” আমার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে দিনের পর দিন লুকিয়ে গেছে। বিয়ের সাত-আট মাস পরে বাইরের লোকজনের থেকে শুনলাম সবকিছু। তবুও তাকে কেউ কিছু বললো না। উপরন্তু আমাকে সবাই শুধু একটা কথাই বলে যাচ্ছে, কিছুতেই সংসার ছেড়ে যাবি না। প্রয়োজনে কাজের লোকের মতো পড়ে থাকবি। সেরকমই আছি আমি। তবুও অশান্তির শেষ নেই। ” কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে থামলো অর্পা। আঁখি যুগল ছলছল করছে। অর্পার পাশে মুখ মলিন করে বসে আছে অষ্টাদশী প্রিয়ন্তি। অর্পার একমাত্র মেয়ে প্রিয়ন্তি। এই বয়সে এসে বাবার দ্বিতীয় বিয়ে বিষয়টা মোটেও মানতে পারেনি প্রিয়ন্তি। এলাকার লোকজন প্রিয়ন্তিকে দেখলে কানাঘুষা করে। অনেকে তো মুখের উপর বলে ফেলে,যে বয়সে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কথা, সেই বয়সে বাবা বিয়ে করে বসে আছে! অর্পা ভগ্নহৃদয় নিয়ে ছুটে এসেছে তার পরিচিত বড়ো বোনে আয়াতের কাছে। না উনি কিছু করতে পারবেন না অর্পার স্বামী রেজওয়ানকে। শুধু মন হালকা করার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলছে অর্পা। আয়াত দুই সন্তানের জননী, স্বামী প্রবাসী। ” অর্পা তোমাকে ঠিক কী বলবো বুঝতে পারছি না। যে বয়সে মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবার কথা সেই বয়সে রেজওয়ান এমন একটা কান্ড ঘটালো। তুমি তো আজীবন স্বামীর বাধ্য স্ত্রী হয়ে ছিলে। রেজওয়ান যে এমন কাজ করবে আমরা কেউ ভাবতে পারিনি।” ” আমার মেয়েটা দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে আপু। এই নিয়ে দুই বার রাতে হসপিটালে নিয়ে ছুটেছি। অতিরিক্ত টেনশনে প্যানিক অ্যাটাক হয়েছিলো। ডাক্তার বলেছে সুস্থ পরিবেশে রাখতে হবে মেয়েটাকে। কিন্তু সেই কপাল আমার মেয়ের নেই। ” ” জানো আন্টি আমি যখন প্রচন্ড কষ্টে হাসফাস করছিলাম,বাবা তখন বলেছিলো আমি মরলে না-কি সে বাঁচে। ” প্রিয়ন্তি কান্না আঁটকে রাখতে পারে না। মা’কে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠে। যে বাবা ছোটো থেকে এতোটা ভালোবেসেছে সে আজ অন্য একজন নারীর জন্য তার মৃত্যু কামনা করে ভাবতেই ভেতরটা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। মায়ের উপর অমানুষিক নির্যাতন হতে দেখেও কিছু বলতে না পারার কষ্টে দগ্ধ হচ্ছে হৃদয়। অর্পা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। ” কাঁদিস না প্রিয়ন্তি। নারী হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো ফেতনা। আর সেই ফেতনায় পড়েছে রেজওয়ান। তবে যাইহোক, তোর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াটা দরকার। লেখাপড়া মেয়েদের আত্মনির্ভরশীল করতে সাহায্য করে। ” ” সেইজন্যই তো সবকিছু সহ্য করে আছি আপু। প্রিয়ন্তি পরীক্ষা সামনেই । উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরে দূরে কোথাও চলে যাবো। প্রয়োজনে লোকের বাসায় কাজ করবো। আমার বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থার কথা তো জানেন আপনি। তাদেরই দিন চলে কোনোমতে। আজ যদি লেখাপড়াটা করতাম!” প্রিয়ন্তি মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারে না। মেয়ে হয়ে মায়ের এতো কষ্ট তার সহ্য হয় না। অর্পা আর রেজওয়ান দু’জন দু’জনাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলো। বিয়ের পরেই অর্পার লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছিলো রেজওয়ান। অর্পাও স্বামীর সাথে শান্তিতে সংসার করবে বলে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে ফেলেছিলো। সন্ধ্যা নামার আগেই বাসায় পৌঁছে অর্পা ও প্রিয়ন্তি। বাড়ির বাইরে গেছে জানলে রেজওয়ান কোনোভাবে জানতে পারলে চরম অশান্তি করবে। মনে মনে এসব ভেবে খুব ভয়ে আছে অর্পা। ইদানীং প্রচুর মারধোর করে তাকে। প্রিয়ন্তি বাঁধা দিতে গেলে বাসা থেকে বের করে দিয়ে দরজা আঁটকে মারে অর্পাকে। গ্যাসের চুলো জ্বালিয়ে নুডলস সেদ্ধ করতে গরম পানি বসিয়েছে অর্পা। প্রিয়ন্তি হাতমুখ ধুয়ে বসার ঘরে সোফায় বসে কিটির সাথে কথা বলছে। কিটি প্রিয়ন্তির পোষা বিড়ালের নাম। এরমধ্যেই কলিংবেলের শব্দে নড়েচড়ে উঠে প্রিয়ন্তি। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে। আটটা বেজেছে সবে,এমন সময় তো রেজওয়ান বাসায় ফেরে না। রেজওয়ান রাত বারোটা কিংবা একটার সময় আসে। মাঝে মধ্যে আবার বাসায় ফেরে না ইদানীং। ” প্রিয়ন্তি দরজা খুলে দেখ তোর বাবা এলো কি-না। ” ” যাচ্ছি মা। ” মায়ের কথায় দরজা খুলে দিলো প্রিয়ন্তি। অদ্ভুত ব্যাপার রেজওয়ান এসেছে। প্রিয়ন্তি কিছু না বলে আবারও কিটির পাশে সোফায় গিয়ে বসলো। রেজওয়ান দরজা আঁটকে সোজা শোয়ার ঘরে গেলো। অর্পা ততক্ষণে নুডলস রান্না শেষ করেছে। বাবার চোখমুখ মোটেও ভালো লাগেনি প্রিয়ন্তির। মনে হচ্ছে আজকেও মা’য়ের উপর অত্যাচার করবে! এসব ভেবে বাবার প্রতি তীব্র ঘৃণা অনুভব করে সে। ” অর্পা! অর্পা!” রেজওয়ানের কন্ঠ গম্ভীরতা। অর্পা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা রুমে ঢুকে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ” হ্যাঁ বলো।” ” দরজা আঁটকে এসো।” চকিতে চমকায় অর্পা। হঠাৎ দরজা আঁটকে আসতে বললো কেনো? গত কয়েকমাসে অর্পা নিজের আশেপাশে ঘেঁষতে দেয়নি রেজওয়ানকে। দ্বিতীয় বিয়ে করা অন্যায় নয় কিন্তু প্রথম স্ত্রী’কে না জানিয়ে করা অবশ্যই অন্যায়। তাছাড়া সবকিছুর উর্ধ্বে নিজের মানুষটাকে অন্য কেউ ছুঁয়েছে ভাবলেই এলোমেলো হয়ে যায় অর্পা। যে শরীরে এখন দ্বিতীয় কোনো নারীর স্পর্শ সেই শরীর চায় না সে। অর্পার নিরবতা দেখে রেজওয়ান নিজেই দরজা আঁটকে দিলো। অর্পাকে কিছু বুঝতে দেওয়ার আগেই কোলে তুলে বিছানায় ফেললো। ” তুমি আমাকে জোর করতে পারো না রেজওয়ান। ” ” অবশ্যই পারি। আমার টাকায় এখনো খাওয়া-পরার ব্যাবস্থা হয় তোদের। ” ” এতদিন পরে আমার কাছে কেনো? তোমার দ্বিতীয় স্ত্রী কোথায়?” রেজওয়ান গর্জে উঠে রাগে। অর্পা ততক্ষণে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। সশব্দে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় অর্পার গালে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে অর্পা। রেজওয়ান দরজা খুলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। প্রিয়ন্তি জানে না ঠিক কী নিয়ে ঝামেলা হবে আজ। কিন্তু ঝামেলা যে হবে সে বিষয় নিশ্চিত। হনহনিয়ে বসার ঘর পেরিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যায় রেজওয়ান। বাবা চলে যেতেই দ্রুত পা বাড়িয়ে মায়ের কাছে যায় প্রিয়ন্তি। মেয়েকে দেখে চোখমুখ যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে অর্পা। ” মা বাবা কি তোমাকে মেরেছে আবার? ” ” আরে না। এমনি একটা ফাইল নিতে এসেছিলো।” ” মা আমি ততোটা ছোটো নেই যতটা তুমি ভাবছো। তোমার গালে চড় মারার দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ” প্রিয়ন্তির কথায় চুপসে গেছে অর্পা। মেয়েকে কীভাবে বলবে কীসের জন্য মেরেছে ওর বাবা। দোকানে অনেক লোকজন। রাতের এই সময়ে ভালোই বেচাকেনা হয় এখানে। প্রিয়ন্তির নামেই এই ফাস্ট ফুডের দোকানটা। শহরে আরো দুইটা দোকান আছে রেজওয়ানের। তবে এই দোকানে বেশিরভাগ সময় থাকে সে। রেজা,জায়েদ ও সালমান সামলায় সবকিছু। রেজা প্রিয়ন্তির বয়সী আর সালমান ও জায়েদ অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ে। তিনজনে পালা করে ডিউটি করে দোকানে। রেজওয়ানের কীর্তির সব কথাই জানে এই তিনজন। দোকানে আসা যাওয়া থেকেই আসমার সাথে সম্পর্ক হয় রেজওয়ানের। ব্যাংকে চাকরি করে আসমা। মোটা একটা বেতন আসে মাস শেষে। আর সেই টাকার লোভেই রেজওয়ান বিয়ে করে আসমাকে। আসমা রেজওয়ানের স্ত্রী, কন্যা আছে জানা স্বত্বেও বিয়ে করতে কোনো প্রকার অসম্মতি জানায়নি। রেজা বার্গার তৈরি করছে। এমন সময় রেজওয়ান আসে দোকানে। রেজওয়ানকে দেখে কাজের গতি দ্বিগুণ করে ছেলেটা। দোকানে ঢুকে চুপচাপ বসে থাকে কিছুক্ষণ। আসমা তাকে ঠকিয়েছে। আসমা এক স্বামী বর্তমান থাকা স্বত্বেও তাকে বিয়ে করেছে। রেজওয়ান জানতো আসমা ডিভোর্সি ও এক সন্তানের জননী। কিন্তু আজকে বিকেলে হঠাৎ একজন লোক এসে নিজেকে আসমার স্বামী হিসেবে দাবি করে তার কাছে। এতো মাস ধরে আসমা বলে এসেছে রাতে একসাথে থাকতে পারবে না কারণ তার ছেলে বিষয়টা এখনও মানতে পারেনি। আসমার ছেলে মুয়াজের বয়স মাত্র আট বছর। তাই রেজওয়ানও আসমার কথা মেনে নিয়েছিলো। আসমাকে কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাচ্ছে না রেজওয়ান। বড্ড অর্থলোভী লোক সে। আসমাকে সবটা জিজ্ঞেস করাতে সে রেজওয়ানকে বলেছে তার সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখবে না। ” স্যার, দোকান কি বন্ধ করবো এখন? কাস্টমার তো আসছে না আর।” সালমানের কথায় ভাবনার ছেদ ঘটলো রেজওয়ানের। বিরক্তি নিয়ে বললো, ” বারোটা বাজতে এখনো বাকি পনেরো মিনিট। তারপর বন্ধ করবে। ” ” ঠিক আছে। ” সালমান রেজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে। জায়েদের আজ কাজ নেই। চলবে,
#তোমায়_যবে_পাই_দেখিতে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১