স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর #লেখা_চাঁদনী_ইসলাম #পর্ব_১২

0
598

#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_১২

ভোর পাঁচটা বেজে ত্রিশ মিনিটে,আসাদরা ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিলো। আসাদ, রাকিব, জনি, আর রিংকি, আসাদদের বাসার সামনে থেকেই বাসে উঠল।রিংকির বান্ধবী সামিয়া সামনের স্টপেজ থেকে বাসে উঠেছে।রাকিব আসাদের পাশের সিটে বসেছে।আসাদ জানালার বাইরে দূর আকাশে তাকিয়ে আছে। রাকিব আসাদকে জিজ্ঞেস করল। ‘এতো আগে যাওয়ার কারণ কী আসাদ?’

_ বাসায় থাকতে ভালো লাগছে না। কয়দিন ঘুরবো।

_ তাহলে রিংকিদের এতো তাড়াতাড়ি আসা?

_ আমি জানি না ভাই।কাল রাতে কল দিয়েছিলো।বললাম আমি আর তুই আগে যাবো।তখন রিংকি বলল আমাদের সাথেই যাবে।আর ওখানে ওর আপার বাসা।আপার বাসাতে থাকবে।তাই আমরা যেদিনই যেতাম না কেন,আমাদের সাথেই যেত।তাই আমি আর কিছু বলিনি।

_ অনিমার সাথে কিছু হয়েছে তোর?

_ ওর সাথে কিছু হলে তো আজ এইভাবে যেতে হতো না। ওই কিছুটাই তো হলো না। না হলো প্রেম,আর না হলো ও আমার।কিন্তু জানিস আসার সময় দেখলাম অনিমা ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলো।আড় চোখে কয়েকবার দেখলাম ও বার বার চোখ মুছছিলো।ওর চোখের জল আমি সহ্য করতে পারিনা।তারপরও কারণে অকারণে শুধু কাঁদে। ওর এই কাঁন্না কিসের জন্য?

_ অনিমাও তোকে পছন্দ করে।

_ না রে দোস্ত।আমাকে নিয়ে কিছু ভাবেও না।

_ তুই আমার কথা মিলিয়ে নিস।

_ এইসব এখন বাদ দে।ভালো লাগছে না।

আসাদের বার বার মনে হচ্ছে নিরু তার সামনে একবারও প্রাণ খুলে হাসে না।আর ওই ছেলেটার সাথে এতো হেসে কথা কেন বলল?নিরুকে হাসানোর জন্য কত কত কান্ড করে তাও তো প্রাণ খুলে হাসতে দেখে না।নিরুর হাসিটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর। নিরু হেসে উঠলে নিরুর পুরো শরীর যেন হেসে উঠে।একদিনই আজিজুল হকের সাথে নিরুকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখেছিলো।আসাদ বিমুগ্ধ হয়ে চেয়ে ছিলো।মনে হচ্ছিলো নিরুর হাসির চেয়ে সুন্দর জিনিস আসাদের জীবনে আর কিছু হতে পারে না। ওই হাসিটা দেখার জন্যই আসাদ কত কিছু করে।কিন্তু প্রাণ খোলা হাসি দেখা হয় না। কিন্তু আজ অপরিচিত একটা মানুষের সামনে নিরু তার সেই সুন্দর হাসিটা হাসলো।আসাদ কোনভাবেই মানতে পারছে না। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে।দিশেহারা লাগছে।নিরুকে শুধু আসাদের জন্যই হাসতে হবে। আসাদ চোখ বন্ধ করে রইল।চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে।

নিরু ছাদ থেকে নেমে ডাইনিংয়ে গিয়ে দেখল।ভর্তার পিরিচটা আছে।কিন্তু পিরিচে কোন ভর্তা নেই। মামানিকে ভর্তাটার কথা জিজ্ঞেস করল।মামানি বলল, ‘এখনো ডাইনিংয়ে যায়নি।’তাই বলতে পারলো না। আসাদ ভাই যেভাবে রুমে দরজা লক করে দিলো আসাদ ভাই তো খাবে না।নিরু আর কিছু না ভেবে নিজের রুমে চলে গেল।
আজ স্কুলে যাবে না। আজ বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকো পার্কে ঘুরতে যাবে।বাহারি সকালে সবজি দিতে এসেছিলো তখনই নিরু বাহারিকে আসতে বলেছিলো, বাহারি কে সঙ্গে নিবে বলে।তাই বাহারি ও গোছগাছ করে চলে এসেছে।বাহারি মেয়েটা দেখতে ভারি মিষ্টি, কোমড় ছাড়িয়ে চুল,গায়ের বরণ ফর্সা। চোখ জোড়া টানা টানা না হলেও মুখের গড়নের সাথে দেখতে ভারি মিষ্টি লাগে।
আজিজুল হক সবাইকে নিয়ে নয়টার মধ্যে বাসা থেকে বের হলো। সাথে দুজন কনস্টেবল ও আছে। বোটানিক্যাল গার্ডেনে বাসার সবার সাথে নিরু এর আগেও একবার গেছে।মাহিয়া আর মনিকার এইবারই প্রথম যাওয়া।মাহিয়া নিরুকে বার বার প্রশ্ন করছিলো।জায়গাটা কেমন এবং কি কি আছে।নিরু খুব সুন্দর করে গুছিয়ে মাহিয়াকে সবটা বলছিলো।

‘বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কে আমরা হেঁটে হেঁটেও যেতে পারি।আবার সিএনজি করেও অনেকেই যায়।হেঁটে গেলে সাত থেকে আট কিলো পর্যন্ত হাঁটতে হবে।এতটা পথ মামা মামানিরা হাঁটতে পারে না। তাই গাড়ি নিয়েই ঘোরে।কিন্তু আমরা প্রথমবার যখন আসি তখন আসাদ ভাইয়ের কিছু ক্লাসমেটরা এসেছিলো।আসাদ ভাই আমাকে নিয়ে তার ক্লাসমেটদের সাথেই হেঁটে হেঁটে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলো।মামা আর মামানি গাড়িতে গেছিলো।
মামা নিষেধ করায়,আসাদ ভাই বলেছিলো। ‘পাহাড় দেখতে এসেছে এডভেঞ্চার না করলে হয়?এই নিরব, কোলাহল মুক্ত বনের মাঝ থেকে হাঁটার অনুভূতিটা মিস করতে চাই না। আব্বু তুমি কিন্তু শিওরলি মিস করবে।’ মামা তখন বলেছিলো। ‘তোমার আম্মুকে একা গাড়িতে রেখে কিভাবে যাই।তোমার আম্মু এতোটা হাঁটতে পারবে না। তোমরাই হেঁটে এসো।’

নিরুর এখনো চোখে ভাসে কিভাবে আসাদ সবটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখিয়েছিলো।সব সৌন্দর্য নিরুকে উপভোগ করিয়েছিলো।সেইদিনটা নিরুর চোখে ভাসছে।

পিচঢালা পথ ধরে সবাই এক সাথে হাঁটছিলো,রাস্তার দু’পাশে গাছের সারি।হাঁটতে হাঁটতে পাখপাখালির কিচিরমিচির শব্দ শোনা।যাওয়ার পথে আখের ক্ষেত দেখে নিরুর জন্য আসাদ আখ চেয়ে নিয়েছিলো।আখ গুলো দেখতে বড় হলেও খাওয়ার উপযোগী ছিলো না। তারপর দশ মিনিট মতো হাঁটার পর বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকো পার্কের মেইন গেটে পৌছায়।গেটে ঢুকতে জনপ্রতি পঞ্চাশ টাকা করে টিকিট কাটতে হয়েছিলো।
নিরু হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। আসাদ নিরুর কাছাকাছি গিয়ে নিরুর সাথেই হাঁটতে হাঁটতে বলল। ‘আজ সুপ্ত ধারা,আর সহস্র ধারা ঝর্ণা দেখবে।আর এই দিকটা দিয়ে চন্দ্রনাথ পাহাড় ও যাওয়া যাবে। ‘
নিরু হাঁটছিলো আর দেখছিলো। এই রাস্তাটা বেশ সুন্দর। রাস্তার দুই পাশে ইট দিয়ে বাঁধানো।যেতে যেতে একটা শিশু পার্ক ও দেখা যায়।আসাদদের ক্লাসমেট সামিয়াকে রাকিব মজা করে বলল। ‘সামনের বছর বাচ্চা নিয়ে এসে এখানে খেলতে দিস দোস্ত।’
সামিয়া হাসতে হাসতে বলল, ‘শুধু আমার বাচ্চা কেন তোর বাচ্চাকেও আমার বাচ্চার সাথে ছেড়ে দিস, এক সাথে ঘুরবে।সাথে তুই ও খেলিস।’
ওদের দুজনের কথায় সবাই হেসে ফেলল।

সোজা গিয়ে এবার সিঁড়ি দেখা যায়। সিঁড়ি গুলোর চেয়ে নরমাল পার্ট থাকলে ওঠা সহজ হয়।সিঁড়িতে কষ্ট হয়ে যায়।সুপ্তধারা ঝর্ণা রাস্তার ডানদিকে পরে।আর সহস্র ধারা ঝর্ণা রাস্তার বামদিকে।সবাই আগে সহস্র ধারা ঝর্ণা দেখতে যায়।এখান থেকে সহস্র ধারায় যেতে দশ থেকে পনেরো মিনিট লাগবে।এইদিকে সিঁড়ি আর অন্যদিকে চন্দ্রনাথ যাওয়ার রাস্তা।সহস্র ধারা এখান থেকে ৫৬৫ ফুট। আসাদ রাকিবকে বলল, ‘৫৬৫ ফুটে কতটা সিঁড়ি হতে পারে আইডিয়া কর।’
রাকিব বলল, ‘আইডিয়া করতে পারছিনা ভাই, যেতে যেতে গুণে তোকে বলছি।’
চারশত সিঁড়ি ক্রস করার পর ঝিরিপথের দেখা পেল।এতক্ষণ নিরুর ভয় ভয় করলেও ঝিরিপথ দেখে সব ভয় উবে গিয়ে ভালো লাগা কাজ করল।
বাকি সিঁড়িগুলো ক্রস করে রাকিব হাফ ছেড়ে বলল, ‘ভাই চারশত ছিয়াত্তরটা সিঁড়ি ক্রস করতে হয়েছে।আবার চারশত ছিয়াত্তরটা সিঁড়ি গুণে গুণে নিচে নামতে হবে। আল্লাহ!’
আসাদ রাকিবের পিঠ চাপড়িয়ে বলল, ধৈর্য আছে তোর,সত্যি গুনেছিস তো?’

_ তোর কি মনে হয়?

আসাদ রাকিবের কাঁধে হাত দিয়ে বলল। ‘আমার ভাই মনে হয় ভাই।’

ঝিরিতে নামার পর সব ক্লান্তি কোথায় যেন উড়ে গেল।শীতল পানিতে পা ভেজাতেই প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল।জলপ্রপাতের সামনে এসে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে। ঝর্ণার পানিতে না ভিজেও শীতল বাতাসে অন্যরকম একটা প্রশান্তি লাগছিল।

সহস্র ধারায় কিছুক্ষণ থেকে সুপ্ত ধারায় যাওয়ার জন্য এগোতে হলো।

সহস্র ধারা ঝর্ণার চেয়ে সুপ্ত ধারা ঝর্ণাটা বড়।সবাই সুপ্ত ধারা ঝর্ণার সিঁড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। ১ কিলোমিটার পাহাড়ি টেইল পেড়িয়ে দেখা মেলে অপরুপ সৌন্দর্যের সুপ্তধারার,সুপ্ত ধারার জন্য নামতে হবে পাঁচশত বিশ ফুট।অনেকটা সিঁড়ি নেমে একটা ঝিরি পাওয়া গেছে। নিরু আসাদকে জিজ্ঞেস করল। ‘আসাদ ভাই আর কতটা হাঁটতে হবে?’

_ ঝিরি পথটা পার হয়ে সামনে যেতে হবে। এই ঝিরি পার হয়ে ঝর্ণা পর্যন্ত যেতে পাঁচ মিনিট মতো লাগবে।

কিছুটা পথ এগিয়ে ঝর্ণার কলকল শব্দে নিরুর বুকের ভিতরটা শীতল হয়ে গেল।কোন কথা মুখে আসছে না।পাঁচ মিনিট হাঁটার পর সুপ্ত ধারা ঝর্ণা দেখে নিরুর চোখ জুড়িয়ে এলো।এতো সুন্দর ও হয়? নিরুর দিশেহারা অবস্থা।ভালো লাগার স্রোত বয়ে যাচ্ছিলো যেন।আসাদের হাতটা শক্ত করে ধরে আসাদ কে বলছিলো। ‘আসাদ ভাই এইদিকে তাকান।দেখেন ওইটার চেয়ে এইটা বেশি সুন্দর, না দুইটাই সুন্দর, একদম অন্যরকম সুন্দর। আমি পুরো মুগ্ধ আসাদ ভাই।আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। এতো সুন্দর কেন?’

‘তুই তো এতো মুগ্ধ হয়ে আমাকে দেখিস না নিরু।এতো মুগ্ধ হয়ে আমাকে দেখলেও তো পারিস।এই পাহাড়ের চেয়েও বিশলতা আছে এই বুকে,এইটা তো বুঝিস না।পাহাড়ের বুক চিরে তো শীতল জলের ধারা নামে।আমার বুকটা যে তোর জন্য খা খা করে।এই বুকটায় এসে তো একটু শীতল করতেও পারিস।একটু শীতল কি করতে পারিস না নিরু?’

আসাদ নিরুর মুগ্ধতায় ভরা চোখ দু’টো দেখছিলো।আর নিরু মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতি দেখছিলো।পাহাড়ের বুক চিরে অঝোর ধারায় কলকল শব্দে গড়িয়ে পড়া জল দেখছিলো।পাহাড়ের দেওয়ালে জন্মানো বুনো গাছপালা শেওলা আর ঘাসের উপর দিয়ে পুরো দমে কলকল শব্দে বেয়ে পড়া জল দেখছিলো।ঘন সবুজ রাবারের মধ্যে দিয়ে জলপ্রপাতের স্রোত নিরুকে মুগ্ধ করে তুলছিলো।নিরু যেন ছবিতে আঁকা কোন দৃশ্য দেখছে।এই আনন্দটা দেখানোর নয়।নিরুর প্রকৃতির মাঝে ডুবে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।নিরু চারপাশে চোখ বুলিয়ে আসাদকে জিজ্ঞেস করল।

– আসাদ ভাই ঝর্ণার উপর স্টিমে উঠা যাবে না?

_ হুম যাবে।

_ আমাকে নিয়ে চলুন।

_ ঝর্ণার উপর স্টিমে ঝুলে ঝুলে উঠতে হয়।এখন অনেক রিস্কি।

নিরু মনটা খারাপ করে ফেলল।উপর স্টিমে যেতে অনেক ইচ্ছে হচ্ছিলো।আসাদ বলল, ‘বাবা যদি শোনে আমি তোকে নিয়ে ওখানে গেছি। আমাকে বাসা থেকেই বের করে দেবে বুঝলি?’

_ মামা কি জানবে নাকি।

_ তোর এস এস সি পরীক্ষার পর ওখানে নিয়ে যাবো।

_ সে তো অনেক দেরি।

_ বেশি দেরি না।

_ আপনি উপর স্টিমে গেছেন?

_ হুম গেছিলাম।পাহাড়ের চূড়া বেয়ে যেতে হয়েছিলো।ঘুরে ঘুরে পেচিয়ে পেচিয়ে নামতে হয়েছিলো।ওঠাটা কঠিন।নামাটা ওতো কঠিন ছিলো না।

_ আপনার কি সাহস।

_ তোর সাহস তো কম না।যেতে চাচ্ছিস।

_ জায়গাটা অনেক সুন্দর।

‘তার চেয়ে সুন্দর তুই নিরু’ আসাদের মনে মনে আওড়ানো কথাটা নিরুর কান পর্যন্ত পৌছালো না।

ওইদিনটা নিরুর জীবনে শ্রেষ্ঠ একটা দিন ছিলো।ঠিক যেন স্বপ্নের মতো। নিরু আসাদকে প্রচন্ড মিস করছে।এতো মানুষের মধ্যেও বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।দম বন্ধ হওয়া অনুভূতি হচ্ছে।যদি পারতো এক ছুটে চলে যেত।অস্বস্তিতে ভরা মন নিয়েই নিরুকে সারাদিন ঘুরতে হলো।খাঁড়া খাঁড়া সিঁড়ি গুলোতে আসাদ কিভাবে নিরুর হাত ধরে রেখেছিলো।ঝিরিপথ গুলোতে কিভাবে হাত ধরে পাড় করে দিয়েছিলো সবটা নিরুর চোখের ভাসছে।আসাদকে এতো মিস কেন করছে নিরু?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here