তু পেঁচা তো রাতে জেগে থাকে।
“আপনি হলেন এক্সট্রা অর্ডিনারি পেঁচা, যে রাতেও জেগে থাকে আর সকালেও!
“তুমি তো একটা পাগল, তোমার সাথে বকবক করে আমিও পাগল হবো। চুপচাপ খাও তুমি। এককথা একশবার বলা লাগে তোমায়!
“কিন্তু আপনি তো…
বলার আগেই আহিয়ান হাত দিয়ে নিজের মুখে আঙ্গুল দিয়ে আমাকে চুপ করতে বলে আর খেয়ে নিতে বলে। আমি খাওয়া শুরু করেছি তখন’ই ওয়েটার এসে চা দিয়ে গেল।
অতঃপর দুজনেই বের হলাম। আহিয়ান শুধু চা’ই খেল আর কিছু খেল না।
.
আহিয়ান আমাকে বাড়ির নামিয়ে দিল। অতঃপর সে চলে গেল। ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেবার পর’ই ঘুমিয়ে গেলাম। কখন ঘুমোলাম টের ও পেলাম না।
কারো দরজা কড়া নাওয়ার আওয়াজে ঘুম ভাঙল আমার। অতঃপর ঘুম থেকে উঠে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি দুপুর দুটো বাজে। এসময় আবার কে এলো। এখনো দরজা কড়া নাড়ছে। অতঃপর চোখ ঢলতে ঢলতে আগালাম দরজার দিকে…
#চলবে….