আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি #৫ম_পর্ব #অনন্য_শফিক

0
300

#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#৫ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



ফেসবুকের নিউজফিডে দেখা ছবিগুলো আর কারোর না।ফৌজিয়ার। ফৌজিয়া সিলেটের চা বাগানে গিয়েছে ঘুরতে। ওখান থেকে অনেক গুলো ছবি পোস্ট করেছে সে।আমি এটা দেখে যারপরনাই অবাক হলাম।অথচ কি সব ভাবছিলাম আমি। ভাবলাম, ফৌজিয়া তার ফোন অফ করে বাবার মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে চাইছে।অথচ সে কি না নিজের শহর ছেড়ে ওই অতো দূরের এক শহরের পাশে চা বাগানে ঘুরতে গিয়েছে। আনন্দের জন্য। আবার ফেসবুকে ছবিও পোস্ট করেছে। বাহ্!
বাবা মারা যাওয়াতে মনে হচ্ছে তার ভীষণ আনন্দই হচ্ছে।
কিন্তু এর খানিক পরেই নিজের এমন ক্ষুদ্র মানসিকতার ক্ষীণ্নর চিন্তার জন্য নিজেই নিজের কাছে লজ্জিত হলাম।মনে মনে বললাম, ছিঃ ছিঃ! এসব কি ভাবছি আমি! একটা মানুষ,যার সবচেয়ে কাছের মানুষ অর্থাৎ তার বাবা মারা গিয়েছে।এটা আসলেই বিরাট শকড খাওয়া। কিন্তু সে যদি তার শোক কাটিয়ে উঠতে, নিজের মন টিক করতে দূরে কোথাও বেড়াতে যায়।এতে তো মন্দের কিছু নাই। এটা তো খুব ভালোকথা। সুন্দর বিষয় এটা।এটা নিয়ে আবার খারাপ কিছু ভাবার কি আছে?
এরপর আমার নিজের উপর নিজেরই এক ধরনের ঘেন্না হলো।মনে হলো, সে আমায় ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে, অনেক বড় হয়ে গিয়েছে বলে আমার ভীষণ হিংসে হয় তার প্রতি। সম্ভবত এই হিংসে থেকেই আমি ওকে নিয়ে এমন উলটপালট ভাবি।
কিন্তু আমার ভাবনা জুড়ে বেশিরভাগ সময়ই এই ফৌজিয়াই থাকে। স্কুলে পড়বার সময় ফৌজিয়ার সঙ্গে প্রথম প্রথম জেদ থাকলেও কিভাবে যেন তার সঙ্গে ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল আমার। সেই আমার সঙ্গে নিজ থেকে মিশেছিল। এমনকি প্রায়ই সে আমার সঙ্গে স্কুল ছুটির পর আমাদের বাসায় আসতো। ভাইয়া তখন ত্রিশালের কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়ে। ভাইয়া যখন ছুটি কাটাতে বাসায় আসতো তখন সে আমায় ইংরেজি পড়াতো। ফৌজিয়া তখন আমায় বলতো, তুমি একাই পড়বা কেন শুধু? আমিও পড়তে চাই ভাইয়ার কাছে। এরপর থেকে আমি আর ফৌজিয়া একসাথেই ভাইয়ার কাছে ইংরেজি পড়তাম। আমার কেন জানি মনে হতো, ফৌজিয়া তখন আমায় খুব পছন্দ করতো ‌। ভালো বাসতো আমায়। এই যে ঘন ঘন আমাদের বাসায় আসতো। এমনকি আমার সঙ্গে একসাথে পড়তে চাইতো।এর উদ্দেশ্যও আমার সঙ্গে একটু সময় কাটানো।আর কিছু না!
কিন্তু কলেজে উঠার পর কি হলো কে জানে। আমার সঙ্গে সে কথা বলাই বন্ধ করে দিলো। এরপর তো কতো কি ঘটে গেল আমার জীবনে। হঠাৎ করে আমাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু অপূর্বর খু*ন হওয়া। আমার উপর মামলা হওয়া। আমার পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো।এসব সমস্যা কাটিয়ে আসার পর দেখি ফৌজিয়া তখন সফল একজন মানুষ। ময়মনসিংহ শহরের প্রসিদ্ধ একজন ডাক্তার। আমার দেখায়, এতো অল্প বয়সে সেই সবচেয়ে জনপ্রিয় ডাক্তার।যার কাছে রোগীর উপচে পড়া ভীড় হয়।আর তার চিকিৎসা সেবাও খুব উন্নত। মানুষ তার চিকিৎসায় ভালো ফলাফল না পেলে তো আর এভাবে এসে তার চেম্বারে ভীড় করে থাকে না!
আমি কখনোই ভাবিনি ফৌজিয়ার সঙ্গে আমার আবার বন্ধুত্ব হবে। কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেন খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমাদের।
কিন্তু এখন কি আর ফৌজিয়া আমায় নিয়ে এভাবে আগের মতো ভাববে? আমায় ভালোবাসবে?
কিছুতেই না।সে কোথায় আর আমি কোথায়? আমাদের দুজনের ব্যবধান এখন আকাশ -পাতাল!
হয়তো এতো দিনে তার নিজের একটা মানুষ হয়ে গেছে।সেও হয়তো বড় কোন ডাক্তার।অথবা বড় কোন চাকুরে। আমার মতো বেকার এক যুবক বড়জোর তার পি-এস হতে পারে।এর বেশি কিছু না! এরপরেও যে সে আমার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক রেখেছে। আমার সঙ্গে নিয়মিত কথা বলে।এও কি আমার জন্য কম কিছু!

এভাবে আরো দুদিন কেটে গেল। মায়ের সঙ্গে কথা হলো দুপুরে।মা বললো,’ কেমন আছো?’
আমি বললাম,’ ভালো আছি মা।’
মা জীবনে যা বলেননি তা আজ এই প্রথমবারের মতো বললেন। তাও রাগ দেখিয়ে। তিনি বললেন,’ তপু, আমি তোমার খালার বাসা থেকে আমার ভাইয়ের বাসায় চলে যাবো।বড় ভাইজানের বাসায় যাবো। কাল যাবো।’
আমি বললাম,’ হঠাৎ ওখানে কেন? কোন সমস্যা? কারোর অসুখ বিসুখ কি?’
মা বললেন ,’ না। এমন কিছুই না।’
আমি বললাম,’ তাহলে? ওখানে যাবে কেন? বাসায় আসবে কবে তুমি? আমার ভালো লাগছে না আর। তুমি না থাকলে ভালো লাগে না।সব শূন্য মনে হয়।’
মা আমায় সবচেয়ে বেশি চমকে দিয়ে বললেন,’ তপু, আমি আর কোনদিন তোমাদের বাসায় ফিরবো না।আমি আমার সবটা জীবন ভাইজানের বাসায় কাটিয়ে দিবো।আর ওখানে ভাইজান যদি আমার উপর অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন, আমাকে যদি সারা জীবন তার ওখানে রাখতে না চান, তবে কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো। তবুও বাসায় ফিরবো না আমি।’
আমার এতো খারাপ লাগছে এসব শুনে! মা কোনদিন এমন কথা বলেননি।কি হয়েছে এমন যে মা এভাবে এরকম শক্ত শক্ত কথা বলছেন!
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’ মা, কি হয়েছে বলো তো।কেন এমন কথা বলছো তুমি?’
মা হাসলেন যেন।এটা হাসি না ঠিক। তার নিজের প্রতি অবহেলার বহিঃপ্রকাশ।
আমি বললাম,’ মা বলো।প্লিজ বলো কেন এসব বলছো তুমি?’
মা বললেন,’ তপু, আমি কি কখনও মিথ্যে বলেছি তোমাদের দুই ভাইয়ের সঙ্গে? কোনদিন এরকম হয়েছে? ‘
আমি বললাম,’ না। বলো নি।’
মা এবার বললেন,’ কখনো খামখেয়ালিপনা করেছি তোমাদের দুই ভাইয়ের সঙ্গে?’
আমি বললাম,’ না।করোনি।’
মা সত্যি সত্যিই কখনো আমার সঙ্গে কিংবা ভাইয়া- ভাবীর সঙ্গে খামখেয়ালিপনা করেননি। মজা করেননি।রাগ অভিমান দেখাননি। তিনি আর দশটা মেয়ে লোকের চেয়ে ভিন্ন। ভীষণ রকম সৎ মানুষ তিনি। এবং এক কথার মানুষ তিনি। কোন কিছু নিয়ে কখনোই অতিরঞ্জিত করেননি তিনি কখনোই। কথা বলেন একেবারে মেপে মেপে। এবং যা বলেন তার সবই গুরুত্বপূর্ণ।সত্য। আচ্ছা তাহলে যে মা বললেন আর ফিরবেন না, এটা কি সত্যি সত্যিই তিনি করে ফেলবেন?
কিন্তু কেন? কেন এটা তিনি করবেন?
আমি আবার বললাম। বললাম,’ কি হয়েছে মা বলবে আমায়! দয়া করে বলো।
মা বললেন,’ এখন আর আমায় দিয়ে তোমাদের কোন প্রয়োজন নেই। এখন তোমরা অনেক বড় হয়ে গিয়েছো। আমার বড় ছেলে অপু আমায় না বলেই সিলেটে যায়। ট্রেনিং না কি যেন করতে।আর আমার কাছে কি অবলীলায় সে মিথ্যে বলে যায় রোজ রোজ। ফোন দিলেই বলে, সে অফিসেই যাচ্ছে নিয়মিত। কোথাও যায়নি। আর তুমি? তুমিও তো নিজের ভাইকেই সঙ্গ দিলে। তোমার ভাই বাসায় নাই। সিলেটে গিয়েছে।আর তুমি আমায় তা জানাওনি। তুমিও মিথ্যে বলেছো আমায়। তোমাদের থেকে আমার মন একেবারে উঠে গেছে।তোমরা তোমাদের মতোই থাকো। নিজেদের স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচো‌।’
মা ফোন কেটে দিলেন।আমি সঙ্গে সঙ্গেই আবার ডায়েল করলাম।মা ফোন বন্ধ করে ফেলেছেন।
এতো গুলো সমস্যা আমি কিভাবে সামাল দিবো বুঝতে পারি না। আমার মাথা কুলিয়ে উঠে না আর।

বিকেল বেলা ভাবী বললেন,’ ঘরে বাজার নাই।বাজার করতে হবে।’
আমি বললাম,’ কি কি লাগবে লিস্ট করে দেও।’
ভাবী লিস্ট করে দিলো। ভাবীর কাছ থেকে লিস্ট নেয়ার সময় ভাবীর মুখের দিকে তাকালাম আমি।এই কদিনেই ভাবীর চেহারা একেবারে কাহিল হয়ে গেছে। তাকে হঠাৎ করে দেখলে মনে হয়, এ তো আমাদের অতি সুন্দরী, ভীষণ মিষ্টি, আর সব সময় হাসিখুশি থাকা অপি ভাবী নয়।এ অন্য কেউ।যাকে আমি চিনি না।যাকে আমি জানি না।যাকে আমি আর কোনদিন দেখি নি!

তখন বাজারে আমি। মাছের আড়তের দিকে যাচ্ছি। তখনই দেখা হলো মহসিন ভাইয়ের সঙ্গে। মহসিন ভাই হলেন ভাইয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আবার কলিগও। আমি মাছের আড়তের দিকে ঢুকছি আর তিনি মাছ কিনে বেরুচ্ছেন। তার দু হাত ভর্তি ব্যাগ।আমায় দেখেই তিনি বললেন,’ এই তপু, কেমন আছো তুমি?’
আমি হাসলাম মৃদু। বললাম,’ ভালো ভাইয়া। বাজার করতে এলাম।ঘরে বাজার নাই।’
মহসিন ভাইয়া বললেন,’ ও আচ্ছা। আচ্ছা অপু কোথায় রে? কোথায় গেল কিছুই জানি না।অফিস থেকে ছুটি নিলো এক সপ্তাহের জন্য।বললো জরুরি কাজে দূরে কোথাও যাবে। কিন্তু কোথায় যাবে কিছু বলেনি। গতকাল ফোন করেছিলাম। ভাবলাম কথা বলি। কেমন আছে না আছে। কিন্তু ফোন বন্ধ ওর। তোমায় পেয়ে ভালোই হলো। তোমার কাছ থেকে জেনে নেওয়া যাবে সে কোথায় আছে আর কোন সমস্যা কি না!’
আমার মাথায় যেন হঠাৎ এই এতো বড় আকাশটা ভেঙ্গে পড়লো।এসব কি বলছেন মহসিন ভাইয়া! ভাইয়া যে বললো অফিস থেকে তাকে সিলেটে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে তবে কি এটা মিথ্যা? তবে কি ভাইয়া সিলেটে যায়নি? আর যদি গিয়েও থাকে তবে কেন গেলো? আর তার নম্বর বন্ধ কেন? এমনকি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ সবকিছু ডিএক্টিভেট করে রাখা কেন?

#চলবে

৪র্থ পর্বের লিংক –
https://m.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/937253797996393/?mibextid=Nif5oz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here