#তোমায়_যবে_পাই_দেখিতে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৮
(প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
” এসব বলো না আর। আমি ভুল করেছি। মায়ের সুখের কথা ভাবলে মা’কে নিয়ে লোকের বাড়ি কাজ করে খাওয়াই শ্রেয় ছিলো। মা মুখে কিছু না বললেও তার কথায় বুঝেছি আমি কোনো কিছু ঠিক হয়নি তিয়াস। আমি যে নিজেই নিজের জন্য মরে যাচ্ছি। ”
হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে চমকে উঠে প্রিয়ন্তি। আবরিশাম মুচকি হাসে। টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে আছে সে। কে বলবে আজ তার বিয়ের পরে প্রথম রাত? নতুন বরের সাজগোছ নেই তার।
” থামলে কেনো? ক্যারি অন মিনি প্যাকেট। ”
আবরিশামকে বুঝতে পারছে না প্রিয়ন্তি। লোকটা কি রেগে বলছে এসব? না-কি স্বাভাবিকভাবে বললো!
তিয়াস ওপাশে পুরুষালী কন্ঠস্বরের আগমনে অস্থির হয়ে উঠেছে। কোনো কিছু না ভেবেই কেটে দিলো কল। বিছানার পাশে রাখা পানির গ্লাসের সবটুকু পানি এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললো। একুশ বছর বয়সের সবচেয়ে দীর্ঘ রাত কাটাতে চলেছে আজ। কীভাবে কাটবে আজকের রাত! প্রিয়ন্তিকে অন্য কেউ ছুঁয়ে দিবে ভাবতেই আঁতকে ওঠে তিয়াস। শীতের মধ্যেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। শরীর কেমন অবশ হয়ে আসছে যেনো। শোয়া থেকে উঠে বসে কয়েক বার আশেপাশে তাকালো। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসছে।
” আসলে আপনাকে আমি বলতাম সবকিছুই। ”
প্রিয়ন্তি কিছুটা ভীতি নিয়ে বললো। আবরিশাম ততক্ষণে বাতি নিভিয়ে প্রিয়ন্তির পাশে শুয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রিয়ন্তি একইভাবে বসে আছে। ড্রিম লাইটের আলোতে আবছা দেখা যাচ্ছে সবকিছু। লোকটার সমস্ত মনোযোগ তার ফোনের স্ক্রিনে।
” আরে এতো বলার দরকার নেই। তোমার যা ইচ্ছে করো,যেমন ইচ্ছে থাকো। আই ডোন্ট কেয়ার। থাকার হলে কিছুদিন থাকো,তারপর না হয় ডিভোর্স দিয়ে চলে যাবে। আসলে আমার অনেকগুলো গার্লফ্রেন্ড আছে। তাদের মধ্যে থেকেই কাকে রেখে কাকে সামলাবো সেই ভেবে পাই না, বউ সামলানো আমাকে দিয়ে হবে না। ”
খুব স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো বললো আবরিশাম। যেনো বিয়েটা কোনো বিষয় না তার জন্য। প্রিয়ন্তি কী বলবে বুঝতে পারছে না। তার বাবা-মায়ের অশান্তির কথা বলা কি ঠিক হবে? না-কি শুধু তিয়াসের কথা বলবে? হ্যাঁ সেটাই ভালো হবে।
” সমস্যা নেই, আমাকে আপনার সামলাতে হবেও না। আমি তিয়াসকে ভালোবাসি, পারিবারিক অশান্তির জন্য আসমান ভাইয়াকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। ”
আসমানের কথা উঠতেই আবরিশাম কেমন চুপ মেরে যায়। ফোন বালিশের পাশে রেখে কেমন বেদনাময় দৃষ্টিতে প্রিয়ন্তির দিকে তাকায়। কিন্তু অন্ধকারে সেটা বুঝতে পারে না প্রিয়ন্তি।
” তুমি জানো আসমান ভাই কেনো বিয়ে করেনি?”
” আমার তো জানার কথা নয়।”
” অনেক দিন ধরে ভাইয়ের শরীর না-কি খারাপ লাগতো। তাই ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল বিয়ের কিছুদিন আগেই। আর কী কপাল বিয়ের আসরে বসেই জানতে পারে ক্যান্সারে আক্রান্ত উনি। ভাইয়ের এই অবস্থার কথা শুনে তখন আমার মাথা কোনো কাজ করছিলো না। তাই বিয়েতে রাজি হয়ে ছিলাম। ”
প্রিয়ন্তি চুপ করে রইলো। মানুষটাকে না চিনলেও তার পরিণতির কথা ভেবে খারাপ লাগছে তার। আবরিশাম আর কিছু বললো না। প্রিয়ন্তি অন্ধকারে নিজের ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে একটা কম্বল নিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো। কিন্তু এই শীতের মধ্যে ফ্লোরে শোয়া সম্ভব হলোনা বেশিক্ষণ। রুমে একটা সোফা থাকলে খুব ভালো হতো। মনে মনে এসব ভেবে বিছানার এক পাশে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়লো প্রিয়ন্তি।
ইদানীং রেজওয়ানের শরীর ভীষণ দূর্বল হয়ে গেছে। প্রিয়ন্তির বিয়ের একমাস কেটে গেছে এরমধ্যে। তিয়াস আগের চেয়ে স্বাভাবিক হয়েছে কিছুটা। রিক্তার সাথে ভালো বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়েছে তার। প্রিয়ন্তি মাঝে মধ্যে কথা বলে অবশ্য। কিন্তু কেমন আছো, কী করছো পর্যন্তই যেনো কথা শেষ! দু’জন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর একটা সময় যেকোনো একজন কল কেটে দেয় কিন্তু দুইপাশে দুজনেই কান্নায় ভেঙে পড়ে।
দু’দিন হলো রেজওয়ান বাসায় পড়ে আছে। নিজের শারীরিক অসুস্থতার জন্য অর্পাকে ডিভোর্স দেওয়া হয়ে উঠেনি তার। আসমা আগের মতো যোগাযোগ করে না। রেজওয়ান এই শরীরেও ফোনে ঝগড়া করে তার সাথে। ঝগড়ার এক পর্যায়ে আসমা ডিভোর্স দিবে বলে জানায়। তাতে রেজওয়ান অবশ্য কিছু বলে না। রেজওয়ানের অসুস্থতার জন্য সবকিছু কেমন হয়ে গেছে। অর্পা ইদানীং খুব হাসিখুশি থাকে। রেজওয়ানের সামনেই বেশি দেখায় সেসব। রেজওয়ান মনে মনে অবাক হয় তাকে দেখে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে রেজওয়ানকে। কিন্তু কোনো রোগ খুঁজে পাননি তিনি। অগত্যা বাসায় বিশ্রাম নিতে বলেছেন ডাক্তার।
” অর্পা! এদিকে একটু এসো তো।”
রান্নাঘর থেকে রেজওয়ানের জীর্ণশীর্ণ গলার স্বরে এগিয়ে আসে অর্পা।
” বলো।”
” তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও অর্পা। আমি লোভে পড়ে অনেক বড়ো ভুল করেছি। টাকা দিয়ে সবকিছু হয় না। আজ এতদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি অথচ এতো টাকা খরচা করেও কোনো লাভ হলোনা। ”
” তোমাকে ক্ষমা করতে পারবোনা কখনো। তুমি তোমার কর্মের ফল অবশ্যই পাবে। তোমার জন্য আমার মেয়েটার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। ”
রেজওয়ান বিছানা থেকে উঠতে চাইলেও উঠতে পারে না। অর্পা আরকিছু না বলে আবারও রান্নাঘরে চলে যায়। চুলোয় চিংড়ি মাছ রান্না করছে অর্পা। কাজ করতে করতে মুচকি হাসছে সে। অতিরিক্ত টেনশন,কষ্ট,মানসিক অশান্তিতে মানুষ কখনো কখনো স্বাভাবিক চেতনা হারিয়ে ফেলে। তখন সেই মানুষ সব কিছু করতে পারে, সবকিছু!
গত একমাসে আবরিশামকে সবচেয়ে খারাপ লোক হিসেবে মনে হয়েছে প্রিয়ন্তির। সপ্তাহখানেক আগের কথা,বাসায় কিছু বন্ধুবান্ধবীদের নিয়ে এসেছিলো আবরিশাম। দুপুরে সবাইকে খাবার পরিবেশন করার পরে সেফটিপিন নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য অন্য একটা সেফটিপিন আনতে রুমে গেলো প্রিয়ন্তি। কিন্তু দরজায় এসে দাঁড়াতেই দৃষ্টি আঁটকে যায় তার। দেয়ালের সাথে ঠেসে অবন্তীর (আবরিশামের বান্ধবী) ঠোঁটে ঠোঁট রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো আবরিশাম। প্রিয়ন্তি আর না দাঁড়িয়ে দ্রুত নিচে নেমে এসেছিল সেদিন। এর আগে ফোনেও একাধিক মেয়ের সাথে কথা বলতে শুনেছে প্রিয়ন্তি। নিজের রুমে বসে যে ছেলে এসব করতে পারে সে ছেলে বাইরে গিয়ে কী করে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শেষে একটা চরিত্রহীন লোকের সাথে একই ঘরে থাকে ভাবলেও গা গুলিয়ে উঠে প্রিয়ন্তির। সেই থেকে আবরিশামের সাথে কোনো রকম কথা বলেনি প্রিয়ন্তি। সেসব অবশ্য খেয়াল করেনি আবরিশাম। মায়ের সাথে কথা হয় প্রতিদিন। কিন্তু বাবার সাথে কখনো কথা বলে না। রেজওয়ান কিছুদিন ধরে অবশ্য কল করে কিন্তু তবুও কল রিসিভ করে না প্রিয়ন্তি। মা’কে বলেছিলো প্রিয়ম্তি, তার বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে দিতে। তারপর দু’জন শহরে একসাথে থাকবে,প্রয়োজনে টিউশনি করাবে সে। কিন্তু অর্পা রহস্যজনকভাবে শুধু বলে ডিভোর্সের দরকার নেই। বেশিদিন আর সংসার করতে হবে না তাকে। প্রিয়ন্তি মায়ের কথায় ভীষণ রাগ করে। প্রথম থেকেই যদি প্রতিবাদী হতেন তিনি তাহলে আর এতকিছু হতোনা।
” প্রিয়ন্তি তোমার কী হয়েছে বলো তো। কেমন চুপচাপ থাকো সব সময়। ”
বাগানে গাছগুলো দেখছিলো প্রিয়ন্তি। বিকেলের এই সময়টায় গাছগুলোর সাথে সময় কাটাতে ভালোই লাগে তার। আকস্মিক শ্বাশুড়ির কথায় গাছের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে উনার দিকে দৃষ্টিপাত করে।
” কিছু হয়নি তো মা। ”
” কিছু তো হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি আবরিশামের সাথে এখনও তোমার স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি হয়নি। কিন্তু তবুও তো আমার সাথে, আনহার সাথে কথাবার্তা বলতে। এখন তো তেমন কথাবার্তা বলো না। ”
” আপনার ছেলের সাথে আমার পক্ষে সংসার করা সম্ভব না মা। ”
পুত্রবধূর মুখে এমন কথা শুনে মর্মাহত হন জাহানারা বেগম। ভেবেছিলেন বিয়েটা যেমন করেই হোক,এক ছাদের নিচে থাকতে থাকতে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিচ্ছু হচ্ছে না। আগের মতোই সারাদিন বাইরে সময় কাটায় আবরিশাম। রাতেও ফেরে দেরি করে। কোনো টান নেই দুজনের মধ্যে।
” এসব বলে না মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। সময় সবচেয়ে বড়ো ঔষধ। ”
প্রিয়ন্তি কথা বাড়ায় না। কথাগুলো সরাসরি আবরিশামকে বলবে বলে ভাবে। রাতে আবরিশাম ফিরলে প্রিয়ন্তি নিজে থেকেই কথা বলতে শুরু করে,
” আপনার সাথে কথা আছে আমার। ”
” হঠাৎ? সেদিন তো রোমান্টিক সিন দেখে দৌড়ে নিচে চলে গেলে। তারপর আর কথাও বললে না কোনো। ”
সহসাই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো প্রিয়ন্তির। কতবড় অসভ্য!
” আপনার লজ্জা করে না এসব বলতে? ঠিক আছে আপনারা এসব করবেন, কিন্তু এভাবে দরজা খোলা রেখে?”
” এমন করে বলছো মনে হয় কখনো এসব করোনি।”
” না করিনি। আপনাদের মতো শরীর ছুঁয়ে প্রেম আমাদের কখনো ছিলোনা। ”
” হয়েছে হয়েছে। যা বলবে ভেবেছিলে সেটা বলো। এমনিতেই তো এতটুকু মেয়ে তুমি, মিনি প্যাকেট! আবার শরীর ছোঁবে কী?”
” বাদ দিন এসব। আমি ডিভোর্স চাই, আপনি ব্যবস্থা করুন। ”
” ওকে। তবে মা কিংবা বাবা যেনো আমাকে কিছু না বলে। তুমি বলে দিও যে তুমিও চাও না এই সম্পর্কে এগোতে। ”
প্রিয়ন্তি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তারপর সোজা গিয়ে সোফায় শুয়ে পড়ে। প্রথম রাত একসাথে বিছানায় থাকলেও পরের দিন আবরিশামকে দিয়ে সোফা আনিয়ে নিয়েছিলো প্রিয়ন্তি।
” রাত তো দশটার বেশি বেজে গেছে ,এবার তোমার বাসায় যাওয়া দরকার রিক্তা।”
তিয়াস আর রিক্তা পাশাপাশি হাঁটছে। কুয়াশাজড়ানো পরিবেশে প্রিয় মানুষটির পাশে হাঁটতে স্বর্গীয় আনন্দ হচ্ছে রিক্তার। রিক্তার বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। টাকাপয়সার অভাব নেই তাদের। রিক্তার বাবা সরকারি চাকরি করে। তিয়াসের জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করতে বলেছে রিক্তা। কিন্তু সমস্যা হলো এতো কম লেখাপড়ায় চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
” হ্যাঁ যাবো। আপনি সাবধানে থাকবেন। আর রাতের খাওয়াদাওয়ার পরে ঔষধ খেয়ে নিবেন। ”
” ঠিক আছে। এসো।”
রিক্তা বিপরীত দিকে হাঁটে। ড্রাইভারকে কল দিয়ে আসতে বলেছিলো রিক্তা। গাড়ির হর্ন শুনতে পাচ্ছে। তিয়াসের শরীরে কোনো রোগ নেই কিন্তু মানসিকভাবে অসুস্থ কিছুটা। সেজন্য ডাক্তার কিছু মেডিসিন নিয়মিত খেতে দিয়েছে।
চলবে,