#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_২৪
আমিনা বেগম সন্ধ্যার পরেই বাড়ি চলে আসেন।নিরু ড্রয়িংরুমে বসে পড়ছিলো। আজিজুল হক নিরুর পড়াশোনার খোঁজ নিচ্ছিলেন,কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা জানছিলেন।আইসিটির কিছু অংক বুঝিয়ে দিলেন।আসাদ ও পাশের সোফায় বসে ল্যাপটপে এস আই এর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখছিলো।তারপর আজিজুল হককে বলল, “আব্বু এই বছর অর্নাস শেষ হয়ে গেলে এই নিয়োগেই এস আই এর মাঠে দাঁড়িয়ে পড়তে পারতাম বলো?”
“পরের মাঠে দাঁড়িও হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ!”
“তোমার ছেলে বলে কথা হতে তো হবেই।কিন্তু ভাবতাম আর্মিতে… ”
“তোমার নিজের যেইটা ভালো লাগবে সেইটাই করবা বাবা।ইচ্ছে হলে ডিফেন্সে ঢুকবা নাহলে অন্যকিছু করবা।”
“ডিফেন্সে ঢোকার তো ইচ্ছে আছে আব্বু।”
“তাহলে এখন থেকেই প্রস্তুতি নাও।আর আমার নিরু মায়ের কি ইচ্ছে আছে?”
নিরু বই থেকে মুখ তুলে বলল, “শেফ হওয়ার ইচ্ছে আছে মামা।”
পাশ থেকে আসাদ বলল, “জানো তো আব্বু তাও আবার সীতাকুণ্ডে রেস্টুরেন্ট দিবে।বিশাল একটা হেঁশেল থাকবে।”
“ভীষণ ভালো আইডিয়া!এমন বিজনেস আইডিয়া এই বয়সে কয়জন ভাবতে পারে?আর নিরুর রান্নার হাতের তো যতই প্রশংসা করি কম হবে।এক কথায় দুর্দান্ত!আমি তো রিটায়ার করেই নিরুর বিজনেসে পার্টনার হবো।কি রে মা নিবি তো?”
“অবশ্যই!তুমি শুধু আমার পাশে থেকো মামা।”
নিরুর এমন সিদ্ধান্তে যে সবাই এইভাবে পাশে থাকবে নিরু ভাবেনি।শুধু ভেবেছিলো আসাদ ভালোবাসে বলে হয়তো সাপোর্ট করে,কিন্তু না আজিজুল হকও প্রশয় দিলেন। নিরু এতে ভীষণ খুশি। নিরু ভেবে নিলো পড়াশোনাটা গুছিয়ে নিয়েই একটা কোর্স করে নেবে।তারপর নিজের স্বপ্নের পথে এগোবে।
নিরুর দ্বিতীয় বর্ষ চলছে।এর মাঝে আনাস মোল্লা বেশ কয়েকটা বিয়ের প্রস্তাব এনেছেন।কোনো না কোনো ভাবে আসাদ সেই ছেলে গুলোর খুত বের করেছে।কোথায় কার দাদা নানার দু’টো বউ সেই লোকের ও দুটো বউ হতে পারে। আগে থেকে রিস্ক নেওয়া যাবে না।নানা বাহানা আর খুত বের করে এখন পর্যন্ত নিজের জায়গা ধরে আছে।নিরু তো মাঝে মাঝেই আসাদের কান্ড দেখে খিলখিল করে হেসে উঠে।
আমিনা বেগম রান্না করছিলেন,গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি দেখে আসাদ আমিনা বেগমের কাছে গিয়ে বলল, আম্মু আজ খিচুড়ি রান্না করো।”
“আজ তো অন্যান্য রান্না শুরু করে দিয়েছি বাবু।এক ঘন্টা পর করে দিচ্ছি।”
“কেউ আসছে নাকি আম্মু?”
“তোর বড় মামা, মামি নতুন বউ আসতে চেয়েছে।”
“ওহ আচ্ছা!আজ খিচুড়ি করতে হবে না আম্মু কাল পরশু করে দিও।”
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।নিরু এখনো কলেজ থেকে ফেরেনি।সকালে আবহাওয়া ভালো ছিলো তাই ছাতা নিয়ে যায়নি।আমিনা বেগম আসাদকে ডেকে বললেন, “বাবু ছাতা নিয়ে এগিয়ে যা মেয়েটা ভিজে যাবে বৃষ্টি বেশি হচ্ছে।”
আসাদ ছাতা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।গাড়ি বের করবে কিনা ভাবতে ভাবতে ছাতা নিয়েই হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে পরল।
এখনো গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।আসাদ গিয়ে দেখে নিরু ক্লাস রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আসাদ হাত উঁচু করে ডাকলো, নিরু আসাদকে দেখে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে এলো।দ্রুত পা ফেলে এসে আসাদের ছাতার মধ্যে দাঁড়ালো।
“এখনো তো জোরে বৃষ্টি নামেনি বাড়ি না গিয়ে দাঁড়িয়ে কেন ম্যাডাম?”
“আমি জানতাম আপনি আসবেন তাই।”
“বৃষ্টিতে ভিজি চল।”
“ভেজা যাবে না।সেদিন জ্বর থেকে উঠলেন।”
“কিছু হবে না চল।”
“ঝুম বৃষ্টি না হলে এই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভেজা যায়?”
“গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতেই ভিজবো।”
“না অন্যদিন ভিজবো। আমার ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব লাগছে।”
“আমি জানি তুই শয়তানি করছিস।”
“আচ্ছা তাই-ই করছি।বাড়ি গিয়ে ভিজবো চলেন।”
“আম্মু ভিজতে দেবে বলে তোর মনে হয়?”
“ভিজতে ভিজতে বাড়ি গেলে আপনাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে বলে আপনার মনে হয়?”
দুজনে কথা বলতে বলতে কলেজ গেট থেকে বেরিয়ে এলো।তারপর আসাদ বলল,
“এখন থেকেই অবজ্ঞা শুরু করে দিচ্ছিস কিন্তু!”
নিরু বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বলল, “অবজ্ঞা কখন করলাম?”
“করছিস তো তুই চোখে কম দেখলেও আমি দেখছি না।আমি সব সময় স্বচ্ছ দেখি।”
“আচ্ছা তাই হলো, চলেন গল্প করতে করতে বাড়ি যাই।আচ্ছা বলুন তো আমাকে নিরু বলে ডাকতেন না কেন?”
নিরুর কথা শেষ হতে না হতেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ছাড়িয়ে ঝুম বৃষ্টি নামলো।আসাদ নিরুর হাত ধরে পাশের টং দোকানটায় গিয়ে দাঁড়ালো।নিরু বলল, এতক্ষণে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিলে কখন চলে যেতাম।অকারণে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করলেন।”
“আমি ঝগড়া করলাম?”
“না আমি ঝগড়া করলাম।”
নিরুর অভিমানী মুখ দেখে আসাদ হেসে ফেলল।আসাদ নিজেই নিরুকে ভিজতে দিতো না। কিন্তু নিরুর এই হালকা শাসন আসাদের খুব ভালো লাগে।নিরু যেইটা নিষেধ করে সেই নিষেধাজ্ঞা বার বার শুনতে ইচ্ছে করে।আসাদ টং দোকান থেকে চা নিয়ে নিরুর হাতে দিলো।নিরু চায়ের কাপটা খোলা আকাশে ধরে কয়েক ফোটা বৃষ্টির পানি নিলো।মোটা মোটা ফোটার পানি চায়ের কাপে পড়ে মিশ্রিত হলো।এই দৃশ্যটা নিরুর এতো ভালো লাগলো আনমনেই হেসে উঠল।
আসাদ নিরুর পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, “এতো সুন্দর করে হাসিস কেন?”
আসাদের কথায় নিরু আবারও হেসে ফেলল।তারপর বলল, “আপনি এতো মুগ্ধ হয়ে দেখেন বলে।”
আসাদ বুকে হাত রেখে ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল, “ইশ!”
নিরু খিলখিল করে হেসে উঠল। রাস্তার মাঝে ঝুম বৃষ্টি, হাতে চায়ের কাপ, আর পাশে প্রিয় মানুষ।নিরুর মনে হলো ‘এর চেয়ে সুন্দর অনুভূতি আর হয় না।’
নিরু আড়চোখে বার বার আসাদকে দেখছিলো।চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নিরু বলল, “বললেন না তো নিরু বলে ডাকতেন না কেন?”
“তোর অসভ্য রুমন ভাইয়ের জন্য।”
“বুঝলাম না।”
“আমি যখন তোর নাম রাখি।তখন থেকে নিরু বলেই ডাকতাম।তারপর যখন তোদের বাড়ি যেতাম, নিরু বলে ডাকতাম, রুমন তখন বলতো অনিমা নিরু, আর আসাদ নাড়ু।আমার রাগ হতো।যখনই নিরু বলে ডাকতাম তখনই রুমন নাড়ু বলে আমাকে রাগাতো।নিরু নামের প্রতি তখন রাগ হতো মনে মনে ভেবেছিলাম, ‘ধুর আর ডাকবোই না।ওর জন্য নিজের নামের বারোটা বাজানোর দরকার নেই।’ তাই আর ডাকতাম না।সবাই ডাকতো শুধু আমি বাদে,তারপর থেকে যখন বুঝতে শিখলাম অনিমা নামের নিরুকে ভালবাসি! তখন ওই নাড়ু নামটাও ভালবেসে নিলাম।মনে হচ্ছিলো তোর জন্য এই পৃথিবীর সবাই আমাকে নাড়ু বলে ডাকলেও আমি আর রাগবো না।”
“নিরু খিলখিল করে হাসতে হাসতে ডান হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরল। ‘ নাড়ু’ বলে আবার হাসতে লাগলো।আসাদ নিরুর দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসে চায়ের কাপে চুমুক দিলো।
বৃষ্টি একটু কমলেই আসাদ নিরুকে নিয়ে বাড়ি যায়।বাড়ি গিয়ে শোনে মাহিয়ার আব্বু অফিসে স্ট্রোক করেছেন।কলিগরা মিলে হসপিটালে নিয়ে যান,খুবই খারাপ অবস্থা।মনিকা ফোন করে কান্নাকাটি করছে।আমিনা আসাদকে এখনই নিয়ে যেতে বলেন।বড় মামা, মামি সবাই যাবে।আসাদ নিজেদের গাড়ি নিয়ে বড় মামা, মামি,আমিনা আর নিরুকে সঙ্গে করে তখনই চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশ্য রওনা দেয়।আজিজুল হক রাতে আসবেন।
নয়’টার আগেই আসাদরা চুয়াডাঙ্গায় পৌছিয়ে যায়।বড় বাজার হয়ে কেদারগঞ্জে বড় মসজিদের পাশেই মাহিয়াদের বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করে।বাড়ির সামনে অনেক মানুষের ভীড়,সবাই খোঁজ নিতে আসছে।বোনের কান্নায় আমিনা বেগম একদম ভেঙে পড়েছেন।মনিকার সামনে যেতেই মনিকা আমিনার বুকে আছড়ে পড়ে।নিরু মাহিয়ার কাছে গিয়ে মাহিয়াকে জড়িয়ে ধরে।নিরুর চোখে নিরুর মা বাবার মুখ ভেসে উঠে।সেই দিন নিরুর বুক ভেঙে কান্না, নিজের পৃথিবীটা শূন্য হয়ে যাওয়া সবটা চোখে ভাসছে।নিরু নিজেকে সামলাতে পারছেনা।মাহিয়াকে জড়িয়ে রেখেই শব্দ করে কেঁদে ফেলল।নিরু জানে আপন মানুষ গুলো হারানোর কি যন্ত্রণা।মাহিয়ার যন্ত্রণাটা নিরুর বুকে গিয়ে লাগছে।মাহিয়াকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে নিরু দাঁড়িয়ে রইল।মনিকা কান্নাকাটি করছে বলে হসপিটাল থেকে কিছুক্ষণ আগে বাড়ি এনেছেন।
ডক্টর বলেছেন বাহাত্তর ঘন্টা না গেলে কিছু বলতে পারবেন না।যত সম্ভব ডান হাত পা প্যারালাইজড হয়ে যাবে।চুয়াডাঙ্গা সরকারি হসপিটালে গিয়ে আসাদরা সবাই মাহিয়ার আব্বুকে দেখে এলো।মাহিয়ার চাচা আতিফ খন্দকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিলেন কিন্তু ডাক্তার এই অবস্থায় নিয়ে যেতে নিষেধ করলেন।সকাল পর্যন্ত দেখতে বললেন।
আজিজুল হক ভোরের দিকে এসে রাজশাহীতে নিয়ে যান।সঙ্গে আতিফ,আমিনা ও মনিকাকে নিয়ে যান।নিরু এখানে কাউকে চেনে না তাই একদম অপরিচিত পরিবেশে আজিজুল হক নিরুকে একা রাখলেন না।আজিজুল হক জানেন নিরু এখন ওর বাবা মায়ের কথা মনে করে ভেঙে পড়বে।কান্নাকাটি করবে।তাই আসাদকে চুয়াডাঙ্গাতেই থেকে যেতে বলে,
নিরুদের দেখে শুনে রাখতে বলল।
নিরু সব সময় মাহিয়ার সঙ্গে সঙ্গে থাকছে।মাহিয়াকে জোর করে দুই এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে দিচ্ছে,পাশে থেকে শান্তনা দিচ্ছে।
মাহিয়াকে সামলানোই যাচ্ছে না। মাহিয়া বাবা বলতে প্রাণ! একজন মেয়ের কাছে তার বাবা যে কি ভালবাসার একটা মানুষ, মেয়েদের কাছে বাবার চেয়ে ভালবাসার মানুষ আর কিছু হয় না।
মাহিয়ার মন খারাপে কান্নাকাটিতে নিরুর ও বুক ফেটে কান্না আসছে।আলগোছে চোখের পানি মুছে নিয়ে মাহিয়াকে বুঝ দিচ্ছে।নিরু এখন ভেঙে পড়তে চায় না।নিরুর যন্ত্রণাটা শুধু নিরুই সহ্য করে যাবে আজীবন!
এমন দিন যেন আল্লাহ শত্রুকেও না দেয়।নিরু বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে স্বাভাবিক হলো।এক জোড়া চোখ ঠিকই দেখলো তার নিরু কিভাবে শক্ত হওয়ার ভান করছে।
আসাদ নিরুকে ডেকে নিজের সামনে দাঁড় করালো।আধো আলোতে নিরুর গালে চোখের জল চিকচিক করছে।আসাদ নিরুর চোখের জল মুছে দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।আসাদের স্পর্শে নিরু ডুকরে কেঁদে উঠল।আসাদ নিরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “নিরু তুই এইভাবে কান্না করলে আমার সহ্য হবে বল?”
“আমি সহ্য করতে পারছিনা আমার আম্মু আব্বুকে এনে দেন।সেদিন কেন আমাকেও নিয়ে গেল না।আমার বুকের মধ্যে চিনচিন করে, আম্মু কি সেইটা দেখে না?”
আসাদ আর কোন কথা বলল না নিরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে,নিরুর মুখটা উঁচু করে চোখের জল মুছে দিয়ে আবার জড়িয়ে রাখলো।
নিরুর সব ভাগ নিতে পারলেও এই যন্ত্রণার ভাগটা আসাদ নিতে পারে না। এই সময়টায় আসাদের সবচেয়ে বেশি অসহায় লাগে।
চলবে….