#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৩
বাড়িতে আজ ভাইয়া আর ভাবী দুজনেই এসেছে। কি মতলব নিয়ে এসেছে বুঝতে পারছি না। আসার পর’ই অনেক খাতির করছে। এই কাঁদছে এই ক্ষমা চাইছে। তবে কারনটা কি এটাই বুঝতে পারছি না। সে কি সত্যি’ই বদলে গেলো নাকি। তবে তার এই পরিবর্তন আর যাই হোক আমার হজম হচ্ছে না। ভাইয়া ও একসময় এসে আমার কাছে ক্ষমা চাইলো। এটাতে আমি হতবাক এর মতো তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।
কোন মা – বাবা পারে না তার সন্তানের প্রতি রাগ করে থাকতে। এখানেও তার ব্যতীক্রম হলো না। মা আর বাবা সহজেই ভাইয়া আর ভাবী কে ক্ষমা করে দিলো। এই নিয়ে আমার কিছু বলার ছিল না। ভাবী এসে আমাকে বলল,
“নিহা বইন ক্ষমা কইরা দে আমাদের।
আমি হাসি মুখে বলি,
“যেখানে মা আর বাবা ক্ষমা করে দিয়েছে সেখানে আমি আর কি করতে পারি বলো।
“এভাবে কইস না মন। আমরা আমার ভুল গুলা বুঝতে পারছি। এখন কি তুই আমাগোরে ক্ষমা করবি না। দেখ তোর ভাইয়া আইয়া তোর কাছে ক্ষমা চাইতাছে।
“এটাই তো আমার কাছে অন্যরকম লাগছে ভাবী। নাহলে দুদিন আগেও এসে সে আমাকে কথা শুনিয়ে গেছে
“দেখ ভুল তো মানুষ’ই করে। তোর বড় ভাই ভুল বুঝতে পারছে। তোর কাছে আইয়া ক্ষমাও চাইছে। মাফ করবি না তুই।
আমি মাথা নিচু করে রইলাম। কি যে বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না। এই সময়’ই চাচা এলেন। তিনি মোটেও ভাইয়া আর ভাবী কে দেখে খুশি না, এটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এদিকে ভাইয়া আর ভাবী তার সাথেও কুশল বিনিময় করছে। ভাইয়া চাচা কে জিজ্ঞেস করছে,
“ভালো আছেন তো চাচা, আপনার শরীর টা কেমন এখন।
চাচা শুকনো মুখে বলেন,
“ভালো। ( অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে ) চারটে ভাত দে তো মা!
“দিচ্ছি চাচা তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো।
অতঃপর চাচা চলে গেল হাত মুখ ধুতে। আমি ঘরে এসে ভাত বাড়ছি। বাইরে উঠোনে বসে ভাইয়া, ভাবী মা আর বাবা কে গল্প করছে। চাচা এসে সামনে বসলে আমি ভাতের থালা টা এগিয়ে দেই। চাচা আমার হাত থেকে ভাতের থালা টা নিয়ে বলে,
“ওরা এখানে ক্যান আইছে!
“জানি না চাচা।
“ওগো মতলব ভালো লাগতাছে না আমার কাছে। ওগোরে যাইতে গা ক!
“কিভাবে বলমু চাচা! দেখতাছো না মা আর বাবা কিভাবে কথা বলছে। কতো খুশি তারা।
“শোন ওরা এমনে এমনে আহে নাই। কিছু না করবো দেখেই আইছে। তুই ওগো কথা একদম শুনবি না বুঝলি।
“আচ্ছা চাচা। তোমাকে একটু ডাল দেই।
“দে! হুন কালকে ওগো মিলাদ, অনেক কাজ
“তুমি কি সারাদিন সেখানে থাকবে।
“হ! সব দেখাশোনা আমারেই করতে হইবো।
“আমিও কি যাবো তোমার সাথে।
“যাবি! আইচ্ছা যাইস।
“হুম।
“তোরে আমি আবারো কইতাছি ওগো কথা কিন্তু হুনবি না। ওরা কিছু করবো দেইখা আইছে
এর মাঝেই ভাবী’র আওয়াজ পেলাম। তাকিয়ে দেখি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবী বলেন,
“কে কিছু করবো চাচা।
চাচা খাবার মুখে দিয়ে বলে,
“তোরা ছাড়া আর কারা। তগো মতলব কি আমি বুঝি না ভাবছোস
“ছিঃ চাচা এসব বইলেন না।
“ক্যান কমু না। দেখ আমার ভাইয়া ভাবী তগো মা বাপ দেইখা তারা সব ভুইলা গেছে। কিন্তু আমি কিছু ভুলি নাই। সব মনে আছে আমার। তোরা কি কি করছোস সব মনে রাখছি আমি।
“চাচা এই জন্যই তো ক্ষমা চাইতে আইছি।
“আইছোস ভালো কথা,রাতে এই খানে খাইয়া দাইয়া যাইস। কোন মতলব কইরা আইলে কিন্তু কোন লাভ হইবো না।
“চাচা গো এই বারের মতো মাফ কইরা দেন। আমরা বুঝতে পারেই আমরা কি ভুল করছি। মা বাপ যে আল্লাহর রহমত আমরা এখন এটা বুঝতে পারছি চাচা।
বলতে বলতে আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন ভাবী। কিন্তু এতে আমার এতো টুকু মায়াও লাগলো না। কেন লাগলো না জানি না। তাদের প্রতি মায়া জিনিসটা আমার আসে না। এর কারন কি হতে পারে? তাদের সেই অমানবিক আচরণ হ্যাঁ এটাই তার একমাত্র কারন।
.
রাতে ভাইয়া আর ভাবী খেলো না। তার আগেই সন্ধ্যার সময় তারা চলে গেলো। তবে যাবার আগে মা আর বাবা কে নিয়ে গেছে। নিজের সাথেই রাখতে চেয়েছিল কিন্তু চাচা তাদের কাছে থাকতে দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। তাই বলেছে কয়েকদিন বেড়িয়ে আসুক। আমাকেও নিতে চেয়েছিল কিন্তু চাচা আমাকে কোনমতে যেতে দেন নি। তার সাথেই রেখে দিয়েছে।
রাতে আমি খাবার গরম করে বসে আছি। চাচা একটু আগেই বাইরে গেছে। পুরো বাড়িতে আমি একা। দুটো গরু ছাড়া আর কেউ নেই সাথে। চাচা যাবার আগে বাইরে থেকে দরজা তালা মেরে গেছেন। একা আমাকে রেখে যেতে বেশ ভয় পাচ্ছেন তিনি। এর মাঝেই দরজায় ঠুক ঠুক শব্দ এলো। আমি উঠোনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বলি,
“কে কে?
কোন শব্দ এলো না। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার! ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঝোপঝাড় থেকেও আওয়াজ আসছে। আমি হাতে একটা হারিকেন নিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু এখন আর কোন শব্দ হলো না। তাহলে কি আমি ভুল শোনলাম।
হারিকেন নিয়ে আবারো ঘরে যেতেই কেউ আবারো কড়া নাড়লো দরজায়। হ্যাঁ সত্যি কেউ কড়া নেড়েছে। আমি স্পষ্ট শুনেছি। আমি আবারো জিজ্ঞেস করি,
“কে, কে এসেছে? দরজায় কড়া কে নাড়ছে। কে এসেছে?
ওপাশ থেকে এবারো আওয়াজ আসলো না। সবকিছু নিশ্চুপ। আমি এবার হাঁটতে হাঁটতে দরজার কাছে গেলাম। গোয়াল ঘর থেকে গরু গুলো ডাকছে। তাদের খাবার দিয়ে দিয়েছি অনেক আগে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করছি আসলেই কি বাইরে কেউ আছে কি না। ভূত প্রেতে আমার কোন বিশ্বাস নেই। হয়তো কোন বাচ্চা এমনটা করছে নাহলে বাতাসের কারনে এমন শব্দ হচ্ছে। আবারো শব্দ এলো। আমি এবার দরজার কাছেই দাঁড়ানো ছিলাম। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম,
“কে?
ওপাশ থেকে কেউ ধীরে বলল,
“আমি!
গলার স্বর পাওয়া মাত্র আবার দু পা পিছিয়ে গেলাম। এটা তো খালেদের গলার স্বর। তাহলে কি ও জেনে গেছে আমি এখানে একা। এজন্য এসেছে আমার কাছে! আমার পুরো শরীর কাঁপছে। গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না। ভয় পাচ্ছি আমি, খুব ভয়।
কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়া দৌড়ে ঘরে চলে গেলাম আমি। দরজা শক্ত করে বন্ধ করে বসে রইলাম চুপটি করে। ঘরের সব জানালা বন্ধ! ঘরে একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আর বাড়িতে আসার একমাত্র রাস্তা শুধু সদর দরজা। এছাড়াও কোন বিকল্প নেই। আর দরজা যখন বন্ধ তাহলে কেউই আসতে পারবে না। তবুও কেন জানি আমার মনে হচ্ছে সে এসে পড়বে। এক্ষুনি এসে পড়বে। এসেই আমার সাথে..
আর ভাবতে পারছি না আমি। ভয় বাড়ছে আমার। দরজা তালা বন্ধ তো কি? যদি সে তালা ভেঙে চলে আসে তখন! আমি ঘরের দরজা ভালো মতো বন্ধ করে নিলাম। এর মাঝেই জানালার দিক থেকে আওয়াজ আসছে। কে জানি জানালা টোকা দিচ্ছে। আমি হাত পা গুটিয়ে বসে রইলাম। এরপর ঢিল ছোড়া শুরু হলো। ঘরের চালে ঢিল মারছে কেউ। আমি কানে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম।
হঠাৎ যেন মনে হলো সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল। সব কিছু নিস্তব্ধ! এখন আর কোন শব্দ নেই। আমি কান থেকে হাত সরিয়ে নিলাম। ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগলাম। হঠাৎ করেই আবারো শব্দ হলো। এবার খুব জোরে শব্দ হলো। কেউ সদর দরজা খুলছে। তাহলে কি সে দরজার তালা ভেঙে দিল। আমি লাফিয়ে উঠলাম। কেউ জোরে জোরে ডাকছে,
“নিহা মা! নিহা মা!
এটা চাচা’র আওয়াজ, তবুও সাহস হচ্ছে না আমার। আমি এখনো ভয়ে চুপচাপ বসে আছি। হঠাৎ আরেকটা আওয়াজ এলো আমার কানে। এটা ছিল ফুলির গলায় স্বর। সে জোরে জোরে আপু বলে ডাকছে। এবার আমি নিশ্চিত হলাম চাচা’ই এসেছে। আমি আর না দাঁড়িয়ে দ্রুত দরজা খুললাম! তাকিয়ে দেখি আসলেই চাচা এসেছে। তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ফুলি। আমাকে দেখেই সে দৌড়ে ছুটে এলো। বলল,
“আপু আইজ আমি তোমার লগে ঘুমামো। চাচা তাই আমারে নিয়া আইছে।
আমি কিছু না বলে ওর মাথায় হাত রাখলাম। চাচা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিরে মা কি হইছে তোর?
“কিছু না চাচা।
“দেইখা মন হইতাছে ভয় পাইছোস?
কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,
“দরজা কেউ বার বার ধাক্কা দিচ্ছিল তাই।
“ওহ ওইটা! ওইটা একটা কুত্তা আছিলো। আমি দেখছি দরজার সামনে ঘুরতাছিল। আমি তাড়াইয়া দিছি। তুই আর ভয় পাইস না।
“আচ্ছা চাচা! তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো আমি খাবার বাড়ি।
“হ বাড় অনেক ক্ষুধা লাগছে। আয়রে মা ফুলি তুই ও হাত মুখ ধুইয়া ল।
“আইচ্ছা!
বলেই ফুলি দৌড়ে চলে গেল। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কেন জানি মনে হচ্ছে এসব মোটেও আমার কল্পনা না। আমি যা শুনেছি একদম ঠিক শুনেছি। সে এসেছিল। খালেদ সত্যি এখানে এসেছিল। হয়ত চাচা কে দেখে চলে গেছে। আর তখন কুকুর টা এসেছে। এটাই হবে। কিন্তু কেন এসেছিল সে। কেন এভাবে ভয় দেখাচ্ছে বার বার আমাকে!
চাচা আর ফুলি কে ভাত বেড়ে দিয়ে ভাতের থালা নিয়ে বসে আছি। কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। গলা দিয়ে খাবার নামছে না। চাচা আমাকে এইভাবে দেখে বলে,
“কি রে মা খাবার খাচ্ছিস না কেন?
“খেতে ইচ্ছে করছে না চাচা।
“এটা কোন কথা, কি হইছে। দেখি জ্বর টর আবার আইলো নাকি।
“না চাচা তেমন কিছু না।
“তাইলে খাইয়া ল মা। খাইয়া তাড়াতাড়ি ঘুমাইয়া পড়িস। কাল অনেক সক্কাল সক্কাল উঠতে হইবো। অনেক কাজ। আর এতিমখানা তো আর এখানে না যাইতেও অনেক সময় লাগবো।
ফুলি খেতে খেতে বলে উঠে,
“চাচা আমিও যামু!
“আইচ্ছা যাইস। এখন তাইলে খাইয়া তাড়াতাড়ি ঘুমাইয়া পড়!
অতঃপর ইচ্ছে না করলেই অল্প করে খেয়ে নিলাম আমি। চাচা’র বিছানা ঠিক করে দিয়ে মশারি টাঙিয়ে দিলাম। তিনি নাক টেনে ঘুমাচ্ছে। অন্য ঘরে আমি আর ফুলি। ফুলি শুয়ে শুয়ে আমার সাথে কথা বলছে। সে বলছে,
“আচ্ছা আপু কদিন আগে কি একটা হলো না।
“কি আবার হলো!
“ওই যে কি ইয়ার টিয়ার নাকি
“তুই কি হ্যাপি নিউ ইয়ারের কথা বলছিস!
“হ্যাঁ এটাই ইংরেজি নতুন বছর তো শুরু হয়ে গেছে নাহ।
“হুম।
“তুমি তো তাহলে চলে যাবে
“হ্যাঁ যেতে তো হবে, আমার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, তারপর টিউশনি
“দেখবা একদিন আমিও তোমার মতো শহরে গিইয়া পড়ালেখা করমু।
“হ্যাঁ করবি তো কিন্তু তার আগে যে এখানে ভালোমতো পড়তে হবে। এখানে ভালো মতো না পড়লে যে শহরে গিয়ে পড়তে পারবি না।
“হ্যাঁ আমি পড়তাছি তো। আচ্ছা ওই ইয়ারের দিন শহরে নাকি অনেক অনুষ্ঠান হয়।
“হ্যাঁ অনেকে করে।
“আমিও করমু একদিন
“আচ্ছা করিস এখন ঘুমা নাহলে সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে পারবি না।
“আইচ্ছা!
বলেই ফুলি কাঁথা মুড়ো দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আমার কোন ঘুম আসলো না। আমি সারারাত বসে বসে কাটিয়ে দিলাম। দু চোখের পাতা আর এক হলো না আমার। ভাবছি আর কয়েকদিন থেকেই ফিরে যাবো গ্রামে। নতুন বছর ও শুরু হয়ে গেছে। এখন না গেলে টিউশনি চলে যাবে হাত থেকে।
#চলবে….