#তোমায়_যবে_পাই_দেখিতে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৪
(প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
বাবা-মায়ের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেছে প্রিয়ন্তির। দ্রুত নিজের রুম ছেড়ে বসার ঘরে উপস্থিত হয় সে। কিন্তু এসেই মায়ের উপর এরকম মারধর দেখে পিলে চমকে উঠে প্রিয়ন্তির। ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে যায় তার। হিতাহিতজ্ঞান শূণ্য হয়ে গেছে যেনো। কী করবে বুঝতে না পেরে রান্নাঘরের দিকে ছুট লাগায় প্রিয়ন্তি। রেজওয়ানকে বাঁধা দিয়ে কোনো লাভ নেই। এ-র আগেও প্রিয়ন্তি চেষ্টা করেছে মা’কে মারধর থেকে রক্ষা করার। কিন্তু রক্ষা তো হয়নি উল্টো প্রিয়ন্তি নিজেও করাঘাতের স্বীকার হয়েছে। তাই এবার রান্নাঘর থেকে বটি নিয়ে এসেছে।
” খবরদার বলছি, মা’কে আর একটাও টোকা দিলে আমি ভুলে যাবো তুমি আমার কে।”
প্রিয়ন্তির হুংকারে রেজওয়ান স্তম্ভিত। সহসাই অর্পার চুলের মুঠি আলগা করে দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকায় মেয়ের দিকে। অর্পা ক্রন্দনরত অবস্থায় মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ায়।
” প্রিয় তোর মাথা ঠাণ্ডা কর। এটা কিন্তু ধারালো খুব, রেখে দে। আমাকে মারতে তুই পারবি না। আর পারলেও সারাজীবন জেলে কাটাতে হবে তোকে। ”
” কাটুক জেলে তবুও আমার মা তোমার হাত থেকে বাঁচবে। ”
” তুই আমার কথামতো বিয়ে কর,আমি তোর মা’কে আর মারধর করবোনা। আসমাকেও ত্যাগ করবো।”
বিয়ে! প্রিয়ন্তির দু-চোখ টলমল করছে। যে-ই বাবা মেয়েকে ডাক্তার বানাবে বলে কতশত স্বপ্ন দেখতো আজ সেই বাবা বিয়ের জন্য বলছে তাকে? হাত থেকে বটি পড়ে যায় প্রিয়ন্তির। অর্পা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে।
” তুই বিয়ে করবি না প্রিয়। আমরা আজই বেরিয়ে যাবো এই বাড়ি থেকে। ”
প্রিয়ন্তিকে নিয়ে দরজার দিকে এগোতে চাইলেই রেজওয়ান প্রিয়ন্তির হাত ধরে আঁটকায়।
” অর্পা আমি প্রিয়ন্তির ভালোর জন্য বিয়ে দিতে চাচ্ছি। বিয়ে হলে লেখাপড়া করতে পারবেনা এমনটা তো না। আমি আর কখনো তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবোনা। প্রিয়কে শুধু বিয়েতে রাজি করাও। নয়তো আমি আত্মহত্যা করবো।”
রেজওয়ানের মুখে আত্মহত্যার কথা শুনে আঁতকে ওঠে অর্পা। যতই হোক রেজওয়ান তার স্বামী। এতগুলো বছর সংসার করেছে তার সাথে। ভালোবাসার মানুষের প্রাণনাশের কথা শুনে তাই ভয় পায় সে। কিন্তু প্রিয়ন্তি? প্রিয়ন্তি তো তিয়াসকে পছন্দ করে। কিন্তু এই মুহুর্তে তিয়াসের কথা রেজওয়ানকে বলাও ঠিক হবে না। ছেলেটা এমনি অসহায়, খালার কাছে থাকে। রেজওয়ান যদি কোনো ক্ষতি করে দেয়? বড়ো বড়ো রাজনৈতিক লোকজনের সাথে পরিচয় আছে রেজওয়ানের। যেকোনোভাবে তিয়াসের খালুর খামারও উৎখাত করার ক্ষমতা আছে তাদের।
” বাবা আমি বিয়ে করতে চাই না। প্লিজ তুমি আমার কথা শোনো।”
” প্রিয় তুই যদি চুপচাপ বিয়ে করে নিস তাহলে আমি তোর মায়ের সাথে শান্তিতে সংসার করবো। এমনিতেই আসমার স্বামী তাকে নিয়ে ঝামেলা করেছে, সে থাকবে না। আর যদি বিয়ে না করিস হয় আমি মরবো নয়তো তোর মা’কে শেষ করে ফেলবো। তোর বিয়ে হওয়াটা খুব দরকার আমার জন্য খুব.. ”
রেজওয়ান কড়া গলায় কথাগুলো বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। মা, মেয়ে মোটেও তার অভিনয় ধরতে পারেনি। প্রিয়ন্তি মাকে ছেড়ে দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আঁটকে বিছানায় শুয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। কী করবে সে? একদিকে তিয়াস অন্যদিকে মায়ের শান্তি। মায়ের থেকে পৃথিবীতে আর কেউ আপন নয় তার কাছে। কিন্তু তিয়াস যখন বাড়ি ফিরে শুনবে এসব, তখন কীভাবে মেনে নিবে সবকিছু! মাথার মধ্যে চিন্তারা এলোমেলো হয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে প্রিয়ন্তির। চাইলেই আইনের সাহায্যে বিয়ে আঁটকাতে পারে, প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে সে। কিন্তু মা’কে তো এ ঘরেই থাকতে হবে। বাবা যতই খারাপ হোক কীভাবে সে মেয়ে হয়ে বাবার সাথে মায়ের ডিভোর্স করাবে?
” প্রিয়! এই প্রিয়! দরজা খোল।”
অর্পা দরজায় বারবার ধাক্কা দিচ্ছে দেখে প্রিয়ন্তি দরজা খুলে দেয়। চোখমুখ কেমন থমথমে হয়ে আছে তার। চোখের কাজল লেপ্টে গালে লেগে আছে। প্রিয়ন্তি সব সময় কাজল পড়ে থাকে। অর্পা প্রিয়ন্তিকে জড়িয়ে ধরে।
” মা রে এরকম কাঁদিস না। চল আমরা পালিয়ে যাই কোথাও। ”
” কোথায় যাবো আমরা? নানা বাড়ি গিয়ে কয়দিন থাকবো? তারপর তো রাস্তায় নামতে হবে মা। আর বাবা কী আমাদের খুঁজবে না মনে হয়? ঘরে যাইহোক,বাইরে তিনি তার ইমেজ বজায় রাখতে আমাদের খুঁজে ঠিক আবারও এখানে নিয়ে আসবে। আমি মাধ্যমিক পাশে কী কাজ করবো মা? আর তুমি? হবে না, হবে না। দুনিয়া কঠিন খুব। আমরা দু’জন নারী বাইরে টিকতে পারবোনা। আমি সিন্ধান্ত নিয়েছি,বিয়ে করবো। আমি চাই তুমি সুখী হও।”
মেয়েকে বাহুডোর থেকে আলগা করে অর্পা। মেয়েটা কয়েক মুহুর্তে কেমন বড়দের মতো কথা বলতে শিখে গেলো! দুনিয়ায় টেকার জন্য না মায়ের শান্তির জন্যই তার এই সিন্ধান্ত।
” প্রিয়! আমি কীভাবে তোর স্বপ্ন বিসর্জন হতে দেই চোখের সামনে? আর তিয়াস… ”
” তিয়াস কয়েকদিন পরে ঠিক হয়ে যাবে মা। ওর সাথে আমার তেমন কোনো ঘনিষ্ঠতা নেই। কোনো দিন পাঁচ মিনিট ফোনে কথা পর্যন্ত বলিনি। আশা করি ধাক্কাটা সামলে নিবে সে। তুমি বাবা ফিরলে বলবে আমি রাজি কিন্তু বিনিময়ে তোমার সাথে সুখে সংসার করতে হবে তাকে। ”
” তোর পাগলামির কথা আমার ভালো লাগছে না প্রিয়। কখনো শুনেছিস মেয়েকে জলে ফেলে মা সুখের সংসার করতে পারে? ”
” আমি মেয়ে হয়ে বাবার মৃত্যু কিংবা মায়ের অশান্তি কোনোটাই সহ্য করতে পারবো না। তাই বিয়ে করে নেওয়াই ভালো। শুধু দোয়া করবে যেনো তোমার মেয়ে সবকিছু সামলে নিতে পারে। ”
অর্পা ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। মেয়েটা যেনো মায়ের মতো করে বোঝালো তাকে। রেজওয়ান কতটা ভয়ংকর আর জেদি অর্পার অজানা নয়। তাছাড়া মেয়ের বিয়ের পরেও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকায় মনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠিক করে।
তিন দিনের মাথায় ধুমধামে বিয়ের আয়োজন করে রেজওয়ান। ছেলে সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার,নাম আসমান শেখ। ঢাকা শহরে বাড়ি। কনে বেশে নিজের ঘরে বসে আছে প্রিয়ন্তি। টুকটুকে লাল রঙের বেনারসিতে সুন্দর লাগছে তাকে। ঠোঁটের কোণের কালো তিলটা যেনো তার সৌন্দর্যকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পার্লার থেকে লোক এসেছিলো সাজাতে। প্রিয়ন্তি প্রথমে সাজতে না চাইলেও রিক্তা আর স্নেহার জোড়াজুড়িতে সেজেছে। পরিস্থিতি কেমন সেসব জানে রিক্তা ও স্নেহা। যা হওয়ার তো হবেই! তাই বান্ধবীকে হাসিখুশি রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে দু’জনেই।
” প্রিয় তোর বর এসেছে। রিক্তা,স্নেহা আয় আয় গেটের কাছে যাই।”
প্রিয়ন্তির অন্য ক্লাসমেট শিরীন ডাকতে এসেছে। প্রিয়ন্তি বরের ছবি পর্যন্ত দেখেনি। যে বিয়েতে মনের স্বায় নেই সেখানে ছবি দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। গত দুই দিন অর্পার সাথে ঠিক আগের মতো আচরণ করেছে রেজওয়ান। মনে শতো কষ্ট থাকা স্বত্বেও মায়ের প্রতি বাবার ভালো আচরণ দেখে চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে গোপনে।
” প্রিয় তুই বস আমরা গিয়ে দেখি আসি বরং।”
” যা ইচ্ছে কর তোরা।”
প্রিয়ন্তি মলিন মুখে বললো। রিক্তা ও স্নেহা শিরীনের সাথে বর দেখতে গেটের সামনে পৌঁছে। এমনিতে ছেলে দেখতে সুন্দর কিন্তু বয়সটা একটু বেশি মনে হচ্ছে রিক্তার। স্নেহাকে কনুই দিয়ে কোমরে গুঁতো মেরে রিক্তা বললো,
” দেখ তো লোকটার বয়স বেশি তাই না? চৌত্রিশ /পয়ত্রিশ তো হবেই!”
” বিষয়টা কেমন লাগছে। আঙ্কেল প্রিয়’র জন্য এতো বয়স্ক ছেলে পছন্দ করলো কেনো বলতো? ”
” জানি না রে। আমি শুধু দোয়া করি,প্রিয় ভালো থাকুক।”
দুজনের কথোপকথনের মধ্যে আসমানকে ভেতরে নিয়ে বরাসনে বসিয়েছে সবাই। আসমানের সাথে তার ছোটো ভাই প্রণয় আর তার কয়েকজন চাচাতো-মামাতো ভাইবোন এসেছে। মুরুব্বি হিসেবে আছে আসমানের চাচা জালাল উদ্দীন। আসমানের চোখমুখ কেমন অস্থির হয়ে আছে। কারণ তার মা এবং প্রিয়ন্তির বাবা কেউই প্রিয়ন্তিকে জানায়নি তার আগে ডিভোর্স হয়েছিলো। আসমান তীব্র প্রতিবাদ করেছিলো। কিন্তু মায়ের আবেগের সামনে জিততে পারেনি তার প্রতিবাদ। আসমানকে হাসফাস করতে দেখে প্রণয় আস্তে আস্তে বলে,
” তোমার কি আবারও মাথা ঘুরছে ভাইয়া?”
” না রে। আমি ঠিক আছি,কিন্তু এখানে কিছু ঠিক হচ্ছে না। প্রণয় শোন।”
” হ্যাঁ বলো ভাইয়া।”
” আমার একটা কথা রাখবি? আমি চাই না অষ্টাদশী মেয়েটার জীবন এভাবে নষ্ট হয়ে যাক।”
” এভাবে কেনো বলছো? তোমার সাথে বিয়ে হলে জীবন নষ্ট হবে কেনো? তুমি যথেষ্ট ভালো মানুষ। ”
” কেনো বলেছি একটু পর জানতে পারবি। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে তুই শুধু আমার সাথে থাকিস।”
প্রণয় বুঝতে পারে তার ভাইয়ের মাথায় অন্য কোনো পরিকল্পনা ঘুরছে। কিন্তু কী সেটা বুঝতে পারছে না। মায়ের অবাধ্য সে হতে পারবেনা কারণ মাথার দিব্যি দিয়েছেন জাহানারা বেগম। তাহলে কী করবে?
চলবে,