#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২২
“এই অলক্ষুনে মেয়ে কে তোমরা ঘরে কেন তুলেছো মা!
ভাইয়ের এমন কথায় আমি পেছন থেকে বলি,
“তোমার ঘরে কি তুলেছে ভাইয়া, আমি যদি অলক্ষুনে হয়ে থাকি তাহলে তোমরা কি! আদৌ কি মানুষ তোমরা, যদি তা হতে তাহলে নিজের অসুস্থ বাপ আর মা কে অবশ্যই বাড়ি থেকে বের করে দিতে না!
আমার কথায় ভাইয়া অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এই প্রথম বার তার মুখে মুখে কথা বলছি বলে হয়তো সে অবাক। ভাইয়া একাই এসেছে বলে মনে হচ্ছে। মা আর বাবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা শুনছে। মা কাঁদছে বোধহয়! বারবার শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছছে। ভাইয়া কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“মুখে মুখে তর্ক করছিস!
“যা সত্যি তাই বলছি।
“কি জানিস তুই, কি সত্যি বলছিস। তোর জন্য পুরো গ্রামে আমাদের মান সম্মান ডুবে গেছে। কোথায় মুখ দেখাতে পারছি না। আর তুই কি না এই মুখ নিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছিস।
“কোথায় মুখ দেখাতে পারছো না নাকি তোমার শশুড় বাড়ি মুখ দেখাতে পারছো না কোনটা বলো তো।
“নিহা!
“চেঁচিয়ে লাভ নেই। আর বললে গ্রামে কেন ফিরে এসেছি, গ্রামে এসেছি নিজের মা বাবা কে দেখতে তবে চিন্তা করো না থাকতে আসি নি। আবার চলে যাবো
“তা এখনই চলে যা না। তোর জন্য আমরা কেন কথা শুনবো।
“কথা তুমি কেন শুনবে, আমি কি তোমার কাছে থাকি নাকি। আমি থাকি আমার মা বাবার কাছে। চাচার কাছে। যদি তাদের কোন সমস্যা না হয় তাহলে তোমার কি? তুমি এতো কথা বলছো কোন কারনে।
ভাইয়া এখন আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে মা’র দিকে তাকিয়ে বলে,
“এই শিখিয়েছো মেয়েকে। শহরে গিয়ে কি করে তোমার মেয়ে। ভালো কাজ করে বলে তো মনে হচ্ছে না।
আমি চুপ করে রইলাম কিছু বললাম না। ভাইয়া আবারো বলে উঠে,
“কিছু বলছো না। নাকি কোন অকাজ কুকাজ করে আবার এখানে এসেছে।
আমি এবার মুখ তুলে বলে উঠি,
“যাই করি না কেন তোমাকে বলতে বাধ্য নই।
“বড্ড মুখে মুখে কথা বলছিস। কে শিখিয়েছে তোকে এভাবে কথা বলতে
“সত্যি কথা বলতে তোমাদের থেকেই এসব শিখেছি। তোমরাই শিখিয়েছো
“কি বললি।
“যা বলেছি ঠিক বলেছি। ছেলে হয়ে যদি মা’র সাথে এভাবে কথা বলো তাহলে আমি দোষ করলাম কোথায়?
ভাইয়া রেগে মা কে বলল,
“তুমি কি এখনো কিছু বলবে না মা। দেখছো কিভাবে কথা বলছে ও
“মা কে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। কিছু বলবে না সে।
“কি বলছিস তুই।
“বুঝতে কষ্ট হবে এমন কথা বলিনি। সদর দরজা খোলাই আছে।
ভাইয়া রাগে ফুসফুস করতে বলল,
“এই অপমান কখনো ভুলবো না আমি।
“অপমান ভুলে যাবার জন্য করা হয় না ভাইয়া।
ভাইয়া হন হন করে রেগে চলে গেলেন। বাবা শান্ত ভাবে ঘরে চলে গেল। মা শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলি,
“ক্ষিধে লেগেছে খেতে দাও!
.
বিকালে কিছু নাড়ু আর মোয়া ডিব্বায় ভরে নিয়ে গেলাম আহিয়ান’র জন্য! আমার মনে হলো তার কাছে এগুলো খুব ভালো লেগেছে। তবে আজ তাদের বাড়ি যাবার সময় মুখ ঢাকি নি। ঢেকে কি লাভ তারা তো আমায় দেখেই নিয়েছে। যাদের থেকে লুকোতে চাই তারাই আমার সামনে এসে ঘুর ঘুর করে আর কি। রাস্তায় হাটার সময় কিছু লোক আমাকে এমন ভাবে দেখছিল যেন জীবনে কোন মানুষ কে দেখে নি তারা। আর রইল তাদের ফিচুর ফাচুর। কানাকানি শুরু হয়ে গেল। ফুলি এসব দেখে মুখ ফুলিয়ে আমাকে বলল,
“লোক গুলোর সমস্যা কি কও তো আপু। এভাবে তোমারে দেহে কেন।
নদী বলে উঠে,
“মনে হইতাছে নতুন বউ যাইতাছে। কেমন উইঠা পইড়া লাগছে দেখ।
“তোরা বাদ দে এসব। দেখ আমরা চলে এসেই উনাদের বাড়িতে।
রুবি বলে উঠে,
“ইয়া আল্লাহ এতো বড় বাড়ি। কিন্তু তারা তো মানুষ হুদা ৪ জন।
মিলি রুবি কে খোঁচা মেরে বলে উঠে,
“আরে গাধা কত্তো বড়লোক দেখছোস তুই। কাজের লোকগুলা আছে না। ওরা কি থাকবো না নাকি। তবে আফা যাই কও আমার অনেক শখ ছিল এখানে আসার। আজ আইলাম কিন্তু আমাদের ভিতরে ঢুকতে দিবো তো।
“কেন দিবো না!
বলতে বলতেই দারোয়ান চাচা সদর দরজা খুলে দিল। আমরা সবাই ভিতরে ঢুকলাম। চাচা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে স্বাগত জানালো আমাদের। বাড়ি ঢুকতেই ফুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে এলো। মালিরা সেখানে পানি দিচ্ছে। চারদিক বিভিন্ন রঙে ফুলে ভরপুর। ব্যাপাটা দেখতে অনেক চমৎকার!
ফুলি ওরা সবাই দল বেধে দৌড়ে গেলো বাগানের ভিতর। আমি মানা করতেই কেউ বলে উঠলো,
“ভূতনি মানা করো না।
উপরে তাকিয়ে দেখি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন আহিয়ান। তার সাথে আকাশ ভাইয়া উনারা সবাই। আমি আর তাদের না ডেকে হাটা ধরলাম বাড়ির ভিতর!
“তুমি এখানে!
“হুম আসতে মন চাইলো তাই, এই নিন!
“কি এগুলো?
“নাড়ু আর মোয়া!
উনি কিছু না বলেই আমার হাত থেকে ডিব্বা গুলো নিলেন। এর মাঝেই আকাশ ভাইয়া তার থেকে একটা ডিব্বা নিতে গেলে তিনি একটু দূরে সরে বলেন,
“মোয়ার ডিব্বা টা চাইলে নিতে পারিস তবে নাড়ু’র টা না।
ওদের এমন কান্ড দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কখনো ভাবিনি উনি এতোটা খুশি হবেন এগুলো আনায়। আকাশ ভাইয়া মুখ ভেংচি কেটে বলে,
“আচ্ছা এটাই দে!
অতঃপর আহিয়ান খুব সতর্ক ভাবে মোয়া ডিব্বা টা দিয়ে দিলো। আর নাড়ুর ডিব্বা টা নিজে নিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ তার থেকে সেটা ছিনিয়ে নিবে।
আকাশ ভাইয়া একটা মোয়া নেবার পর নাহান ভাইয়া আর আনাফ ভাইয়া দুজনেই মোয়া নিয়ে কামড় বসিয়ে দিল। আহিয়ান তার কোলের মাঝে নাড়ুর ডিব্বা টা নিয়ে
একটা মুখে দিল। সবার এমন কান্ড দেখে বেশ হাসি পাচ্ছিল আমার। আকাশ ভাইয়া বলেন,
“বলতে হবে নিহা তোমার মায়ের হাতে বানানোর মোয়া খেতে দারুন।
“আমি জানি। তা আপনাদের মিলাদ হবে কবে?
“কয়েকদিন পর হবে।
“ওহ আচ্ছা!
“হুম। তা নিহা তোমাদের গ্রাম টা সেভাবে ঘুরা হলো না আমাদের।
“কেন চাচা কে বললেই তো তিনি ঘুরিয়ে দিতেন।
নাহান ভাইয়া বলেন,
“তা তো জানি কিন্তু এতিম খানায় মিলাদ হবে সেই নিয়েই তিনি খাটছেন।
“আচ্ছা চলুন তাহলে আপনাদের ঘুড়িয়ে নিয়ে আসি আমি।
“কোথায় যাবে।
“এখানেই একটা নদী আছে। নৌকায় চড়বেন!
আনাফ ভাইয়া বলেন,
“আইডিয়া টা মন্দ না যাওয়া যায়। এমনে তেও এখন তেমন কোন কাজ নেই। কি বলিস আহিয়ান।
আহিয়ান আবারো একটা নাড়ু মুখে দিয়ে বলে,
“তৈরি হয়ে আসছি আমি!
বলেই সে চলে গেল। অতঃপর তারা সবাই একে একে চলে গেলো তৈরি হবার জন্য। ছেলেরা তৈরি হতে এতো সময় লাগে আহিয়ান না থাকলে হয়তো আমি জানতাম না। আকাশ ভাইয়া তারা সবাই এসে হাজির কিন্তু উনি এখনো আসে নি। আকাশ ভাইয়া একবার গিয়ে ডেকেও এসেছে বলেছে আসছে ৫ মিনিট পর। হায়রে কি কান্ড! কি এতো সাজগোজ করছে তিনি।
ফুলি আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
“কি গো আপু! এতো সময় লাগে নাকি ওই মালিকের তৈরি হইতে।
“কি করে বলবো আপু।
নদী বলে উঠে,
“ছেলে মানুষের এতো কিসের সাজ!
আকাশ ভাইয়া হেসে বলেন,
“বুঝলে তো আপু মনি এটা আহিয়ান চৌধুরী! তাই আজ এই অবস্থা!
“কি অবস্থা!
আওয়াজ টা আসলো ওপাশ থেকে। আমরা সবাই ওদিক তাকালাম। দেখি উনি শার্টের হাতা ফোল্ট করতে করতে আসছে। মিলি তাকে দেখে চট করে বলে দেয়,
“আপনে আইছেন তাহলে! আমরা তো ভাবছি আর আইবেন না আপনে!
“কেন?
“এতোক্ষণ যে দাড়া করাইয়া রাখলেন কি আর কমু
“চেয়ার তো এখানেই ছিল। ভূতনির মতো সেখানেই বসে থাকতে।
আমি রেগে বলে উঠি,
“আপনাদের বক বক শেষ হলে চলুন তো। এভাবেই অনেক দেরি হয়ে গেছে! যেতে কতোক্ষণ লাগবে যানেন।
“গাড়ি দিয়ে যাবো!
“গাড়ি দিয়ে?
“কেন যাওয়া যাবে না।
“হ্যাঁ যাবে তবে পুরো পথ না।
“ঠিক আছে যতটুকু যাওয়া যায়। চলো এবার!
অতঃপর আমরা সবাই বের হলাম। গাড়ি তে উঠার আগেই চাচা এলেনা। চাচা অবশ্য আমাদের সাথে গেলেন না। কিছু কথা বলল শুধু আহিয়ানের সাথে। অতঃপর আবারো চলে গেলো।
আমরা সবাই গাড়িতে উঠলাম। ফুলি ওরা সবাই গাড়িতে উঠে বেশ হইচই শুরু করে দিল। তাদের হইচই আরো বাড়িয়ে দিল আহিয়ান। কি সব গান ছাড়লো আর তার সাথে ওরাও শুরু হয়ে গেল।
অতঃপর গাড়ি থামলে আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর নদীর কাছে চলে এলাম। আহিয়ান একটা বড় নৌকা ভাড়া করলেন, তাতেই আমরা সবাই চড়লাম। সূর্য অস্ত যাওয়া অবদি আমরা সবাই নৌকাতে ছিলাম। অতঃপর সন্ধ্যা নামার পর পর’ই সবাই নৌকা থেকে নামলাম।
নৌকা থেকে নামার পর আকাশ ভাইয়া সবাই কে আইসক্রিম কিনে দিল। আমার পিচ্চি বাহিনী আইসক্রিম পেয়ে লাফাতে লাগলো। আহিয়ান তারা সবাই ওদের কান্ড দেখে হাসতে লাগলো। নাহান আর আনাফ ভাইয়া তাদের কিছু চকলেট ও কিনে দিলেন।
গাড়ি কাছে আসতেই থমকে গেলাম সবাই। কিছুলোক গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। এসব দেখেই আহিয়ান ওরা বেশ বিরক্ত। আমি একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখি এগুলো এই গ্রামের’ই লোক। আহিয়ান আগাতে গেলে আকাশ ভাইয়া তাকে থামিয়ে দেয়। অতঃপর তিনি আর নাহান ভাইয়া যায় কথা বলতে। তারা কিছুক্ষণ কথা বলার পর’ই তারা সরে যায়। অতঃপর আমরা যাই গাড়িতে উঠতে। আহিয়ান গাড়ির দরজা খুলে আমাকে বলে ভিতরে ঢুকতে। আশেপাশের ছেলে গুলো খুব বাজে বাজে কথা বলছিলো তখন। আমি ফুলি ওদের সবাইকে গাড়িতে উঠিয়ে নিজে উঠতে নিলাম তখন ওই ছেলেগুলোর মধ্যে একজন বলে উঠল,
“আরে এই তো দেখছি নিহা!
অপরজন বলে,
“কোন নিহা!
“আরে ওই যে খালেদের সাথে বিয়ে হবার কথা ছিল সে।
“আরে ওই যে বিয়ে ছেড়ে পালিয়ে গেছিল সে।
“হ্যাঁ , সে তো দেখছিস কাকে ধরেছে।
“মনে হচ্ছে এই জন্য’ই খালেদ কে ছেড়ে দিয়েছে।
“আরে নিজের ভালো পাগল ও বুঝেছিস। মালটা তো আর খারাপ না ভালাই তো দেখছি। বেশ মালদার পার্টি।
“নাহিয়ান চৌধুরী’র নাতি! বুঝলি তো!
“হুমম তাইলে অনেক আগে থেকেই সবকিছু ফিটফাট ছিল মনে হচ্ছে!
“হ্যাঁ সেদিন যে নিহা পালালো সেদিন তো এরাও চলে গেছিল জানিস!
“হ্যাঁ হ্যাঁ এখন সব সহজ পুরোই পানির মতো।
বলেই সবাই হাসতে লাগলো। আমার বেশ রাগ হচ্ছিল। আহিয়ান’র ও যে রাগ লাগছিল তা না। তবুও আমরা কিছু না বলে চুপচাপ গাড়ি নিয়ে এসে পড়লাম। আমি মন ঠিক করার জন্য বাইরে তাকালাম। সারাদিক শুধুই অন্ধকার,ঝিঁঝিঁ পোকাদের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই আমি যেন খালেদ কে দেখলাম বলে মনে হলো। আমার পুরো শরীর জমে গেল। ভয় পেতে লাগালাম আবারো!
#চলবে….