#অরুর_সংসার
পর্ব-৩০
লেখিকাঃতানহা ইসলাম (ছদ্মনামঃনিশিকথা)
____________________
আজ অরু অয়নকে স্বামি স্ত্রির সম্পর্ক নিয়ে বলা তার ৩ টা কথার প্রমান হাতেনাতে দিয়েছে। অরুর প্রতি এখন অয়নের মনে সম্মান আর ভরসার অবিচ্ছিন্ন প্রাচীর গড়ে উঠেছে….. তবে ভালবাসা???
অরু তো অয়নকে নিজের সবটা দিয়ে ভালবেসেছে… কিন্তু অয়ন কি পারবে অরুকে ভালবাসতে???
জানা নেই অয়নের….
.
অয়ন নিজের আর অরুর চেক আপ করিয়ে বাড়ী ফিরবে ফিরলো….
বাড়ীতে ঢুকতেই অয়ন আর অরু হল রুমে নিসাদ হুসাইনের সাথে এক মধ্যবয়সী মহিলা কে দেখলো…….
পিছন থেকে দেখে পুরোপুরি চিনতে না পারলেও কেন যেন অরু ভ্রু কুঁচকে ফেলল….
-মা দেখো কে এসেছে? তোমার মা
-আন্টি
-কথা বল তোমরা
অয়ন লাকি আফরোজ কে দেখে বলল……
-আসসালামুআলাইকুম
-ওয়ালাইকুমআসসালাম।
শরীর কেমন এখন তোমার বাবা?
-আলহামদুলিল্লাহ
-ভাল
-কথা বলেন আপনারা
-আচ্ছা বাবা
(অয়ন সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে থেমে গেল অরুর কথায়…)
-কেন এসেছেন আন্টি?
-মারে তোর বাবা অনেক অসুস্থ রে। ৩বার স্টোক করে এখন প্যারালাইজড!
-তো??
-সব জমিজমা বেঁচে খেয়েছি এতদিন। উনার চিকিৎসা করার জন্য, ওসুধ কেনার জন্য একটা টাকাও নাই। আমারে একটু সাহায্য কর রে মা
-আমি কি সাহায্য করতে পারি আপনাকে?
-৫০ হাজার টাকা খুব দরকার রে মা
-আমি কি করবো? আমি টাকা দিতে পারবো না
-প্লিজ না আমি তোর পায় ধরি
(আরে কি করছেন? দুরে সরেন প্লিজ…. )
-শোন মা এই দেখ আমি কি আনছি??? তোর আম্মুর সেই চুড় টা।এটা নিয়ে আমারে ৫০হাজার টাকা দে।
-হুম।দেন!!!!
(অরু চুড় টা নিয়ে রুমে চলে গেল….. গত কয়মাস ধরে অরু আর অয়ন নিচে গেস্ট রুমে থাকে। ঊপরে ওঠানামায় অরুর সমস্যা হবে প্রেগন্যান্সি তে আর অয়ন ও তো অসুস্থ ছিল…
অয়ন অরুর এমন অদ্ভুত কঠোরতা দেখে অবাক। সে তার বউ অরু আর এই অরুকে মিলাতে পারছে না।অয়ন সিঁড়ি থেকে নেমে রুমে গেল…রুমে ঢুকে দেখে অরু চুড় টা বুকে চেপে চোখের জল ফেলছে…
-অরু
-হু
-কি করছো
-আমার এই চুড় টা লাগবে।আপনার কাছে ৩৫ হাজার টাকা হবে??
-৩৫ কেন?? এটা তো বেশ মোটা চুড়… ৪০,৪৫ এর কম হবে না
-১৫হাজার আছে আমার লাছে
-কিভাবে?
-ওই যে আমাকে সালামি যা দিয়েছিলেন আপনারা সবাই আর বিয়ের রাতে!!
-পাগল তুমি? ৫০ হাজার লাগবে তো? আমি ৩০দিচ্ছি আর বাবার কাছে থেকে ২০ এনে দিচ্ছি। আমি ই ৫০ দিতাম কিন্তু আপাতত ওইখান থেকে টাকা ভাংবো না।তোমার ডেলিভারির জন্য রেখেছি
-হু
-অরু চুড় টা নিয়ে তার বদলে টাকা দেবার কি খুব দরকার ছিল??
-ছিল। এটা আমার মায়ের চুড়। এমনি দেবে না উনি
-অরু তোমার বাবা অসুস্থ আর তুমি তার চিকিৎসার জন্য টাকা মায়ের চুড় কিনে দেবে?
-হ্যা তাই ই।উনি অসুস্থ…আমার কেমন ফিল হচ্ছে জানেন?
যেমন টা আপনার মা অসুস্থ হবার সময় আপনার আর আরোহী আপির হয়েছিল……
(অয়ন অরুর ওরূপ কথায় তখন আর কিছু বলে নি…তবে এই অরুর সাথে আসল অরুকে অয়ন মিলাতে আজ বারবার ভুল করছে….)
…..
…………
………………..
মৌ শুয়ে শুয়ে মোবাইলে সূরা ইয়াসিন শুনছিল। সাদ মোবাইলে ক্লাইন্টদের সাথে কথা বলছে…. রাজ গত ১সপ্তাহ অফিস যায় না।ছুটি নিয়েছে কেননা মৌ এর শরীর ইদানিং আরো খারাপ থাকে…. হাটতেই পারে না মেয়েটা। পায়ে অনেক পানি জমেছে তার….. তাই রাজ অফিস থেকে ২০ দিনের ছুটি নিয়েছে……… হটাৎ………..
-আহ্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্ ওমাগো
-মৌ?? কি হল???
(রাজ ফোন ফেলে দৌড়ে মৌ এর কাছে গেল…মৌ কিছু বলতেই পারছে না শুধু পেট চেপে আর্তনাদ করছে……।
-এএএএএই মৌ কি হল? লিভার পেইন উঠলো নাকি ????
চল হাসপাতালে…..
সাদ দ্রুত গাড়ী বের করে মৌ কে নিয়ে রওনা দিল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে….. সাথে বুয়াটাকেও নিল।
-হেলো আসসালামুআলাইকুম
-দোস্ত কই তুই?
-বাসায়
-মমমমমমমৌ…
-কি হয়েছে মৌ এর
-হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি পেইন উঠেছে
-ওকে আমি আসতেছি
অয়ন ফোন রাখতেই…
-কি হয়েছে মৌ আপুর?
-পেইন উঠেছে
-আমিও যাব
-না দরকার নেই এই অবস্থায়
-কি বলেন? কিছু হবে না।
-চল
…………………
…………….
……..
-অহনা
-শুনছি
-কি হয়েছে বল ত? সকাল থেকে দেখি তোমার মুড খারাপ। অফিসে যাব তো। যাওয়ার পথে যদি তোমার এমন মুড দেখি….!
-ত কি করবো??? তোরে ওই বিদেশি মাইয়া ফোন দেয় কেন রাত বেরাত??
-অহনা! ভদ্র ভাষায় কথা বল
-কিসের ভদ্রতা? বল রাজ কেন ফোন দেয় এত? আমি অনেক দিন ধরেই খেয়াল করেছি। জরুরি কথা একদিন থাকে দুইদিন থাকে তাই বলে রোজ রোজ? আমি তোমাকে একবার ও প্রশ্ন করি নি এতদিনে যে বিগত ১বছরে তুমি বিদেশে কি করেছো না করেছো….কিন্তু এখন তো আমার ডাউট হচ্ছে…!!!
-অহনা……!!!!!!!
-বল কেন ফোন দেয়।
-বলবো না
-তাহলে আমি এই বাসায় ই থাকবো না
-চলে যাও ।
– তুমি বলতে পারলে এটা?
-অহনা……।।
(অহনা ঘটঘট করে চলে গেল রুম থেকে…… )
……..
……………
……..
অরু বসে আছে ওটির বাইরে।
♦♥♦
অয়ন সাদ কে লক্ষ্য করছে। মৌ কে ওটি তে নিয়ে যাবার পর থেকে একটা মুহূর্তের জন্যও সে স্থির হয়ে বসে নি। ঘামছে খুব করে সাদ।সাদকে দেখে এমন মনে হচ্ছে যে তার শুধু শরীর টা এখানে আর মন মৌ এর কাছে
আচ্ছা? বাবা হবার মুহূর্তটা এমন ই????
সেও তো বাবা হতে চলেছে। আল্লাহ্ এর রহমত থাকলে আর কিছুদিন পর তো সাদের জায়গায় অয়ন থাকবে…
না সাদের মত ভাল স্বামী অয়ন হতে পারবে না।
অয়ন তো অরুর স্বামী হবার যোগ্যই না……
একটা মেয়ের অন্তঃসত্বা সময়কালীন কত যত্ন, ভালবাসার দরকার হয়।।।। অরু তো অয়নের কাছে সেসব কিছুই পায় নি। অরু উল্টো অয়নকে এই অবস্থায় যত্ন, ভালবাসায় কোন কমতি রাখে নি…….
অয়নের এই মুহূর্তে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে অরুকে স্ত্রি রূপে পেয়ে….
অরু বলেছিল
স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক মানে
ভালবাসার সম্পর্ক…..
অরু তো নিজের বলা কথা অনুযায়ী নিজের সর্বস্ব দিয়ে অয়নকে ভালবেসেছে………
অরু বলেছিল
স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক মানে সম্মানের সম্পর্ক……..
অরু বিয়ের প্রথম রাত থেকে অয়নকে সম্মান দিয়েছে… এমনকি গত কয় মাসে অয়নের অসুস্থতায় অরু কখনো অয়নকে এটা ফিল হতে দেয় নি যে অরু বিরক্ত….. অরুর চোখে নিজের জন্য সবসময় অয়ন একই সম্মান দেখেছে………
অরু বলেছিল
স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক মানে ভরসার সেই অটুট সম্পর্ক যেখানে দুই পক্ষের ই একে অন্যের প্রতি এই আস্থা থাকে যে জীবনের যে কোন মুহূর্তে যে বিপদ ই আসুক না কেন ওই একটা মানুষ তার হাত কখনো ছাড়বে না। আর অরু অয়নের জীবেনের সেই আস্থার স্থান হিসেবে নিজেকে প্রমান করেছে যে তার বিপদে, জড়া জীর্নতায় তাকে ছেড়ে যায় নি…..
♦♥♦
বাচ্চার কান্নার শব্দে অয়নের ভাবনায় ছেদ পরলো…..
অয়ন সাথেসাথে সাদের দিকে তাকালো….. সাদের চোখে পানি……. ♥
অয়ন গিয়ে সাদকে জড়িয়ে ধরলো….
-congratulation yar
সাদ কাঁপছে…… ১মিনিটের মাথায় আবার বাচ্চার কান্নার আওয়াজে সাদ এবার বসে পড়লো….
-♥…আমার বাচ্চারা…♥
২ জন নার্স ২ টা বাচ্চা কোলে বের হল… অরু উঠে দাড়ালো….
একজন নার্স অরুর কোলে একটা বাচ্চা দিল আর সাদের কোলে আরেকজন নার্স আরেকটা বাচ্চা দিয়ে বলল….
– ২টা ছেলে আর একটা মেয়ে
-মাশাআল্লাহ্ ♥♥
অয়ন মিস্টি কিনতে চলে গেল……..
কিছুক্ষন বাদে ডক্টর ফারহানা আর জয়া বের হল….
-ডক্টর!!!! ডক্টর…! আমার মৌ কেমন আছে???
-আলহামদুলিল্লাহ মা আর বাচ্চারা সবাই ভাল আছে ♥
-আমি দেখা করতে পারবো মৌ এর সাথে?
-একটু পর।আগে কেবিনে সিফ্ট করা হোক…..
-ওকে
অয়ন সারা হাসপাতালে মিস্টি বিলালো …..
অরুর কাছে মিস্টি দিয়ে বলল….
-নেও অরু। Congratulation কাকি হয়ে গেলে
-আপনি কোলে নিন??
-না না থাক
-কেন??
-আমি পারবো না ও অনেক ছোট… এ কি মেয়ে না ছেলে???
-তাতো জানিনা। দাড়ান
(অরু বাবুর গা থেকে কাঁথা সরিয়ে বলল…
-মেয়ে
(অরুর এমন কান্ড দেখে অয়ন জোরে জোরে হেসে দিল)
-বোকা
♥♥♥♥♥♥♥
অহনা বাড়ী আসার পথে সাদের বাচ্চা হবার কথা শুনে ডিরেক্ট হাসপাতালে গেল আর রাজ বাড়ীতে গিয়ে শুনলো অহনা আসে নি।রাজের খুব টেনশন হচ্ছে…..
কই গেল মেয়েটা…. মেয়েটা বড্ড অভিমানী… কি যে করবে রাজ মেয়েটাকে নিয়ে………..
ফোন দিচ্ছে তাও রিসিভ করছে না অহনা
…
রাতে অহনা, অয়ন আর অরু বাসায় ফিরবে গাড়ীর তেল ভরতে গাড়ী থামালো অয়ন……..
অরু জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে তাকাতে হুট করে এক জায়গায় চোখ থেমে গেল তার…
-তন্নি না…..তন্নি
(অরু গাড়ী থেকে বের হয়ে দাড়ালো….)
-তন্নি
-অরু কেমন আছিস?
-ভাল।এই রাতে তুই এখানে?
-আব্বার ওষুধ কিনতে
-ওহ
-শরীর ভাল তোর বোন?
-হুম
-কয়মাস?
-৮
-অরু কে??
-ও তন্নি আমার বোন
-ওহ।কেমন আছো?
-ভাল।
-এখানে এত রাতে একা কেন? চল কোথায় যাবে আমরা ড্রপ করে দিচ্ছি
-না না দুলাভাই দরকার নেই.. যে জ্যাম দেরী হয়ে যাবে তার চেয়ে বরং আমি হেটে দ্রুত যেতে পারবো। বেশি পথ না তো…এই তো বার্ডেমে
-না তাও চল।
-আয় না চল তন্নি
(অয়ন পথে তন্নি কে তার বাবার জন্য ফল আর কিছু শুকনা খাবার কিনে দিল)
-আসি অরু..আসি দুলাভাই,আপু। আল্লাহ হাফেয
(হটাৎ অরু কি মনে করে বলল….
-তন্নি দাড়া
-হু
-নে এই টাকা টা রাখ উনাকে ওসুধ কিনে দিস।
-আচ্ছা। একবার দেখতে যাবি না???
-না
……………..
……….
…..
বাসায় ফিরে সবাই দেখে রাজ আর নিসাদ হুসাইন বসে চা খাচ্ছেন আর সাদের বাচ্চাদের ভিডিও কলে দেখছেন….. অহনা হাসপাতালে রাতে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু সাদের কাজিন সুম্মি থাকবে বলে আর থাকে নি। অহনা রাজ কে দেখে মুখ কালো করে নিল।কিছু না বলে নিজের রুমে চলে এলো…
-অহনা
-কি?
-চলে এলে যে
-ইচ্ছা
-বাসায় চল।
-না।তুমি ই ত চলে যেতে বলেছিলে
-সেটা রাগের মাথায়।তুমি জানো আমি তর্ক পছন্দ করি না……
– ………….
-অহনা…!! লিসেন ওই মেয়ে টার সাথে পরিচয় আমার এয়ারপোর্টে দেশে ফেরার সময়।ওর কাছে শুনলাম ওর বর বিদেশি তবে বাংলাদেশি একজন কে বিয়ে করে দেশে সেটেল হয়েছিলেন ৩বছর আগে। তারপর থেকে ও সিংগেল মাদারর
.. ওর বর অনেক অসুস্থ গত বছর থেকে তাই নিজের ছেলে সমেত বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিল সেদিন … কোন কারনে তার ভিসা হয় নি।পরে আমাকে পেয়ে আমার কাছে টাকা পাঠিয়েছিল নিজের বর কে।এর পর থেকে প্রতি মাসেই টাকা পাঠায়। আমি তুলে ওই লোক কে দিয়ে আসি।!That’s it.
-ওহ এই কথা।আগে বল নি কেন???
-বলতাম তুমি তো এতদিনে কখনো জিজ্ঞাস কর নি।আর আজ যখন করলে সন্দেহ করে করলে
-রাজ আমি তো
-থাক। অহনা তুমি আমায় সকালে বললে আমি বিদেশে ১বছর কি করেছি না করেছি জানো না।it means তুমি আমার বিষয়ে সন্ধিহান….. আচ্ছা
অহনা তুমিও তো ১বছর দেশে আমার থেকে দুরে ছিলে…কই আমি তো তোমাকে সন্দেহ করি নি একটা বারের জন্য….
-সরি রাজ
-এতে সরির কিছুই নেই। তবে স্বামী স্ত্রির মাঝে বিশ্বাস অত্যাবশ্যকীয়… বিশ্বাস ব্যতীত সম্পর্কের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়।ঠুনকো হয়ে যায়।
(অহনা এবার হাউমাউ করে কেঁদে রাজকে জড়িয়ে ধরলো……)
-ক্ষমা করে দেও আমায় প্লিজ।আমিও অভিমান করে ওমন বলেছি। আমি তোমায় অবিশ্বাস করি না…. I believe you more than myself… i love you more than me
-I know.I love you too.And i believe a lot. বাসায় চল এখন ।
♥♥♥♥♥♥♥
অরু বারান্দায় দাড়ীয়ে আছে…… চোখে পানি টলমল করছে……
-অরু
-হু
-তন্নি তোমার আপন বোন??
-উহু…… তন্নি আমার বোন।
-ওহ
-সৎ হলেও ওই আমার একমাত্র আপন ছিল ওই বাসায়! ১ বছরের ডিফারেন্স আমাদের। ও বড়….. কিন্তু সেম ক্লাশে পড়ি আমরা।
আমাকে তো আমার সৎ মা লেখাপড়া করতে দিত না! বই কিনে দেওয়া তো দুরে থাক!!এজন্যই তো এখানে বই ছাড়া এসেছিলাম….. মনে নেই আপনার এইচ এস সি পরীক্ষার সময় আমার বই নেই শুনে অবাক হয়েছিলেন আপনি। তাহলে শুনেন…… তন্নির মা আমাকে দেখতেই পারতো না… সে চাইতো যে আমি ঘরের কাজ ই করি, কোনদিন কাজের মেয়েও রাখে নি জানেন। রাখবে কেন? আমি ছিলাম তো! আর তন্নির বাবা ক্লাশ ১০ পর্যন্ত আমার পড়ার খরচ চালিয়েছেন….. কিন্তু যেই এস এস সি পরীক্ষারয় আমি গোল্ডেন পেয়েছিলাম আর তন্নি বি পেয়েছিলো সাইন্স থেকে ওই তো আমার সৎ মায়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছিল! সেই সাথে অশান্তি করে আমার পড়ার খরচ দেওয়া বন্ধ করিয়ে দিল।। তবে তন্নি আমাকে ভালবাসতো যদিও ওর মায়ের সামনে ওর চলতো না।
তাই গোপনে আমাকে একটা টিউশুনি মেনেজ করে দিয়েছিল। ওর বান্ধুবির মেয়ে,……ক্লাশ ২ তে পড়তো। ৩ হাজার টাকা দিত।ওই দিয়েই আমার কিলেজে যাওয়ার খরচ, কলেজের খরচ চালাতাম সারা মাস।বাসার সব কাজ নিয়মিত করতাম আর আমাকে কোন টাকা দেওয়া লাগতো না ওই মহিলা আর আমার কলেজে যাওয়া দিয়ে কিছু বলতো না।
তবে সে আমাকে বলেছিল যে সাইন্সে পড়া চলবে না।তার মেয়ে যেহেতু আর্টসে পড়ে আমারও তাই পড়তে হবে। আমি কোন মতে শিক্ষিত হতে চেয়েছিলাম উপায় না পেয়ে আর্টসেই ভর্তি হলাম।
তন্নি বড় বড় টিচারের কাছে পড়তো আর আমাকে বই নোটপাতি দিয়ে হেল্প করতো।
এভাবেই পড়ছিলাম কিন্তু টেস্টের রেজান্ট যেই আমার খুব ভাল হল আর তরুর আবার খারাপ হল সেই ওর মা আমার লেখাপড়া বন্ধ করার উদ্দেশ্যে আমার বিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল।
(অয়নের মন টা খুব খারাপ হয়ে গেল অরুর কথায়……)
অয়ন:কিন্তু অরু তোমার সৎ বোন তোমার থেকে ১বছরের বড় কিভাবে হয়? ভুল বললে নাকি?? আম্মু মারা গেলে সাথেসাথে বিয়ে করলেও তো তোমার থেকে বড় হওয়া পসিবল না ?
( অরু এতক্ষন না কাঁদলেও এখন তার চোখে পানি টলমল করছে
ভারী গলায় বলল )
অরু: তন্নির বাবার সাথে উনার অবৈধ সম্পর্ক ছিল।
একারনে ১ বছরের ডিফারেন্স। আমার মা যেদিন লোকটের এই ধোকা,নংরএয়ানূ কথা জানতে পারেন সেদিন রাতেই!!!
স্টোক করেছিলেন! (অরু কেঁদে দিল) ওই লোক তো আমার আম্মুর খুনি। ওই মহিলাও
কাঁদতে কাঁদতে অরু আবার বলল সবাই জানে
আমাকে জন্ম দিওয়ার সময় আমার মা মারা গেছেন। আসলে না। আম্মু আমার বাবার এতবার প্রতারণা সহ্য না করতে পেরে!!!!!!!!!
(হাউমাউ করে কেঁদে দিল অরু)
(অয়ন নিশ্চুপ)
( অয়ন অরুর কাছে গিয়ে ওকে নিজের টেনে নিল)
অয়ন: কেঁদো না। বরং দুয়া কর আম্মুর জন্য।
আর ওই লোকের জন্য তো কাঁদবাই না। উনি একজন খুনি, উনাকে বাবা বলবা না
অরু : বলি না তো। জানেন আমার ইচ্ছা করতো না উনার টাকায় খেতে,পড়তে! উপায় ছিল না বলে বাধ্য হয়েছিলাম। কবে গত ২ বছর টিউশুনি পাওয়ার পর থেকে আর উনার টাকায় খাই ও নি পড়িও নি। কাপড় চোপড় ও উনার টা ধরি নি।
দিতো ও না।ভুল বশত দিলেও নেই নি। এই যে আমার যত শাড়ি দেখছেন সব ই আমার মায়ের। আর বিয়েতে কিছু পেয়েছিলাম সেগুলা ! উনার কিচ্ছু আমি আনি নি! আমি ভেবেছিলাম যে একদিন বড় হয়ে উনার মুখে টাকা ছুড়ে এসে বলবো যে আমার আর আমার মায়ের জন্য যা টাকা খরচ করছিলেন নেন। শোধ।
(অয়ন অরুর কথা শুনে ভাবছে যে মেয়েটার মধ্যে রাগও আছে? সে তো জানতো অরু শুরু ভালবাসতে জানে)
– বাবা যখন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ওই বাসায় গিয়েছিলেন সেদিন তো ওই মহিলা আমাকে মেরেই ফেলে রাতে যে তার মেয়ের জন্য না এসে আমার জন্য এত বড় বাড়ীর থেকে প্রস্তাব এসেছে। তাই দেখলেন না একটা কোন অনুষ্ঠান করলো না।আমার নানা বিয়ের সব ব্যবস্থা করেছিলেন। জানেন আমি না এসব জানতাম না। এস এস সির পর জেনেছিলাম নানার কাছে যে মায়ের মৃত্যুর পিছনে ওই লোক দায়ী। আমি তো উনার উপর রাগ ছিলাম ২য় বিয়ে নিয়ে আর বউ এর সামনে উনার কাপুরুষতা নিয়ে। কিন্তু উনি যে আমার মায়ের খুনি…! ঘেন্না করি আমি উনাকে। ঘেন্না।
একারনে…! একারনেই আমি উনার চিকিৎসার টাকা দেই নি….. একারনেই…. আমি ওই মহিলার কাছে থেকে আমার মায়ের চুড় আদায় করেছি। ভুল কিছু করেছি??
-না..
থাক বাদ দেও।
-হু।
-তোমার ইচ্ছা পুরণ হবে। আমি উনাকে আনুমানিক একটা এমাউন্ট দান কর দিব তোমার আর আম্মুর পিছনে যা খরচ করেছে তার শোধ হিসেবে
-আম্মু??
-হ্যা আমার আম্মু না? আমার বাবা যেমন তোমার বাবা
-জ্বি
-অরু
-বলেন
-উনি আম্মুর মৃত্যুর পিছনে দায়ী…. উনি তোমার শৈশব নস্টের পিছনে দায়ী। উনার কারনে তুমি পুরুষজাতিকে ঘৃণা কর না???
-নাহ আমি পুরুষ নামক উনাকে ঘেন্না করি। উনি বাবা নামে কলঙ্ক,স্বামী নামে কলঙ্ক তবে সব পুরুষ তো উনার মত নয়……
বলেছিলাম না? সব মানুষ এক হয় না।
এই পৃথিবীতে হাজার খারাপ পুরুষ থাকতে পারে তবে কোন খারাপ বাবা থাকতে পারে না। আমি এই জীবনে বাবার মত বাবা পেয়েছি তাহলে ওই লোকের জন্য সবাইকে এক বলে মাপবো কেন? যেখানে উনার কথা উনি কখনো বাবা হয়ে উঠতেই পারে নি। শুধু আমার কেন? তন্নির ও না।যে বাবা হয়ে উঠতেই পারে নি তাকে কি বলবো?
আর আপনার নজরে অত্র জগৎ এর নারী খারাপ আপনার মায়ের জন্য… তবে আসলেই কি তাই?
-না অরু। আমি ভুল ছিলাম। I was wrong…সবাই এক নয়
– হুম। অভাবে ঘেন্না করতে গেলে তো আনার নারী পুরুষ দুজন কেই করা লাগতো কেননা আমার আম্মুর মৃত্যুরর পিছনে যতিটা ওই লোক দায়ী তই ওই মহিলা।
….
নিস্তব্ধ রাত। সজাগ ২জোড়া চোখ। অরু আকাশ পানে চেয়ে গান ধরলো…..
সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী,
যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী
‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সখী, ভালোবাসা কারে কয় ! সে
কি কেবলই যাতনাময় ।
সে কি কেবলই চোখের জল ? সে
কি কেবলই দুখের শ্বাস ?
লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে
এমন দুখের আশ ।
আমার চোখে তো সকলই
শোভন,
সকলই নবীন, সকলই বিমল, সুনীল
আকাশ, শ্যামল কানন,
বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল—
সকলই আমার মতো ।
তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়,
হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়—
না জানে বেদন, না জানে রোদন,
না জানে সাধের যাতনা যত ।
ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে,
জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,
হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে
আকাশের তারা তেয়াগে কায় ।
আমার মতন সুখী কে আছে। আয়
সখী, আয় আমার কাছে—
সুখী হৃদয়ের সুখের গান শুনিয়া
তোদের জুড়াবে প্রাণ ।
প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল
একদিন নয় হাসিবি তোরা—
একিদন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে
মিলিয়া গাহিব মোরা ।।
………………………
অয়ন ভাবছে…সাথী চৌধুরী তার বাবাকে আর তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল বলে তার পর থেকে সে নারীদের ঘৃণা করেছে…. সেই মেন্টালিটির জন্য কতই না এই মেয়েটাকে কষ্ট দিয়েছে সে……
আর এদিকে এই মেয়ে….!!
অরুর বাবার প্রতারণার জন্য তার মা স্টোক করে মারা গিয়েছিল….. জীবনে কতই না কষ্ট পেয়েছে অরু
….একবুক ভরা পাহাড় সমান যন্ত্রনা নিয়ে অরু তার পরিবার কে ভালবাসায় আগলে রেখেছে……….
এই মেয়েকে ভাল না বেসে পারা যায়???? যায় না…….
অয়নের চোখ বেয়ে ২ফোটা জল গরিয়ে পরলো…..
এই ১বছরে কতই না কষ্ট দিয়েছে অয়ন অরুকে….
না অতন অরুর সাথে খারাপ ব্যবহার করতো না…তবে অয়নের শান্ত কথা যে অরুর বুকে প্রায় ই তীরের মত বিধঁতো সেটা অয়ন এখন হারে হারে জানান দিচ্ছে………..
আর সে কিনা অরুকে তার জীবন থেকে চলে যেতে বলেছিল……!
ওদিকে অরুর চোখ বেয়ে পানি পরতেই আছে। না সে ভুলে যায় নি অয়নের বলা সেদিনের কথা….
ভুলে যায় নি এটা যে অয়ন তাকে বলেছিল যে ফিরে এসে তাকে আর দেখতে চায় না অয়ন……
সকালে………………..
আজ থেকে অয়ন কাজে জয়েন্ট করবে……. আড়াই মাস পর আজ সে হাসপাতালে যাবে
অয়ন ঘুম থেকে উঠে আগেরর মত তার কাপড়, ফাইলপত্র, ওয়ালেট সহ যাবতীয় জিনিস গুছানো অবস্থায় সামনে পেল। হেসে দিল অয়ন। জানে এসব তার বউ এর কাজ।বসে থাকতে পারে না অরু কোন মতেই।টুকটুক করে কাজ করতেই থাকে…..
অয়ন নাকে সরিসার তেলের তেহারীর ঘ্রান পেল। নিশ্চই অরু রাঁধছে
……অরি ছাড়া এমন ঘ্রান কারো রান্নায় আসে না…..
অয়ন ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখলো অরু সামনে দাড়ানো।
অরু অয়নকে কোট পরিয়ে দিল পিছন থেকে।
– এই অবস্থায় কি দরকার ছিল রান্নাঘরে ঢোকার?
(অরু অয়নের টাই বাধতে বাধতে বলল…..)
-খালা রা হেল্প করেছে
-তাদের হেল্প আমার জানা আছে
-আপনার শার্ট, গেঞ্জি, আন্ডারওয়ার গুলা সব আলমারির ডান সাইডে রাখা আছে, আর স্যুট, প্যান্ট লেফট সাইফে।ওয়ালেট, টাই গুলা ওয়ারড্রবের ৩য় ড্রয়ারে আর পরের ২ টায় ফাইল সব আছে। ফোনের চার্জার…..
-আরে তুমিক এগুলা আমাকে বলছো কেন? তুমি ত আছ ই এসব সামলে রাখার জন্য
– ছোট ড্রয়ারে রাখে আছে….
(অয়নের কথার প্রতিউত্ত্ররে অরু আর কিছু না বলে টাই বেধে অয়নের থেকে একটু দুরে সরে এলো……)
-তোমাকে এই পেটু অবস্থায় অনেক কিউট লাগে অরু (বলে পাশে তাকাতেই অয়ন দেখে অরু নেই!! বারান্দায় দাড়িয়ে আছে….. অয়নের অরুর আজকের বিহেভিয়ার কেমন ওড লাগলেও দেরী হচ্ছে বলে আর কিছু বলল না……..
সন্ধ্যা……………
অয়ন আজ ৭ টার মধ্যেই বাড়ী ফেরেছে আজ……
অয়ন রুমে ঢুকে অন্ধকার পেল…. এই সময় তো অরু ঘর অন্ধকার করে রাখে না???? তাহলে আজ কেন??
লাইট জ্বালিয়ে রুম খালি পেল অয়ন বারান্দায় দেখলো….. অরু নেই…….. ওয়াশরুম দেখলো……..অরু নেই…
অয়নের বুক টা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো…..
অরু কোথায় গেল????
অয়ন সারা বাড়ী তন্নতন্ন করে খুঁজলো….. কোথাও অরুকে পেল না…..অয়ন কেন জানি প্রচুর ঘামছে….
দৌড়ে নিজেদের উপরের রুমে ঢুকে অয়ন এবার চিল্লাতে লাগলো….
-অরু………. ??
অরু……………!! কোথায় তুমি?? কোথায় গেলে??
দেখো আমি ফিরেছি…
তুমি জানো না আমি খুব ক্লান্ত অবস্থায় ফিরি…. তুমি না আমি বাসায় ফেরার সাথেসাথে আমাকে লেবুর পানি দেও রোজ?? আজ কই সেটা??? অরু…..!!!
দেও না আমায় লেবুর পানি….? আমার না খুব তেষ্টা পেয়েছে অরু……. গলাটা খুব শুখিয়ে গিয়েছে………..
অরু…………………
চলবে……….