#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_১৬
বিয়ে বাড়ি থেকে আসার পর আসাদ আর একদিনও বাসায় থাকলো না।পরের দিন সকালেই ঢাকায় ব্যাক করল।নিরু আজিজুল হকদের সাথেই বাড়ি চলে এসেছে।নিরুকে সবাই আরও কিছুদিন রাখতে চাচ্ছিলো কিন্তু আসাদ আজিজুল হককে বলে থাকতে দিলো না।আসাদ জানে নিরু ওখানে নিরাপদ থাকবে না। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়ে বাবাকে হলুদের দিনের ওই ঘটনাটা বলে নিরুকে সঙ্গে নিতে বলল।আজিজুল হক ও চাচ্ছিলেন নিরু চাইলে আরও কিছুদিন থেকে আসুক।কিন্তু আসাদের কথা শুনে আর এক বেলাও রাখলেন না।রুমনকে একটা উচিত শিক্ষা দিতেও চাচ্ছিলেন।এতো মানুষের মধ্যে এইসব নিয়ে কথাবার্তা না বলাই ভালো বলে মনে করলেন।তাই আর এক বেলাও থাকলেন না।
সেই হলুদের দিনের পর থেকে নিরুর মনটা অস্থির হয়ে আছে।আসাদ ও দ্রুত চলে গেল। নিরুর ভালো মতো মনে আছে আসাদ ফোনে বলেছিলো গুলিয়াখালী বিচে নিয়ে যাবে।কিন্তু মুখে একবারও বলল না।নিরুর মাঝে মাঝে মনটা কেঁদে যায়।চোখের কোণ ঘেঁষে জল গড়িয়ে পড়ে।নিরু বোঝে না এতো মায়া কেন হয়।নিরুর মন চায় আসাদকে ফোন দিতে,ফোনটা হাতে নিয়েও কল দিতে পারে না। হাতটা থেমে যায়।বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে।কল করে কি বলবে বুঝতে পারে না। তাই কল করাও হয় না।এইভাবেই দিনের পর দিন মাসের পর মাস চলে যায়।
নিরু ক্লাস টেনে উঠেছে।নিয়মিত ক্লাস করে।প্রাইভেট পড়ে।পড়াশোনাতেও একটু মনোযোগ এসেছে।প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিরু পড়ে আর আমিনা বেগম পাশে বসে থাকেন।নিরু পড়তে পড়তে একটু অন্যমনষ্ক ও হতে পারে না। একটু গভীর ভাবে তার আসাদ ভাইকে নিয়েও ভাবতে পারে না। পড়া শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় গিয়ে শুতেই ঘুমে তলিয়ে যায়।এইভাবেই দিন গুলো যাচ্ছে।
ওইদিকে আসাদ পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত, আর তার নিরুর ভাবনা তো ব্যস্ততম শহরের মতোই মন জুড়ে ব্যস্ত হয়ে থাকে প্রতিটাক্ষণ।আসাদ এখন বাড়িতে যায় ঠিকই কিন্তু নিরু যখন দাদুর কাছে বেড়াতে যায় আসাদ তখন নিজের বাড়ি থেকে ঘুরে আসে।ইচ্ছে করে নিরুর টলমলে চোখ জোড়া সামনে থেকে দেখার কিন্তু আসাদের ওয়াদা আসাদ ভাঙবে না।সেদিন হলুদে তোলা ছবির মধ্যে থেকে একটা ছবি আসাদ বাধাই করে এনেছে।সব সময় ছবিটা সঙ্গে রাখে।সেদিন আয়েশার ছবি দুই একটা তুলে সব গুলো নিরুর ছবি তুলেছিলো।হাসি হাসি মুখের একটা ছবিও নেই।সব ছবিতে ডাগর চোখের নারী রুপী রুপসীর মুখ ভার করা অভিমানী আদলে গড়া ছবি।এই রুপটাও যে আসাদের এতো ভালো লাগবে আসাদের জানা ছিলো না। কেমন অভিমানী রুপে রাগী রাগী মুখ করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।আসাদের ওই ছবির দিকে তাকালেই কেমন যেন লাগে।অদ্ভুত রকম ভালো লাগা কাজ করে।নিজের অজান্তেই ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হয়ে হাসি চলে আসে।
নিরুর সামনেই এস এস সি পরীক্ষা।স্কুলে কোচিং শুরু করেছে।প্রতিদিন কোচিং করতে যায়।একটার পর কোচিং ছুটি দিয়ে দেয়।নিরু পরীক্ষা নিয়ে বেশ চিন্তিত। তানজিলাও নিরুর পিছনে বেশ পরিশ্রম করে। তানজিলার মাধ্যমে আসাদ ও দূর থেকে নিরুর পড়াশোনায় নজর রাখে।সাজেশন তৈরি করে দেয়।ঢাকাতেও টিউশনি শুরু করেছে।
একদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে রাহিমা নিরুকে বলল, “এখন দুইদিন কোচিংয়ে আসবো না।তোকে একাই আসতে হবে।”
“আসবি না কেন?সামনেই তো পরীক্ষা।”
“পড়াশোনা তো আছেই আর চলবেও। কতদিন পর বিয়ের দাওয়াত পেয়েছি।অনেক মজা করবো।এখন দুইদিন পড়াশোনা থেকে বহু দূরে!”
” কার বিয়ে?আর কোথায় যাবি?”
” বাড়ির বাইরে যাবো না। বাড়ির মধ্যেই রিংকি আপুর বিয়ে।”
নিরু হালকা অবাক হলো।অবাক হওয়া গলায় বলল, “রিংকি আপুর বিয়ে মানে?”
“বিয়ে মানে আবার কি? বিয়ে মানে তো বিয়েই তাই না?”
“ওইটা বলিনি ছাগল।কোথায় বিয়ে আর কার সাথে বিয়ে?”
“রিংকি আপুর বাবার বন্ধুর ছেলের সঙ্গে, ছয় মাসের রিলেশনে সোজা ছাদনাতলায়।তুই আর আসাদ ভাইয়া ও তো বিয়ের দিন আসছিস।ভালোই এগিয়ে গেছো। শুধু আমাকেই কিছু বলো না তাই না?”
” তোর কি মাথাটা গেছে?না কিছু খেয়েছিস?”
রাহিমা চোখ পাকিয়ে বলল, “তোর মনে হয় আমি আবোলতাবোল জিনিস খেয়ে বেড়াই?”
” না খেলে আবোলতাবোল বকছিস কেন?”
“কোনটা আবোলতাবোল বকলাম?”
“আমি আসাদ ভাইয়ের সাথে রিংকি আপুর বিয়েতে যাবো কেন?”
রাহিমা কৌতুক করে চোখ টিপে বলল, ” তাহলে কি আমি যাবো?”
“এবার কিন্তু মাইর খাবি।পরিষ্কার করে বল।”
“তুই আমার কাছে লুকাস কেন নিরু?”
“তোর কাছে লুকানোর মতো আমার কিছু আছে?”
“আসাদ ভাইয়ের সাথে তুই সম্পর্কে নেই?”
নিরু যেন এবার আকাশ থেকে পরল।রাহিমা এইসব জিজ্ঞেস করছে কেন? এইসব ধারণায় বা কোথায় থেকে ওর মধ্যে এলো।
” কিরে নিরু বল?”
” ওমন কিছু হলে আমি তোকে বলতাম না?”
“সত্যিই কিছু নেই?”
“না রে বাবা নেই।তুই-ই তো একদিন বলছিলি রিংকি আপুর সাথে আসাদ ভাইয়ের কিছু আছে।বলছিলি না বল?”
“তোদের মাঝে সত্যি কিছু হয়নি? সিরিয়াসলি?”
নিরু এবার ভ্রু কুচকে বলল, “তোর সাথে কি আমি মজা করতে বসেছি?”
“আসাদ ভাই তোকে ভীষণ ভালবাসে নিরু!”
নিরু যেন কিছু শুনলো না। কথাগুলো যেন তীব্র বাতাসের সাথে মিশে গিয়ে নতুন করে আবার ছন্দ মিলিয়ে নিরুর কানে কানে বলতে শুরু করল,”আসাদ ভাই তোকে ভীষণ ভালবাসে নিরু!” নিরু এক প্রকার পাগলপারা হয়ে হন্তদন্ত হয়ে রাহিমাকে জিজ্ঞেস করল, “কে বলল তোকে?কোথায় থেকে শুনলি তুই,মজা করছিস তাই না? ”
“তোর সাথে কখনো মজা করেছি?”
” না!”
রাহিমা বলতে শুরু করল, “কয়দিন আগে রিংকি আপুই বলছিলো প্রথম ভালবাসা তো পেলাম না। কিন্তু দ্বিতীয় ভালবাসাকে অনায়াসেই পেয়ে গেলাম।তাই সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি বিয়ের পিড়িতে বসা।”
নিরু অস্থির হয়ে শুধালো ‘তারপর।’ রাহিমা আবার বলতে শুরু করল।
“রিংকি আপুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।প্রথম ভালবাসা কে? আর না পাওয়ার কারণ কি?জানিস তো রিংকি আপু প্রথম থেকেই আমার সাথে সব কেমন শেয়ার করে।”
“হ্যাঁ তা তো জানি।তারপর বল।”
রিংকি আপুর প্রথম ভালবাসা ছিলো আসাদ ভাই। এডমিশনের পর রিংকি আপু আসাদ ভাইকে প্রপোজ করেছিলো।কিন্তু আসাদ ভাই রিজেক্ট করে দেয়।আর তোর কথা আপুকে বলে।”
“কি বলে আমার কথা?”
নিরুর চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করছে।বুকের ভিতরটা দুপুরের কাঠফাটা রোদের ক্লান্ত পাখি গুলোর মতো ছটফট করছে।একটু পানি খেতে পারলে ভালো হতো।
“আসাদ ভাই তোকে ভালবাসে এইটা বলেছিলো।”
নিরু আর একটা সেকেন্ড ওখানে দাড়াল না।রাহিমাকে শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরে কানের কাছে নিচুস্বরে ‘ভালবাসি’ বলে দ্রুত পায়ে চলে গেল। রাহিমা কিছু বুঝল কিনা জানে না।তবে মুচকি হাসলো।
নিরু বাসায় গিয়ে ব্যাগটা রেখে মামানির ফোনটা হাতে নিলো।আধা ঘন্টা পার হয়ে গেল তবুও আসাদের নাম্বারে ডায়াল করতে পারলো না। তারপর বেশ কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে একটা মেসেজ লিখে পাঠালো।মেসেজটা পাঠিয়ে কতবার যে পড়ল তার হিসেব নেই।মেসেজটা পাঠিয়ে ফোন নিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইল।ফিরতি কোন ম্যাসেজ পেল না।মনিকা খালামণি ফোন করায় মেসেজটা ডিলিট করে মামানির কাছে ফোনটা দিয়ে এলো।একটু ভয় ভয় ও লাগলো আসাদ ভাই যদি কোন মেসেজ দেয়।মামানি যদি দেখে নেয়? নিরু সারাটা বেলা মামানির আশপাশেই ঘোরাফেরা করল।এবং বই নিয়ে ফোনের আশপাশে বসে রইল।পড়ায় তো মন নেই।শুধু বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
এইদিকে আসাদ গোসল থেকে বেরিয়ে রাকিবকে কল দিতে গিয়ে আম্মুর নাম্বার থেকে আসা ছোট একটা মেসেজ দেখে থমকে গেল।ছোট একটা মেসেজ এই মেসেজেই আসাদের পুরো শরীরের রক্ত সঞ্চালন বেড়ে গেল। “আসাদ ভাই আমি আপনাকে মিস করছি।আপনি কবে আসবেন?” মেসেজটা কয়েকবার পড়ে বুকের সাথে ফোনটা শক্ত করে ধরল।যেন নিরুই কানে কানে বলছে, ‘আসাদ ভাই আমি আপনাকে মিস করছি। ‘
আসাদ একটুও দেরি না করে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো।পাঁচটার বাসে রওনা দেবে।রিংকি দুইদিন আগেই ফোন করেছিলো।অবশ্যই যেন তার বিয়েতে যায় বলেছিলো।কিন্তু আসাদের প্রেজেন্টেশন আছে বলে বাহানা করছিলো।যাবেনা ভেবেও রেখেছিলো।কিন্তু এখন আর একটা সেকেন্ড নষ্ট করবে না।দুপুরে না খেয়েই বেরিয়ে পরল।নিরুকে মেসেজ বা কল কোনটাই দেবে না।একবারে সামনে গিয়ে চমকে দেবে।আর কল দিলেও কথা বলতে পারতো না।মেসেজ দিলেও আমিনা বেগম দেখে ফেলার সম্ভাবনা বেশি।তার চেয়ে এইটাই উত্তম হবে বলে মনে করল।
নিরু বার বার ফোন চেক করছে।নাহ আসাদ কোন রিপ্লাই দেয়নি।অস্থিরতায় রাতের খাবারটাও খাওয়া হলো না। আসাদ যদি ব্যস্ততার জন্য ফোন চেক না করে?রাতে দেখে যদি মেসেজ দেয়।এখন কত চিন্তা করতে হচ্ছে।মেসেজ না দিয়ে কল করলেই ভালো করতো বলে মনে হচ্ছে এখন, নিরু বাহানা খুঁজে মামানির সাথে মামানির ঘরেই শুয়ে পরল।যেন রাতে মেসেজ এলেও নিরু বুঝতে পারে।দরকার হয় সারারাত আজ ঘুমাবে না।আজিজুল হক সীতাকুণ্ডের বাইরে গেছে তিনদিন হচ্ছে।নিরু অনায়াসেই শুয়ে পরল।আমিনা বেগম কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলেও নিরু জেগে রইল।
টানা পাঁচ ঘন্টা জার্নি করার পর আসাদ বাড়ি পৌছালো।আসাদ চায় সবার আগে নিরুর সঙ্গে দেখা হোক।কলিংবেল বাজালে আমিনা বেগম-ই দরজা খুলতে আসবেন।আসাদ বুদ্ধি বের করে নিরুর ঘরের জানালায় একটা খোয়া ছুড়ে মারে।নিচুস্বরে বেশ কয়বার ডাকেও কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পায় না।আরেকটা খোয়া ছুড়ে মারার জন্য প্রস্তুতি নিলেই পিছন থেকে কারো হাতের ছোঁয়া পায়।
চলবে…