#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_১৪
“মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখে,
মেঘমুক্ত হোক মন।
জড়তা কাটুক মনের সনে,
আলগা হোক প্রতিটি ক্ষণ।”
ঝলমলে রোদের মতো বাঁধন ছাড়া ঝলমল করছে নিরুর মুখের হাসি।এতো খুশি নিরু বহুদিন হয়নি।আজ যেন অন্যরকম একটা খুশির দিন।আজিজুল হক বাসায় হরেকরকম মিষ্টি এনে বাসাটাই মিষ্টিময় করে ফেলেছেন।আসাদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্স পেয়েছে।আসাদের স্বপ্ন ছিলো জাহাঙ্গীরনগরে পড়বে।আসাদের এই স্বপ্নটা শুধু নিজের জন্য না, নিরুর জন্যও দেখা।নিরুর মা জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রী ছিলেন।ছোট বেলায় নিরু মায়ের মুখে জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসের অনেক গল্প শুনেছে।নিরুর মা আসাদকেও অনেক গল্প শোনাতো।আসাদ তখন বলতো।
“ফুপিমা আমিও তোমার ওখানে পড়বো।”
নিরুর মা তখন হেসে বলতো।
“তাহলে তুমি আর আমি এক সাথে ক্লাস করবো হবে তো।”
আসাদ তখন ভারি মজা পেতো।নিরু যখন পেটে থাকে।একটা প্রয়োজনে নিরুর মা আর নিরুর বাবা ক্যাম্পাসে এসেছিলেন।আসাদ তখন ছোট ছিলো।নিরুর মায়ের সাথে আসার জন্য কাঁন্না করছিলো বলে ছোট আসাদকে নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। আসাদ বড় হওয়ার পর আমিনা বেগম আসাদকে ছোট বেলার গল্প গুলো শোনাতো।আসাদ তখন থেকে স্বপ্ন দেখতো ফুপিমার ওখানেই পড়বে।এই স্বপ্নটা আরও জোড়ালো হলো নিরুর মা মারা যাওয়ার পর।নিরু যখন মন খারাপ করে থাকতো। আসাদ বলতো,”নিরু আমি ফুপিমার ক্যাম্পাসে পড়বো আর তোকে মাঝে মাঝেই ঘুরতে নিয়ে যাবো।চট করে আমার জন্য দোয়া কর তো,যেন চান্সটা হয়ে যায়।”
এইটা ওইটা বলে নিরুকে ভোলাতো।তারপর আসাদের পুরোপুরি টার্গেট হয়ে যায় জাহাঙ্গীরনগরেই পড়বে।আসাদের সাথে সাথে নিরুও স্বপ্ন দেখতো।তাই আজ নিরু ও ভীষণ খুশি।ঠিক আজকের এই ঝলমলে রোদের মতোই!শুধু মা ওখানে পড়তো বলেই কি নিরু এতো খুশি? না আরও কারণ আছে?
আজ বিকেলে আসাদ বাসায় আসবে।আমিনা বেগম আসাদের পছন্দের রান্না গুলো করছেন।হাতে হাতে নিরু সাহায্য করছে।আজ নিরুর মনটা খুবই উৎফুল্ল। সেই কবে তার আসাদ ভাইকে সে দেখেছে।কতদিন হয়ে গেল ওই মুগ্ধকর কন্ঠস্বরটা শোনা হয় না।নিরুর ভিতরটা অস্তির ভাবে ব্যাকুল হয়ে থাকে।নিরু একটু একটু করে উপলব্ধি করতে পারছে আসলে নিরুর মন খারাপটা কিসে হয়।আসাদ নামক জ্বালাতনময় পুরুষটা যে নিরুকে দূর থেকেও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে এইটা বুঝতে দেরি হয়ে গেছে। ক্ষণিকেই আবার ভাবে আসাদ ভাই যদি অন্যকাউকে পছন্দ করে? এইটা ভাবতে গিয়েও নিরুর বুক কেঁপে উঠে।দিকশূন্য হয়ে পড়ে ভাবনা গুলো, এলোমেলো হয়ে যায় ভিতরে জমা সকল অনুভূতি!
নিরু দুপুরের পর থেকে বারবার বারান্দায় পায়চারি করছে।এই বুঝি আসাদ ভাই গাড়ি থেকে নামবে।নিরু জানে আসাদের আসতে বিকেল হবে।তারপরও নিরুর মনে হচ্ছে আসাদ ভাই যখন তখন এসে যাবে।
সেদিন কল কাটার পর, পরের দিন এশার পর আসাদ আবার কল করেছিলো।নিরু একবারে সেদিন ফোনটা ধরেছিলো।
” হ্যালো অনিমা,আম্মু কি করছে রে?”
“মামানি নামাজ পড়ছে।”
“ওহ তুই কি করছিস? পড়াশোনা করছিস তো?”
“হ্যাঁ! ”
“কোন সমস্যা হলে আমাকে জানাবি।কিছু বুঝতে না পারলে তানজিলা আপুকে প্রশ্ন করবি।”
“আচ্ছা।”
“কোন কথা নেই তোর?”
“মামানি নামাজ শেষ করে আপনাকে ফোন দিবে।”
“আমি তোর সাথে কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছি নিরু।”
আসাদের গলাটা কেমন যেন শোনালো।নিরুর মনে হলো। “আসাদ ভাই এতো নরম হয়ে কথা বলছে কেন?”
“আপনার মন খারাপ আসাদ ভাই?”
“আমি তোকে মিস করছি। ”
নিরুর বুকটা অস্বাভাবিক ভাবে কেঁপে উঠল।বুকের মধ্যে জমে থাকা ব্যাথাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হলো।নিরুও যে তার আসাদ ভাইকে বড্ড মিস করে।নিরু বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারলো না।আসাদ আবারও বলল।
“তুই সাবধানে থাকিস।কোন সমস্যা হলে আমাকে জানাবি।মন খারাপ হলে ফোন দিবি।”
“আপনি এই সময় ফোন দেন কেন আসাদ ভাই।আপনি তো জানেন এই সময় মামানি নামাজ পড়ে। ”
“জানি বলেই তো এইসময় দিই।না হলে তো অন্য কোন সময় তোকে পাইনা।ফোন ধরিস ও না।”
“আপনি জেনে শুনে ফোন দেন?”
“তোর তো মনে পড়ে না আমার কথা,আমার খুব মনে পড়ে।তাই বাহানা খুঁজি কথা বলার।সময় বুঝে কল ও দিই।”
সেদিন যে নিরুর এতো ভালো লেগেছিলো বলার মতো না।নিরুর উড়তে ইচ্ছে করছিলো।তাকে আসাদ ভাই মিস করে।ঠিক তার মতোই।এই অনুভূতিটা নিরু খুব যতনে বুকের মধ্যে পুষে রাখলো।
তারপর থেকে প্রতিদিন এশার পর আসাদ কল দিতো।পড়াশোনা বিষয়ক সাধারণ কথাবার্তা হতো।মাঝে একদিন নিরু বলল,
“আসাদ ভাই আপনার এখন পাঁচটা মিনিট ও নষ্ট করা ঠিক না।আর সেই আপনি প্রতিদিন এই সময় দশ মিনিট করে নষ্ট করেন।এইটা কি ঠিক বলেন?”
“মাত্র তো দশ মিনিট। ”
“এই দশ মিনিট ও অনেক কিছু।আপনার এডমিশন না হওয়া পর্যন্ত এত কল দিবেন না। আমি আর ফোন ধরবো না।”
“আমার কথা শুনলে কি তোর রাগ হয়?”
“রাগ হবে কেন?”
“ফোন করতে নিষেধ করছিস।”
“ফোন করতে নিষেধ করছি না।মামানির কাছে আপনি ফোন দিতেই পারেন।তাই বলে প্রতিদিন এই সময়েই কেন?”
“আর দেবো না যা।পড়তে বস।”
সেদিনের পর থেকে আসাদ আর কল দেয়নি।নিরুর ও সাহস হয়নি আসাদকে একবার ফোন করার,এইভাবেই দিন গুলো পার হয়ে গেছে।
“কিরে নিরু গোসল করবি কখন?তিনটা বেজে এলো,আবার ঠান্ডা জ্বর বাঁধাবি?”
“যাচ্ছি মামানি।বারান্দা থেকে কাপড় তুলছিলাম।”
যাচ্ছি বলেও এইটা সেইটা করে গোসলে যেতে চারটা পার করল।নিরু গোসল সেরে বারান্দায় ওড়না মেলতে গিয়ে দেখল।আসাদ আজিজুল হকের গাড়ি থেকে নামছে।নিরুর চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করে উঠল।ওড়না সরিয়ে বাম দিকে এগিয়ে গেল।ওখান থেকে গেটের কাছে ভালো করে দেখা যায়।নিরুর মুখে এক গাল হাসি ফুটে উঠল।গেটের বাইরে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।আসাদের পর জনি রাকিব সহ আরও অনেকেই নামলো।শেষে রিংকি সহ আর একটা মেয়ে নামলো।রিংকি আসাদের দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে আসাদের হাত ধরল।তারপর একটা প্যাকেট দিলো।নিরু আর একটা সেকেন্ড ওইদিকে তাকাতে পারলো না। সোজা রুমে চলে এলো।এতদিন বুকে যেই অনুভূতি পুষে রেখেছিলো তা যেন এক পলকে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল।বুকের মধ্যেটা ফুলে ফেঁপে উঠে চোখের জল হয়ে বেরিয়ে এলো।সারাদিনের এতো আমেজ উৎফুল্লতা সব এক নিমিষেই শেষ।নিরু দ্রুত ঘরের দরজাটা লক করে দিলো।নিরু জানে আসাদ এসে নিরুকে ডাকবে।নিরুর অশান্ত মনটা বলে উঠল, “নিরু তুই তো আশ্রিতা ওইটুকু সহানুভূতি তো আসাদ দেখাবেই।কেন বুঝলি না তুই?”
নিরু বদ্ধ ঘরে কাঁন্নায় ভেঙে পরল।সব দুঃখ যেন একবারে গলা পর্যন্ত ফুলে ফেঁপে উঠল।মা বাবা হারানোর দুঃখ। সদ্য প্রেমে পড়ে মন ভাঙার দুঃখ। সব যেন একত্র হয়ে নিরুকে ভেঙে চুড়ে খান খান করে দিলো।
আসাদ এসে বেশ কয়েকবার নিরুকে ডাকল।কিন্তু নিরু চুপচাপ বসে রইল।কোন কথা বলল না।আমিনা বেগম বললেন। “গোসল করল একটু আগেই,রান্নায় অনেক সাহায্য করেছে।ক্লান্ত লাগছে হয়তো ঘুমাচ্ছে।”
আসাদ ও আর ডাকল না।গোসল সেরে খেতে বসল।আসাদ খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে চলে গেল।
নিরুর কেমন যেন দম বন্ধ লাগছে।এখনো মাথায় তোয়ালে পেচানো আছে।নিরু ঘরের দরজা খুলে ছাদে চলে গেল।দম বন্ধ হয়ে আসছে।এই সময় খোলা আকাশটা নিরুর খুব প্রয়োজন।হঠাৎ করেই শেষ বিকেলে আকাশে মেঘ করেছে।মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে নিরু চেয়ে রইল।মাথায় পেচানো তোয়ালেটা খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।শীতল চোখ জোড়া ওই দূর আকাশের সীমানায় আটকে রইল।পিছনে যে কখন আসাদ এসে দাঁড়িয়েছে নিরু বুঝতে পারেনি।আসাদ ডাইনিংয়ে পানি খেতে এসে দেখে নিরুর ঘরের দরজা খোলা।রুমে না পেয়ে ছাদে এসে দেখে নিরু দাঁড়িয়ে। আসাদের বুঝতে বাকি নেই তার নিরুর মনে মেঘ জমেছে।সেই মেঘ কাটানোর দায়িত্ব তার।সেইটাই এখন করবে।নিরুর মন খারাপের কারণ উদঘাটন করবে এবং মন খারাপ দূর করবে।
নিরুর পিছনে দাঁড়িয়ে ঠিক কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল।
“মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখে,
মেঘমুক্ত হোক মন,
জড়তা কাটুক মনের সনে,
আলগা হোক প্রতিটি ক্ষণ।”
আসাদের কন্ঠ এত কাছ থেকে শুনে কেঁপে উঠল নিরু।ছিটকে কিছুটা পিছিয়ে গেল।একদিকে রাগ অভিমান অন্যদিকে হৃদয় শীতল করা আসাদের কথা।নিরু বুঝে উঠতে পারলো না এখন তার কি করণীয়। চুপচাপ নিচে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।আসাদ পিছন থেকে নিরুর একটা হাত চেপে ধরল।
নিরুর মস্তিষ্কে গেঁথে থাকা,রিংকি আসাদের হাত ধরা ওই মুহূর্তটুকু মনে হওয়ায় নিরুর মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক যন্ত্রণা শুরু হলো।আসাদের হাতটা এক প্রকার জোর করে ছাড়িয়ে নিলো।
“তোর মন খারাপ কেন? ”
“সব কি আপনাকে বলতে হবে।আমার মন খারাপ নিয়ে আপনার সমস্যা কী আসাদ ভাই?”
“এইভাবে কথা বলছিস কেন?”
“এর চেয়ে ভালো ভাবে কথা বলতে পারিনা।”
নিরু চলে যাচ্ছিলো।আসাদ আবারও নিরুর ডান হাতটা টেনে ধরল।
” কি হয়েছে না বললে বুঝবো কি করে রে বাবা।”
“খবরদার আমার হাত ধরবেন না।ছাড়ুন বলছি।”
আসাদ কিছুটা বোকা বনে গেল।হয়েছেটা কী?
“হাত ধরলে সমস্যা কী?”
” আপনার হাত কেন অন্যকেউ ধরবে?”
“আমার হাত আবার কে ধরল।”
“কেউ ধরেনি তাই না?”
“না কেউ ধরেনি।আমার হাত ধরবে কেন?”
“আচ্ছা ভালো। ”
” কি হয়েছে কি তোর?এতদিন পর এলাম আর তুই এমন করছিস।”
নিরুর রাগে অভিমানে শরীর জ্বলে যাচ্ছে।কিভাবে আসাদ ভাই তার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে মিথ্যা বলছে।নিরুর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, “ওই মেয়ে কেন আপনার হাত ধরবে আসাদ ভাই।আমি সহ্য করতে পারছি না।”
নিরুর শীতল টলমলে দৃষ্টি দেখে আসাদের ভয় হতে লাগলো।নিরু এইসব বিলাপ কেন বকছে।কি চলছে ওর মধ্যে?
নিরু আসাদের চোখে চোখ রেখে করুণ দৃষ্টিতে একটাবার তাকালো।তারপর চোখ নামিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে এলো।মনে মনে আওড়ালো,
“আসাদ ভাই আমার সব অনুভূতি আপনি ভেঙে চুড়ে শেষ করে দিয়েছেন।আমাকে পুরো গুড়িয়ে দিয়েছেন।আমি আর একবেলাও আপনার সামনে থাকবো না।”
চলবে….