#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_২৫
এক সপ্তাহ রাজশাহীতে চিকিৎসা করার পর মাহিয়ার আব্বু এখন সুস্থ হয়ে উঠছে, হাত পা প্যারালাইজড হওয়ার যে সম্ভাবনা ছিলো সেইটা কেটে গেছে।গতকাল রাত দুইটার পর বাড়ি এনেছেন।আজিজুল হক রাজশাহী থেকেই ঢাকাতে চলে গেছেন।নিরুর চাচারা দাদুরা রোজ-ই মেডিকেলে দেখা করে যেতেন।সবাই অনেক সাহায্য করেছে।
আমিনা বেগম আজিজুল হককে বলেছেন, সচরাচর আসা হয়না, এখন কয়দিন বোনের বাড়িতে থাকবেন।আজিজুল হক ও সায় দিলেন।কিন্তু আসাদ থাকতে পারলো না, সামনের সপ্তাহ থেকে সেমিস্টার ফাইনাল আসাদকে চলে যেতে হলো।সাথে বড় মামা,মামি ও আসাদের সাথে চলে গেলেন।আমিনা আর নিরু থেকে গেল।
মাহিয়ার আব্বুকে রাজশাহী থেকে বাড়ি নিয়ে আসার এগারো দিন হলো, এই এগারো দিনে মাহিয়ার আব্বু অনেকটায় সুস্থ বোধ করছেন।একা একা উঠা বসা করতে পারছেন।এখন সবাই অনেকটায় চিন্তা মুক্ত।
এই কয়দিনে মাহিয়া প্রাইভেটে যায়নি।সামনে ফার্স্ট ইয়ারের ইনকোর্স পরীক্ষা।মাহিয়া চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে অর্থনীতিতে অনার্স করছে।প্রাইভেট এতো গ্যাপ দেওয়ার কারণে মনিকা মাহিয়াকে তাড়া দিলো পড়তে যেতে,মাহিয়া পড়তে যাওয়ার জন্য গোছাচ্ছিলো নিরুকে দেখে বলল, “আমার সাথে যাবে নিরু?”
“তোমার পড়ার ওখানে?”
“হ্যাঁ সমস্যা নেই চলো,আমাদের শহর ঘুরিয়ে দেখাই।”
আমিনা ও যেতে বললেন, মাহিয়া চলে গেলে একা একা বসে থাকবে।তারচেয়ে ঘুরে আসুক,
নিরু মাহিয়ার সঙ্গে গেল।মাহিয়া আড়াইটার ব্যাচে হসপিটাল রোডে প্রাইভেট পড়ে।নতুন বাজার থেকে অটো নিয়ে কোট মোড় হয়ে হসপিটাল রোডে ঢোকে।নিরু চারপাশটা দেখছে আর মনে মনে ভাবছে, ‘শহরটা সুন্দর।’ নিরুর এইটুকু এসেই ভালো লাগলো।মাহিয়ার তিনটা ত্রিশ মিনিটে পড়া শেষ হয়ে গেল।মাহিয়া প্রাইভেট থেকে বেরিয়ে নিরুকে নিয়ে সামনের দিকে হেঁটে এলো।তারপর নিরুকে শুধালো, “কী খাবা বলো? ফুচকা,না ঝালমুড়ি?”
“আপু তুমি যেইটা খাবে।”
মাহিয়া নিরুর হাত ধরে বলল, “তুমি এতো কিউট কেন?আমি ছেলে হলে নির্ঘাত তোমাকে অন্যকারো হতে দিতাম না।”
মাহিয়ার কথা শুনে নিরু হেসে ফেলল।মাহিয়া আবারও বলল, “এই হাসির কথা না,সত্যি বলছি। ”
“তুমি অনেক বেশি কিউট আপু।”
“ইশ রে! তুমি যদি আমার নিজের বোন হতে তোমাকে সারাজীবন আমার কাছে রেখে দিতাম।এতো মিষ্টি একটা মেয়ে!”
নিরু মৃদু হাসলো।মাহিয়া আবার শুধালো, “এই নিরু তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই?কয়টা প্রপোজাল পেয়েছো গো?”
কথা গুলো বলতে বলতে মাহিয়া কলেজের সামনে ঝালমুড়িওয়ালাকে দেখে নিরুকে উৎসাহ নিয়ে বলল, “নিরু এই মামার কাছে ঝালমুড়ি খেলে তুমি সারাজীবন মনে রাখবে,এতো দারুণ ঝালমুড়ি বানায়।”
মাহিয়া নিরুকে ঝালমুড়ি খাওয়ালো।তারপর হাঁটতে হাঁটতে কবরী রোডে ফুচকা হাউজে নিয়ে গিয়ে ফুচকা খাওয়ালো,ফুচকা খেয়ে বের হয়ে হেঁটেই সোজা বড় বাজারে এলো।নিরুকে সব ঘুরিয়ে দেখালো।তারপর নিউ মার্কেটে ঢুকে দুটো একই রকম হিজাব কিনে নিরুকে একটা দিলো আর নিজের জন্য একটা রাখলো।নিরু ওই দোকান থেকেই কিছু ওড়নার কালেকশন দেখলো।ওড়না গুলোর মধ্যে থেকে একটা ওড়না মাহিয়ার জন্য নিলো।তারপর মাহিয়া নিরুকে নিয়ে নিউ মার্কেট থেকে বের হয়ে গলির মার্কেটের সামনে থেকে দুটো কদবেল কিনে মেখে নিরুর হাতে দিলো।তারপর মাহিয়া সন্ধ্যা পর্যন্ত নিরুকে নিয়ে ঘুরলো।বাড়ি যাওয়ার আগে নিরুকে আখের রস খাওয়ালো।তারপর বড় বাজার থেকে অটো নিয়ে বাড়ির দিকে গেল।
এর মধ্যে আমিনা মাহিয়ার কাছে ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে কখন বাড়ি আসছে।মাহিয়া নতুন বাজার থেকে বাড়ির সবার জন্য চটপটি নিলো।আজ অনেক দিন পর মাহিয়ার ও সময়টা অনেক ভালো গিয়েছে।নিরুর সঙ্গ আর নিজের শহরটা ঘুরিয়ে দেখানো দুটোই মাহিয়াকে আনন্দ দিয়েছে।
নিরু সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে এসে বিছানা গুছিয়ে ফেললো।মাহিয়ায় বিছানা গোছায়, নিরুকে হাত দিতে দেয় না।মাহিয়া এসে বলল, “এই নিরু তোমাকে বলিনা এইসব করবা না, আমি আব্বুকে ঔষধ দিয়ে এসেই তো গোছাতাম।”
নিরু জানালাটা খুলে দিতে দিতে বলল, “সমস্যা নেই আপু।আমি বিছানা গোছাতে পারি।”
তারপর জানালার দিকে তাকিয়েই বলল, “আপু এইদিকে স্কুল কলেজ আছে নাকি?”
মাহিয়া এগিয়ে এসে বলল, “হ্যাঁ মহিলা কলেজ আছে, আর একটা বালিকা বিদ্যালয় আছে।”
“তুমি পড়তে যাও ওইদিকেও একটা কলেজ দেখলাম না আপু?”
“হ্যাঁ ওইটা সরকারি কলেজ, আর এইটা আদর্শ সরকারি মহিলা কলেজ।আমি ইন্টার মহিলাতেই পড়েছি।তোমাকে এক সময় ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো। ”
“তোমাদের শহরটা অনেক সুন্দর আপু।”
“থেকে যাও।”
নিরু মৃদু হেসে বলল, “তাহলে দ্বিতীয় নজরে রাখলাম।”
মাহিয়া বলল, “প্রথম নজরটা ঢাকা রাইট?”
“একদমই না আপু।”
“তাহলে?”
“সীতাকুণ্ড।”
“নজরে রাখার মতোই একটা জায়গা,আমি এখনো মিস করি।”
মনিকা মাহিয়াদের নাস্তা করার জন্য ডাকলো।খাওয়া শেষে বিকেলে কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়, সেই বিষয়ে আলোচনা করলো।মাহিয়ার আব্বু অসুস্থ, বেশি দূর যাবেনা।পুলিশ পার্কটা ঘুরে দেখবে এই সিদ্ধান্ত নিলো।
আসাদ আমিনা বেগমের কাছে ফোন দিয়েছে।ঢাকায় এসে পর্যন্ত দুটো দিন নিরুর সঙ্গে মেসেজে কথা হয়েছে আর একদিন ফোনে কথা হয়েছে।ভীষণ মিস করছে,কথা বলার কোন বাহানা খুঁজে পাচ্ছে না। অনেক ভেবে চিন্তে একটা বাহানা খুঁজে বের করলো।আমিনা বেগমের কাছে কল দিয়ে বলল, “আম্মু নিরুর কলেজে কিছু কাগজ জমা দিতে হবে ওর একটা ক্লাসমেট বলল।নিরুকে ফোনটা দাও রেজিষ্ট্রেশন কার্ড মার্কশীট কোথায় রেখেছে শুনতে হবে।”
আসাদ কথা গুলো একটানা বলে জোরে একটা শ্বাস নিলো।আমিনা বেগম নিরুকে ফোনটা দিলেন, “দেখ তো নিরু আসাদ কিসের কাগজপত্র লাগবে বলছে।”
নিরু ফোনটা নিয়ে হ্যালো বললো।আসাদ দ্রুত বললো ওখান থেকে দূরে যা।
“এসেছি বলুন।”
“কতদিন কথা হয়নি বল আমাকে?”
“গত কাল সকালেই না কথা বললাম।”
“গতকাল সকালে বলেছিস।আর আজ বেলা দুইটা পার হয়ে গেছে,আমার ভালো লাগছে না, দম বন্ধ লাগছে।মনে হচ্ছে কি যেন আমার সঙ্গে নেই।তোকে বলিনা সকালে বিকেলে রাতে মেসেজ দিয়ে রাখবি তোর মেসেজ পেলেও আমি শান্তি পাই।”
“আমি মেসেজ দেওয়ার পর, আপনি মেসেজ দিলে মামানি যদি দেখে নেয় তাই দিই না।”
“আমি তোর মেসেজ পেলেই শান্তি পাবো রিপ্লাই করবো না।কল দেবো সুযোগ পেলে ধরবি,না হলে আম্মুকে দিয়ে দিবি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। কিসের কাগজ জমা দিতে হবে? ”
“প্রেমের কাগজ, কতদিন যেন ওখানে আছিস? উহুম একুশ দিন।একুশ দুগুণে বিয়াল্লিশ। বাড়ি এসে গুণে গুণে বিয়াল্লিশটা চিরকুট দিবি।”
“এতো কেন?”
“আমি কত মিস করছি জানিস?আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।”
“আমার হচ্ছে না, মনে হচ্ছে।”
“তাহলে তোর কষ্টটুকু আমার কষ্টের সাথে জোড়া লাগিয়ে পঞ্চাশটা চিরকুট দিবি।”
“পারবো না, আমি আপনাকে মিস করছি না।”
“আমি পারলে তুই ও পারবি। এই কয়দিনে তোর জন্য একশত তিনটা চিরকুট লিখেছি।”
“কিহ!”
“জ্বি ম্যাডাম,প্রচুর মিস করছি।যদি আরও বেশি মিস করি রাতেই রওনা দিয়ে দেবো।”
“আপনার না পরীক্ষা চলছে?”
“দুদিন গ্যাপ আছে।”
“পরীক্ষার মধ্যে বের হতে হবে না। আর রাত করে তো একদমই না।”
“দেখেশুনে আসবো।”
“চার পাটি দাঁত, আর মোহগ্রস্ত চোখ বের করে বললেও আসা যাবে না।”
“দেখা যাবে,এখন রাখছি।”
“আমি নিষেধ করছি কিন্তু! ”
“সব নিষেধ মানবো,শুধু তোর কাছে আসা নিয়ে কোন নিষেধ মানবো না, বাই!”
নিরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে গিয়ে বসলো।
বিকেলের দিকে বাড়ির সবাই পুলিশ পার্কে ঘুরতে গেল।অল্প এরিয়া হলেও পার্কটা ছিমছাম সুন্দর দেখতে,পার্কের পাশ ঘেঁষে মাথাভাঙ্গা নদী বয়ে চলেছে।পার্ক থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে নদীতে,দৃশ্যটা নিরুর মন কেড়ে নিলো।পুকুর বা নদীতে সিঁড়ি নেমে যাওয়া এই দৃশ্যটা নিরুর খুবই ভালো লাগে।আর পার্কটা খুবই নিরিবিলি, দুপাশে বাধানো রাস্তা, হরেকরকম গাছ,পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। নিরু সিঁড়িতে বসে মাহিয়ার সাথে অনেক কয়টা ছবি উঠালো।শেষ এরিয়ায় বানর আর খরগোশ দেখে এগিয়ে গেল।মাহিয়ার চাচাতো বোন মায়ার হাতে চিপসের প্যাকেট ছিলো।নিরু ওখান থেকে কয়েকটা চিপস নিয়ে বানরকে দিলো।নিরুর মুখে উচ্ছল হাসি, এই দৃশ্যটা মাহিয়া এক পাশ থেকে ক্যাপচার করে নিলো।
রেড চিলি রেস্টুরেন্ট থেকে রাতের খাবার খেয়ে সবাই বাড়ি গেল।বিকেল থেকে পুরো সময়টা সবাই খুব উপভোগ করেছে।সবাই একত্র হয়ে খাওয়া দাওয়া ঘোরাঘুরির মজাই অন্যরকম। একটা বিপদ কাটিয়ে উঠে এমন একটা দিন পেয়ে সবাই খুবই উৎফুল্ল!
পরের দিন পরীক্ষা দিয়ে এসে আসাদ আমিনার কাছে কল দিয়ে বলে, “আম্মু খাওয়ার খুব সমস্যা হচ্ছে আর থেকো না,বাড়ি একদম ফাকা হয়ে আছে।”
“তোর আব্বু আসতে পারে কবে শুনি।আমি তো বাসে উঠতে পারিনা শরীর খারাপ হয়ে যাবে। বাসে গেলে নিরু একা সামলাতে পারবে না।”
“আব্বুর এখন সময় নেই,আমি এখন নিতে আসি?”
“এই রাতে গাড়ি নিয়ে বের হবি?”
“সমস্যা নেই,সাথে রাকিবকে নেবো।দুজন মিলে চালাবো।”
“কাল ভোরে আসিস বাবু।”
“কাল গেলে সময় হবে না পরীক্ষা চলছে।আজকেই আসি রাকিব থাকবে।
“আচ্ছা তাহলে সাবধানে আয়।”
চলবে…