#তোমায়_যবে_পাই_দেখিতে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৩
(প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
লেখাপড়া নিয়ে এতো আশা করা মেয়েটা যদি জানতো তিনদিন পরে তার জীবনে কী অপেক্ষা করছে! রেজওয়ান সেদিন বিকেলেই আসমাকে প্রিয়ন্তির জন্য ছেলে দেখতে বলে। একেবারে পাত্র ঠিকঠাক করে বাসায় সিন্ধান্ত জানিয়ে দেবে বলে ভেবেছে সে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে অর্পাকে ব্যবহার করেই প্রিয়ন্তিকে রাজি করাবে বলে বুদ্ধি দিয়েছে আসমা। রেজওয়ান কতটা স্বার্থপর একটা মানুষ। একবারও ভাবলোনা প্রিয়ন্তি আদৌও বিয়ের রাজি কি-না!
” দেখ আসমান, তোর ডিভোর্স হয়েছে প্রায় আট বছর হয়েছে। বয়স পঁয়ত্রিশের কোটায় চলছে, এখনও যদি বিয়ে না করিস আর কবে করবি বাবা?”
রাতের খাবার খেতে খেতে জাহানারা বেগম তার বড়ো ছেলে আসমানকে উদ্দেশ্য করে উপরোক্ত কথাগুলো বললেন। আসমান ভাবলেশহীনভাবে প্রত্যুত্তরে বলে,
” মা তোমাকে তো কতোবার বলেছি,বিয়ে আর করবোনা আমি। আর যদি করি তাহলে নিজের পছন্দ মতো করবো।”
” হ্যাঁ একবার পছন্দ করে বিয়ে করে তো উদ্ধার করেছো আমাদেরকে।”
বাবার কথায় থমকে গেলো আসমান। চোখমুখ শক্ত করে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। অর্ধেক খাওয়া ভাতের প্লেটে হাত ধুয়ে বসা থেকে উঠে নিজের ঘরের দিকে হনহনিয়ে চলে গেলো আসমান।
” তুমি কি চাও না আসমান সংসার করুক? আমি যখনই বিয়ের জন্য বুঝিয়ে-সুঝিয়ে একটু নরম করি ছেলেটাকে তখনই তুমি এরকম খোঁচা দিয়ে কথা বলো। এতে যে ছেলেটার পুরনো ক্ষত দগদগে হয়ে উঠে সেটা বুঝতে পারো না তুমি? ”
আলতাফ হোসেনকে চোখ রাঙিয়ে বলেন জাহানারা বেগম। আলতাফ হোসেন কিছু বলে না আর। মৃন্ময়ী শ্বশুরের প্লেটে আর এক চামচ তরকারি দিয়ে প্রণয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে। প্রণয় ইশারায় কিছু লাগবে না বলে। প্রণয় আসমানের কনিষ্ঠ ভাই। পেশায় আসমান সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার আর প্রণয় নতুন চাকরি পেয়েছে স্কুলে। এর আগে প্রাইমারি স্কুলে চাকরি ছিলো তার এখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে চাকরি হয়েছে। মৃন্ময়ী গৃহিণী, এক সন্তানের জননী। রাহা সবে হাঁটতে শিখেছে। সারা বাড়ি জুড়ে রাহা ছোটো ছোটো পায়ে হেঁটে বেড়ায়। আসমান রাহাকে খুব ভালোবাসে। জাহানারা বেগম আসমানকে না জানিয়েও অনেক সম্মন্ধ দেখেছে কিন্তু কোনো অবিবাহিতা মেয়েকে আসমানের সাথে বিয়ে দিতে রাজি নয় তাদের বাবা-মা। ঘটক যেসব মেয়ে পায় তারা সবাই ডিভোর্সি নয়তো কোনো দিক থেকে খুঁত সম্পন্ন। কী অদ্ভুত বিষয় তাই না? ছেলে ডিভোর্সি হলেও তারজন্য বউ চাই অবিবাহিত।
” এবার বলো,হঠাৎ করে এভাবে দেখা করতে বললে কেনো? তুমি তো জানো বাবা জানলে অনর্থ হবে! ”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো প্রিয়ন্তি। নিজেদের বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে সে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে তিয়াস। চোখেমুখে তার অদ্ভুত দ্যুতি ছড়াচ্ছে। প্রিয়ন্তি তার সামনে এলেই এমন অদ্ভুত সুন্দর লাগে তাকে। জীবনের সব পাওয়া না পাওয়া সবকিছু ভুলে যায় নিমিষেই। তিয়াসকে চুপ করে থাকতে দেখে এবার কিছুটা বিরক্ত হলো প্রিয়ন্তি। এমনিতেই ঘরে অশান্তির শেষ নেই। তার উপর কেউ দেখে বাবার কাছে বললে সর্বনাশ! ডিসেম্বরের রাত, মোটামুটি ভালোই শীতের প্রকোপ বেড়েছে। গায়ের চাদরটা আরেকটু জড়ানোর চেষ্টা করে প্রিয়ন্তি ফের বলে,
” এই তিয়াস! এভাবে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
” দেখছি আমার প্রিয় অস্থির হলে কতটা সুন্দর লাগে। ”
” তোমার ঢং এর কথা আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না এখন। জানো না এমনিতেই বাসায় অশান্তি! ”
” আঙ্কেল তো অনেক রাতে ফেরে আর আশেপাশে কেউ নেই। ”
” এরমধ্যে একদিন তাড়াতাড়ি ফিরেছিলেন। তাই সাবধানের মার নেই। তোমার কিছু বলার থাকলে বলো অন্যথায় আমি গেলাম। ”
প্রিয়ন্তি চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে উদ্ধত হতেই তিয়াস হাত ধরলো। থমকে গেলো প্রিয়ন্তি,অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তিয়াসের দিকে।
” কথা না শুনেই চলে যাবে প্রিয়?”
” তুমি হাত ছাড়ো। তারপর বলো কী বলবে।”
তিয়াস হাত ছেড়ে দিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
” আমি কাল পাশের জেলায় যাবো খালুর সাথে কিছু গরু নিয়ে। হয়তো সপ্তাহখানেক থাকবো সেখানে। তবে গরু আগেভাগে বিক্রি হয়ে গেলে চলে আসবো। ততদিন তোমার দোরগোড়ায় কেউ বেলি ফুল রেখে যাবে না, তাই সাতটা বেলি একসাথে নিয়ে এসেছি। ”
তিয়াস শার্টের পকেট থেকে ফুলগুলো বের করে প্রিয়ন্তির হাতের মুঠোয় পুরে দিলো। প্রিয়ন্তি মুচকি হাসলো।
” সাবধানে যেও, আসছি।”
তিয়াস আর কিছু বলে না। প্রিয়ন্তির চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ চোখে। কথা হয় না, দেখা হলেও দূর থেকে। তাতেই এতটা পাগল পাগল লাগে মেয়েটির জন্য। সম্ভব হলে আজকেই বিয়ে করে নিজের ঘরে নিয়ে আসতো তাকে। আনমনে হাসে তিয়াস। চুলগুলো উপরের দিকে ঠেলে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে মনে মহা শান্তি নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায় তিয়াস।
দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করতেই চমকে উঠে প্রিয়ন্তি। অর্পা দাঁড়িয়ে ছিলো দরজার ওপাশে। মনে হয় দরজা খুলতেই তার এই অপেক্ষা। প্রিয়ন্তি চোখমুখ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে।
” কী হয়েছে মা? এভাবে পথ আঁটকে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
” তুই ভালো করেই জানিস সেটা। ”
মায়ের থমথমে গলায় চুপসে গেলো প্রিয়ন্তি। কোনোভাবে কি তিয়াসের বিষয় জেনে গেলো মা?
” হিয়ার কাছে গেছিলাম, হঠাৎ করে ডেকে পাঠিয়েছিল। ”
” মিথ্যা কথা বলিস না প্রিয়। তিয়াস ছেলেটা ভালো, দুঃখীও বটে। কিন্তু এখন আবেগে গা ভাসিয়ে দেওয়ার পরিস্থিতি নেই তোর।”
প্রিয়ন্তি মায়ের হাত চেপে ধরে। ছলছল নয়নে বলে,
” আমি আবেগে ভেসে যাইনি মা। আমি বলেছি তিয়াসকে অপেক্ষা করতে। শুধু বন্ধু হিসেবে কথা হয় তা-ও টেক্সটে। কালকে শহরের বাইরে যাবে, ফিরবে অনেক দিন পর। তাই দেখা করতে চেয়েছিলো,এতটুকুই। ”
অর্পা প্রিয়ন্তিকে বুকে জড়িয়ে নিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো বারকয়েক।
” আমি জানি আমার মেয়ে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। তিয়াসের সাথে আমি কথা বলবো। তোর লেখাপড়া শেষ হলে আমি যেকোনো ভাবেই তোর বাবাকে রাজি করাবো। আর সে যদি দ্বিমত পোষণ করে তাহলে তুই তোর নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করে নিবি। তিয়াস ছেলেটা আর পাঁচটা ছেলের চেয়ে আলাদা। ওর জীবনে কষ্ট ছাড়া কিছু নেই। আর যার নিজ অন্তর আঘাতে জর্জরিত সে অন্যকে আঘাত করতে গেলে অন্তত দু’বার ভাববে। ”
” তুমি যা বলবে তাই হবে মা। আমি চাই তুমি সুখে থাকো। আমি চাই না আমার জন্য তোমার অশান্তি আরো বাড়ুক।”
” এতো ভাবিস না তুই। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোর জন্যই তোর বাবার এতো অত্যাচার সহ্য করে আছি। তোর লেখাপড়া শেষ হলে যখন চাকরি করবি,তখন আমরা আলাদা থাকবো।”
” হ্যাঁ, তোমার স্বপ্ন পূর্ণ হবে ইনশাআল্লাহ। ”
মানুষের সব ইচ্ছে পূরণ হয় না। তেমনই ভোরের আলো ফুটতেই প্রিয়ন্তির স্বপ্ন ভাঙার আভাস পায় অর্পা। গতকাল রাতে বাড়ি ফেরেনি রেজওয়ান। কেউ না বললেও অর্পা জানে রাতটা আসমার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে কাটিয়েছে সে। নিজের মানুষটা অন্য কাউকে ছুঁয়ে দিচ্ছে চোখে না দেখেও সারারাত ছটফটিয়ে মরেছে অর্পা। যেদিন প্রথম আসমার বিষয় জেনেছিল অর্পা,সেদিন রাতে রেজওয়ান বিশ্রী কিছু কথা বলেছিলো তাকে। অর্পার শরীরে না-কি আসমার মতে মাদকতা নেই। আসমার মেদ বিহীন উন্মুক্ত উদরের দিকে তাকালে চক্ষু শীতল হয় কিন্তু অর্পার দিকে তাকালে অসহ্য লাগে! কথাগুলো শুনে গা ঘিনঘিন করে উঠেছিলো অর্পার। এমন একটা অমানুষের সাথে এতো বছর কীভাবে সংসার করেছে ভাবতেই নিজেকে নরকের কীট মনে হতো অর্পার। সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত একসাথে রাত কাটায়নি। রেজওয়ান খাটে ঘুমোয় আর অর্পা সোফায়। সকাল হতেই উষ্কখুষ্ক চেহারায় বাসায় ফিরেছে রেজওয়ান। এসেই অর্পাকে জরুরি তলব করে। শুক্রবার বলে প্রিয়ন্তি এখনো ঘুমিয়ে আছে।
” প্রিয়ন্তির বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি আমি। ছেলে ভালো চাকরি করে, টাকাপয়সা আছে। সামনের সপ্তাহে বিয়ে, তোমার মেয়েকে রাজি করানোর দায়িত্ব তোমার। ”
অর্পার মাথার উপর যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। পরিস্থিতি বুঝে উঠতেই বাঘিনীর মতো গর্জে উঠে সে। যার জন্য এতোকিছু সহ্য করে থাকা তার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেবে না অর্পা।
” খবরদার বলছি রেজওয়ান, আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে আর একটা কথাও বলবে না। আমরা প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো তা-ও তোমার পছন্দমতো বিয়ে করবে না প্রিয়।”
” তাহলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। কিন্তু আমার মেয়েকে রেখে যাবি।”
রেজওয়ান কপট রাগ দেখিয়ে অর্পার চুলের মুঠি ধরে ধাক্কা দিলো কয়েকটা। অর্পা ব্যথায় ককিয়ে উঠলো। বাবা-মায়ের চেঁচামেচিতে ঘুৃম ভেঙে গেছে প্রিয়ন্তির। দ্রুত নিজের রুম ছেড়ে বসার ঘরে উপস্থিত হয় সে। কিন্তু এসেই মায়ের উপর এরকম মারধর দেখে পিলে চমকে উঠে প্রিয়ন্তির। ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে যায় তার।
চলবে,
(বেশি বেশি মন্তব্য চাই! অসুস্থ শরীর নিয়েও আপনাদের জন্য লেখি,এতটুকু তো পাওয়া যায় তাই না?)