#উজান_যমুনা
#পর্বঃ১০
#লেখনীতেঃসুৃমাইয়া_আফরিন_ঐশী
দিন পেরিয়ে রাত নামলো প্রকৃতির বুকে। বিষন্ন মনটা নিয়ে এলোমেলো পায়ে বাসায় প্রবেশ করলো উজান চৌধুরী। বসার ঘরে সোফায় বসে ছিলেন লায়লা চৌধুরী। দরজায় উনি ছেলেকে দেখেই উচ্ছাসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“উজান জানিস, যমুনার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামীকালই বিয়ে। তোর ফুপি কল করে জানিয়েছে দুপুরে।”
মায়ের কথা শুনে রাগে কাঁপছে উজান চৌধুরী। সামনে থাকা দরজায় এক লা’থি মেরে, সশব্দে নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। হঠাৎ ছেলের এহেন আচরণে ঘাবড়ে গেলো লায়লা চৌধুরী। কি হলো তার ছেলেটার? উনি ততক্ষণাৎ বন্ধ দরজায় হাত দিয়ে আঘাত করে ডাকলেন ছেলেকে,
“আব্বা দরজা খোল, কি হয়েছে তোর? এতো রেগে আছিস কেন? কি হয়েছে আম্মুকে বল। দরজ খোল উজান। ”
ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স আসলো না। লায়লা চৌধুরী আর ছেলেকে ডাকলো না। উনি জানে,এখন শত ডেকেও লাভ হবে না। তাই উনি ছেলেকে সময় দিলো।
অফিসে থাকা ফর্মাল ড্রেসেই ফ্লোরে হাত-পা ছড়িয়ে একটার পর একটা সিগারেট টানছে উজান চৌধুরী। ছেলেটাকে বড্ড এলোমেলো লাগছে। চোখ দু’টো তার লাল হয়ে আছে, পরিপাটি চুল গুলো আজ এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কপালে। ফ্লোরে ঠান্ডায় শরীর জমে আসছে তার। তবুও সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তার। তার কানে এলার্মের শব্দের ন্যায় বাজছে প্রেয়সীর বলা লাস্ট কথা,
“তুমি কখনো আমার সামনে এসো না উজান। তোমাকে আমি কখনো ক্ষমা করতে পারবো না, তোমার মুখটাও আমি দেখতে চাই না।”
লাস্ট সিগারেটায় লম্বা টান দিয়ে, অর্ধ খাওয়া সিগারেটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো ছেলেটা। পরমুহূর্তে পকেট থেকে মোবাইল বের করে যমুনার একটি ছবির দিকে তাকিয়ে দেখছে তার অতী শখের নারী’কে।
তার চোখ ঘোলাটে হয়ে আসছে, এই বুঝি গড়িয়ে পড়বে জল। তান্মধ্যে প্রেয়সীর ছবি খানায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলে উঠলো উজান,
“তোমারে ছাড়া আমার যাবার জায়গা নাই,তোমারে ছাইড়া আমি কই যাবো উপমা!
আমার দুই চোখের জলে তুমি আছো,তুমি আছো আমার মিথ্যে হাসিতে,আমার মন খারাপের একলা সময়ে তুমি আছো, আছো আমার ভিতর বাহির সবখানেই, তোমারে কি ভুইলা থাকা যায়?
তুমি দুঃখ দিলেও, আমি তা তুমি মনে করে জড়াইয়া ধইরা বাঁচি। তোমারে ছাড়া আমার ভাবনা নাই,
কোনো স্বপ্ন নাই – কোনো আশা নাই।
তোমারে ছাড়া আমি এক মুহূর্ত না পারি থাকতে,
না পারি ভাবতে। সেই তুমি কেমনে অন্য মানুষের হইবা?
তোমারে ছাড়া আমার সত্যিই যাবার জায়গা নাই,
এই যে তুমি আমারে দুঃখের সাগরে ডোবাও
আমি ডুবে ডুবে তবু তোমার মাঝেই বেঁচে যাই। তোমাকে ছাড়া আমার একলা বাঁচা সম্ভব নয়!আমি যে তোমায় বড্ড ভালোবাসি উপমা! আমাকে কেন এতো কঠিন শাস্তি দিলে তুমি? ভালোবাসার বিপরীতে মৃ’ত্যু দ’ন্ড দিলেও বোধহয় এর থেকে সহজ হতো। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না উপমা, ফিরে এসো তুমি। একটিবার আমার হয়ে যাও।”
বলতে বলতে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে ছেলেটার চোখের কার্ণিশ বেয়ে। নিজেকে আজ কেমন অসহায় লাগছে! ভালোবাসার কাছে মানুষ এতো অসহায়!
ঘন্টা পেড়িয়ে গিয়েছে ছেলের কোনো সাড়াশব্দ নেই। থেমে থেমে আরো কয়েকবার ডেকেছে মা। কিন্তু নো রেসপন্স। এবার ভয় হচ্ছ মায়ের। উনি রুমের এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করতেই কেঁপে উঠলো তার বক্ষ। এই এলোমেলো ছেলেকে কখনো দেখেনি মা। উনি দৌড়ে ফ্লোরে বসে থাকা ছেলের পাশে বসে কেঁদে দিলেন। ছেলের গায়ে হাত দিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধালো,
“তোর কি হয়েছে বাপ? তোর এই অবস্থা কেনো?”
মা’কে দেখে চোখ তুলে তাকালো উজান। কত অসহায় এই চোখের চাহুনি! পরমুহূর্তে মায়ের কোলো আলগোছে মাথা রেখে সুয়ে পড়লো উজান। মায়ের হাত ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বারবার কারণ জানতে চাইলো। উজান কিয়াৎ ক্ষণ সময় নিয়ে মায়ের হাত ধরে অবুঝ শিশুর মতো কান্নারত কণ্ঠে আবদার করে বললো,
“আম্মু আমার যমুনাকে আমার করে এনে দেও আম্মু। আমি যমুনাকে ভালোবাসি! তার পাশে অন্য পুরুষ আমি সহ্য করতে পারবো না আম্মু। তুমি কিছু একটা করো আম্মু। তাকে ছাড়া আমার নিজেকে অসহায় লাগছে আম্মু! দেখো আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
যমুনা…. যমুনা নামটা শুনেই আতঙ্কে উঠলো মা। পরক্ষণে উনি অবাক হয়ে বললেন,
“যমুনা কোন যমুনার কথা বলছিস তুই?”
“ফুপির মেয়ে।”
“হোয়াট? এটা কি করে সম্ভব উজান?”
“আম্মু তুমি চাইলে সব সম্ভব। আমি তাকে ভালোবাসি আম্মু। তোমাকে একদিন বলছিলাম না,আমি একজনকে ভালোবাসি। এটাই হলো সেই মেয়ে। তোমার কাছে একটা আবদার আমার পাওনা রয়ে ছিলো না আম্মু?
তুমি বলছিলে না আম্মু, আমার চাওয়া আবদার তুমি পূরণ করবে। আমার যমুনা’কে আমার বউ করে এনে দেও আম্মু! তাকে ছাড়া তোমার ছেলে বাঁচতে পারবে না। এই জীবনে তোমার কাছে আর কিছু চাওয়ার থাকবে না আম্মু।”
ছেলের কথা শুনে থমকে গেলেন লায়লা চৌধুরী। হ্যা, যমুনা ভালো মেয়ে! তাই বলে, একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে মোটেই মানতে পারছে না উনি।
কেননা, সব বাবা-মা’ই চায় তার ছেলে অথবা মেয়ে তার সমান-সমান জীবন সঙ্গী পাক বা তার চেয়েও উঁচুতে থাকুক।
সেখানে যমুনা একটা ডিভোর্সী মেয়ে, বয়সেও সিনিয়র। সমাজের মানুষ কি বলবে, তাদের সম্মান থাকবে?
লায়লা চৌধুরী সরাসরি বলে দিলেন,
“এ সম্ভব নয়। এই রকম আবদার পূরণ করা যায় না উজান।”
উজান মায়ের কোল থেকে মাথা সরিয়ে উঠে বসলো। পরমুহূর্তে চিৎকার দিয়ে বললো,
“কেনো সম্ভব নয় আম্মু? যমুনা ডিভোর্সী, বয়স বেশি বলে? এতে তো আমার সমস্যা নেই, আমি তাকে নিয়েই ভালো থাকবো। তুমি কি চাও না আম্মু তোমার ছেলে ভালো থাকুক?”
ছেলেকে উওেজিত হতে দেখে মা আশ্বাস দিয়ে বললেন,
“শান্ত হও উজান। দেখছি কি করা যায়। ”
উজান ভরসা পেলো। লায়লা চৌধুরী ছেলেকে ফ্লোর থেকে ধরে উঠিয়ে, বিছানায় বসিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মা সম্মতি জানালেও বেঁকে বসলেন জুনায়েদ চৌধুরী। উনি মাএই বাহির থেকে এসেছেন। কাসেম তালুকদারের সাথে ভাগিনী’র বিয়ে’র জন্য ভরপুর কেনাকাটা করেছেন আজ। বাসায় আসতেই স্ত্রী’র মুখ থেকে অনর্থক মূলক আবদার শুনে মেজাজ বিগড়ে গেলো তার।
উনি রাগান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,
” এই কথা এখানেই ক্লোজ করো লায়লা। আমাদের মানসম্মানের একটা ব্যপার আছে তো না-কি?
এটা কি আদৌও সম্ভব? তাছাড়া,মেয়েটার আগামীকালই বিয়ে। ইতোমধ্যে, বাড়িতে সব কিছুর তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। এই সময় এমন আবদার নিয়ে আমি বোনের কাছে যেতে পারবো না। তুমি তোমার ছেলেকে বুঝাও লায়লা। সব থেকে বড় কথা, আমি চাইছি না যমুনাকে আমার একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে। ছেলেকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। তোমরা মা-ছেলে এসব পাগলী বন্ধ করো।”
কথা শেষ করে নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় সুয়ে পড়লো জুনায়েদ চৌধুরী। হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মা।
উজান চৌধুরী দরজার আড়াল থেকে বাবা-মায়ের কথা শুনে চোয়াল শক্ত করে ফেললেন। না কাউকে ভরসা করা যাবে না! উজান চৌধুরী হার মানার পাএ নয়। পরমুহূর্তে কিছু একটা ভেবে, ফোন হাতে নিয়ে উজান চৌধুরী কল দিলো কাউকে।
________
রাত পোহালেই বিয়ে অথচ হঠাৎ করেই কনে গায়েব। বিয়ে বাড়ির তোড়জোড় থমকে গেলো। চারপাশে থমথমে অবস্থা। ইতোমধ্যে বিয়ে বাড়ি ছড়িয়ে পড়ছে, চাপা গুঞ্জন। ঘন্টা খানিক হলো যমুনাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। রাতে দরকারী কাজে মেয়ের রুমে এসে মেয়েকে না দেখতে পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়লো তাহেরা খানম। হয়তো ওয়াশরুম বা আশেপাশে আছে ভেবে, অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি। কিন্তু ঘন্টা খানিক সময় হয়ে গেলো, আশেপাশে কোথাও যমুনা নেই। ঘড়ির কাঁটায় এখন রাত দু’টো ছুঁই ছুঁই। এবার ব্যপারটা আর চাপা রইলো না। বিয়ে বাড়ির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়লো।
প্রতিবেশীরা কানাকানি করছে, হয়তো মেয়ে কোনো ছেলের সাথে পালিয়েছে।
কিন্তু, মায়ের আত্মবিশ্বাস তার মেয়ে এমন কাজ কক্ষণো করতে পারে না। তবুও ভিতরে ভিতরে গুমরে ম’র’ছে তাহেরা খানম। তার মেয়ের কোনো বিপদ হলো না তো? মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন মা। তারই পাশে দাঁড়িয়ে আছে জলি ও কাসেম তালুকদার। এই দু’টো মানুষের মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। তাদের মনে কিছু একটা চলছে।
চলবে……
(আমার লেখা গল্পের মধ্যে সবচেয়ে রেসপন্সহীন গল্প হচ্ছে এটা। হাতে গোনা গুটি কয়েক পাঠক। তবুও এদের জন্যই লিখছি আমি। আপনারা যারা পড়ছেন সবাই দয়া করে পেজে লাইক কমেন্ট করবেন। কেমন লাগছে গল্প?)