#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_২৮
আমিনা বেগম আজিজুল হককে ডেকে ফ্রেমটা দেখার জন্য এগিয়ে দিলেন।আজিজুল হক ফ্রেমটা দেখে উৎসুক চোখে আমিনার দিকে তাকিয়ে রইলেন।আমিনা বেগম আজিজুল হকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আসাদ নিরুর সাথে সম্পর্কে গিয়েছে?”
আজিজুল হক ছবিটা হাতে নিয়ে বসে পড়লেন।নিজেকে ধাতস্থ করে বললেন, “দুজনকে দেখে এমনটা তো কখনো মনে হয়নি।”
“নিরুকে ডাকবো?”
“নিরুকে ডেকে কি বলবা? এমনও তো হতে পারে নিরু কিছু জানে না,আসাদের ভিতরেই আছে।দেখো না হয় এমনই হবে,নিরু এইসব কিছু জানে না।”
আমিনা বিরস মুখে বললেন, “তাই-ই যেন হয়,এই নাও চাবি।”
আজিজুল হক চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।আমিনা বেগম রান্না ঘরে গেলেন,শত চিন্তায় মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।আমিনা বেগম মনে মনে ভাবছেন, ‘এমন কিছুর সম্মুখীন যেন না হতে হয়।’
নিরু রান্না ঘরে এসে বলল, “মামানি রান্না হয়নি?তুমি গোসলে যাও, আমি বাকিটা করে দিচ্ছি।”
আমিনার নিরুর দিকে একবার তাকিয়ে কেমন যেন লাগলো।নিরুর মুখটা যে এতো মায়াবী, আমিনা বেগম নিরুকে ভিতর থেকে খুবই স্নেহ করেন।আমিনা বেগমের ও মনে হচ্ছে নিরু কিছু জানে না।
আমিনা বেগম চুলা বন্ধ করে বললেন, “রান্না শেষ হয়ে এসেছে,ভাজি করলে হয়ে যাবে।”
“তুমি গোসল করে নামাজ পড়ে নাও,আমি ভাজি করছি।”
আমিনা বেগম নিজের অস্বস্তি লুকিয়ে, নিজেকে শান্ত করে গোসলে গেলেন।আমিনা বেগম বেশি চিন্তা নিতে পারেন না,অসুস্থ হয়ে যান।যেকোন কিছু হলে অতিরিক্ত ভেবে ফেলেন।
সন্ধ্যার পর থেকে এই ব্যাপারে আজিজুল হকের মাথা অর্ধেক নষ্ট করে দিয়েছেন।বার বার বলেছেন, ‘আমি যেমনটা ভাবছি, এমন কিছু হবে না বলো?’
আজিজুল হক ঠিক ততবারই অভয় দিয়েছেন।আমিনাকে বুঝিয়েছেন এমন কিছুই হবে না।তারপর থেকে আমিনা শান্ত হয়ে আছেন।
আসাদ ভাইবাতে টিকে গেছে,একটু আগে মেসেজ এসেছে।যখন মেসেজ আসে আসাদ বাড়ির বাইরে ছিলো, মেসেজ পেয়ে আজিজুল হককে আগে জানালো।আজিজুল হক আমিনাকে ডেকে সুখবর শোনালেন,দুজনে দারুণ খুশি।
তানজিলা গত পরশু ঢাকাতে এসেছে,বিকেলে আসাদদের বাড়ি এসে নিরুকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে গেছিলো।তানজিলা বেড়ানো শেষে, নিরুকে দেখানোর জন্য বোনের বাড়িতে নিয়ে গেছিলো।তানজিলার বড় বোন বন্ধুসুলভ, খুবই ভালো মনের একজন মানুষ! নিরুকে না খাইয়ে ছাড়লো না।মাগরিবের আযান হয়ে যাওয়ায় তানজিলা আসাদকে ফোন দিয়ে বলে নিরুকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, আসাদ বাইরেই ছিলো। তাই কিছুক্ষণের মধ্যে বাইক নিয়ে তানজিলার বোনের বাড়ি থেকে নিরুকে নিয়ে আসে।
নিরু এখনো খবরটা জানে না,তাই কিছুটা পথ এসে বাইক থামিয়ে আসাদ রাকিবকে একটা মেসেজ করে।নিরু বাইকের পিছনে বসে আসাদের শার্টের কলার ঠিক করে দিয়ে বলে, “এখানে থামলেন কেন?”
“তোকে ডাকাত দিয়ে ধরিয়ে দেবো তাই।”
নিরু আসাদের কাঁধে চিবুক রেখে বলল, “তাহলে সারাজীবন কার হাসি মুখ দেখার জন্য অবাক চোখে তাকিয়ে থাকবেন শুনি?”
“কার আবার আমার বউয়ের হাসি মুখ।”
নিরু মুখটা কাচুমাচু করে ফেলল।আসাদ নিরুর হাতটা টেনে আঙ্গুল গুলো নাড়তে নাড়তে বলল, “ডাকাতের কাছ থেকে আমিই কিনে নেবো, হবে না?”
নিরু অভিমানী মুখ করে বলল, “ধরিয়ে দিয়ে আবার কেনার কী দরকার?”
“তোর চোখ,তোর মুখের হাসি, তোর শরীরের নিজস্ব গন্ধ এইসব ছাড়া আমি শূন্য তাই দরকার,বুঝলি?।”
নিরু আসাদের কাঁধে একটা কামড় দিয়ে বলল, “শয়তানি বেশি হয়ে যায়।”
“উফ!লাগে না?”
“আমার ঠোঁটে তো দামী মিষ্টি মধু লেগে থাকে,মধুতে কী লাগে?”
“দিলি তো দাঁত বসিয়ে,এখানে ঠোঁটের মধু কোথায় থেকে এলো?”
“ঠোঁটের নিচে দাঁত থাকে,ঠোঁটের মধু দাঁতেও লাগে।তাই ব্যাথা লাগার কথাও না।”
“বুলি ফোটার ক্লাস করলি কোথায়?আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিস।”
নিরু উৎসাহ নিয়ে বলল, “মিস্টার আসাদ অসভ্যতা কোচিং সেন্টারে।”
নিরুর কথায় আসাদ হো হো করে হেসে উঠল,ঠিক তখনই রাকিবের মেসেজ এলো। রাকিবের মেসেজ পেয়ে নিরুকে নিয়ে আসাদ রেস্টুরেন্টে গেল।রাকিব আর আসাদের দুটো বন্ধু রেস্টুরেন্টের ভিতরেই দাঁড়িয়ে ছিলো।রেস্টুরেন্টের একটা কর্ণার অল্প সময়ে খুব সাধারণ ভাবে সাজানো হয়েছে।আসাদ এসে রাকিবের পেটে একটা আলতো করে ঘুষি দিয়ে বাকি বন্ধুদের জড়িয়ে ধরলো।নিরু এতক্ষণ আসাদের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো।রাকিব নিরুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ফুলের তোড়াটা আসাদের হাতে দিলো।
আসাদ হাঁটু গেড়ে বসে, নিরুর দিকে এক হাত দিয়ে ফুলের তোড়াটা বাড়িয়ে, অন্যহাত সামনে রেখে বলল, “উইল ইউ ম্যারি মি নিরু! আমি বলবো না এই ছোট জীবনে আমি তোকে চাই।বরং,আমি বলছি এই বিশাল জীবনটায় আমি তোকে চাই নিরু,আমি এই জীবনকে ছোট জীবন ভাবি না।চলার পথে কতরকম বাধা আসবে,হোচট খেতে হবে,দুঃখ হবে,কষ্ট হবে।সুখ আসবে আবার অনেকটা দূরেও থাকতে হবে। যেই জীবনে এতো কিছু ঘটবে সেই জীবনকে কি ছোট জীবন বলা চলে বল? আমি মনে করি এই জীবনটা বিশাল একটা জীবন,আমার এই অধিক সময়ের জীবনটায় তোকে আজন্মের মতো নিজের করে চাই।তুই সারাজীবনের জন্য আমার হয়ে যাবি নিরু?”
নিরু অপলকভাবে আসাদের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। আসাদ শুধু বলে নিরুর চোখে মায়া,কিন্তু আজ নিরু দেখলো,এই সুপুরুষের চোখে সাগর পরিমাণ মায়া।নিরু আসাদের এক হাত শক্ত করে ধরে অন্যহাত দিয়ে ফুলের তোড়াটা নিতে নিতে ঘাড় নাড়িয়ে, ‘হ্যাঁ!’ বলল।আসাদ উঠে নিরুর পাশে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে মেসেজটা নিরুকে দেখালো।রাকিবরা খাবার অর্ডার দিতে গেছে।নিরু মেসেজটা দেখে আনন্দে আত্নহারা, রেস্টুরেন্ট না হলে নিরু আসাদের গলা ধরে ঝুলতো এতটাই খুশি নিরু।
“নিরু তুই খুশি হয়েছিস?”
“ভীষণ খুশি হয়েছি,খুশিতে মনে হচ্ছে পাগল পাগল লাগছে।”
আসাদ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল, “ওয়ারেন্ট অফিসারের বউ হয়ে পাগল পাগল লাগলে হবে?”
নিরু আসাদের হাতটা নিয়ে আসাদের হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে নিজের হাতের আঙ্গুল গুলো রেখে বলল, “আমরা বিয়ে করছি কবে?”
“এখনই করবো চল।”
“আমি মজা করছি না কিন্তু! ”
“আমি মজা করলে তোকে এখন প্রপোজ করতাম।ট্রেনিংয়ে যাওয়ার আগেই বিয়ে করে রেখে যাবো।আমি থাকতেই যা অবস্থা হয়,চলে গেলে ভরসা নেই।”
খাবার চলে আসায় সবাই মিলে খেয়ে নিলো।খেতে খেতে আসাদের ট্রেনিংয়ের বিষয়ে গল্পগুজব হলো।খাওয়া শেষ করে আসাদ আর বসলো না বের হয়ে গেল।বেশি রাত করে নিরুকে নিয়ে বাড়িতে ঢোকা যাবে না।
“নিরু তোর ভয় করছে না?”
“ভয় করবে কেন?”
“এই যে রাত হয়ে গেল।”
“আপনি সাথে আছেন, আমার ভয় কিসের?মামানি বকতে পারে,এইটা ছাড়া ভয় নেই।”
“আজ আম্মু বকবে না,কত খুশি দেখবি।চাকরি হয়ে গেছে বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছি।”
“আস্তে চালান,এই রাস্তাটুকু ভালো না।”
“চল লং ড্রাইভে যাই?”
“আমাকে বাড়িতে রেখে আসেন,তারপর যান।”
“তুই ছাড়া কোথাও গিয়ে শান্তি পাই না।”
নিরু হাত উঁচু করে আসাদের চুল গুলো নেড়ে দিলো।আসাদ নিরুর হাতটা নিয়ে উল্টো পিঠে একটা চুমু খেলো।বাড়ির মধ্যে ঢুকে বাইকটা পার্ক করে রেখে,আসাদ কলিংবেল সুইজ চাপলো।নিরু ফুলের তোড়াটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ছিলো।আসাদ নিরুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাকে কোনদিন এইভাবে জড়িয়ে ধরেছিস?”
নিরু আসাদের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে ফুল গুলোতে চুমু খেলো।আর আসাদ এগিয়ে এসে টুপ করে নিরুর গালে একটা চুমু দিলো।এই দৃশ্যটাই আমিনার চোখে পড়লো।কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে আমিনা বেগম দরজা খুলতে এসে, দরজার ফুটো দিয়ে দেখে কে এসেছে।কারণ আজিজুল হোক বাড়িতে নেই, মিষ্টি কিনতে বের হয়েছেন।তাই আমিনা বেগম দেখে দরজা খুলছিলেন।এই দৃশ্যটাতেই আমিনা বেগমের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গেল।
চলবে…