#উজান_যমুনা
#পর্বঃ৮+৯
লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী
কেটে গিয়েছে আরো একটি মাস। উজান চৌধুরী’র কর্ম জীবনের প্রথম স্যালারি পেয়েছে আজ। প্রথম ইনকামের টাকা পেয়েই মার্কেটে চলে গেলো ছেলেটা। ভরপুর কেনাকাটা করেছে সবার জন্য। কেনাকাটা শেষ হতেই বাসায় এসে মা-বাবা’র হাতে তুলে দিলো নতুন পোশাক ও বাকি টাকা যতটুকু ছিলো। ছেলের প্রথম সফলতা দেখে, খুশিতে মায়ের চোখে অশ্রুকণারা ভীর জমেছে। জুনায়েদ চৌধুরীও ভীষণ খুশী। উজান ব্যাগ থেকে মায়ের জন্য আনা বরাদ্দ শাড়ীটা বের করে মায়ের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে উচ্ছাসিত কণ্ঠে শুধালো,
“মাশাআল্লাহ! শাড়ীটা তোমার গায়ে অনেক মানিয়েছে আম্মু। তোমার পছন্দ হয়েছে?”
মা ছেলের কপালে ঠোঁটের পরশ একেঁ দিয়ে ভেজা কণ্ঠে বললো,
“ভীষণ পছন্দ হয়েছে আব্বা। আমার লাইফের সব চেয়ে দামী শাড়ী হয়ে থাকবে এটা।”
জুনায়েদ চৌধুরী নিজের জন্য আনা পাঞ্জাবিটা কতক্ষণ নাড়াচাড়া করে দেখলো। দেখতে দেখতে তার ছেলেটাও বড় হয়ে গিয়েছে। বাবা যে কত খুশী আজ! কিন্তু বাবাদের সেই খুশী প্রকাশ পায় না, তারা প্রকাশ করতে পারে না। ততক্ষণাৎ বাবা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আর্শীবাদ করে দিলো,
“জীবনে অনেক বড় হও বাবা! প্রতি ধাপে ধাপে সফলতা আসুক তোমার।”
উজান বাবা-মায়ের সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ফুপির বাড়ির উদ্দেশ্য। তাদের সবার জন্যও কেনা-কাটা করেছে উজান।
.
.
অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে যমুনা। উজান চৌধুরী তাকে জ্বালিয়ে মা’র’ছে। দু’দিন ধরে ঘরকুনো হয়েছে যমুনা, পাঁ’জি ছেলেটার মুখোমুখি আর হবে না সে। তাই অফিস সহ বাহিরে যাওয়া একদম বন্ধ করে দিয়েছে। এরিমধ্যে হুট করে বসার ঘরে উজানের কণ্ঠ স্বর শুনতে পেয়ে কেঁপে উঠলো যমুনা। বিচ্ছু ছেলেটা এখানেও হাজির। টের পেয়ে ততক্ষণাৎ দরজা ভিতর থেকে আঁটকে দিলো সে। মা বার কয়েক ডেকেছে তাও লাভ হয়নি।
উজান প্রেয়সীকে এক নজর দেখার জন্য কতক্ষণ আশেপাশে ঘুরঘুর করেও লাভ হলো না। জলি টাও এখন বাসায় নেই, কলেজে গিয়েছে। তাহেরা খানম রান্না ঘরে এখন। সেই সুযোগে উজান যমুনার দরজায় টোকা মেরে চাপা কণ্ঠে শুধালো,
“দরজাটা একবার খুলুন উপমা। আপনাকে একটুখানি দেখেই চলে যাবো। ট্রাস্ট মি! একদম জ্বালাবো না।”
ওপাশ থেকে শুনেও শুনলো না যমুনা। বার কয়েক বলেও ওপাশ থেকে রেসপন্স আসলো না। উজান দরজা’র পানে তাকিয়ে পুনরায় আকুতিভরা এলোমেলো কণ্ঠে শুধালো,
“তোমাকে যখন দেখি, তার চেয়েও বেশি মিস করি যখন দেখি না।
চড়ুই পাখি জানে আমি কার প্রতিক্ষায় প্রহর গুনি।তুমি পাষাণী! তুমি অভিমানী! তুমি এলোকেশী! তবুও আমি জানি, তুমি আমায় অন্তরালে ভালোবাসো!
আমি নিরুপায়, নিমগ্ন! দিনশেষে তোমাতেই আসক্ত!
একবার দেখো তুমি চেয়ে,কেমন সন্ন্যাসীর মতো হাহাকার করে উঠে এই হৃদয়!
দেখা দেও,দেখা দেও আমার প্রেয়সী!”
কত মায়া!কত আকুতি ছিলো এই কণ্ঠে। যমুনার কলিজা কাঁপছে। এই প্রথম তাকে বোধহয় তুমি করে সম্মোধন করেছে উজান চৌধুরী। হঠাৎ করেই তার চোখ দু’টো কি ঝাপসা হয়ে গেলো! অকারণেই কেমন অশ্রু কণারা চোখে ভির জমেছে চোখের পাতায়! কিসের জন্য এই চোখের জল, জানে না যমুনা! তবে সে অনুভব করছে তার কষ্ট হচ্ছে, উজান চৌধুরী’র জন্য কেমন অচেতন মনটা পু’ড়’ছে। যমুনা ততক্ষণাৎ ধরা গলায় বললো,
“তুমি চলে যাও উজান।”
উজান ততক্ষণাৎ গেলো না। বারবার বারবার রিকোয়েস্ট করছে, সামনে আসতে বলছে। কিন্তু, যমুনা’র একগুঁয়ে স্বভাব অটল রইলো। এরিমধ্যে তাহেরা খানম ডাকলো উজানকে। ফুপির কণ্ঠ স্বর শুনে তড়িঘড়ি করে ওখান থেকে সরে গেলো উজান। পরমুহূর্তে ফুপুকে বলে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো ছেলেটা। যদিও তাহেরা খানম থাকার জন্য জোর-জবরদস্তি করেছিল অনেক। কিন্তু, থাকেনি উজান। কার জন্যই বা থাকবে? যাকে দেখার জন্য শত বাহানা খুঁজে মন, সেই মানুষটাই দিনশেষে অবহেলার চাদরে মুড়িয়ে দেয়।
.
.
উজান বাসা থেকে বের হতেই যমুনা জানালার কাছে গিয়ে আলগোছে সেদিকে উঁকি দিলো একবার। ছেলেটাকে একটু কি এলোমেলো লাগছে আজ? না এসব ভাবতে গিয়েও ততক্ষণাৎ মনকে শাসিয়ে নিলো যমুনা। চোখ সরিয়ে নিলো অবলীলায়।
এভাবে তো থাকা সম্ভব নয়। এসবের একটা সলিউশন দরকার! যমুনা কিছুক্ষণ কিছু একটা ভেবে চিন্তে উজানের নাম্বারে টেক্সট করে দিলো,
“আজকে বিকেল চারটায় আমার সাথে দেখা করবে উজান?তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা বলার ছিলো।”
উজান সাথে সাথে সম্মতি জানালো। এবং কোথায় দেখা করবে, লোকেশন জানতে চাইলো। যমুনা নিজের পছন্দ মতো একটা কফি শপের এড্রেস টেক্সট করে জানিও দিলো।
.
.
বিকেল চারটায় কফিশপে মুখোমুখি বসে আছে উজান যমুনা। উজান ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে প্রেয়সী’কে। তার তৃষ্ণার্ত চোখ জোড়া জুড়িয়ে যাচ্ছে এই মায়াবী মুখটা দেখে। উজানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে যমুনা একটুখানি নড়েচড়ে বসে স্বাভাবিক কণ্ঠে শুধালো,
“কি খাবে উজান? অর্ডার করো।”
উজান দু’টো কফির অর্ডার দিয়ে যমুনাকে জিজ্ঞেস করলো,
“তা এতো জরুরী তলব কেনো মহারাণী?”
যমুনা মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে নিজের ভিতরে কথা সাজিয়ে নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললো,
“আমি তোমাকে এখন কিছু কথা বলবো,তুমি মন দিয়ে শুনবে এবং বুঝার চেষ্টা করবে উজান।”
“জ্বি বলুন।”
“দেখো উজান, আমি মানি তুমি আমায় ভালোবাসো। কিন্তু একবার ভেবেছো, এই ভালোবাসা আদৌও পাওয়া সম্ভব কি-না? কক্ষণো সম্ভব নয়! যতো যাই হোক, দিনশেষে আমি একটা ডিভোর্সী মেয়ে। সমস্যা শুধু একটা নয়,আমি তোমার থেকে বয়সেও সিনিয়র। বয়স হয়েছে আমার, সমাজ বুড়ো উপাধী দিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া, তুমি তোমার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। সেই হিসেবে উনাদের তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন, আশা-ভরসা রয়েছে। এটা থাকাই স্বাভাবিক।
তোমার বাবা একজন এমপি। উনার সমাজে আলাদা একটা সম্মান রয়েছে। উনি নিশ্চয়ই চাইবে না একটা ডিভোর্সী মেয়ে, যে কিনা তার ছেলের থেকে বয়সে বড়, এমন একটা মেয়েকে নিজের একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে। আমরা মানুষ। সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয় আমাদের। সমাজ বলতে তো কিছু একটা আছে! এই সমাজ ডিভোর্সী মেয়েকে এমনিতেই হেয় চোখে দেখে। আমি চাই না এসব, আমার মামুর রেপুটেশন নষ্ট করতে আমি পারবো না। আমি স্বার্থপর হতে পারবো না উজান!
তুমি সবদিক থেকেই পারফেক্ট একজন পুরুষ উজান। যে কেউ তোমাকে পেতে চাইবে। তুমি আমার থেকে ভালো কিছু ডিজার্ভ করো। তাই বলছি তুমি আমার পিছু ছেড়ে দেও উজান। আমাকে নিজের মতো বাঁচতে দেও।”
লম্বা কথা শেষ করে দ’ম নিলো যমুনা। এতোকিছু শুনেও কোনো হেলদোল নেই সামনে থাকা উজান চৌধুরী’র মাঝে। যমুনার হঠাৎ ডাকার কারণ যে এগুলো হবে তা আগেই আন্দাজ করে নিয়েছে উজান চৌধুরী।
এরিমধ্যে ওয়েটার বয় এসে তাদের কফি দিয়ে গেলো। উজান চৌধুরী নিজের কফির মগে লম্বা এক চুমুক দিয়ে বললো,
“সমাজ! সমাজ! সমাজ! এই সমাজ আমাদের কি দিয়েছে উপমা? কখনো কি ক্ষুধার্ত একজন মানুষকে এক মুঠো ভাত দিয়েছে? অসহায় একটা মেয়ে’কে বাঁচত সাহায্য করেছে? বেকার একটা ছেলেকে ভরসা দিয়েছে? কই, কখনো তো তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় না!
উল্টো এই সমাজ তাদের অবহেলা, অবজ্ঞা করে পি’ষে দেয়, যার জন্য অকালে ঝরে যায় কত প্রাণ! তাহলে, ছোট্ট একটা জীবনে আমরা কেনো তাদের জন্য এতো এতো স্যাক্রিফাইস করবো?
আপনি সবার কথা ভাবলেন, আমার কথা কেন একটি বার ভাবলেন না?
জানেন না, আপনি ছাড়া আমি অসহায়! আমার ধ্যান-জ্ঞান আপনাতেই সীমাবদ্ধ। আপনাকে ছাড়া যে আমার এক মুহূর্ত চলছে না। আপনি বিহীন আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়।
ছোট্ট এক জীবনে সমাজ কি বললো বন্ধু কি বললো এসব ভেবে ভেবেই যদি পাড় করে দেই তাহলে নিজের জন্য আর বাঁচা হলো কই? আমি নিজের জন্য বাঁচতে চাই উপমা। আমি আপনাকে নিয়ে বাঁচতে চাই! এ নিয়ে কে কি ভাবলো, আই ডোন্ট কেয়ার! আপনি… আপনি একটিবার আমার হাত ধরে দেখুন না উপমা, আপনাকে সারাজীবন ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবো বক্ষপিঞ্জরে! আপনার গায়ে কখনো একটা আঁচড় ও লাগবে না কথা দিলাম।
আমায় ভরসা করুণ উপমা, আমি সব ঠিক করে দিবো। আই প্রমিজ! আমি সব ঠিক করে দিবো।”
“ইহা সম্ভব নয়! আমার যা বলার বলে দিয়েছি।তোমার সুন্দর জীবনটা নষ্ট করার অধিকার আমার নেই। আমার শহরে এসো না ছেলে, সহ্য করতে পারবে না তুমি। স্বপ্ন ভা’ঙা, হৃদয় ভা’ঙা, মন ভা’ঙা, অন্তর ভা’ঙা এমনকি বুকের হাড় ভা’ঙা’র দৃশ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা দেখে তোমার বুক কেঁ’পে উঠবে।”
যমুনা উঠে দাঁড়ালো। আরো কিছু কড়া কথা শুনিয়ে জায়গা ত্যাগ করলো মেয়েটা। উজান চৌধুরী সবটা শুনে প্রেয়সীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে, হাসলো। দমে যাওয়ার পাএ সে নয়। শুধু মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায়!
__________
যমুনাকে কমফোর্ট ফিল করাতে হুটহাট বিরক্ত করা ছেড়ে দিয়েছে উজান। যমুনা এতে স্বঃস্তি পেলো। পুনরায় অফিসে যাওয়া সহ নিজের মতো চলছে। কেটে গিয়েছে আরো কয়েকটি মাস। রাত এগারোটা বাজে পঞ্চাশ মিনিট। সবার সাথে রাতের ডিনার শেষ করে মাএ সুয়েছে যমুনা। এমন সময় কর্কশ আওয়াজে পাশে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্কিনে জ্বলজ্বল করছে “উজান চৌধুরী” নামটা। কপালে ভাজ পড়লো যমুনার। এতো রাতে কল দিয়েছে কেন ছেলেটা? কেননা, সচারাচর এখন তাকে কল দেয় না উজান চৌধুরী।
যমুনার সাত-পাঁচ ভাবনার মাঝে কল কেটে গেলো। পুনরায় কল আসতেই রিসিভ করলো যমুনা। ওপাশ থেকে পুরুষালী কণ্ঠে ভেসে আসলো,
“একটু গেইটের কাছে আসবেন উপমা?”
“এতো রাতে গেইটের কাছে কেনো যাবো?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো যমুনা।
“আসুন না একটিবার, প্লিজ উপমা! খুব আর্জেন্ট।
আমি আপনার জন্য গেইটের কাছে অপেক্ষা করছি।”
কল কেটে গেলো। যমুনায় দোটানায় পড়লো। যাবে কি যাবে না? উজান যে বললো, খুব আর্জেন্ট। আচ্ছা একটি বার গিয়েই দেখা যাক
মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করে সাবধানী পায়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়লো যমুনা। গেইটের কাছাকাছি আসতেই হালকা আলোয় একটি ছায়া মূর্তি দেখা গেলো। উজান চৌধুরী বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে।
যমুনাকে দেখতে পেয়ে ছেলেটা এগিয়ে আসলো কাছাকাছি। এক গাল হেসে শুধালো,
“আপনি এসেছেন উপমা?”
চারপাশে একবার তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো যমুনা,
“দেখতেই তো পাচ্ছো এসেছি। ডাকলে কেনো? কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো?”
উজান ততক্ষণাৎ কিচ্ছুটি বললো না। আরো কিছু সময় তাকিয়ে রইলো প্রেয়সীর মায়াবী মুখের দিকে। বিরক্ত হলো যমুনা। যা দেখে উজান খানিকটা হেসে বললো,
“ঘুম আসছিলো না। হুট করে আপনাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিলো। দেখা শেষ, আপনি এখন ভিতরে যান উপমা। আমিও যাচ্ছি, আজ শান্তি’র একটা ঘুম হবে।”
মানে কি? ছেলেটা তাকে এতো রাতে ডেকে মশকরা করছে? তাকে দেখার জন্য এতো রাতে বাহিরে এনেছে। রাগে ফুঁসে উঠলো যমুনা। পরমুহূর্তে উজানের লম্বা চুল গুলো ধরে টান দিয়ে ক্রোধিত কণ্ঠে শুধালো,
“তুমি এতো রাতে আমার সাথে মশকরা করছো উজান? আমাকে মিথ্যে বললে কেন?”
উজান নিচের চুল ছাড়িয়ে মৃদু কণ্ঠে শুধালো,
“মিথ্যা না বললে কি আর আপনি আসতেন। মিথ্যা বলেও যদি আপনাকে এক পলক দেখর সৌভাগ্য হয়, তবে আমি সারাজীবন মিথ্যেই বলবো।”
এরিমধ্যে কোথা থেকে যেন পাশের বাসার এক আন্টি এদিকেই আসছে। উজান তা দেখে দ্রুত ওখান থেকে সরে গেলো। যমুনাও ব্যস্ত পায়ে নিজের রুমে চলে গেলো। তবে তাদের চোখ ফাঁকি দেওয়া গেলো না।
পরদিন সকালে যখন অফিসের জন্য বাসা থেকে বের হয়েছে যমুনা, এমন সময় তাকে দেখে পাশের বাসার আন্টিগণ তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে একজন আরেক-জনকে বলছে,
“জামাইটা ছাইড়া দিয়া বাপের ঘরে ঘাপটি মেরেছে। দিনরাত পর-পুরুষের মধ্যে ঘুরে ফিরে চলে তাও হয় না, এখন আবার রাত-বিরেতে বাইরে এসে পরপুরুষের সাথে ঢলাঢলি করে। এই মেয়ের চরিত্র ভালো না ভাবি। আমি নিজ চোখে গতকাল রাতে একে একটা ছেলের সাথে দেখেছি।”
পাশ থেকে অন্য আরেকজন মহিলা বললো,
“আমি আগেই কইছিলাম এই মাইয়ার চরিত্রে দোষ আছে। এই বার দেখলেন তো ভাবি? চারিএ খারাপ দেইখাইতো জামাইডা তারে ছাড়ছে। নইলে এতো সুন্দর মাইয়া কেউ ছাড়ে?”
আর একজন মুখ বাঁকিয়ে বললো, “শুধু সাদা চামড়া থাকলেই হয় না, চরিত্র ও ভালা থাকতে হয়। দু’দিন আমোদ ফুর্তি করার জন্য এখন পুরুষ আসলেও সংসারের মুখ আর দেখন লাগবে না এই জীবনে। বয়স তো আর কম না!”
এদের নোংরামি মূলক কথা শুনে কান গরম হয়ে গেলো যমুনার। নিজেকে আর সামলাতে না পেরে আন্টিদের কাছাকাছি এগিয়ে এসে তেঁতো কণ্ঠে শুধালো,
“অন্যের মেয়েদের নিয়ে এতো চিন্তা কেনো আপনাদের? আপনাদের কোনো কাজ-কর্ম নেই? একটা মেয়েকে নিয়ে এসব বিশ্রী কথা বলার আগে নিজেদের দিকে একবার চেয়ে বলবেন, আপনাদের ছেলে-মেয়ে কেমন? খুউব ধোঁয়া তুলসীপাতা তাই না! সেসব রাস্তা ঘাটে চলার পথেই দেখা যায়। থাক সেসব আর নাই বললাম। সারাদিন অন্যের গীবত না করে, নিজের চরকায় তেল দিন। নেক্সট টাইম আমাকে নিয়ে বানোয়াট বাজে কথা শুনলে, জিব টেনে ছিঁ’ড়ে ফেলবো। মাইন্ড ইট!”
যমুনা আর দাঁড়ালো না এখানে, নিজের গন্তব্যে পা বাড়ালো। থেমে নেই আন্টিগণ, ক্ষেপে গেলো তারা। পিছনে ফেলে আসা মানুষ গুলো তাকে ইচ্ছে মতো কথা শুনাতে লাগলো। সেসব শুনেও শুনলো না যমুনা। আজ আর অফিসে গেলো না মেয়েটা। কিছুক্ষণ নিরিবিলি প্রকৃতির মাঝে সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরলো বেলা বারোটার নাগাদ। বাসায় পা রাখতেই তার গালে পড়লো, মায়ের হাতের শক্ত একখানা চড়। যমুনা গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
“আম্মু…! তুমি আমাকে মারলে?”
“হ্যাঁ মেরেছি। তুই আমাদের মানসম্মত নষ্ট করে দিলি যমুনা। লোকজন যাচ্ছে তাই বলছে। তোকে এতো বড় করেছি কি এসব শোনার জন্য? গতকাল রাতে কোন ছেলের সাথে দেখা করছিস তুই?”
“আম্মু তুমি এতোদিনে এই চিনলে আমায়? বাহিরের কেউ ছিলো না আম্মু, ছেলেটা তোমাদের উজান ছিলো।”
তাহেরা খানম দমলেন না। তার মেজাজ বিগড়ে আছে। লোকজন তার মেয়েকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করছে। মা হয়ে সেসব সহ্য করতে পারলো না সে। তাদের সমস্ত রাগ উগড়ে দিলো যমুনা’র উপর। পরমুহূর্তে মেয়েকে আরো কিছু শক্ত কথা শুনিয়ে দিলো। যমুনা ছিলো নির্বাক। রুমে এসে থম মে’রে বসে আছেন। ঘন্টা খানিক পর মা পুনরায় এসে জানালেন,
“তোর বিয়ের জন্য আমি ছেলে দেখেছি যমুনা। ছেলে ডক্টর, স্বভাব চরিত্রও ভালো। তাছাড়া, ছেলে নিজ থেকে তোকে আগে থেকেই পছন্দ করেছে। ইভেন তোর অতীত জেনেও সে তোকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। এই ছেলে আমি হাতছাড়া করতে চাচ্ছি না, আমি তাদের পাকা কথা দিয়ে ফেলছি। আমি এবার তোর কোনো অযুহাত শুনবো না যমুনা। আমি চাচ্ছি এই বিয়েটা হোক।”
“বিয়েটা হলে তোমরা হ্যাপি আম্মু?”
“হ্যাঁ! এছাড়া তোর কাছে আর কোনো কিছু চাওয়ার নেই আমার।”
যমুনা সম্মতি জানালো। তাহেরা খানম খুশী মনে জায়গা ত্যাগ করলো। বিয়ের পাকা-পোক্ত কথাও বললেন ছেলে পক্ষের সাথে। আত্মীয় স্বজনদের ও সুখবর জানাতে দেরী করলো না উনি।
যমুনা এখনো আগে’র ন্যায় নির্বাক, পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে আছেন। এরিমধ্যে ফোন ভেজে উঠলো। উজান কল দিয়েছে। যা দেখে এতক্ষণের চাপা রাগ তড়তড় করে বেড়ে গেলো তার। ফোনটা রিসিভ করেই কর্কশ কণ্ঠে বললো,
“তুমি এবার খুশীতো উজান? তোমার তো এখন খুশী’র দিন।”
ওপাশে থাকা পুরুষটি, বিস্মিত! হতবাক! আজ যমুনা অফিসে আসেনি বলেই কল দিয়েছে সে। এরিমধ্যে কি হয়ে গেলো, সব তার মাথার উপর দিয়ে গেলো যেন! নিজেকে সামলে উজান কোমল কণ্ঠে বললো,
“রিলাক্স! কি হয়েছে আপনার উপমা?”
“তুমি আমার চরিত্র দাগ লাগিয়ে দিয়েছো উজান। তোমার ছেলে মানুষিকতার জন্য আমার চরিত্রে দাগ লেগেছে। তোমার জন্য চরিত্রহীন তকমা লেগে গিয়েছে আমার শরীরে।”
বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো যমুনা। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান উজান চৌধুরী’র সবটা বুঝতে বেশীক্ষণ সময় লাগলো না। প্রেয়সীর কান্না তাকে উতলা করে দিচ্ছে। উজান ব্যস্ত কণ্ঠে শুধালো,
“প্লিজ! আপনি কাঁদবেন উপমা। শান্ত হন! আপনি পবিত্র! আপনি স্নিগ্ধ! আপনাকে যে অপবিত্র বলছে, তার মুখ ঝ’ল’সে যাক! আমি আসছি উপমা। ”
যমুনা নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত কণ্ঠে ডাকলো,
“উজান?”
“হ্যাঁ, বলুন। আপনি ঠিক আছেন উপমা?”
“আমি তোমায় একটা কথা বলি, রাখবে?”
“অবশ্যই রাখবো। আপনার সব কথা আমি রাখবো উপমা। তবুও আপনি প্লিজ শান্ত হন।”
“তুমি কখনো আমার সামনে এসো না উজান। তোমাকে আমি কখনো ক্ষমা করতে পারবো না, তোমার মুখটাও আমি দেখতে চাই না আর।
তুমি যদি আমায় এতটুকু ভালোবেসে থাকো, তাহলে আশা করছি আমার এই কথাটি রাখবে। তাছাড়া, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। আগামীকাল আমার বিয়ে। ইভেন এই বিয়েটা আমি নিজ ইচ্ছেই করছি।”
কল কেটে গেলো। উজান চৌধুরী’র দুনিয়া ঘুরছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হলো যেন, মস্ত বড় আকাশটা তার মাথায় ভে’ঙে পড়েছে।
চলবে…..
(উজান চৌধুরী কি তার এতোদিনের যত্নে গড়া ভালোবাসা আবারো হারিয়ে ফেলবে, না-কি নিজের করে পাবে? কি হবে এই ভালোবাসার শেষ পরিণতি? জানতে আগামী পর্বে’র অপেক্ষা করুণ। লম্বা পর্ব দিয়েছি। আজ পাঠকদের সাড়া যাচ্ছি। এই পর্বে সবাই পেজে ৩০০/৪০০ + রেসপন্স করলে আগামী পর্ব দ্রুত পোস্ট করা হবে।)