স্বচ্ছ_প্রেমের_গল্পকথা #লেখা_চাঁদনী_ইসলাম #পর্ব_১৯

0
539

#স্বচ্ছ_প্রেমের_গল্পকথা
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_১৯

নিরু বিশদিন মতো দাদুর কাছে থেকে সীতাকুণ্ড চলে এলো।আরও কিছুদিন থাকার ইচ্ছে থাকলেও রুমনরা দাদুর বাড়িতে বেড়াতে আসার কারণে নিরু আর থাকলো না। নিরু ভেবেছিলো ফুফুর সাথে কয়দিন থাকবে।ফুফু আসার পরের দিন-ই রুমন চলে আসে।জানালা দিয়ে নিরুর গায়ে একটা চিরকুট ছুড়ে ফেলে নিরুকে ইশারা করে বাইরে ডাকে।এইসব নিরু আসাদকে জানায় না।সেদিন সন্ধ্যাতেই মামার কাছে কল দিয়ে মামাকে নিতে আসতে বলে।আজিজুল হকের সময় ছিলো না বলে বলেছিলেন, ‘দুইদিন পর গেলে হবে না মা?’ নিরুর মন খারাপ হচ্ছে বলে তাড়াতাড়ি আসার জন্য জোড়াজুড়ি করাতে আজিজুল হক নিরুর চাচাকে কল দিয়ে রেখে যেতে বলেন।নিরুর চাচাও ফ্রী ছিলো পরের দিন-ই নিরুকে রেখে যায়।
নিরু নিজের মনে নিজেকে প্রশ্ন করে চলেছে। দাদু বাড়িতে এক মাস শান্তি করে থাকতে পারে না।ফুপিরা সবাই আসলে এক সপ্তাহ থাকা দুর্বিষহ মনে হয়। তাহলে নিরু যদি মামা বাড়ি না থেকে দাদু বাড়ি থাকতো এতোদিনে নিরুর সাথে কি হতো?কয়েকদিনের জন্য গিয়েও কেউ হাত ধরে টানে কাগজ ছুড়ে মারে।আর মামার বাড়িতে আসাদ ভাই? কখনো ঘরে টোকাও দেয়নি।এতো স্বস্তি আর শান্তি নিয়ে থেকেছে। নিরু এখন কাহিনি গুলো মিলাতে বসেছে।আসাদ ভাই কত আগে থেকে পছন্দ করতো ভালোবাসতো কিন্তু নিরুর জন্য যে এতো অনুভূতি আছে তা বুঝতেই দেয়নি।ভালবাসার এতো শক্তি এতো সম্মান?
নিরু আনমনেই হেসে ফেলল।দাদু দিদাকে মিস করলেও এখানে থেকে যেই শান্তিটা পায় অন্য কোথাও এই শান্তিটা নিরু পায় না।

আজ অনেক দিন পর নিরুর বাহারির সাথে দেখা হবে। কত দিন হলো সে বাহারিকে দেখেনি।মামা মামানিদের সঙ্গে ফোনে কথা হলেও বাহারির সাথে একদিনও কথা হয়নি।বাহারিকে আসতে দেখে নিরু দূর থেকেই হেসে উঠল।বাহারি একটা বক্সে করে আইরি সিদ্ধ করে এনেছে।নিরু এইটা আগে কখনো খায়নি খেতে নোনতা নোনতা বেশ ভালো লাগছে ।লবণ দিয়ে সিদ্ধ করা। সবুজ আবরণে ঢাকা লম্বা সরু আইরি গুলোর খোসা ছাড়াচ্ছে আর মুখে দিচ্ছে খেতে বেশ মজা লাগছে।নিরু খোলা ছাড়িয়ে মামানির জন্যও রেখে দিলো।

নিরুর পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পরই আসাদ বাড়ি আসতে চেয়েছিলো।নিরু দাদু বাড়ি যাবে শুনে আসাদ তখন আসেনি।আজ বিকেলেই আসাদ বাড়ি আসছে।আমিনা বেগম ছেলের পছন্দের সব রকম রান্না করে মাত্র রান্না ঘর থেকে বের হলেন।আসাদ ফোনেই বলেছিলো, ‘আম্মু অনেকদিন হলো ছোলার হালুয়া করোনি।এবার বাড়ি গেলে ছোলার হালুয়া বানিয়ে খাওয়াবা তো।’
আমিনা বেগম গোসল করে দুপুরের খাবার খেয়ে হালুয়া বানাতে আবার রান্না ঘরে গিয়েছিলেন।হালুয়া বানানো শেষ করে গরম গরম মসুর ডালের বড়াও বানিয়ে ফেললেন।আসাদের আসার সময় হয়ে গেছে। গরম ভাতের সাথে মসুর ডালের বড়া আসাদের অনেক পছন্দের খাবার।নিরু তো আছেই হাতে হাতে সাহায্য করার জন্য,
আমিনা বেগম নিরুকে বললেন গান কি একবারে ছেড়ে দিলি?আগে তো গুন গুন করতে দেখতাম এখন তো তাও দেখিনা।একটা গান ধর দেখি।তোর মায়ের মিষ্টি গানের গলা ছিলো ঠিক তোর মতো,একটা গান শোনা নিরু।নিরু কাজ করতে করতেই একটা গান ধরল,

“একা বসে তুমি
দেখছো কি একই আকাশ,
দিন শেষে তার তারাগুলো দিবে দেখা।

মেঘে ঢাকা তারার আলো,
দেখে থাকো তুমি, দেখো ভালো।
হয়তো তার মাঝে খুঁজে পাবে আমায়,

সেই দিনে, এক গানে
এক গল্পকারের গল্প খুঁজে পাবে।
খুঁজে পাবে না সেই গল্পকার,

দিনগুলো, খুঁজে পাবে গানের প্রতিটা ছন্দে
শুনতে পাবে মৃত মানুষের চিৎকার

আমার দেহখান, নিওনা শ্মশান
এমনিতেও পুড়ে গেছি
আমার সব স্মৃতি, ভুলোনা তোমরা
যা ফেলে গেছি

দেহ পাশে কেহ কেঁদো না
গল্পগুলো রেখো অজানা
গানখানা থেকে খুঁজে নিও মোর সে গল্প

যাতে লিখা হাজার কষ্ট
নিজেকে ভেবে নিতাম এক শ্রেষ্ঠ
যার প্রতিপদে জীবন বিচ্ছেদের স্বপ্ন।

সেই দিনে, এক গানে
এক গল্পকারের গল্প খুঁজে পাবে
খুঁজে পাবে না সেই গল্পকার

দিনগুলো, খুঁজে পাবে গানের প্রতিটা ছন্দে
শুনতে পাবে মৃত মানুষের চিৎকার

আমার দেহখান, নিওনা শ্মশান
এমনিতেও পুড়ে গেছি
আমার সব স্মৃতি, ভুলোনা তোমরা
যা ফেলে গেছি।”

“এই মেয়ে এই গান কেউ শোনায় মনটাই খারাপ করে দিলি।”

“এই গানটা ভালো লাগে মামানি।”

“গান গাইতে হয় মনের সুখে,তাই সুখী গান গাইবি।সুখী গান শোনাবি।”

নিরু মামানির কথায় খিলখিল করে হেসে উঠল।নিরুর হাসি দেখে আমিনা বেগম নিরুর গাল টেনে দিলেন।

“আচ্ছা এবার থেকে তাই শোনাবো।”

রান্নার সব গুছিয়ে আমিনা বেগম সোফাতে বসতেই কোলিংবেল বেজে উঠল।আসাদ বাড়ি এলে আমিনা বেগমের বুক জুড়িয়ে আসে।বাড়ি আসার কথা শুনলে বার বার গেটের দিকে তাকান আর এইটা ওইটা করেন।আসাদ বের হওয়ার পর পথের মধ্যেই আমিনা বেগম কতবার যে ফোন দেন সেই হিসেব নেই।কতদূর এসে পৌছালো এখনো কতক্ষণ লাগবে আধা ঘন্টা পর পর ফোন দিতে থাকেন।

আসাদের খিদেতে পেটে ছুঁচো দৌড়াদৌড়ি করছিলো।অনেকদিন পর মায়ের হাতের রান্না পেয়ে পেট ভরে ভাত খেলো।আমিনা বেগম ছেলেকে পেয়ে রাজ্যের গল্প শোনাতে লাগলেন। কোন সময় আসাদকে বেশি মিস করেছে। আসাদের জন্য কি কি করে রেখেছে।মামার হাতে যেই খাবার গুলো পাঠায় সেগুলো খেতে পারে কিনা কত শত কথা।আসাদ মায়ের এই অনর্গল কথা বলে যাওয়াটাই বেশি মিস করে।
নিরু আসরের নামাজ পড়ছিলো।আসাদের কথা শুনে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে চোখে চোখে হাসি বিনিময় করলো।আমিনা বেগম নিরুকে বসতে বলে পিরিচে হালুয়া তুলে দিয়ে কেমন হয়েছে দেখতে বললেন।

“মামানি তোমার মতো এতো স্বাদ করে আমি হালুয়া বানাতে পারিনা কেন?”

“তোর মায়ের কাছ থেকে শেখা।তুই এক সময় আমার চেয়েও ভালো পারবি।”

নিরু মায়ের কথা শুনে আজ আর মন খারাপ করল না।চুপচাপ হালুয়াটা শেষ করল।তারপর বলল, “খেতে দারুণ হয়েছে মামানি।”

আসাদ বলল, “আমার জন্য বানিয়েছো আর আমাকেই দিচ্ছো না।”

“ওই দেখ তোর জন্য কখন তুলে রেখেছি।”

আসাদ হালুয়াটা এগিয়ে নিলো।নিরুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ঘোরাঘুরি শেষ?”

আমিনা বেগম মাঝখান থেকে বললেন, “ঘুরতে আর গেল কোথায় শুধু ওর দাদুর কাছেই কয়দিন থেকে এসেছে।দেখি কিছুদিন পর তোর মামাদের বাসা থেকে কয়দিন ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো।”

“আত্নীয় বাসায় গিয়ে কাজ নেই তার চেয়ে ট্যুর দাও।”

“সব জায়গায়-ই যেতে হবে।”

“নিরুর কি এখনো আত্নীয়দের বাড়ি যাওয়া বাকি আছে নাকি?”

“হ্যাঁ ওর ফুফু তো যেতে বলছিলো।”

“ওহ আচ্ছা।”

নিরু এবার বলল, “এখন আর কোথাও যাবো না মামানি।বেশি জার্নি ভালো লাগে না। ”

“আমিও এখন আর কোথাও যেতে দিচ্ছি না।বড় ভাই কতদিন থেকে বলছে ওখানে দুইদিন থেকে আসবো।তোর মামা ছুটি পাবে তখন।

” আম্মু আমাকেও নিয়ে যেও।”

“তোকে এতো বলে তাও তো যাস না।”

“সব সময় তো ইচ্ছে করে না।”

ডাইনিংয়ে খোশ গল্প শেষ করে আসাদ ড্রয়িংরুমে এসে বসল।আমিনা বেগম আসরের নামাজ পড়তে নিজের ঘরে গেলেন।নিরু নিজের ঘরে চলে যাচ্ছিলো।আসাদ নিরুকে ডেকে একটু পাশে বসতে বলল।

” নিরু!”

“হু বলেন।”

” মিস করিস না আমাকে?”

নিরুর একবারে বলতে ইচ্ছে হলো প্রত্যেকটা মুহূর্ত আপনার জন্য আমার বুক পোড়ে।কিন্তু মুখে বলল, “নাহ করি না।”

“তোর চোখ কিন্তু অন্য কথা বলছে।”

নিরু আসাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি মিস করেন আমাকে?”

“পাগলের মতো মিস করি।দেখিস না একবেলা কথা না হলে কি করি।আব্বুকে খুব শিঘ্রই ঢাকাতে পোস্টিং নিতে বলবো।”

“মামা বলছিলো এখনো দেরি আছে। ”

আসাদ টিভি ছেড়ে একেরপর এক চ্যানেল বদলিয়ে যাচ্ছে।

নিরু বলল, “এতো বদলাচ্ছেন কেন?”

আসাদ নিরুর দিকে রিমোট এগিয়ে দিয়ে বলল, “নে তুই কিছু দেখলে দেখ।”

“আমি টিভি দেখিনা।”

আসাদ ড্রয়িংরুমে জানালার দিকে তাকিয়ে নিরুকে বলল, “ইচ্ছে করছে ওই পাহাড়ের চূড়ায় তোকে নিয়ে গিয়ে মন খুলে গল্প করি।তুই আমার সামনে বসে আছিস তাও যেন শান্তিতে তোকে দেখতে পাচ্ছিনা।এমন লাগছে কেন নিরু?”

নিরু এক গ্লাস পানি এনে আসাদের হাতে দিলো। “অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছেন শরীরের মধ্যে খারাপ লাগছে হয়তো। একটু ঘুম হলে দেখবেন ভালো লাগবে।”

আসাদের অস্থির কেন লাগছে আসাদ বুঝতে পারছে না।মনের মধ্যে বড্ড অস্থির লাগছে।আসাদের মস্তিষ্কে হঠাৎ করেই একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।যখন নিরুর বাবা মা ভাই মারা যায়।নিরুকে যখন আসাদদের বাড়িতে একবারে নিয়ে আসে।আসাদের বড় মামা আমিনাকে বলেছিলেন, ‘চিন্তা করিস না নিরু অনেক লক্ষ্মী মেয়ে, মেয়েটাকে দেখলেই মায়া হয়।আর এতিম মেয়েদের ঘরে নিলে ঘর আলোকিত হয়।নিরু তোর কাছে বড় হোক।রোহান ও পড়াশোনা শেষ করুক তারপর একটা সিদ্ধান্ত নেবো।’
আসাদের বড় মামার বড় ছেলে রোহানের সঙ্গে বিয়ে দিবে এমন কিছু বলেছিলেন।এতদিন পর আজ আসাদের মস্তিষ্কে ওই কথা গুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।আসাদের মনে হচ্ছে, “আম্মু মনে মনে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবে না তো?”
হঠাৎ আসাদের এমন দুশ্চিন্তার কারণ কী?আসাদ কি মনে মনে কিছু আন্দাজ করছে?

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here