#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_৪৩
নারী কূলে রচিত মায়া,
কত কূলহীন প্রত্যাখ্যান।
প্রেমময় নিরাশায় ভরা,
আকুল আহবান!
বাশঁবাড়িয়া সমুদ্র সৈকতের বেড়িবাধের শেষ অংশে নিরু আর আসাদ দাঁড়িয়ে আছে।একরাশ মন খারাপ নিয়ে সমুদ্রের স্রোতের দিকে নিরু নিষ্পলক চোখে চেয়ে আছে।মাহিয়ার এই পরিনতির কথা নিরুর অজানা ছিলো।নিরু আসাদের সাথে পুরোপুরি যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার মাসখানেক পর থেকে,মনিকা আমিনার সাথে আসাদ আর মাহিয়ার বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা এগোতে বলে।আমিনা অনেক বোঝানোর পরেও আসাদ মানতে নারাজ ছিলো।আসাদের সিদ্ধান্ত থেকে আসাদ এক পা পিছায়নি।তার মধ্যে মাহিয়া একদিন নিজ থেকে আসাদকে প্রপোজ করে।এতকিছুর পরও মাহিয়া জানতো না আসাদ আর নিরুর মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে।
আসাদ ভেবেছিলো মাহিয়া সব জানার পরেও নিজের ভালবাসাটুকুই ধরে রাখতে চাচ্ছে।অন্যের অনুভূতি,ভালবাসা মাহিয়ার কাছে খুবই স্বাভাবিক জিনিস,তাই আসাদ মাহিয়ার সাথে আর কোন কথা বলেনি।সেদিনের পর থেকে মাহিয়ার কল মেসেজ এড়িয়ে গেছে।
আসাদ যেদিন আয়েশা আর নিরুর হলুদ সাজে ছবি দেখেছিলো।তার দু’দিন পর নতুন একটা নাম্বার থেকে মাহিয়া আসাদকে ফোন দিয়েছিলো।আসাদ সেদিন কিছুটা উচ্চস্বরেই বলেছিলো,
“তোরা আমাকে কয়টা দিন ছেড়ে দে প্লিজ!এতো মানসিক যন্ত্রণা আমি আর নিতে পারছি না। বড্ড ক্লান্ত আমি,আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তোদের এই একেক জনের মনে একেক রকম আমাকে নিয়ে খেলা বন্ধ কর।আমি আর এইসব নিতে পারছি না।একদিকে আম্মু,একদিকে খালামণি, একদিকে নিরু আমাকে শেষ করে দিলো,আরেক দিকে তুই,আর কি চাস তোরা? আমি তো শেষ হয়েই গেছি।আর তো কিছু বাকি নেই,আমাকে আমার মতো ছেড়ে দে প্লিজ! তোদের কাছে হাতজোড় করি।”
মাহিয়া সেদিন আসাদের কথার পিঠে কিছু বলেনি।ফোন কেটে দিয়ে মনিকার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।মাহিয়ার চোখে জল টলমল করছে,বুকে তীব্র ব্যাথা। মাথার মধ্যে অস্বাভাবিক যন্ত্রণা।মনিকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শীতল কণ্ঠে মাহিয়া মাহিয়ার আম্মুকে শুধালো,
“আম্মু আসাদের সাথে নিরুর সম্পর্ক আছে তাই না?”
মনিকা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “হ্যাঁ ছিলো,অল্প বয়সে ভুল করেছে।নিরু এখন আর তোর খালামণির কাছে থাকে না। নিরুর দাদুর কাছে থাকে।”
মাহিয়া স্মিত হেসে বলল, “আমার ও তো অল্প বয়সে ভালবাসা,এইটাও ভুল তাই না আম্মু।”
“তোর ভালবাসা ভুল হবে কেন? না বুঝে ওরা অনেক আগে থেকে সম্পর্কে জড়িয়েছে।এইটা ভুল।”
“ওদের সম্পর্ক যেমন অনেক দিনের,ভালবাসার গভীরতাটাও অনেক আম্মু।”
মনিকা কিছু বললো না।মাহিয়া একটা সময় পর উচ্চস্বরে বলল, “তুমি আমাকে আগে কেন জানাওনি আম্মু,আগে জানলে আমার এই অনুভূতির কথা আসাদকে জানিয়ে আসাদের কাছে এতো নিচু হতাম না।আমি অনেক আগে থেকে দূরে সরে আসতাম।তোমাদের এইসব বিষয়ে কথা বলতে দিতাম না। তুমি আগে কেন বলোনি?”
মাহিয়া চিৎকার করতে করতে মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরে রইল।মাহিয়ার চারপাশ যেন ঘুরছে,মাথার মধ্যে প্রচন্ড যন্ত্রণায় তোলপাড় করছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই মাহিয়া ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো।মাহিয়ার জ্ঞান ফিরে দেখে হসপিটালে ভর্তি,পাশে মনিকা বসে আছে।মনিকা টলমল চোখে মাহিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মাহিয়ার চোখের কোন ঘেঁষে জল গড়িয়ে পড়ছে।মনিকা মাহিয়ার চোখ মুছিয়ে দিলো।মাহিয়ার মাথা ব্যাথা করছে,দু’হাতে মাথাটা চেপে ধরে আছে।এই চিল্লাচিল্লি এতো মানুষজন মাহিয়ার একদম সহ্য হচ্ছে না। বিকেলের মধ্যে মাহিয়াকে বাড়িতে নিয়ে চলে এলো।
কিন্তু কে জানছিলো এই একটু একটু করে মাথা ব্যাথাটায় কাল হয়ে দাঁড়াবে।মাঝে মাঝেই মাথা ব্যাথা করতো, সাধারণ ব্যাথা ভেবে যন্ত্রণাটা এড়িয়ে গেছে।ফার্মেসী থেকে ঔষধ এনে খেয়েছে।সামান্য যন্ত্রণায় ভেবে এসেছে।সেই একটু একটু হওয়া যন্ত্রণাটা এখন ব্রেন টিউমারের রুপ নিয়েছে।মাসখানেকের মধ্যেই অ’সুস্থতা বেগতিক রুপ ধারণ করেছে।
চার মাস ভু’গে মাহিয়া মা’রা যায়।
মাহিয়া অ’সুস্থতার সময়ে মৃ’ত্যুর এগারো দিন আগে আসাদকে ফোন দিয়ে বলেছিলো, “আসাদ আমি জানতাম না,তোমার সাথে নিরুর সম্পর্ক আছে বা ছিলো।আমি যদি জানতাম তাহলে কখনোই তোমাকে জানাতাম না।তোমাকে কোনভাবে আমি কষ্ট দিতে চাইনি।আমার কারণে যদি কষ্ট পেয়ে থাকো আমাকে ক্ষমা করে দিও।নিরু অনেক ভালো মেয়ে,নিরুকে ভালো রেখো।”
ততদিনে আসাদ ও শুনেছে মাহিয়া আর বেশিদিন তাদের মাঝে নেই।এই একতরফা ভালবাসা গুলো বড্ড অসহায়।
সমুদ্রের জোয়ার এসে নিরুর পায়ের উপর আছড়ে পড়লো।নিরুর শাড়ির কিছুটা অংশ ভিজে গেল।নিরুর চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।আসাদ পিছন থেকে দু’হাতে নিরুর কাঁধ জড়িয়ে রেখেছে।যতদূর চোখ যায় নিরু সমুদ্রের দিকেই তাকিয়ে আছে।নিরুর চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল ঝরছে।নিরু কোনভাবেই মানতে পারছেনা মাহিয়া আর নেই।
নিরু মুখে হাত চেপে শব্দ করে কেঁদে উঠলো।মাহিয়ার সাথে নিরুর যতবার দেখা হয়েছে মাহিয়া নিরুকে নিজের বোনের মতো ভালবেসেছে,চুয়াডাঙ্গা থাকাকালীন ও নিরুকে এক মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করেনি।আর সেই মানুষটা পৃথিবীতেই আর নেই।
পড়তে গেছে তাও নিরুকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে, নিরু যেন একা অনুভব না করে।পুরো চুয়াডাঙ্গা শহর ঘুরিয়ে দেখানো,নিজের বোন বলে দাবি করা।নিরু আর কিছু ভাবতে পারছেনা।আসাদের দিকে ফিরে আসাদকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। আসাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিরুকে শান্ত হতে বললো।
আমাদের জীবনে কিছু মানুষ থাকে তারা রক্তের না হয়েও অদ্ভুত এক মায়া নিয়ে জীবনে আসে।আর বড়সড় একটা জায়গা করে নেই।মাহিয়াও নিরুর জীবনে ঠিক এমনই একজন মানুষ ছিলো।
মাহিয়া মারা যাওয়ার পর-ই আমিনা নিজের ভুলটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।আর মাহিয়া যখন নিজের অসুখ সম্পর্কে অবগত হয়েছিলো তখনই আমিনাকে বলেছিলো সব কিছু ভুলে যেন নিরুকেই আসাদের বউ করে নিয়ে আসে।আমিনা বলেছিলো তুমি আগে সুস্থ হও মা।তুমি যা বলবা তাই করবো।
মাহিয়া দ্বিতীয় কোন কথা আর বলতে পারলো না,পৃথিবী থেকে চিরজীবনের জন্য চলে গেল। তারপর থেকে আমিনা বেগম নিরুকে হন্য হয়ে খুঁজতে লাগলো।নিজের ভুল গুলো বুঝতে পারলো।ছোট থেকে মানুষ করা মেয়েটাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া, ছেলের থেকে পাওয়া দূরত্ব,বোনের মেয়ের মৃত্যু, আজিজুর হকের অবজ্ঞা সব যেন একই সুতোয় গাথা এক রশি।সুখের জীবন সংসার সব যেন এক ঝড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল।
মাঝের দিন গুলোতে প্রত্যেকটা মানুষ এলোমেলো জীবনযাপন করছিলো।কোথাও যেন শান্তি মিলছিলো না।রঙিন জীবনটায় রঙহীন তীব্র এক যন্ত্রণা নেমে এসেছিলো।দুঃখের পাখা মেলে একরাশ কষ্ট ছুয়ে গেছে।জীবনে এগিয়ে যাওয়ার বদলে বরং কয়েক ধাপ আরও পিছিয়ে গেছে।
একমাত্র নিরুই নিজের জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।অসময় থেকে বেরিয়ে নিজের একটা পরিচয় তৈরি করতে পেরেছে।আসাদের ক্যারিয়ারেও অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে।আসাদের লক্ষ্য অনুযায়ী আরও আগে সফলতা অর্জন করার চেষ্টায় ছিলো।সাজানো গোছানো সময় গুলো দমকা এক হাওয়ায় তছনছ হয়ে গেছিলো যেন।
কিন্তু নিরুর নিজের কাছেই আজ বড্ড অসহায় লাগছে।সেই সময়ের কথা গুলো ভেবে বুকভার হয়ে আসছে।প্রিয় মানুষ গুলোর জীবনে কত ঝড় বয়ে গেছে।বিশেষ করে মাহিয়ার এইভাবে চলে যাওয়াটা নিরু একদম মেনে নিতে পারছেনা।
বাশঁবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত থেকে সন্ধ্যার আগেই নিরুকে নিয়ে আসাদ বাড়ি চলে এসেছে।নিরুর মনটা এখনো ভীষণ খারাপ,আসাদ বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে ছিলো।নিরু বিছানায় এসে বসলো। আসাদ নিরুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার আম্মুর জন্যই সবার জীবনে এক সাথে এতো সমস্যা নেমে এসেছিলো।না হলে এতটা কষ্ট ও কেউ পেতো না।”
“মামানির কোন দোষ নেই,মামানির জায়গায় মামানি ঠিক ছিলো।”
আসাদ শোয়া থেকে উঠে বসলো,বালিশটা কোলের উপরে নিয়ে বলল, “তাহলে ভুল ছিলো কার?”
নিরু আসাদের দিকে ফিরে বলল, “ভুল কারোর-ই ছিলো না।সবার জায়গায় সবাই ঠিক ছিলো।”
“মন রাখার জন্য বলিস না,আমি তো সবটা জানি তাই না?”
নিরু মাথা ঘুরিয়ে বলল, “উহু!জানার বাইরেও অনেক কিছু থাকে।”
আসাদ ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “যেমন?”
নিরু আসাদকে শুধালো, “আপনি রামায়ণ পড়েছেন?”
“হ্যাঁ পড়েছি, কেন?”
“মেঘনাদবধ পড়েছেন?”
“হ্যাঁ অনেক আগেই তো পড়েছিলাম।”
“তাহলে দেখেন,রামায়ণে রাবণকে কিভাবে ভিলেন রুপে প্রকাশ করেছিলো।কিন্তু আমরা মেঘনাদবধ পড়ে অন্যরকম এক অনুভূতির সাথে পরিচয় হয়েছিলাম।মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরো কাহিনিটাকেও ঘুরিয়ে দিয়েছে।মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখিয়েছে।মেঘনাদবধ পড়ে কি রাবণকে আপনার খারাপ লেগেছিলো?”
“নাহ!”
“মেঘনাদবধ কাব্যে রাবণকে এমন ভাবে প্রকাশ করেছে,মেঘনাদবধ পড়া প্রত্যেকটা পাঠকের মনে রাবণ জায়গা করে নিয়েছে।যেখানে রামায়ণে রাবণ দু’চোখের বিষ ছিলো।সেখানে রাবণের শোকে সবাই শোকাহত হয়েছে।দেখেন না হয়, রাবণ কিন্তু সীতাকে এমনি হরণ করেনি।রাবণের বোন সূর্পণখার নাক কান কেটে নিয়েছিলো বলেই সীতাকে রাবণ হরণ করেছিলো।বোনের অপমান সহ্য করতে পারেনি তাই সীতাকে হরণ করেছিলো।তারপর রাবণের প্রথম সন্তান বীরবাহুর মৃ’ত্যুর জন্য যু’দ্ধের সিদ্ধান্ত নেই।পুত্রের মৃ’ত্যুর ব’দলা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পর-ই আরেক পুত্র মেঘনাদকে হারায়।তাহলে শোক বেশি কার? রাবণের দিক থেকে ভেবে দেখেন তো,রাবণকে অপরাধী মনে হয় কিনা।রাবণের জায়গা থেকে ধরতে গেলে রাবণ ঠিক।বোনের অপমান,পুত্রদের মৃ’ত্যু এইসবেই তো রাবণকে ক্রুদ্ধ করেছিলো।তাই না?
ঠিক তেমনই যার জায়গা থেকে সে ঠিক!শুধু নিজেদের দিক গুলো না ভেবে,বা অন্যকারো অন্যায়টা না দেখে মুদ্রার উপর পিঠটাও দেখতে হবে।মামানিও মামানির চিন্তা ভাবনায় ঠিক ছিলেন।”
“নিরু তুই দেখছি সাহিত্যের মানুষ হয়ে গেছিস।”
“আমি পড়া চোর হলেও এইসব পড়তে মন্দ লাগে না।”
“তোকে বিসিএস দেওয়াবো।”
নিরু ভেংচি কেটে বলল, “কেন এখন পাশে মানাচ্ছে না।”
আসাদ চোখ টিপে বলল, “না মানে আরেকটু বেশি মানাতো আরকি।না হয় আমার বাচ্চা গুলোর কি অবস্থা হবে বুঝতে পারছিস।তোর মতোই বোকাসোকা হবে।”
নিরু উঠে গিয়ে আসাদকে কিল মারতে থাকলো।আসাদ এইদিকে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।আসাদ নিরুর হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিরুকে বুকে নিয়েই শুয়ে পড়ে হো হো করে হেসে যাচ্ছে।নিরু ও শেষে হেসে ফেললো।হাসতে হাসতেই বলল, “আপনার বাচ্চা গুলো আমার মতোই হোক, আর আমার সাথে আপনাকে এইভাবেই সব সময় জ্বালাক।”
আসাদ নিরুর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “এই জ্বালাতন গুলোই আমার সুখে থাকার কারণ বুঝলি?”
চলবে….