#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_০৬
গত চারদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে।একদম ঝুম বৃষ্টি, বৃষ্টি থামার নাম নেই। এতো বৃষ্টি অনিমা এবারই প্রথম দেখছে। ভাগ্যিস পরীক্ষার মধ্যে বৃষ্টি হয়নি। তা না হলে বৃষ্টির মধ্যে পরীক্ষা দেওয়া কষ্টকর হয়ে যেত।জানালার গ্রিল ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিরু এই গুলোই ভেবে চলেছে।
শেষ কয়মাসে আসাদ নিরুর পড়াশোনার প্রতি অনীহা নিয়ে যত সমস্যা ছিলো সব সমাধান করেছে।গ্রামার এবং ম্যাথ গুলোর নিয়ম নিরুর আয়ত্ত করে দিয়েছে। পড়াশোনা ভালো না লাগলেও আগের মতো অমনোযোগী নেই।নিরুর পিছনে আসাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।সময় ব্যয় করতে হয়েছে।ওর সমস্যা গুলো বুঝতে হয়েছে।আসাদের জন্য সবটা খুব একটা সহজ ও ছিলো না। নিরুর পড়াশোনায় মনোযোগ আনতে ওকে বোঝাতে অফুরন্ত সময় ব্যয় করেছে।আসাদ আশা রেখেছিলো নিরু এবার ভালো রেজাল্ট করবে।আর তাই-ই করেছে।নিরু ভালো রেজাল্ট-ই করেছে।
এই বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ি এলাকা যেন অন্যরকম এক সাজে সজ্জিত হয়েছে।বৃষ্টিস্নান পাহাড়ি এলাকা এর আগে নিরুর দেখা হয়নি।সীতাকুণ্ড আসার পর থেকেই নিরু প্রকৃতির সৌন্দর্যের সাথে পরিচিত হচ্ছে।এই পরিচয়ের একমাত্র পরিচালক আসাদ ভাই।ওই মানুষটা নিরুকে প্রতিটা সৌন্দর্য খুটিয়ে খুটিয়ে দেখায়।একটা সাধারণ জায়গাও আসাদ খুব সুক্ষ্মদৃষ্টিতে অসাধারণ করে তোলে।প্রথম প্রথম নিরুর বাইরে ঘুরতে যাওয়া, পর্যটন এরিয়া গুলো দেখতে যাওয়া। এই গুলো নিয়ে একদমই আগ্রহ ছিলো না।কিন্তু মাসখানেক থেকে আসাদ ভাই নিরুর অভ্যাস পরিবর্তন করে দিয়েছে।নিরু যখন ক্লাসের বই গুলো কেনার জন্য মামাকে বলে।আজিজুল হক আসাদের উপরে দায়িত্ব দিয়ে যায়।আসাদ সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ, তাই নিরুকেও বাসা থেকে বের করার পায়তারা কষে।
_ আম্মু অনিমাকে রেডি হয়ে বের হতে বলো।
_ কেন নিরু কোথায় যাবে?
_ কোথায় যাবে মানে,ওর বই কেনার জন্য আমি সারাজীবন থাকবো নাকি।ওর বই ওকে কিনতে হবে না। সব তো শিখতে হবে।তোমার মেয়ের প্রয়োজনে হুটহাট করে তো আর চলে আসতে পারবো না। তাই ওকেই শিখতে হবে। আর ওর বই ও দেখে নেবে।
_ আচ্ছা হয়েছে। নিরু রেডি হয়ে নে তো।বই গুলো আসাদের সাথে গিয়ে নিয়ে আয়।
আসাদ মুখে গম্ভীর ভাব ধরে রাখলেও, বুকের মাঝখানটায় সুখের স্রোত বয়ে চলেছে।আসাদের পরিকল্পনা আছে। বই গুলো কিনে নিরুকে নিয়ে রাবারডেমে ঘুরতে যাবে।রাবারডেমের রাস্তাটা আসাদের খুব পছন্দের একটা জায়গা।নিরুর ও পছন্দ হবে বলে আসাদের ধারণা।
আসাদ বাইক বের করতে করতে নিরু নিচে চলে আসে।আধা ঘন্টা আগেই নিরুকে স্বাভাবিক মনে হলো।এখন মুখের দিকে তাকিয়েই বোঝা যাচ্ছে অস্বাভাবিক কিছু চলছে।এই কিশোরীদের মন এই ভালো তো এই খারাপ। আর সেই বোকা শোকা কিশোরীর প্রেমেই কিনা আসাদ ফাসলো?
পুথিঘর থেকে বই গুলো নিয়ে আসাদ হাইওয়ে ধরে রাবারডামের দিকে যায়।
_ বাসায় না গিয়ে,এইদিকে কোথায় যাচ্ছেন?
_ তোকে বিক্রি করতে।নে সানগ্লাসটা পরে নে।প্রচন্ড বাতাস বইছে। চোখে ধুলাবালি যাবে।চোখে ধুলাবালি গেলে টাকা কম দেবে বলেছে।
_ যতসব আজগুবি কথা,আপনি বাইক চালাচ্ছেন আপনি পড়েন।
_ আমার কাছে আছে,এইটা তুই ধর।আর আধা ঘন্টা মতো সময় লাগবে।ভালো করে বস।মিরসরাই যাবো।
_ ওইদিকে কি ?
_ রাবারডেমে নিয়ে যাবো।
_ কোন দিকে ওইটা?
_ মিরসরাইয়ের ঠাকুরদিঘীর পারের ঠিক উল্টো পাশেই রাবারডেম।
_ মামানিকে তো বলে আসেননি।
_ সমস্যা নেই।ফোনে জানিয়ে দিবো।
নিরু জানেনা আজ কেন এমন অদ্ভুত ভাবে আসাদের দিকে নজর পড়ল।আসাদের দিকে কেমন একটা মোহগ্রস্ত ভাবে তাকিয়ে রইল।প্রতিদিন চোখে দেখা মানুষটাকে আজ কেমন হুট করেই নতুন লাগছে।বিশাল বড় মনে হচ্ছে।বলিষ্ঠ দেহের মানুষটার প্রশস্ত কাঁধে হাত রাখতে নিরুর অভিমানী মনটা কেমন এক অদ্ভুত নেশায় মত্ত হয়ে রইল।ক্রিম কালারের টি-শার্ট পড়নে এই জ্বালাতন ময় পুরুষকে হঠাৎ করেই ভালো লাগছে।কিশোরী মনে জলরাশির শীতল একটা বাতাস বয়ে চলেছে যেন।অসম্ভব ভালো লাগায় নিরুর বুকের মধ্যিখানে সমুদ্রের জোঁয়ার উথলে উঠছে।
নিরুকে এক পাশে নামিয়ে দিয়ে,আসাদ বাইকটা সাইড করে রাখলো।বাইক চালানোর সময় প্যান্ট গুটিয়ে যাওয়াতে বাইক থেকে নেমে আসাদ প্যান্টটা পায়ের কাছে ঠিক করে নিচ্ছিলো।এইটুকুতেই নিরুর কি যে হলো,নিরু আর আসাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। কত শত পুরুষের সাথে রাস্তাঘাটে কত বার-ই তো দেখা হয়।কাউকে তো কখনো এইভাবে দেখে না।এক বাসাতে থেকেও এমন অনুভূতি তো আগে কখনো হয়নি।হঠাৎ কী হলো নিরুর?
বাইকের চাবিটা পকেটে রাখতে রাখতে ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা করে নিরুকে জিজ্ঞেস করল।
_ মন খারাপ কেন তোর ?
নিরুর মন খারাপ অভিমান হঠাৎ করেই দূর হয়ে গেছিলো।আসাদের কথায় হারিয়ে যাওয়া অনুভূতি যেন আবার ছন্দ খুঁজে পেল।নতুন করে অভিমানের পাল্লা ভারি হলো।
_ আমার জন্য তো আপনি সারাজীবন থাকছেন না।তাহলে আমার মন খারাপ কেন জেনে আপনার কি হবে?
আসাদের আর বুঝতে বাকি রইল না।ওইসময় কেন ঘন ভ্রু পল্লবের নিচে স্বচ্ছ জলের ধারা চিকচিক করছিলো।
_ সামনের দিকে চল।এইটা আমার অনেক পছন্দের একটা জায়গা, এই যে সরু রাস্তাটা দেখছিস। এই রাস্তা ধরে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করবে।দুইপাশে বিচিত্র অরণ্য আর মাঝখানে এই সরু রাস্তা, নিরিবিলি একটা পথ,সারাদিন হাঁটলেও ক্লান্তি লাগবে না।তোর হাঁটতে কি কষ্ট হচ্ছে? বাইক নিয়ে আসবো?
_ না কষ্ট হচ্ছে না। জায়গাটা অনেক সুন্দর।
_ সুন্দর বলেই তোকে নিয়ে এসেছি।এই সীতাকুণ্ডে এমন অসংখ্য জায়গা আছে।সব তোকে দেখাবো।
রাবারডেমের সরু রাস্তা ধরে আসাদ আর নিরু অনেকটা পথ এক সাথে হাঁটলো।সামনে হাঁটতে হাঁটতে অনেক যুবক যুবতীদের দেখা মিলল,যারা হাতে হাত রেখে হেঁটে যাচ্ছে।অনেকটা পথ হাঁটার পর আসাদের মনে হলো এক সপ্তাহ আগে অনিমার পায়ে ব্যথা ছিলো।কাছাকাছি আসাদের পরিচিত একটা পরিবারকে দেখা গেল।আসাদ ওনাদের সাথে কথা বলে নিরুকে ওনাদের সাথে একটু দাঁড়াতে বলে গেল।কিছুক্ষণের মধ্যে বাইক নিয়ে এসে নিরুকে উঠতে বলে, বাকিটা রাস্তা বাইকে ঘুরালো।এই পথে বাইকে ঘোরাও অন্যরকম মজা।নিরুর এতো সুখ বহুদিন লাগেনি।এই প্রকৃতির মাঝে নিজেকে খুব সুখী মানুষ বলে মনে হলো।এতদিন অহেতুক নিজেকে অপয়া ভেবেছে।এই পৃথিবী নিয়ে একরাশ অভিমান দুঃখ জমা হয়ে ছিলো।আজ যেন সব অভিমানে ভাটা পড়ল। আসাদের কাছে প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে শত শত কথা শুনল।রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি খেল।একটা ছেলের উল্টিয়ে পড়ে যাওয়া দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।এ যেন অন্যরকম এক নিরু,আসাদ নিজেই ভীষণ অবাক হলো।নিরু মুখে এক গাল হাসি নিয়ে আসাদের কাঁধ ধরে রইল।এ এক অন্যরকম অনুভূতি, অন্যরকম ভালো লাগা।এই সুখের নাম দেওয়া যায় না। শুধু ভিতর থেকে অনুভব করা যায়।
তারপর থেকে নিরুর উচাটন মন যতবারই আসাদ কে নিয়ে এলোমেলো কিছু ভাবতে গেছে। নিরু খুব যত্ন সহকারে এড়িয়ে গেছে।নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে।মনের চেয়ে মাথাকে গুরুত্ব বেশি দিয়েছে।সেদিনের সেই ভাবনাটুকু ভুলে, নিজের গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নিরু।
নিরু আর্স নিয়েছে।আসাদরা কেউ নিরুর উপরে নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়নি।নিরুর জন্য একজন মেয়ে টিচার রাখা হয়েছে।উনিই দুইটা সাবজেক্ট করিয়ে দেয়।নিরুর পড়াশোনা ভালোভাবেই এগোচ্ছে।সন্ধ্যার পর নিরু পড়তে বসেছে।হঠাৎ করে আসাদ এসে বলল।
_ এই অনিমা গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে যাবি?
_ এখন? মামানিরা যাচ্ছে?
_ এখন না কাল বিকেলে,আম্মুরা যাবে না।আমি তো এডমিশন কোচিং করতে চলে যাবো।ভাবছিলাম তোকে ঘুরিয়ে আনি।আব্বু তো সেইভাবে সময় পায় না।আমি চলে গেলে তো তোর ঘোরাও হবে না।
_ কাল তো খালামণি মাহিয়া আপুরা আসছে।পরশু বিকেলে নিয়ে যাবেন? সবাই মিলে এক সাথে যাওয়া হবে।
_ নিজের চিন্তা করতে পারিস না?
_ কেন নিজের চিন্তা কি করবো?
_ আমার মাথা, তোকে কোথাও যেতে হবে না। সব লোকে দেখে যাক,তোর অধিকার নেই দেখার এই প্রকৃতি আর আ…
_ রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি কি বললাম।
আসাদ কোন জবাব না দিয়ে হনহন করে নিরুর রুম থেকে চলে গেল।
_ এই শুনবেন তো!
চলবে……